টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -২

কাজী সাব্বির আহমেদ

সম্প্রতি জাপান সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, আমেরিকা কি চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে যদি তাইওয়ানের পরিস্থিতি সেই পর্যায়ে চলে যায়? অতীতে এই ধরণের প্রশ্নগুলিকে পাশ কাটিয়েই গেছেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্টেরা। কিন্তু এবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরাসরি বলে দিয়েছেন যে আমেরিকা অবশ্যই চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কারণ নীতিগতভাবে আমেরিকা তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাইওয়ান জো বাইডেনের এই উক্তিকে স্বাগত জানালেও চীনের ফরেন মিনিস্ট্রির মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে তাইওয়ানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে চীনের স্বার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপের সামিল। চীনের জনগণ তাদের দেশের স্বার্বভৌমত্ব এবং টেরিটরিয়াল ইন্টিগ্রেটি রক্ষার জন্য বদ্ধ পরিকর। তাইওয়ানকে নিয়ে চীন এবং আমেরিকার এই কূটনৈতিক টানাপোড়ন কিন্তু আজকের নয়, এর সূচনা সেই কম্যুনিস্ট চায়না অর্থাৎ পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার জন্মলগ্ন থেকেই। ১৯৪৯ সালে চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি যখন আমেরিকার আশীর্বাদপুষ্ট কোয়ামিনটাং সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় তখন আমেরিকা চীনের সাথে সব ধরণের ডিপ্লোমেটিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু ষাট দশকের শেষ ভাগে রাশিয়ার সাথে ঠান্ডা লড়াই যখন তুঙ্গে তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন সরকার চীনের সাথে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ প্রজেক্টটি পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ায় চীনের সাথে রাশিয়ার মধুর সম্পর্কটি ততদিনে অনেকটাই তিক্ততায় ভরে উঠেছে। তদুপরি রাশিয়া চীনের কাছ থেকে তার দেয়া ঋণের টাকার পুরোটাই ফেরত চেয়ে বসেছে যা কিনা চীনকে একটি অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। পরিস্থিতি বিচার করে নিক্সন সরকার চীনের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য মোক্ষম সময়টিই বেছে নিয়েছিল। তবে চীনের সাথে আমেরিকার সেই বন্ধুত্ব স্থাপন ছিল আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা কিনা পরবর্তীতে ‘পিংপং ডিপ্লোম্যাসি’ নামে খ্যাতি লাভ করে।

চীন নামক দেশটির কথা আমরা যখন মনে করি তখন আনুষঙ্গিক যে জিনিষগুলি আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে তার মধ্যে রয়েছে চীনের প্রাচীর কিংবা গ্রেট ওয়াল, অ্যাক্রোবেটিকস, টেবিল টেনিস খেলা ইত্যাদি। টেবিল টেনিস খেলাকে চীনা ভাষায় বলে ‘পিংপং’। খেলার আচরণ বা ধরণের সাথে ‘পিংপং’-এর ধ্বনিগত মিল থাকার করণে বিশ্বব্যাপী এই খেলাকে ‘পিংপং’ নামেই অভিহিত করা হয় এবং খেলাটিকে চীনের একটি সহজাত খেলা হিসেবেই মেনে নেয়া হয়। কম্যুনিস্ট চায়নার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ডিপ্লোমেটিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য যে কূটচালের আশ্রয় নেয়া হয় সেটার সাথে এই ‘পিংপং’ খেলার একটি সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং সে জন্যেই এই ঘটনাকে ‘পিংপং ডিপ্লোম্যাসি’ বলে উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে। কোল্ড ওয়ারের কারণে আমেরিকা যখন রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত তখন ‘শত্রুর শত্রু হচ্ছে বন্ধু’ এই নীতিতে চীনের সাথে আমেরিকা বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠে। অন্যদিকে চীনও উদগ্রীব ছিল আমেরিকার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। কোরিয়ান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৫৫ সালে চীনের কম্যুনিস্ট সরকারের প্রিমিয়ার চৌ এনলাই ইন্দোনেশিয়ার বানদোং শহরে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে উল্লেখ করেন যে, চীনের জনগণ আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করতে চায় না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাঁর এই কূটনৈতিক অভিলাষকে প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ১৯৬৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে। তিনি সেখানে উল্লেখ করেন যে, “মৃত্যুর আগে আমি যদি কোন কাজ সমাধা করে যেতে চাই সেটি হবে আমার চীন সফর”। আমেরিকা এবং চীন উভয় পক্ষই পরস্পরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী কিন্তু কীভাবে এই আলোচনার সূত্রপাত হবে সে ব্যাপারে আমেরিকা ছিল সতর্ক। তাই তারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এই আলোচনা শুরু করার চিন্তা ভাবনা করছিল যাতে কোন কারণে চীন যদি রাজী না হয় তবে আমেরিকার যেন মান বজায় থাকে। আর সেই তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পাকিস্তান এসে যুক্ত হয় চীন-আমেরিকার বন্ধুত্ব স্থাপনের সমীকরণে যার মূল্য অবশ্য কড়ায় গণ্ডায় শোধ দিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে।

১৯৭০ সালের অক্টোবরের ২৫ তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক সরকারি সফরে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে হোয়াইট হাউজে মিলিত হন। তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়া খানকে উচ্চ পদস্থ চাইনিজ লীডারদের কাছে একটি ‘সিক্রেট ওরাল মেসেজ’ বা গোপনীয় মৌখিক বার্তা পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেন। মেসেজটির সারমর্ম হচ্ছে যে আমেরিকা চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী এবং এ ব্যাপারে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করার জন্য একজন উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাকে চীনে পাঠাতে চায়। তবে মার্কিন কর্মকর্তার সফরটির ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। সেই বছরের নভেম্বর মাসেই ইয়াহিয়া খান নিক্সনের সেই গোপন বার্তাটি চীনের প্রিমিয়ার চৌ এনলাই-এর কাছে পৌঁছে দেন। কিছুদিন পরেই প্রত্যাশিত জবাব চলে আসে চেয়ারম্যান মাও-এর কাছ থেকে। তবে চীন আলোচনা শুরুর আগে আরো কিছু খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে জানতে চায়। ফলে দুই পক্ষের দূত হিসেবে ইয়াহিয়া খানের কাজ এবং গুরুত্ব বেশ অনেকটা বেড়ে যায়। এই কারণে খান সাহেব ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করা শুরু করেন যার প্রতিফলন দেখা যায় সেই সময়ে চলমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার কিছু নাটকীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ২১ তারিখে সরকারি সফরে বেইজিং-এ এসে চেয়ারম্যান মাও-এর সাথে মিলিত হন  আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

ঘটনাক্রমে এই সময়ে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ থেকে ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত জাপানের নাগোয়া শহরে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড কাপ টেবিল টেনিস বা পিংপং প্রতিযোগীতায় অন্যান্য দেশের সাথে চীন এবং আমেরিকা উভয়েই অংশ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কীভাবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের কার্যক্রমের প্রথম ধাপ হিসেবে এই ‘পিংপং’ প্রতিযোগীতাকে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চীনের ফরেন মিনিস্ট্রি মাথা ঘামানো শুরু করে। মার্চের ১১ তারিখে প্রিমিয়ার চৌ এনলাই সিদ্ধান্ত নেন যে নাগোয়াতে প্রতিযোগীতা চলাকালীন চীন অফিসিয়ালি আমেরিকার টেবিল টেনিস দলকে বেইজিং-এ আসার আমন্ত্রণ জানাবে। যা কিনা হবে আমেরিকান সরকারের প্রতি চীনের একটি মেসেজ যে তারা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। পরিকল্পনা অনুযায়ী নাগোয়াতে খেলা চলাকালীন চীনা দলের ম্যানেজার আমেরিকান দলের ম্যানেজার স্টিনহোভেন-এর সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেন এবং ইশারায় জানান যে আমেরিকান দলকে যদি চীন খেলার জন্য বেইজিং-এ আমন্ত্রণ জানায় তবে আমেরিকার কী প্রতিক্রিয়া হবে। উত্তরে স্টিনহোভেন বলেন যে, আমেরিকান খেলোয়াড়দের চীনের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। চীনের কাছ থেকে প্রচ্ছন্ন এই বার্তা পাওয়ার পর নিক্সন তার সরকারি বক্তব্যে চীনকে ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ বলে উল্লেখ করা শুরু করেন যা চীনের দৃষ্টি গোচর হয় অর্থাৎ চীন আমেরিকার কাছ থেকে প্রাথমিক সবুজ সংকেত পেয়ে যায়। কিন্তু ভিয়েতনামের যুদ্ধের কারণে আমেরিকা চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কিছুটা দোটানায় পড়ে কারণ সেই যুদ্ধে চীন ভিয়েতনামকে সরাসরি সাহায্য করছিল। তারপরও এপ্রিলের ৭ তারিখে আমেরিকা যখন চীনের কাছে থেকে অফিসিয়াল আমন্ত্রণ পায় তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন কাল বিলম্ব না করে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে এপ্রিলের ১৪ তারিখে আমেরিকা সহ কানাডা, কলম্বিয়া এবং নাইজেরিয়ার দল বেইজিং-এ আসে ইতিহাসের সেই বহুল আলোচিত ফ্রেন্ডশীপ ‘পিংপং টুর্নামেন্ট’ খেলার জন্য। দলগুলিকে সাদর অভ্যর্থনা জানান প্রিমিয়ার চৌ এনলাই এবং আমেরিকান দলের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বলেন যে, “অতীতে চীনের জনগণের সাথে আমেরিকানদের অনেক যোগাযোগ ছিল কিন্তু মাঝে সেই যোগাযোগে ছেদ পড়ে। আজকে তোমাদের আগমনের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের একটি নতুন দরজা খুলে গেল।” চৌ এনলাই-এর দেয়া এই উষ্ণ সম্ভাষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমেরিকা চীনের প্রতি দেয়া এমবার্গো শিথিল করে ফেলে। এপ্রিলের শেষভাগে চীন এবার পাকিস্তানের মাধ্যমে একটি পত্র পাঠায় যেখানে তারা উল্লেখ করে যে, তারা আমেরিকার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হেনরি কিসিঞ্জার কিংবা স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে চীন ভ্রমণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাতে আগ্রহী। মে মাসের ১৭ তারিখে নিক্সন সেই পত্রের জবাবে লিখেন যে তিনি আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষায় আছেন তবে তার সফরের পূর্বে তিনি হেনরি কিসিঞ্জারকে পাঠাতে চান চৌ এনলাই-এর সাথে মিলিত হয়ে এই সফরের কর্মসূচি ঠিক করার জন্য। নিক্সনের প্রস্তাবে চীন রাজী হওয়াতে হেনরি কিসিঞ্জার জুলাই মাসের ৭ তারিখে দুইদিনের গোপন সফরে চৌ এনলাই-এর সাথে মিলিত হন। ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ২১ তারিখে ৭ দিনের সরকারি সফরে বেইজিং-এ এসে পৌঁছান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন। তার এই আকস্মিক সফরে পুরো বিশ্ব তাক লেগে যায়। কারণ এই সফরের পিছনের সকল কার্যকলাপ সম্পন্ন হয়েছিল অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে। ‘পিংপং’ খেলার মাধ্যমে চীন-আমেরিকার ডিপ্লোম্যাটিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হওয়ার কার্যক্রমের সূচনা হওয়াতে এবং ‘পিংপং’ খেলায় বল যেমন একপক্ষ থেকে আরেকপক্ষে আনাগোনা করে তদ্রূপ চীন এবং আমেরিকার মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে এই যুগান্তকারী সফরের গ্রাউন্ড ওয়ার্ক সম্পন্ন হওয়াতে ইতিহাসে এই ঘটনাটি ‘পিংপং ডিপ্লোম্যাসি’ নামে স্থান করে নেয়।

‘পিংপং ডিপ্লোম্যসি’-এর প্রধান বার্তাবাহক পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন একদিকে পিংপং বলের মতন চীন-আমেরিকা করছেন, অন্যদিকে তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী নিধনে ব্যস্ত। তার নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালো রাত্রিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর (বর্তমান নাম ফয়সলাবাদ) জেলে এনে বন্দী করে রাখা হয়। বন্দীর অবস্থান কিংবা বর্তমান অবস্থা পুরো বিশ্বের কাছ থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। অগাস্ট মাসের তিন তারিখে জাতির উদ্দেশ্য দেয়া ভাষণে ইয়াহিয়া খান উল্লেখ করেন যে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে’। লায়ালপুর জেলের ভিতর একটি কক্ষকে বিচারকক্ষ হিসেবে তৈরি করে নিয়ে অতি দ্রুত সেই বিচার কার্য শুরু হয়ে যায়। বিচারের গতিধারা দেখে জুলফিকার আলী ভুট্টো একদিন ইয়াহিয়া খানকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘শেখ মুজিবকে কি মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে’? উত্তরে ইয়াহিয়া খান নির্বিকারভাবে জানান, ‘অবশ্যই’। ভুট্টো তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে আমেরিকানরা আপনাকে এখন যতখুশী বাঙালী মারতে দিচ্ছে কারণ তাদের হয়ে আপনি দূতালি করছেন। কিন্তু তারা আপনাকে শেখ মুজিবকে মারতে দিবে না। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী নিধনের পিছনে ইয়াহিয়া খানের প্রধান ভরসা ছিল আমেরিকা। তার উপর চীনও এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। অতএব তাকে আর ঠেকাবে কে? ইন্ডিয়া? ডিসেম্বরের চার তারিখ মধ্যরাতে ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আকাশবাণী দিল্লী থেকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। সেই সময় ইয়াহিয়া খান লাহোরের এক পার্টিতে মাতাল অবস্থায় বিদেশী সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে আপনারা আমাকে আগামী দশদিনের ভেতর যুদ্ধের ফ্রন্টে দেখতে পাবেন। আর সেই মাতলামির হ্যাং ওভার কাটতে না কাটতেই তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন যে, ইসলামকে রক্ষার জন্য তিনি বাধ্য হচ্ছেন ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে।

কথায় বলে খুঁটির জোরে ছাগল নাচে। ইয়াহিয়া খানের মূল খুঁটি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার সাথে সুর মিলিয়ে বললেন, ‘ভারত যা করছে তার নাম সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশের অংশ দখল করার অশুভ পাঁয়তারা’। দ্বিতীয় খুঁটি চীনও রেডিও পিকিং থেকে ঘোষণা দিল, ‘চীন পাকিস্তানকে সব রকম সাহায্য দিবে’। আমেরিকা তার অত্যাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ সপ্তম নৌবহর যা কিনা সেই মূহুর্তে উত্তর ভিয়েতনামের কাছে মালাক্কা স্ট্রেইটে ছিল, সেটাকে বঙ্গোপসাগরের অভিমুখে রওনা করিয়ে দিল। এর জবাবে রাশিয়া তার বিশটি রণতরীকে ভারত সাগরে নিয়ে এলো। অন্যদিকে চীন যাতে লাদাখ সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে না পারে সেই জন্য চীন-রাশিয়া সীমান্তে রাশিয়া দশ লক্ষ সেনা মোতায়েন করল। আন্তর্জাতিক এক ওয়ার গেমের মাঝেই ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামের আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশটির জন্ম হয়। যেহেতু বাংলাদেশের জন্ম হলো রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাই দেশ গড়ার জন্য বাংলাদেশকে সাহায্য নিতে হলো রাশিয়া এবং রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট অন্যান্য কম্যুনিস্ট দেশগুলির কাছ থেকে যার খেসারত অবশ্য বাংলাদেশ সুদেমূলে দিতে হয়েছিল জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মূল পরামর্শদাতা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ যে আমেরিকার জন্য কোন ‘বাস্কট কেস’ হবে না সেটা ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিউবার সাথে পাটজাত পণ্যের রপ্তানী চুক্তির অভিযোগে আমেরিকা বাংলাদেশকে তার প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্য না দেয়াতে ১৯৭৪ সালে সারা দেশ ব্যাপী দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে সফরে আসেন এবং বাংলাদেশকে একটি ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কটাক্ষ করেন। জোর গুজব আছে যে তার এই সফরের একটা পূর্বশর্ত ছিল বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে মন্ত্রীসভা থেকে বিদায় দিতে হবে। অনেকে মনে করেন ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তাজউদ্দিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে হেনরি কিসিঞ্জার পরাজিত হয়েছিলেন বলেই তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশে এই কাজটি করিয়েছিলেন। তবে তিনি তার এই সফরের আগে একজন লোকের নাম পাঠিয়েছিলেন যার সাথে তিনি সাক্ষাৎ করতে বিশেষ আগ্রহী। হোটেলের লবীতে সেই লোকটি যখন পায়জামা পাঞ্জাবী পরে উপস্থিত হন, হেনরি কিসিঞ্জার তখন ডঃ কামাল হোসেন সহ অন্যান্য বিখ্যাত লোকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন যাদের অনেকেই কিসিঞ্জারের স্টুডেন্ট ছিলেন। সেই লোকটিকে আসতে দেখে হেনরি কিসিঞ্জার দ্রুত এগিয়ে এসে উষ্ণ করমর্দনসহ তাকে অভ্যর্থনা জানান। সেই সাথে তার নতুন স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এই বলে, ইনি হার্ভাডে আমার কলিগ ছিলেন। সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী এবং জ্ঞানতাপস এই মানুষটিকে কিসিঞ্জার যে এতখানি সমীহ করেন সেটা দেখে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যান।

চীন সরকারের শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে ১৯৮৭ সালে আমি বেইজিং যাই। আমাদেরকে প্রথম বছরে চাইনিজ ল্যাংগুয়েজ শিখতে হয়েছিল। বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে চাইনিজ শেখার জন্য আমাদেরকে প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ক্লাস করতে হত। সাতজন বাংলাদেশী আর ছয়জন কেনিয়ান স্টুডেন্ট নিয়ে আমাদের ক্লাস। সবাই আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। পরে অবশ্য দুইজন পোলিশ ছাত্রী এসে যোগ দেয় আমাদের ক্লাসে, তাদের বিষয় ছিল ফাইন আর্টস। আটটা থেকে দশটা এই দুই ঘণ্টা ক্লাস নিতেন একজন মহিলা টিচার যাকে আমরা ‘ট্রোং লাওশ্রি’ বলে সম্বোধন করতাম। ‘ট্রোং’ হচ্ছে তার ফ্যামিলি নেম, আর চীনা ভাষায় টিচারকে বলে ‘লাওশ্রি’। দশটা থেকে বারোটার ক্লাস নিতেন মাঝ বয়সী একজন পুরুষ টিচার, ‘ট্রাং লাওশ্রি’। প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে বোকা বনে গেলাম। টিচারদের কারো মুখেই একটি ইংরেজী শব্দ নেই। তারা যদি ইংরেজীই না বলেন তবে কোন ভাষায় আমাদেরকে শিক্ষা দিবেন। চাইনিজে? যে ভাষার মাথামুন্ডু কিছুই আমাদের জানা নেই। কিন্তু আস্তে আস্তে আমাদের ভুল ভেঙ্গে যায়। শুধু মাত্র চাইনিজ ভাষা এবং তার সাথে কিছু এক্সপ্রেশন যোগ করে তারা আমাদেরকে বেশ ভালোভাবেই চাইনিজ ভাষা শেখাতে সক্ষম হলেন। এই পদ্ধতির সবচেয়ে কার্যকরী দিকটি হলো আমরা যখন চাইনিজ ভাষায় কথা বলতাম তখন মনে মনে সেটাকে বাংলা থেকে অনুবাদ করার প্রয়োজন হতো না যেমনটি করতে হয় ইংরেজী বলার সময়। ফলে আমরা বেশ তাড়াতাড়ি সাবলীলভাবে চাইনিজে কনভারসেশন চালিয়ে যাওয়া শিখে গেলাম। ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে আমাদেরকে প্রায়শই

বেইজিং-এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া হত। সে রকম এক সাইট সিয়িং ট্যুরে ‘ট্রাং লাওশ্রি’-এর সাথে আমার কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রসংগ নিয়ে। তিনি বললেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চীন যে ১৯৭৫ সালের ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি সেটি ছিল একটি দুঃখজনক ঘটনা। তবে বর্তমানে ‘ট্রোং কোয়া হ মংচিয়ালা কোয়া শির ইয়ো হাও ডি কোয়াচিয়া’। যেহেতু তখন আমার চাইনিজের দৌড় অল্প কিছু সামাজিক আলাপচারিতার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাই আমার দূরাবস্থার কথা ভেবে তিনি তার কথাটাকে ইংরেজীতে অনুবাদ করে বললেন, ‘চায়না এন্ড বাংলাদেশ আর ফ্রেন্ডস নাউ’। তার মুখে আগে কখনও ইংরেজী শুনিনি, তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তুমি ক্লাসে ইংরেজী বলো না কেন? উত্তরে জানালেন যে নিয়ম নেই তাই। সেদিন আঠারো বছরের তরুণ আমি চীন বাংলাদেশের পারস্পরিক বন্ধুত্ব নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিলাম না। তবে আজকের পরিণত আমি চীন বাংলাদেশের বন্ধুত্ব নিয়ে বেশ সন্দিহান। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলামিস্ট

টরন্টো