প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯৫

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

তবে এখানকার ছুরি পৃথিবী বিখ্যাত। আমি একটি ছুরি পছন্দ করলাম, লেদার বাট। ৩০ ফ্রাঙ্ক। এটাই কেনার বাসনা হলো। ভাবলাম খুব ওজনও নয়। জায়গাও বেশী নিবে না। কিন্তু রায়হান মানা করলো। বললো, মামনি তুমিতো লাগেজ নিচ্ছ না। ‘ক্যরি অন’ এ ছুরি এ্যালাও নয়। তাইতো? যার জন্য প্যরিস থেকে আমি একটিা পারফিউমও কিনতে পারলাম না। কারণ তরল পদার্থও ‘ক্যরি অন’ এ এ্যালাউ নয়। ঈশ… ছুরিটা দারুণ পছন্দ হয়েছিল। যাইহোক, আরেকটু এগিয়ে দেখছিলাম চারপাশটা। কি শুনশান গ্রামটি। কেমন যেন একটা নিস্তব্দ ভাব। চারপাশে নানা আকৃতির পহাড়। নানা বর্ণের। আর প্রচুর নদী বা লেকের সমাহার। আবার কয়েক জায়গাতে দেখলাম ছোট ছোট ব্রীজ। এত সুন্দর। দূর থেকেই দেখলাম। অনেকে দৌড়ে ঐ ব্রীজের উপর গিয়ে ছবি তুললো।

আমাদের বাসের আনেকে আবর রেস্টুরেন্টে খেতে বসলো। রায়হান বললো, খাবে নাকি?

ওমা! বলে কি ছেলে, একটু আগেই তো কত কি খেয়ে এলাম। বললাম, তোর ক্ষিধে লাগলে তুই খা।

বেশ কিছু ছবি তুললাম। একটু পর এডুইন সবাইকে ঈশারা করলো। কারণ এখানে সময়ের ব্যাপার আছে। আমাদের ট্রেন ধরতে হবে।

সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে দেখলাম। এবং সবার হাতেই একটা ঘন্টা। সবাই খুব হাসছে এবং ঘন্টা বাজাচ্ছে। একজন দেখলাম বিশাল আকৃতির এটা ঘন্টা কিনেছে। তবে কয়েকজন দেখলাম ছুরিও কিনেছে। ঈশ- আমার আবার কিঞ্চিত দুঃখ জেগে উঠলো।

সুইজারল্যান্ডের Kleine Scheidegg এর Restaurant. ছবি : লেখক

বাস ছেড়ে দিল। এবার আমাদের গন্তব্য হলো ‘Lauterbrunnen’ (ঈশ, কি বিদঘুটে উচ্চারণ এদের সব নাম)।  ‘Interlaken’ থেকে ওখানে যেতে ২০ মিনিটের মত লাগবে। আমাদের ড্রাইভার খুব জোরে গাড়ি চালায়। তাই ১৯ মিনিটেই পৌঁছে যাবে।

সবাই হুড়মুড়িয়ে Lauterbrunnen নেমে পড়লাম। সবার হাতে এডুইন একটা পাস (কার্ডের মত) দিল। আমাদের ৪ জনেরটা রায়হানের হাতে দিল। হলুদ রঙের একটা কার্ড। তাতে আমাদের ৪ জনের নাম মেনশন করা আছে। এবং ট্রেনের সামনে এসে সবাইকে বলে দিল, ঠিক এই সময়ের মধ্যে ওখানে সবাই থাকবে। দেরী হলে নিজেরাই ফিরে যাবে। ইচ্ছা করেই বলেছিল। পরে বুঝেছিলাম।

বুঝেছিলাম, সে এক অজানা আনন্দের উৎসব সৃষ্টিকর্তা ওখানে রচনা করে রেখেছেন। যে কোন মানুষের পক্ষেই ফিরে আসা অসম্ভব ব্যাপার। অন্তহীন সৌন্দর্য্যরে কাছে মানুষ স্তব্দ হয়ে যায়।  

সবাই যে যেমন খুশী এক একটা কামরায় উঠে পড়লো। আমরা ৪ জন জানালার ধারটা বেছে নিলাম। এখন আমাদের গন্তব্য হলো  Wengen। Lauterbrunnen থেকে Wengen এই ‘গোল্ডেন পাস প্যানারোমিক’ ট্রেনে যেতে লাগবে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট। এমনই ঘোষণা দেয়া হলো। ট্রেন ছাড়ার আগে একজন সিকিউরিটি এসে সবার কার্ড চেক করলো এবং একটা দাগ দিল। এই ট্রেনের টিকিট একবার কাটলে সারাদিন আমরা যতবার খুশী Wengen টু Lauterbrunnen যাতায়ত করতে পারবো। ট্রেনে স্পিকারে বলা শুরু করলো আজকের ভ্রমণের বৃত্তান্ত। কিছু শুনলাম, কিছু শুনলাম না। মাথার মধ্যে আগে থেকেই ছিল এই ভ্রমণের যাত্রাটাই সবকিছু। কাঙ্খিত লক্ষ্যে নয়। অতএব মনোযোগ স্থির কলাম বাইরের দিকে।

‘গোল্ডেন পাস প্যানারোমিক’ ট্রেনটাই দেখার মত। মনে হয় যেন একটা বৃহৎ খেলনা। এত মনোরম দেখতে ট্রেনটি, যেমন ভেতরে, তেমনি বাইরে।

ট্রেনটি খুব জোরে যাচ্ছে না। একটু ধীমা তালে। যেন হেলে দুলে উঠছে। আস্তে আস্তে বেশ ঘুরে ঘুরে উপরে উঠছে। কাঁচের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে আমার চোখ দুটো অস্থির মুগ্ধতায় ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে রইল। আমার হাতে রায়হান একটা চিপস এর প্যাকেট ধরিয়ে দিল। খেতে ভুলে যাচ্ছি। চারপাশে পাড়ার আর ঝর্ণা। শুধুমাত্র Lauterbrunnen- ই ৭২ টা ঝর্ণা। চোখের উপর সমস্ত সৌন্দর্য পদ্ম ফুলের মত ফুটে উুঠেছে। গোটা সুইজাল্যান্ডের সৌন্দর্য যেন এই জায়গাতে স্থির হয়ে গেছে। বিভিন্ন গ্রামের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে এই ট্রেনটি আস্তে আস্তে ইউরোপের সর্ব বৃহৎ মাউন্টেনের উচ্চতাকে স্পর্শ করবে। ভাবতেই শরীরে অসাধারণ শিহরণ হচ্ছে।

সুইজারল্যান্ডের Kleine Scheidegg। ছবি : লেখক

যতই উপরে উঠছি, একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। চারদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়। তবে এখানে পাহাড়ের খুব উচ্চতায় দেখছি স্নো থাকে না। সাইডে লেগে থাকে। আবার কোন কোন চুড়ায় বরফ ঢাকা। উহ, নিলাভ আকাশের বুকে ধবধবে সাদা পাহার যেন কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন দেখছি বিভিন্ন পাহাড়ের উপর সাদা ধবধবে খুব স্ন্দুর কিছু বাংলো। আমি ভাবছিলাম-ওরা কি ভাবে থাকে? পরে জানলাম ঐগুলো সব রিসোর্ট। ঈশ, ওখানে কিছুদিন থাকতে পারলে দারুণ হতো। ট্রেনের গাইডের ধারা বর্ণনায় অনেক কিছু জানতে পারছি। এখন কোন কোন এলাকা বা গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এইরকম নানা রকমের তথ্য সে দিয়ে চলেছে। আমি ছবি আর তুলছি না। শুধু দেখছি আর সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জানাচ্ছি। এবারে একটি স্টেশনে থামলো Grindelwald। সবাই নেমে পড়লো। আবার ১৫ মিনিটের মধ্যে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনটা আবার ছেড়ে দিলে। এবারে সরাসরি Wengen।

এখন বরফের সাদা বেশী চোখে পড়ছে। একসময় এখানে এতই তুষারপাত হতো যে, জনজীবন থেমে যাবার উপক্রম হয়েছিল। কিছুতেই কোন সময়ই সেই তুষার পাত বন্ধ হয় না। তখন বিপন্ন (কথিত আছে) জনসাধারণ ‘পোপ’ এর কাছে গিয়েছিল। এবং পোপ এর একাগ্র প্রার্থনায়  সেই অভিশপ্ত বরফ ক্রমশ কমে যেতে থাকে।

যেহেতু এখন আমরা অনেক উপরে তাই চারপাশে কেমন যেন নিস্তব্দ সৌন্দর্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা Wengen এ চলে এলাম। ঘড়ি দেখলাম ঠিক কাঁটায় কাঁটায়  ১ ঘন্টা ২০ মিনিটের মধ্যেই এসেছে। ট্রেনের গাইড Wengen এ নামবার কিছুক্ষণ আগেই বললো, পৃথিবীর (ইউরোপের) সর্বোচ্চ উচ্চতা Wengen নয়, Kleine scheidegg এ। কিন্তু ওখানে যেতে গেলে আবারও টাকা দেওয়া লাগবে। এর আগে আমরা যখন Grindelwald এ নেমেছিলাম, তখনও ট্রেনের গাইড বলেছিল, আমাদের সবার প্যাকেজ ট্যুরে টিকিটের যে পাস দিয়েছিল সেটা শুধুমাত্র এই পর্যন্ত। Wengen এ যেতে হলে এখন প্রত্যেককে আবার ৬০ ফ্রাঙ্ক করে দিতে হবে। সবাইতো আমরা খুবই আশ্চার্য হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরও পৃথিবীর ‘সবচেয়ে বেশী’ উচ্চতাকে স্পর্শ করবার আশায় রায়হান আবারো ৪ জনের জন্য ২৪০ ফ্রাঙ্ক দিয়েছিল। যদিও সকলের মেজাজ যথেষ্ট খারাপ  হয়েছিল। কারণ অবশ্যই টাকাটাই নয়। কারণ ট্যুরের প্যাকেজ নেবার সময় তারা ঘুনাক্ষরেও এই ব্যাপারটি আমাদের জানায়নি। (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com