‘ফোর্ড এবার ভোটারদেরকে বোকা বানাতে পারবেন না’

খুরশিদ আলম

অন্টারিও’র পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ২ জুন। ঐ নির্বাচনে কোন দল জিতবে আর কোন দল হারবে তা নিয়ে জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলো গত কয়েক মাস ধরেই তাদের ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছে। ঐসব জরিপে দেখা যাচ্ছে বর্তমান প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডের নেতৃত্বাধীন অন্টারিও’র প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি আবারো ক্ষমতায় আসছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই তারা আবারো সরকার গঠন করবে।

অবশ্য ইতিপূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে জরিপের ফলাফল অনেক সময় পাল্টে যেতে থাকে। এবারের পরিস্থিতিও সেরকম কিছু হবে কি না তা সময়ই বলে দিবে। তবে ড্যাগ ফোর্ড আবারো ক্ষমতায় আসার জন্য ইতিমধ্যেই ভোটারদেরকে একের পর এক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনে আবারও জয়ী হলে জনগণের জন্য তিনি কি কি করবেন তার ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত।

সিবিসি নিউজ তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলতি মাসের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ড্যাগ ফোর্ড যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী খরচ হবে সরকারের। তবে প্রতিশ্রুতি প্রদান এখনো শেষ হয়নি। আগামী কয়েক সপ্তাহে আরো প্রতিশ্রুতি আসবে এমনটাই বলছেন পর্যবেক্ষক মহল।

কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনের আগে যে সকল প্রতিশ্রুতি দেন তার সবকটিই কি তারা পুরণ করেন? এর সোজা জবাব – না। তাহলে প্রতিশ্রুতি দেন কেন? এর সোজা জবাব – ভোট পাবার জন্য। তা হলে এই প্রতিশ্রুতিকে কি প্রতারণা বলা যেতে পারে? এর সোজা জবাব – হ্যাঁ অথবা না এই দুটোই হতে পারে। যদি কেউ নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি যথাসময়ে পূরণ করতে পারেন তবে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতারণা করেছেন এমন কথা বলার কোন সুযোগ নেই। আর কেউ যদি নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারেন তবে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতারণা করেছেন এমনটা বলার সুযোগ থাকে বৈকি।

কিন্তু এটিও সত্যি যে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সবসময়ই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনা নানান করণে। রাজনীতি, অর্থনীতি বা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক সময়ই এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যে অতীতে দেয়া কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি তখন সদিচ্ছা থাকা সত্বেও বাস্তবায়ন করা কঠিন বা অসম্ভব হয়ে উঠে।

এখন অতীতে দেয়া কোন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে একজন রাজনৈতিক নেতার সদিচ্ছা কতটুকু আছে বা নেই সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। আর এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠতে পারে ড্যাগ ফোর্ডের বেলায়ও। তার আগে এক নজর দেখে নেয়া যাক ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড্যাগ ফোর্ড যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভোট পাবার জন্য সেগুলো তিনি কতটা পূরণ করেছেন।

‘হোন্ডা কানাডা’, ইলেক্ট্রনিকস জায়েন্ট ‘খএ’, অটোমেকার ‘ঝঃবষষধহঃরং’ এই সকল বৃহৎ কোম্পানীর জন্যও ফান্ড যোগাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ফোর্ড। ছবি : ক্রিস ইয়ং/কানাডিয়ান প্রেস

কানাডায় কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অংশগ্রহণে গঠিত ‘প্রমিস ট্র্যাকার’ (চৎড়সরংব ঞৎধপশবৎ) নামের একটি সংস্থার (ম্যাক্মাস্টার বিশ^বিদ্যালয় এবং অন্য আরো দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্বে) হিসাবে দেখা গেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে নির্বাচিত হওয়ার পর চলতি সালের এপ্রিল মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত ড্যাগ ফোর্ড তাঁর দেয়া প্রতিশ্রুতির মাত্র ৩৭% পুরোপুরি রক্ষা করেছেন। আর ১৮% রক্ষা করেছেন আংশিকভাবে। প্রতিশ্রুতির ২৩% পূরণ হওয়ার ব্যাপারে অগ্রগতি চলছে। আগামী ২ জুন নির্বাচনের আগে তা পূরণ হবে কি না সেই বিষয়ে কিছু বলা হয়নি প্রমিস ট্রাকার এর প্রতিবেদনে। আর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ১৩% ভঙ্গ করা হয়েছে গত চার বছরে এবং বাকি ১০% এর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা যায়নি এখনো।

অন্যদিকে অন্টারিও লিবারেল পার্টির ওয়েবসাইটে ড্যাগ ফোর্ডের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এক তালিকা তুলে ধরা হয়েছে। গত ৪ এপ্রিল প্রকাশিত ঐ তালিকায় ৮ টি প্রধান ইস্যুকে সামনে টেনে আনা হয়েছে। তবে আরো অনেক বিষয়ে ড্যাগ ফোর্ড প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন বলে দাবী করা হয় দলটির ওয়েবসাইটে।

লিবারেল এর মতে যে ৮ টি প্রধান বিষয়ে ড্যাগ ফোর্ড প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন তার মধ্যে আছে :

১.  অটিজম : অন্টারিওতে বর্তমানে ৮ হাজার ৪ শ শিশু সরকারী অনুদানে অটিজমের চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। আর প্রায় ২৩ হাজার শিশু এখনো অপেক্ষায় আছে এই চিকিৎসা পবার জন্য। 

২.  হেলথ কেয়ার : অন্টারিওতে ক্যান্সারসহ নানান জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য ওয়েটিং টাইম অনেক দীর্ঘ। এটি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ড্যাগ ফোর্ড। 

৩.  মেন্টাল হেলথ : যারা মেন্টাল হেলথ বা মানসিক রোগে ভুগছেন এবং এডিকশন বা মাদক আসক্তিতে ভুগছেন তাদের চিকিৎসার ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন ড্যাগ ফোর্ড।

৪.  রেন্ট কন্ট্রোল : অন্টারিওতে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে ড্যাগ ফোর্ড বলেছিলেন তিনি এটি স্থিতিঅবস্থায় রাখবেন। লিবারেল এর দাবী, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি।

৫.  হাউজিং : ড্যাগ ফোর্ড প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলন যখন কেউ বাড়ি কিনতে যাবেন তখন এটি হবে সহজ এবং আরো সাশ্রয়ী। কিন্তু অন্টারিওতে বাড়ির দাম ক্রমাগতই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা অনেক আগেই আকাশ ছোঁয়া অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সাধারণ এমনকি মধ্যম আয়ের লোকদের কাছেও বাড়ি কিনার বিষয়টি এখন দিবাস্বপ্নের মত।

৬.  হাইড্রো প্রাইজ : ড্যাগ ফোর্ড প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন হাইড্রো বা বিদ্যুৎ এর দাম ১২% কমাবেন। ফোর্ড টিমের দাবী, তারা তা কমিয়েছেন। কিন্তু লিবারেল পার্টি টরন্টো স্টার এর বরাত দিয়ে বলছে দাম কমেনি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। 

৭.  গ্রীনবেল্ট : টরন্টো ও তার আশেপাশে কিছু এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ঐসব এলাকায় কোন বাড়িঘর, শিল্পকারখানা বা সড়ক মহাসড়ক নির্মান না করার প্রতিশ্রুতি একাধিকবার দিয়েছেন ড্যাগ ফোর্ড। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি তিনি আবার ভাঙ্গারও চেষ্টা করেছেন কয়েকবার। তবে জনরোষের কারণে আবার পিছিয়েও এসেছেন। এবার আবার গত বছর পরিকল্পনা করেছেন অন্টারিওতে একটি সুপারহাইওয়ে নির্মানের যা গ্রীনবেল্ট এর উপর দিয়ে যাবে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশর উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে।  

৮.  কাট ইনকাম টেক্স : গত নির্বাচনের আগে ড্যাগ ফোর্ড কথা দিয়েছিলেন অন্টরিওতে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জন্য টেক্স কমাবেন। তার কথামত সেকেন্ড ইনকামটেক্স ব্রেকেট ২০% কমিয়ে আনার কথা ছিল। তিনি বলেছিলেন, আমাদের সোজাসাপ্টা মতবাদ –  ‘সরকারের পকেটের পরিবর্তে করদাতাদের পকেটে ডলার জমা করতে হবে।’ কিন্তু সেই ওয়াদা ড্যাগ ফোর্ড রাখেননি। 

সেই ফোর্ড এবার আবার নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতিদানের উৎসবে মেতে উঠেছেন। তিনি ধরেই নিয়েছেন অন্টারিওর জনগণের স্মৃতিশক্তি কম। অতীতে তিনি খরচ কমানোর নামে যে ভাবে লোকজনকে ঠকিয়েছেন তা সবাই ভুলে গেছেন। তিনি যে তার অনেক প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি তাও জনগণ ভুলে গেছেন। এবং তারা সহোৎসাহে আবারও তাকে নির্বাচিত করবেন।

ড্যাগ ফোর্ডের হিসাব নিকাশ হয়তো ঠিকই আছে। কারণ বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে তিনি আবারও নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন এবং বিপুল ভোটেই নির্বাচিত হবেন।

রহস্যটা কি তাহলে? আমরা দেখেছি ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হবার পর এক বছরের মাথায় ড্যাগ ফোর্ডের জনপ্রিয়তা একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছিল। ঐ সময়ে মেইনস্ট্রিট রিসার্স এর জরিপে দেখা গিয়েছিল, যদি তখন অন্টারিওতে সাধারণ নির্বাচন ডাকা হতো তবে শতকরা ৪০ জন ভোটার ভোট দিতেন লিবারেল পার্টিকে। এনডিপি-কে ভোট দিতেন শতকরা ২৪ জন ভোটার। আর ড্যাগ ফোর্ডের প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি ভোট পেতো শতকরা ২২ জন ভোটারের। অথচ ২০১৮ সালের ৭ জুনের নির্বাচনে ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধীন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি জয়ী হয়েছিল মোট ৭৬টি আসনে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল অন্টারিও এনডিপি। তারা জয়ী হয়েছিল ৪০টি আসনে। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। ড্যাগ ফোর্ডের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল ক্ষক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি। সেই পার্টিকে তিনি এমন ভাবে ধরাশায়ী করেছিলেন যে, তারা পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মর্যাদাও হারায়। পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে অন্তত ৮টি আসনে জয়ী হতে হয়। লিবারেল পার্টি পেয়েছিল মাত্র ৭টি আসন!

মেইনট্রিট রিসার্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিইটো ম্যাজি সেই সময় বলেছিলেন, ‘আমরা কখনো দেখিনি কোন ক্ষমতাসীন প্রিমিয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে জনগনের এতটা বিরাগভাজন হয়ে উঠেছেন।’

টরন্টোর ‘নাউ’ পত্রিকা তখন এই বলে মত প্রকাশ করেছিল যে, ‘ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম এক বছরে বিভিন্ন খাতে ড্যাগ ফোর্ডের অপরিকল্পিত ব্যয় সংকোচন এর উন্মাদনা এবং নিজ প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার কারণে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। শতকরা ৭৫ জনই এখন তাকে পছন্দ করছেন না।’

ক্ষমতায় এসে ড্যাগ ফোর্ড জনগণের সেবায় বরাদ্দ তহবিল কেটে-কুটে একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন শুরু থেকেই। ড্যাগ ফোর্ডের অপরিকল্পিত ‘কাট কাট এবং কাট’ নীতি অর্থাৎ জড়বুদ্ধিতাসম্পন্ন ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে এবং একই সাথে অনেক কিছু বেসরকারী করণের পরিকল্পনা নেয়ার কারণে তখন তার অবস্থা এমন পর্যায়ে নেমে এসেছিল যে, তিনি নিজ দলের মধ্যেও অনেকের সমর্থন হারিয়েছিলেন। তার খামখেয়ালীপনার কারণে তখন কয়েকজন মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্মকর্তাও পদত্যাগ করেছিলেন।

নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পর ড্যাগ ফোর্ডের কাট-ছাটের উৎসব অব্যাহত থাকে। শুরুর দিকেই তিনি বাতিল করে দেন স্বল্প আয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ফ্রি টিউশন’ এর সুযোগ। এর পর অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৫ ডলার করার পরিকল্পনাকেও স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার আগে লিবারেল সরকারের করা ঋধরৎ ড়িৎশঢ়ষধপবং নবঃঃবৎ লড়নং ধপঃ অনুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাস থেকে ন্যূনতম মজুরী ১৫ ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। সেই সময় হাফিংটন পোস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইতিপূর্বে লিবারেল সরকার কয়েক দফায় ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি করলেও চাকরীর বাজারে তার রিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি।

ড্যাগ ফোর্ডের ব্যয় সংকোচন তালিকার মধ্যে আরো ছিল, স্কুলে বাচ্চাদের জন্য লাঞ্চ প্রোগ্রাম, ক্লাশরূম সাইজ, অটিজম ফান্ড, পাবলিক হেলথ, চাইল্ড কেয়ার স্পেস-সহ আরো কিছু বিষয়।

কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ড্যাগ ফোর্ডকে কেউ কেউ ‘এক্সিডেন্টাল প্রিমিয়ার’ হিসাবে আখ্যায়িত করলেও তিনি আবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি নিজেই নিজেকে ‘জনগণের প্রিমিয়ার’ হিসাবে আখ্যায়িত করে আসছেন শুরু থেকে। আর এবারের নির্বাচনের আগে ড্যাগ ফোর্ড আবির্ভূত হয়েছেন একজন ‘দানবীর’ হিসাবে। তিনি ইতিমধ্যেই অন্টারিও’র গাড়ির মালিকদেরকে লাইসেন্স প্লেট রিনিউ করার টাকা ফেরত দিয়েছেন বা দিচ্ছেন যার পরিমাণ ১.১ বিলিয়ন। টাকা লাগবে না টরন্টোর নিকটবর্তী ডারহাম এলাকায় কয়েকটি হাইওয়েতেও যেখানে আগে টুল বা শুল্ক নেয়ার ব্যবস্থা ছিল। ব্র্যাম্পটনে হাসপাতালের ধারণক্ষমতা বর্ধিতকরণের জন্য ২১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। অশোয়া এবং ইনগারসোল এলাকার বাসিন্দাদের নতুন কর্মসংস্থানের জন্য ২৫৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশ^াস দিয়েছেন তিনি জেনারেল মটর্স এর পিছনে। এছাড়াও ‘হোন্ডা কানাডা’, ইলেক্ট্রনিকস জায়েন্ট ‘খএ’, অটোমেকার ‘ঝঃবষষধহঃরং’ এই সকল বৃহৎ কোম্পানীর জন্যও ফান্ড যোগাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ফোর্ড।

অন্যদিকে গ্যাস ও জ¦ালানী টেক্স বা কর কমানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামীতে। গ্যাস ও জ¦ালানী কর কমানো হবে যথাক্রমে ৫.৭% ও ৫.৫% করে। সামালোচকরা অবশ্য দাবী করছেন গ্যাস এর কর কামানো হলেও চালকদের কোন সাশ্রয় হবে না উল্লেখ করার মত। বছরে বড়জোর ৬৫ ডলার সেভ করতে পারবেন চালকরা।

ফোর্ডের এই হঠাৎ দানবীর বনে যাওয়ার পিছনে আসল উদ্দেশ্য যে ভোট চাওয়া সে কথা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। এই প্র্যাকটিস অবশ্য সব রাজনীতিবিদই করে থাকেন নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে। তবে ফোর্ডের ব্যাপারে বলতে হয় যে, তিনি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই ব্যয় সংকোচের নামে জনগণের প্রাপ্য অনেক আর্থিক সুবিধা কর্তন করেছিলেন। এখন আবার কিছু আর্থিক সুবিধা প্রদানের কথা বলছেন। কিন্তু নির্বাচনে যদি এবারও জয়ী হন তখন আবার কোন কর্তন উন্মাদনায় মেতে উঠবেন কে জানে। এবং সব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন তারও কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ আমরা দেখেছি গত নির্বাচনের আগে যে সকল প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তার অনেক কিছুই এখনো পূরণ হয়নি।

সিবিসি নিউজ গত ২০ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হঠাৎ ‘দানবীর’ বনে যাওয়া ফোর্ড এর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কিছু তথ্য তুলে ধরে। এর মধ্যে আছে টরন্টোর সেন্ট জোসেফ হেলথ সেন্টারের ভবিষ্যত পুনঃউন্নয়নের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি। এছাড়াও স্কারবরো, বেরী, ব্রান্টফোর্ড, ব্র্যাম্পটন এবং অটোয়ার কয়েকটি হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ফোর্ড।

ঠিক নির্বাচনের আগে এই সকল প্রতিশ্রুতি আসায় অনেকেই একে ভোট রাজনীতির সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে ফোর্ড মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্রিস্টিন এলিয়ট সিবিসি নিউজের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটি নতুন কোন প্রতিশ্রুতি নয়। আমরা অনেকদিন ধরেই এই কথাগুলো বলে আসছিলাম যে অন্টরিওর হাসপাতালগুলোর সংস্কার করা প্রয়োজন নতুন সুযোগ-সুবিধা যোগ করার জন্য। কারণ এগুলোর অবকাঠামো অনেকদিনের পুরানো।

তবে অন্টারিও’র লিবারেল পার্টির প্রধান স্টিভেন ডেল ডুকা এই ব্যাখ্যা মানতে রাজী নন। তিনি বলেন, এটি একেবারেই প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি তথা ড্যাগ ফোর্ডের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য করা হচ্ছে। 

ড্যাগ ফোর্ড ভোট পাবার আশায় আরো যে সকল খাতে অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার মধ্যে আছে- রুরাল ব্রডব্রেন্ড ইন্টারনেট (৯০০ মিলিয়ন ডলার), রিটেনশন বোনাস ফর নার্সেস (৭৬৩ মিলিয়ন ডলার), লং-টার্ম কেয়ার স্টাফিং (৬৭৩ মিলিয়ন ডলার), কলেজ এ্যান্ড ইউনিভার্সিটি টিউশন ফ্রিজ (৪৫০ মিলিয়ন ডলার), লং-টার্ম কেয়ার হোমস ইন টরন্টো (২৩৫ মিলিয়ন ডলার), লং-টার্ম কেয়ার হোমস ইন ভেরিয়াস লোকেশনস (২০৫ মিলিয়ন ডলার), ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রিসিটি সাবসিডি ফর নর্থান অন্টারিও (১৭৬ মিলিয়ন ডলার) সহ আরো কয়েকটি খাত। সিবিসি নিউজে এই তথ্য তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য যে, কানাডিয়ান ইউনিয়ন অফ পাবলিক এমপ্লয়ীজ এর প্রেসিডেন্ট ফ্রেড হ্যান মাস কয়েক আগে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কেউ যদি মনে করেন ড্যাগ ফোর্ড হঠাৎ বদলে গেছেন এবং তিনি কর্মজীবী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন তাহলে তারা তার বিগত সময়ের কর্মকান্ডের প্রতি সজাগ নন।’

ফ্রেড হ্যান আরো বলেন, ‘ করোনা মহামারীর পুরোটা সময় জুরেই অন্টারিও’র ‘ফিনান্সিয়াল একাউন্টিবিলিটি অফিস’ বলে আসছে যে, ড্যাগ ফোর্ডের সরকার করোনা মোকাবেলায় সাধারণ অন্টারিওবাসীসহ সরকারী কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের  সমর্থন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’

ফ্রেড হ্যানের মতে, ফোর্ড সরকার সেই অর্থ বাঁচিয়ে এখন নির্বাচনের আগে ভাব ধরেছে যে তারা মহামারীকালে অর্থনীতি পরিচালনায় ভাল কাজ করেছে। তবে কানাডিয়ান ইউনিয়ন অফ পাবলিক এমপ্লয়ীজ এর সদস্যরা সেই ধোকায় বিশ^াস করে না। ফোর্ড তাদেরকে বোকা বানাতে পারবেন না। ফ্রেড আরো বলেন, ‘অন্টারিও’র অর্থনীতি মহামারীর ধাক্কা সামলে উঠে পুনরুদ্ধারের পথে এগুচ্ছে ফোর্ডের এমন দাবী মিথ্যা। মহামারীকালে তিনি অন্টরিও’র শ্রমজীবী লোকদের সমর্থন করেছেন এই দাবীও মিথ্যা। বরং এখন দেখা যাচ্ছে ফোর্ড মহামারীকালে জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় না করে সেগুলো জমিয়ে রেখেছিলেন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ব্যয় করার জন্য। তিনি তার শুভাকাংখী বন্ধুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য হাইওয়ে ৪১৩ নামের একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন।’

উল্লেখ্য যে, হাইওয়ে ৪১৩ নামের প্রজেক্টে খরচ হতে পারে ৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর এই প্রজেক্ট অপ্রয়োজনীয় এবং তা পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে এমন দাবী করছেন অনেকেই। অথচ এই অপ্রয়োজনীয় কিন্তু বিপুল ব্যয়বহুল প্রজেক্টে তিনি টাকা ঢালতে রাজী। এতে মোটেও কার্পণ্য করছেন না। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তিনি অন্টারিওর নিন্ম আয়ের শ্রমজীবী মানুষের বেতনবৃদ্ধির আইনকে স্থগিত করে রেখেছিলেন। এখন নির্বাচন সামনে আসাতে তিনি হঠাৎ ‘জনদরদী’র ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে বেতন বৃদ্ধির কথা বলছেন। আর কি পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি? করোনা মহামারীকালে কানাডিয়ানদের মর্মপীড়ার মূল কারণ যখন অর্থসংকট তখন গত বছর অক্টোবর মাসের ১ তারিখ থেকে অন্টারিওতে কর্মজীবী মানুষের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা হয় মাত্র ১০ সেন্ট! এর ফলে তখন ন্যূনতম মজুরি ঘন্টায় ১৪.২৫ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.৩৫ ডলারে উন্নীত হয়েছিল।

অন্টারিওর প্রধান বিরোধী দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র নেতা এন্ড্রিয়া হোরওয়াথ তখন এই ১০ সেন্টের এই মজুরি বৃদ্ধির আইনকে শ্রমজীবী মানুষের জন্য অপমানজনক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সিবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই মজুরি বৃদ্ধি অন্টারিওর শ্রমজীবী মানুষের জন্য কোন ভিন্নতা বয়ে আনবে না।

গত জানুয়ারী মাস থেকে অবশ্য অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৫ ডলারে উন্নীত করা হয়। উল্লেখ্য যে, অন্টারিও’র  বিগত লিবারেল সরকারের করা ঋধরৎ ড়িৎশঢ়ষধপবং নবঃঃবৎ লড়নং ধপঃ অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। সেটি বাতিল করে দিয়ে গত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে অন্টারিওতে কষ্টে চলা প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ নিন্ম আয়ের মানুষদের জীবনকে আরো দুর্বিসহ করে তুলেছেন তিনি আয় থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে। এখন তিনিই আবার তাদের ভোট চাইছেন পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য!

আর কদিন পরেই শুরু হবে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। বিভিন্ন দল ভোটারদের কাছে ভোট চাইবেন। কিন্তু  জনগণ কাকে ভোট দিবেন আর কাকে দিবেন না সেটি সম্পূর্ণ তাঁদের এখতিয়ারে। তবে তারা আসন্ন নির্বাচনে জনবান্ধব যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে সচেষ্ট থাকবেন এমনটাই আশা সকলের।  

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ