কানাডার এক-পঞ্চমাংশ কর্মস্থলে নতুন কর্মীদের জন্য নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই

শ্রমিকদের দেয়া ক্ষতিপূরণের অঙ্ক থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কানাডার কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ৩,৮০০ লোকের মৃত্যু ঘটেছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক ॥  ২০ এপ্রিল, ২০২২ : নতুন এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কানাডার প্রায় ২০ শতাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নেই। দেশের বেশিরভাগ অংশেই আইন অনুযায়ী নতুন শ্রমিকদের জন্য এ ধরণের  কর্মসূচি থাকা জরুরী। এটি এমন এক উদ্ঘাটন যাকে একজন শ্রম বিশেষজ্ঞ “দুঃখজনক” এবং “আইন লংঘনের উদাহরণ” হিসাবে উল্লেখ করেন। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন বানেছা বলিনটেক।

কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে সোচ্চার থ্রেড অব লাইফ নামের একটি সামাজিক গ্রুপের পক্ষে এঙ্গুশ রেইডের পরিচালিত সমীক্ষায় এমন এক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে যা সিন্থিয়া ক্যাথলিন আগাগোড়া খুব ভালো করেই জানেন।

তার ভাই টিম ডেসগ্রোসেলিয়ারস টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে চাকরিরত অবস্থায় বিভিন্ন সরঞ্জাম পড়ে পাঁচ বছর আগে মারা যান। তখন থেকেই তিনি কর্মস্থলে নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন।

টরন্টোর বাসিন্দা সিন্থিয়া ক্যাথলিন সিবিসি নিউজকে বলেন, “টিম-এর ঘটনা বলে দেয়, নিয়োগদাতা ও সুপারভাইজাররা নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবেন এটাই হওয়া দরকার।”

ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে টিম ডেসগ্রোসেলিয়ারস। টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে এলিভেটর স্থাপনের সময় দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে তিনি মারা যান। (সিন্থিয়া ক্যাথলিনের সৌজন্যে)

সিন্থিয়া বলেন, তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলতে পারেন যেজন্যে টিমের মৃত্যু হয়েছিল: তাকে একেবারে শেষ মুহূর্তে তার কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কাজের সময় তাকে কোনও পর্যবেক্ষণকারী ( spotter) দেওয়া হয়নি এবং এ কাজের জন্য তার হালনাগাদ প্রশিক্ষণ ছিল না।

২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কানাডার কর্মস্থলে সংঘটিত ৩,৮০০ মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে সিন্থিয়ার ভাইয়ের মৃত্যু একটি। এই তথ্য কানাডার ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বোর্ডের শ্রমিক সমিতির। সিন্থিয়া বলেন, এঙ্গুশ রেইডের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আর কোনও নতুন শ্রমিককে যেন তার ভাইয়ের ভাগ্য বরণ করতে না হয় সেজন্যে এখনও কানাডার অনেক নিয়োগদাতাকে জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজন আছে।

“দিনের শেষে প্রতিটি মানুষের ঘরে ফিরে আসাটা সত্যিই সবচেয়ে জরুরী বিষয়।”

৫৪৫টি কোম্পানির ওপর সমীক্ষা চালানো হয়

এঙ্গুশ রেইড ফোরামের সদস্য ৫৪৫টি কোম্পানির ব্যবস্থাপকদের ভাড়া করে এনে ২৩ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়।

ওই ব্যবস্থাপকদের মধ্যে মোট ১০২ জন বলেছেন, তাদের কোম্পানিতে উদ্বুদ্ধকরণ, অনবোর্ডিং, নিরাপত্তা, জরুরী পরিস্থিতি, ক্ষতির ঝুঁকি বা অসুস্থতা এবং জখমজনিত বিষয়ে কোনওরকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এসব বিষয়ের মধ্যে কোনও একটিতেও প্রশিক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই এমন কোম্পানিগুলোর ৫২ শতাংশই হলো এমন প্রতিষ্ঠান যেগুলোতে ২৯ জন বা তার চেয়ে কম সংখ্যক কর্মচারী আছে।

থ্রেডস অব লাইফ-এর নির্বাহী পরিচালক শার্লি হিকম্যান বলেন, দুই বছরের কোভিড-১৯ মহামারির পর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয় এবং শ্রমিক নিয়োগের বিষয়গুলি কীভাবে সম্পন্ন করছে সেটা বোঝার চেষ্টা থেকেই তার গ্রুপ এই সমীক্ষার উদ্যোগ নেয়।

হিকম্যান-এর ২০ বছর বয়সী ছেলে ১৯৯৬ সালে লন্ডনের এক কর্মস্থলে বিস্ফোরণে মারা যায়। তিনি বলেন, “মহামারির কারণে তরুণদের চাকরি নেই। আর তারপর মহামারির অবসান হলো। এর ফলে নিয়োগদাতারা কি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিককে চাকরি দিচ্ছেন?”

তিনি বলেন, “এটা সত্যি বলেই প্রমাণিত হলো।”

সমীক্ষায় বলা হয়, উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ খাত যেমন কৃষি, সম্পদ, নির্মাণ, জ্বালানি, প্রস্তুতকারক

ও পরিবহন খাতের ২৭ শতাংশ কোম্পানি আগের দুই বছরের চেয়ে বেশি সংখ্যায় তরুণ শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

হিকম্যান বলেন, গত কয়েক বছরে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বাড়লেও মহামারির বিধিনিষেধ শিথিল হবার পর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণস্থলের মত কর্মক্ষেত্রে তরুণদের ফিরে যাওয়া নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি আশা করেন এসব তরুণ তাদের অধিকার সম্পর্কে জানবে এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানাবে।

তিনি বলেন, “কর্ম সম্পাদন করতে হবে এমনভাবে যেন সেখানে আহত হওয়া, অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে।”

শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ ও টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ওসগুড হল আইন অনুষদের প্রফেসর এরিক টাকার বলেন, প্রতিটি প্রদেশের আলাদা বিধিবিধান আছে তবে সাধারণভাবে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইনে নিয়োগকর্তাদে ওপর শ্রমিকদেরকে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্টারিওতে যেখানে এঙ্গুশ এইডের সমীক্ষাধীন কোম্পানিগুলোর ৪০ শতাংশের অবস্থান সেখানে ওই দায়িত্ব আরোপিত হয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আইনের আওতায়।

টাকার বলেন, আইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণদানের বাধ্যবাধকতা থাকার পরও কোম্পানিগুলি প্রকাশ্যেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না বলে স্বীকার করায় এটা স্পষ্ট যে, এখানে “ব্যাপকভিত্তিক আইনলংঘনের” ঘটনা ঘটছেÑ এর আংশিক কারণ প্রাদেশিক সরকারের আইন প্রয়োগে দুর্বলতা।

“প্রত্যেক নিয়োগকর্তারই কোনও না কোনও ধরণের নিরাপত্তা কর্মসূচি থাকা জরুরী, তাই এ ধরণের কর্মসূচি না থাকার স্বীকারোক্তি সত্যিই দুঃখজনক বাস্তবতা।”

অন্টারিওর শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সিবিসি নিউজকে বলেন, তাদের প্রদেশ কর্মস্থল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ করে তোলার উদ্যোগে “থ্রেডস অব লাইফকে মদদ দিতে পেরে গর্বিত”।

এক ই-মেল বার্তায় সিয়ারা নার্ডেলি বলেন, “কানাডায় নিরাপত্তার সেরা রেকর্ড আছে অন্টারিওর। আমাদের প্রতিরোধমূলক সক্রিয় উদ্যোগে নিরাপত্তাকেই সবার প্রথমে স্থান দেয়া হয়, শ্রমিকদের রক্ষায় কর্মস্থলের ঝুঁকি প্রতিরোধ ও সংশোধন করা হয়।”

“আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ছোট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্য ও সচেতনতার উন্নয়ন ও তার চর্চা করা যা চূড়ান্ত পর্যায়ে কর্মস্থলে আহত হওয়া, মৃত্যু ও অসুস্থতার ঘটনা কমিয়ে আনতে সহায়ক হয়।”

অন্টারিওর অডিটর জেনারেলের ২০১৯ সালের রিপোর্টে কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ জোরদারে শ্রম মন্ত্রণালয়ের জন্য ২৭ দফা সুপারিশ পেশ করে। ২০২১ সালে ওই দপ্তরের পরবর্তী রিপোর্টে বলা হয়, তাদের সুপারিশের ১১ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে, ৫২ শতাংশ বাস্তবায়নাধীন আছে এবং ৩৩ শতাংশের ক্ষেত্রে খুব সামান্য অগ্রগতি হয়েছে অথবা একেবারেই হয়নি।

টাকার বলেন, প্রদেশে কর্মস্থলে বিদ্যমান বাস্তবতা আইনের মাধ্যমে সুরাহা না করা পর্যন্ত নিয়োগদাতারা নিরাপদ পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে কোনও উৎসাহ দেখাবে না।

“সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার অভাব কোম্পানিগুলিকে ব্যবসা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে না।”