আরো বেশী আসনে জয়ী হলো ড্যাগ ফোর্ডের নেতৃত্বাধীন প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি

প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পাটি’র নেতা ড্যাগ ফোর্ড ও তার স্ত্রী কার্লা । ছবি ; কানাডিয়ান প্রেস/নাথান ডেনেট

প্রবাসী কণ্ঠ : যাদু দেখালেন অন্টারিও’র প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান ড্যাগ ফোর্ড। ২০১৮ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবার আরো বেশী আসন দখল করে তার দল। গত ২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল আসন পায় ৮৩ টি। অন্টারিও পার্লামেন্টে মোট আসন সংখ্যা ১২৪ টি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে মোট ৬৩ টি আসন জয়ী হতে হয়।
ড্যাগ ফোর্ডের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমে বলতে গেলে প্রায় নাকানি-চুবানি খাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে প্রধান দুই বিরোধী দল অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি ও অন্টারিও লিবারেল পার্টির। এন্ড্রিয়া হরওয়াথ এর নেতৃত্বাধীন নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি আসন পেয়েছে ৩১ টি এবং স্টিভেন ডেল ডুকা’র নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টি আসন পেয়েছে মাত্র ৮ টি। গতবারের তুলনায় মাত্র ১ টি আসন বেশী পেয়েছে এই দলটি। আর নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি গতবারের তুলনায় ৯ টি আসন কম পেয়েছে। গতবার তারা আসন পেয়েছিল ৪০ টি।
লিবারেল পার্টি ২০১৮ সালের প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে ৭ আসন পেয়ে বিরোধী দলের মর্যাদাও হারিয়েছিল। অথচ দলটি সেই সময় ছিল ক্ষমতায়।
ড্যাগ ফোর্ডের দল এবার পপুলার ভোট পেছে ৪০.৮%। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পপুলার ভোট প্রাপ্তির হারও ছিল প্রায় একই রকম। সেবার তারা পেয়েছিল ৪০.৫%। এই সামান্য বৃদ্ধিতেই তাদের আসন সংখ্যা বেড়ে যায় ৭ টি। অর্থাৎ ২০১৮ সালের তারা আসন পেয়েছিল ৭৬ টি। এবার পায় ৮৩ টি।
তবে এবারের নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অন্টারিও’র ইতিহাসে সবচেয়ে কম। মাত্র ৪৩.৫% ভোটার ভোট দিয়েছেন। অন্টারিওতে রেজিস্টার্ড ভোটার রয়েছেন ১০.৭ মিলিয়ন। সেই হিসাবে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছেন ৪.৬ মিলিয়ন ভোটার। বাকি ভোটারগণ ভোট দিলে নির্বাচনের ফলাফল কি হতে পারতো তা জানার কোন উপায় অবশ্য নেই এই মুহূর্তে।
উল্øেখ্য যে, এবারের নির্বাচনে ড্যাগ ফোর্ডের দল বিপুল সংখ্যক আসন পেলেও ২০১৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক বছর পরই তার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছিল। একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছিল তার জনপ্রিয়তা। ঐ সময়ে মেইনস্ট্রিট রিসার্স এর জরিপে দেখা গিয়ে ছিল, যদি তখন অন্টারিওতে সাধারণ নির্বাচন ডাকা হতো তবে শতকরা ৪০ জন ভোটার ভোট দিতেন লিবারেল পার্টিকে। এনডিপি-কে ভোট দিতেন শতকরা ২৪ জন ভোটার। আর ড্যাগ ফোর্ডের প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি ভোট পেতো শতকরা ২২ জন ভোটারের। অথচ ২০১৮ সালের ৭ জুনের নির্বাচনে ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধীন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি জয়ী হয়েছিল মোট ৭৬টি আসনে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল অন্টারিও এনডিপি। তারা জয়ী হয়েছিল ৪০টি আসনে। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। ড্যাগ ফোর্ডের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি। সেই পার্টিকে তিনি এমন ভাবে ধরাশায়ী করেছিলেন যে, তারা পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মর্যাদাও হারিয়েলি।
মেইনট্রিট রিসার্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিইটো ম্যাজি সেই সময় বলেছিলেন, ‘আমরা কখনো দেখিনি কোন ক্ষমতাসীন প্রিমিয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে জনগনের এতটা বিরাগভাজন হয়ে উঠেছেন।’
টরন্টোর ‘নাউ’ পত্রিকা তখন এই বলে মত প্রকাশ করেছিল যে, ‘ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম এক বছরে বিভিন্ন খাতে ড্যাগ ফোর্ডের অপরিকল্পিত ব্যয় সংকোচন এর উন্মাদনা এবং নিজ প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার কারণে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। শতকরা ৭৫ জনই এখন তাকে পছন্দ করছেন না।’
ক্ষমতায় এসে ড্যাগ ফোর্ড জনগণের সেবায় বরাদ্দ তহবিল কেটে-কুটে একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন শুরু থেকেই। ড্যাগ ফোর্ডের অপরিকল্পিত ‘কাট কাট এবং কাট’ নীতি অর্থাৎ জড়বুদ্ধিতাসম্পন্ন ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে এবং একই সাথে অনেক কিছু বেসরকারী করণের পরিকল্পনা নেয়ার কারণে তখন তার অবস্থা এমন পর্যায়ে নেমে এসেছিল যে, তিনি নিজ দলের মধ্যেও অনেকের সমর্থন হারিয়েছিলেন। তার খামখেয়ালীপনার কারণে তখন কয়েকজন মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্মকর্তাও পদত্যাগ করেছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পর ড্যাগ ফোর্ডের কাট-ছাটের উৎসব অব্যাহত থাকে। শুরুর দিকেই তিনি বাতিল করে দেন স্বল্প আয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ফ্রি টিউশন’ এর সুযোগ। এর পর অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৫ ডলার করার পরিকল্পনাকেও স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার আগে লিবারেল সরকারের করা Fair Workplaces, Better Jobs Act অনুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাস থেকে ন্যূনতম মজুরী ১৫ ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। সেই সময় হাফিংটন পোস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইতিপূর্বে লিবারেল সরকার কয়েক দফায় ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি করলেও চাকরীর বাজারে তার রিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি।
ড্যাগ ফোর্ডের ব্যয় সংকোচন তালিকার মধ্যে আরো ছিল, স্কুলে বাচ্চাদের জন্য লাঞ্চ প্রোগ্রাম, ক্লাশরূম সাইজ, অটিজম ফান্ড, পাবলিক হেলথ, চাইল্ড কেয়ার স্পেস-সহ আরো কিছু বিষয়।
কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ড্যাগ ফোর্ডকে কেউ কেউ ‘এক্সিডেন্টাল প্রিমিয়ার’ হিসাবে আখ্যায়িত করলেও তিনি আবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি নিজেই নিজেকে ‘জনগণের প্রিমিয়ার’ হিসাবে আখ্যায়িত করে আসছেন শুরু থেকে। আর ২০২২ সালের নির্বাচনের আগে ড্যাগ ফোর্ড আবির্ভূত হয়েছেন একজন ‘দানবীর’ হিসাবে। তিনি নির্বাচনের ঠিক আগে অন্টারিও’র গাড়ির মালিকদেরকে লাইসেন্স প্লেট রিনিউ করার টাকা ফেরত দিয়েছেন বা দিচ্ছেন যার পরিমাণ ১.১ বিলিয়ন। টাকা লাগবে না টরন্টোর নিকটবর্তী ডারহাম এলাকায় কয়েকটি হাইওয়েতেও যেখানে আগে টুল বা শুল্ক নেয়ার ব্যবস্থা ছিল। ব্র্যাম্পটনে হাসপাতালের ধারণক্ষমতা বর্ধিতকরণের জন্য ২১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। অশোয়া এবং ইনগারসোল এলাকার বাসিন্দাদের নতুন কর্মসংস্থানের জন্য ২৫৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি জেনারেল মটর্স এর পিছনে। এছাড়াও ‘হোন্ডা কানাডা’, ইলেক্ট্রনিকস জায়েন্ট ‘LG’, অটোমেকার ‘Stellantis’ এই সকল বৃহৎ কোম্পানীর জন্যও ফান্ড যোগাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ফোর্ড।
অন্যদিকে গ্যাস ও জ¦ালানী টেক্স বা কর কমানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামীতে। গ্যাস ও জ¦ালানী কর কমানো হবে যথাক্রমে ৫.৭% ও ৫.৫% করে। সামালোচকরা অবশ্য দাবী করছেন গ্যাস এর কর কামানো হলেও চালকদের কোন সাশ্রয় হবে না উল্লেখ করার মত। বছরে বড়জোর ৬৫ ডলার সেভ করতে পারবেন চালকরা।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করেন ফোর্ডের এই হঠাৎ ‘দানবীর’ বনে যাওয়ার পিছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল ভোট চাওয়া। এবং সম্ভত এই ‘দানবীর’ বনে যাওয়ার বিষয়টি কাজে লেগেছে। তিনি অন্য দুটি প্রধান দলের তুলনায় সুবিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।
তবে এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তিনি কতটা রক্ষা করবেন বা করতে পারবেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার অনেকগুলোই তিনি পূরণ করেননি। ঐ প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্য ছিল অটিজম, হেলথ কেয়ার, মেন্টাল হেলথ, রেন্ট কন্ট্রোল, হাউজিং ইত্যাদি সহ আরো কয়েকটি বিষয়ে সেবা বৃদ্ধি বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
এবারের নির্বাচনে ড্যাগ ফোর্ড যাদু দেখালেও অন্য দুটি প্রধান দল অন্টারিও লিবারেল পার্টি ও অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি মোটেও সুবিধা করতে পারেনি। অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি সামান্য এগিয়ে থাকলেও স্টিভেন ডেল ডুকা’র নেতৃত্বাধীন অন্টারিও লিবারেল পার্টির অবস্থা গতবারের মতোই খুবই শোচনীয় অবস্থায় নিপতিত হয়। তাছাড়া ডেল ডুকা নিজের আসনেও জয়ী হতে পারেননি। ফলে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। আর ডেল ডুকা অন্টারিও লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে খুব একটা সক্রিয়ও ছিলেন না। নির্বাচনের মাস খানেক আগে তাকে সক্রিয় হতে দেখা যায়।
দলের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা এন্ড্রিয়া হরওয়াথ-ও।