প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯৪
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
কি জানি এখানে এসে কি হলো? একদম ঘুমহীন হয়ে আছি। দিনে তো গোটা অনুভূতি টান টান হয়ে থাকে। আর রাতে বিনিদ্র রজনীতে কেবল ঝিম মেরে যাওয়া অনুভূতিতে, জেগে ওঠার স্বপ্ন্। হয়তো খুব বেশী উত্তেজিত হলে শরীরে এমন-ই হয়। অন্তত পক্ষে ১৫/২০ বার আসলে সুইজারল্যান্ডে, তবেই বোধ হয় অনুভূতিগুলোর এই আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যাবে। গতকাল একজন বৃদ্ধ দম্পতির সাথে দেখা হয়েছিল, যারা এটা নিয়ে ২৭ বার এসেছে। তবুও তারা এখনও সমভাবে উত্তেজিত।
ঝিম মেরে থাকা শরীর, উদগ্রীব হয়ে ছিল কখন ভোর হবে? এবং ভোরে সবার আগে আমিই রেডী হলাম। মাহিন একটু ধীর স্থির। তবুও আমার পাল্লায় পড়ে জলদি করে আমরা নীচে নেমে এলাম, ব্রেকফাস্ট টেবিলে। রায়হান তার বাবাকে নিয়ে হাজির। তার বাবা প্রতিদিনের মত আজও বললো, ‘পেট ভরে খাও’। যাই বলুক এত ভোরে খাওয়া যায় নাকি? যদিও এখানে ব্রেকফাস্ট এর সময় ১০টা পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের বাস আজ ছেড়ে যাবে ৯টার সময়। এবং গতরাতে আসার সময় গাইড বলে দিয়েছে, ৯টা মানে ৯টা। যে দেরী করে আসবে তার জন্য গাড়ী অপেক্ষা করবে না। অতএব, আজ আমাদের মত বেশ কিছু পাবলিক ব্রেকফাস্টে এসে হাজির। সবাই মোটামুটি হেভি খাবার খাচ্ছে। দিনের প্রথমে ক্ষুধার উদ্রেক-ই হয় ১২টার পর থেকে আমার। যাই হোক অল্প কিছু খেলাম। এছাড়া একটা ব্যাগে আমরা বিভিন্ন টাইপের চিপস কিনে নিলাম।
আজ ‘ Interlaken’ এ যাবো। আগেই বলেছি, সুইজারল্যান্ডে আসবার মূল উদ্দেশ্যই মনে হয় আমার এখানে যাবার। প্রতিটি দেশ বা জায়গায় যাবার আগে আমি বেশ কিছুটা পড়াশুনা করে ঐ জায়গাটি সম্পর্কে কিছুটা জানবার চেষ্টা করি। তাতে করে ওখানে গেলে বেশ পরিচিত মনে হয়। যেন মনে হয় ‘ওহ তুমি?’ তোমাকে তো চিনি… ‘যদিও বহুদিন পর দেখা হলো’ প্রথম প্রেমের সাথে। উত্তেজনা, আনন্দ, কৌতুহল সব একসাথে ভীড় করে। ‘ইন্টারলেকেন’ সম্পর্কে শুধু মাত্র পড়েছি তাই-ই নয়। দেখেছিও। হিন্দী এবং প্রচুর ইংরেজী মুভির সুটিং এখানে হয়। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ এর ৪০% সুটিং এখানেই হয়েছিল।
আজ সেখানেই চলেছি। গতকাল আমাদের মোট ৪টা সিটি দেখিয়েছে। আজ নিয়ে যাচ্ছে ‘ইন্টারলেকেন’ এ এবং তারপরই যাত্রা ঐ ‘প্যানারোমিক’ ট্রেনেই ইউরোপের সর্বোচ্চ স্থানে। এরা দাবী করে এটাই সর্বোচ্চ। যদিও এটা ঠিক নয়। সর্বোচ্চ হলো হিমালয়। এটা সবাই জানে। তবু এরা কেন দাবী করে জানিনা। হতে পারে সবাই ইচ্ছা হলেও হিমালয়ে যেতে পারেনা। কিন্তু এখানে ইচ্ছা করলে যাওয়া সম্ভব। তাছাড়া হিমালয় যাওয়াটা সহজ নয়।
আমরা পৌনে নয়টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। পথে রায়হান কি যেন একটু খাবারও কিনলো। সবার ঝাড়া হাত পা। সবার হাতেই ক্যামেরা। কারো কারো হাতে জুম ক্যামেরা। সবাই মোটামুটি ৯টার মধ্যে হাজির। এবং আমাদের সুন্দর বাসটি একদম কাটায় কাটায় ৯টার সময় ছেড়ে দিল।
এডুইন আর বিখ্যাত স্টাইলে এবং অসম্ভব সুন্দর ভয়েসে প্রথমে ‘ইন্টারলেকেন’ এবং তারপর তাদের দাবী অনুযায়ী পৃথিবীর বা ইউরোপের সর্বোচ্চ উচ্চতাসম্পন্ন মাউন্টেন সম্পর্কে বলে চললো। আমি এতটাই উত্তেজিত যে, এডুইনের বাক্যগুলো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।
এবারে আমার ড্রাইভার সাহেব প্রথমে একটু ধীরে জুরিখ শহরের ভেতরে একট চক্কর লাগালো। তারপরই বাসের গতি বেড়ে চললো। যদিও আমার মন চাইছিল বাস যেন এভাবেই চলে, তাহলে জুরিখের সমগ্র সৌন্দর্য আমার হাতের মুঠোয় ধরা থাকবে। কিন্তু এডুইন বলছিল, আজ যাতায়তটাই সব। তাই সময়টা যাতায়তেই চলে যাবে। এর মধ্যেই সব দেখতে হবে, চোখে, মননে এবং ক্যামেরায়। তাছাড়া এটা পার্সোনাল ট্যুর নয়। তবে ঐ ভদ্র মহিলা যিনি ২৭ বার এসেছেন (সম্ভবত মহিলা অনেক ধনী) উনি বলছিলেন, একবার উনি একাকি ঘোরাঘুরি করছিলেন, মজা পাননি। তাই তারপর থেকে কনটাক্ট ট্যুরেই ঘোরাঘুরি করেন। তাছাড়া এতে সুবিধা হলো গোটা সুইজারল্যান্ডে যাবার অপশন আছে।
এডুইন বললো, আমরা এখন ‘ইন্টারলেকেন’ এ যাচ্ছি। আমাদের যেতে ২ ঘন্টা ৩২ মিনিটের মত লাগবে। জুরিখ টানেলের শহর। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর টানেল আছে এই সুইজারল্যান্ডে। যার ভেতর দিয়ে গাড়ী যাতায়ত করে। তখন হালকা আলো আঁধারি খেলা করে। এবং সাঁই সাঁই শব্দ হয়। প্রতিটি টানেলের মধ্যে অজশ্র আলোর ব্যবস্থা। গোটা ইউরোপে যে আধাঘন্টা পরপর ১ মিনিট বিদ্যুৎ বন্ধ হবার নিয়ম, সেটা অবশ্য টানেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এবং এক একটি টানেলের মাঝখানে বেড়ার মত হাফ পাচিল দেওয়া আছে, ওপাশে ২টা গাড়ী, এপাশে ২টা। এত বড় বড় টানেল আমি আর কোন দেশে দেখিনি। টানেল এর মধ্যে ঢুকলেই একই সাথে কেমন জানি ভয় এবং আনন্দ লাগে। তবে এর মধ্যে ছবি তুললে অন্ধকার হয়ে যায়। আমি একটি ভিডিও করেছিলাম। কিন্তু এত সাউন্ড এসেছে যে মাথা ফেটে যাবার মত অবস্থা।
আমাদের ‘ইন্টারলেকেন’ এ যেতে মোট ২ ঘন্টা ১৫ মিনিটের মত লাগছে। সুইজারল্যান্ডের ট্যুরে মজা হলো, যেখানে যাবেন সেটা নয়, বরং যখন যাবেন সেই পথটি। আস্তে আস্তে বাসটি শহর ছাড়িয়ে এবারে লোকালয় বিহিন এক অপরিসীম সৌন্দর্যের দিকে এগিযে যাচ্ছিল। আমি আনন্দে বারবার বলছি ‘সুবনাল্লাহে ওয়া বিহামদিহি’।
এই দুর্দান্ত সৌন্দর্য্যরে তুলনা কোন কিছুর সাথেই করা সম্ভব নয়। আমি এক একটা অদ্ভূত কিছু দেখি আর ছবি তুলি। তারপর একসময় ছবি তোলা বন্ধ করে দিলাম। কিছু কিছু জায়গায় কেবল ভিডিও করলাম। ড্রাইভার বেশ দ্রুত বাসটা চালাচ্ছিল। কারণ ওদের টাইমের ব্যাপার আছে।
একসময় ‘ইন্টারলেকেন’ এ চলে এলো বাসটি। আমি দূর থেকে একটি বিশালাকৃতির খোলা প্রান্তর দেখছিলাম। বাসটি আমাদের একটি রিসোর্টের সামনে দাড় করালো। এবং ‘ইন্টারলেকেন’ এ আমাদের ঘোরবার জন্য মাত্র ১ ঘন্টা টাইম দিল। হায় আল্লাহ, এই মাত্র ১ ঘন্টায় কি করবো? তার মধ্যে আবার ওরা বললো রিসোর্টের ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে। কারণ যখন ট্রেনে উঠা লাগবে আবার Wengen এ যাওয়া পর্যন্ত, আর ওয়াশরুমের সুব্যবস্থা নাই। অতএব, সবাই ফ্রেশ হওয়ার জন্য ভেতরে দৌড়ালো। তবে অল্প বয়সীরা সামনের দিকে এগুলো। আমিও ঐ দিকেই গেলাম। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’র মধ্যে যেমনটি দেখা গেল ঠিক তেমন-ই। খুব ছিমছাম। মনে হচ্ছে বিখ্যাত কোন চিত্র শিল্পী মনের রঙে একটি ছবি এঁকেছে। অপরূপ সেই ছবি। গোটা গ্রাম বা শহরটি ছিমছাম। চুপচাপ। কোন শব্দ নাই। কোন চঞ্চলতা নাই। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। আর উপরে এক আকাশ ভরা নীল। উহ! এত সুন্দর কেন? সবাই সুভেনিরের দোকানে দৌড়ালো। ওখানে সার সার দেওয়া সুভেনিরের দোকান। এখান থেকেই সবাই ‘ঘন্টা’ কেনে। গরুর গলার যে ঘন্টা পরানো হয়েছিল ‘দিলওয়ালে’ মুভিতে। সবাই দেখলাম র্যানডম কিনছে। যদিও দাম অনেক চড়া। ২/৩ ইঞ্চি একটি ঘন্টার দাম দেখলাম ১৬/১৭ ফ্রাঙ্ক। যদিও দেখতে সত্যিই সুন্দর। নীচে ঘন্টা উপরে সুন্দর পেপার দিয়ে মোড়ানো। রায়হান এবং মাহিন ওরা দুজন দুটো ঘন্টা কিনলো। (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।
gulshanararina@gmail.com