টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পিপলস রিপাবলিক অব চায়না – বাংলায় এই দেশটাকে আমরা গণচীন বা চীন বলে থাকি। অনেকে সিঙ্গাপুর, হংকং কিংবা তাইওয়ান থেকে চায়নাকে আলাদা করে বুঝানোর জন্য একে আবার ‘মেইনল্যান্ড চায়না’ বলেও অভিহিত করে থাকে। যাই হোক, এই চীন অথবা মেইনল্যান্ড চায়নার সাথে আমার এবং আমার স্ত্রীর একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। কারণ আমরা দু’জনেই ১৯৮৭ সালে চীন সরকারের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে পড়ার জন্য বেইজিং-এ যাই। তখন অবশ্য আমাদের বিয়ে হয়নি, সেই সময়ে আমরা দুজনে সহপাঠী ছিলাম। আমার বিষয় ছিল কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং আর আমার স্ত্রীর মেডিসিন। সেই বছর বাংলাদেশ থেকে আমরা মোট দশজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার জন্য চীনের রাজধানী বেইজিং-এ গিয়েছিলাম। বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট-এ চাইনিজ বা ম্যান্ডারিন ভাষা শিক্ষার এক বছর মেয়াদী কোর্স দিয়ে শুরু হয় আমাদের চীনের শিক্ষা জীবন। ভাষা শিক্ষার কোর্স শেষ হওয়ার পর আমি চলে যাই বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোষ্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস-এ কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার জন্য। চার বছর মেয়াদী এই কোর্স শেষ করে আমি ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে যাই। তারপর আবার ১৯৯৪ সালে একই ইউনিভার্সিটিতে ফেরত আসি কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পোষ্ট গ্রাজুয়েশন করতে। আমি অবশ্য ১৯৯৬ সালে এই কোর্স অসমাপ্ত রেখেই মালেয়শিয়ার কুয়ালালুমপুরে পাড়ি জমাই। এরপর আর আমার চীনে যাওয়া হয়নি, শুধু একবার সাংহাই এয়ারপোর্টে তিন ঘণ্টার ট্রানজিটে থেমেছিলাম ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। সেই হিসেবে আমি প্রথম বারে পাঁচ বছর, মাঝে দুই বছরের বিরতি দিয়ে দ্বিতীয়বারে দুই বছর অর্থাৎ দুই কিস্তিতে মোট সাত বছর চীনের রাজধানী বেইজিং-এ বাস করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমার চীন প্রবাস কালের প্রথম পর্বে, অর্থাৎ ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সালের মাঝে পৃথিবীতে বেশ কিছু যুগান্তকারী ঘটনা একের পর এক ঘটে যায়। সেই ঘটনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৮৯ সালের জুন মাসে বেইজিং-এর ‘থিয়েন আন মেন স্কোয়ার ম্যাসাকার’। ধরা যেতে পারে যে এই ঘটনা ছিল চীনের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। এখানে উল্লেখ্য যে, থিয়েন আন মেন ঘটনার জন্য সেই বছর চায়নাকে আমেরিকার ‘এমএফএন (মোস্ট ফেভারিট নেশন) ট্যারিফ’ স্ট্যাটাস রিনিউ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। একই বছরে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে ঘটে ‘বার্লিন প্রাচীর’-এর পতন। এই বার্লিন প্রাচীরের পতনের সাথে সাথে শেষ হয় ১৯৪৫ সালে শুরু হওয়া প্রায় চুয়াল্লিশ বছরের পুরানো ‘কোল্ড ওয়ার’ যা মূলত ছিল পশ্চিমা বিশ্বের সাথে কম্যুনিস্ট ব্লকের ঠান্ডা লড়াই। ১৯৯১ সালের জানুয়ারীতে আমেরিকা ইরাককে আক্রমণ করে যা ‘গালফ ওয়ার’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব কম্যুনিস্ট ব্লকের বদলে তাদের নতুন টার্গেট হিসেবে ইসলামী বিশ্বকে দাঁড় করায় এবং পরবর্তী দশকগুলিতে যা ‘ওয়ার অন টেরর’ নামে প্রচারিত হয়। তারপর সেই বছরের অগাস্ট মাসে রাশিয়ায় ‘গ্লাসনট’ এবং ‘পেরেস্ত্রয়েকা’-এর বুলি আওড়ে ক্ষমতায় আসা গর্বাচভ সরকারকে হটিয়ে আমেরিকার তাবেদার ইয়েলৎসিন ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মাধ্যমে ইউএসএসআর এবং রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টি উভয়েরই বিলুপ্তি ঘটে। বর্তমান কালে আমরা যে বিশ্ব পরিস্থিতির মাঝে বাস করছি তার পিছনে এই ঘটনাগুলির প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। কম্যুনিস্ট ব্লকের পুরোধা সোভিয়েত ইউনিইয়নের পতন ছিল চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির জন্য একটি উদ্বেগজনক ঘটনা। কারণ ইস্ট ইউরোপে তখন একের পর এক কম্যুনিস্ট দেশগুলি থেকে সমাজতন্ত্রকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হচ্ছিল। ইউরোপব্যাপী কম্যুনিজমের এই পতনের ডোমিনো এফেক্ট যাতে চীনকে এসে গ্রাস না করে সেটাই ছিল চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির চিন্তার বিষয়। তাই তারা এই ঘটনাগুলিকে গভীরভাবে অনুসরণ এবং সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে বিশেষ মনোযোগী হয়। সেই সময় চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা বিশ্বের এই টালমাটাল অবস্থার প্রেক্ষাপটে নিজেদেরকে সঠিকভাবে রিফর্ম করতে পেরেছে বলেই আজকে আমরা বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে এক শক্তিশালী চীনের আগমন প্রত্যক্ষ করছি। আমার সৌভাগ্য যে আজকের এই বদলে যাওয়া চীনের সেই বদলের শুরুটা বেইজিং-এ বসে অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। সামরিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিতে শক্তিশালী এক ‘নয়া চীন’-এর আবির্ভাব যে অবশ্যম্ভবী আমি তখনই সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। চীনের আজকের এই উত্থান যদিও অনেকের কাছে বিস্ময়কর এবং একই সাথে অনভিপ্রেতও বটে।
রোম যেমন একদিনে গড়ে উঠেনি, আজকের এই চীনও তেমনি রাতারাতি এমন শক্তিশালী হয়ে উঠেনি। এর পিছনে রয়েছে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতাদের যেমন প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব, তেমনি রয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অক্লান্ত অধ্যবসায়। আজকের চীনকে বুঝতে হলে কম্যুনিস্ট চীনের ইতিহাস জানাটা খুবই জরুরী। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি চীনের ন্যাশনালিস্ট সরকারকে সিভিল ওয়ারের মাধ্যমে পরাজিত করে তাইওয়ানে বিতাড়িত করে দেয়। এই বিজয়ের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর, যিনি চেয়ারম্যান মাও (চাইনিজ ভাষায় মাও টুসি) নামেই অধিক পরিচিত। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টির নিজস্ব বাহিনী রেড আর্মি ‘লং মার্চ’ নামক মিলিটারি অপারেশনের মাধ্যমে চীনের ন্যাশনালিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জয় লাভ করতে সমর্থ হয়। এই বিজয়ের ফলে চীনের নাম ‘রিপাবলিক অব চায়না’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’-তে পরিণত হয়। পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য চীনের ন্যাশনালিস্ট সরকারকেই সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখে। এমন এক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্য চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারস্থ হতে হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি চীনকে ঢেলে সাজিয়ে এক নয়া চীন গঠনের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সাহায্য নিশ্চিত করে। এই সময় চেয়ারম্যান মাও-এর একটি উক্তি ছিল ‘সু লিয়েন শির ওয়ামেন তি তা গ’, অর্থ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন হচ্ছে আমাদের বিগ ব্রাদার। এই উক্তিটি আমি যখন চীনে ছিলাম তখন আমার সহপাঠীদের মুখে উচ্চারিত হতে শুনেছি, অবশ্য ততদিনে চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন দেয়ার সূত্র ধরে ১৯৫০ সালে ‘কোরিয়ান যুদ্ধ’-এ চীন আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। একই সময়কালে ভিয়েতনাম যুদ্ধেও চীন আমেরিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। ১৯৯০ সালে, আমার চীন প্রবাসকালের তৃতীয় বছরে যখন আমি বেইজিং-এর অ্যাকসেন্টে ম্যান্ডারিন ভাষায় কথাবার্তা পুরোপুরি চালাতে পারি সেই সময়ে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে আলাপচারিতার সময় জানতে পারি যে সে এক সময় ভিয়েতনামে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সে আমাকে বেশ কনফিডেন্সের সাথে বলেছিল যে চীন আমেরিকাকে অতীতে দুইবার সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত করেছে, তাই ভবিষ্যতেও যদি যুদ্ধ লাগে তবে চীনই আবার জিতবে। সেই সময় থিয়েন আন মেন ম্যাসাকারের পর আমেরিকা চীনকে ‘এমএফএন (মোস্ট ফেভারিট নেশন) ট্যারিফ’ স্ট্যাটাস দিতে গড়িমসি করার কারণে দুই দেশের মধ্যে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
ক্ষমতায় এসেই চেয়ারম্যান মাও চীনের সমাজকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। চাষযোগ্য ভূমির মালিকানার পুনর্বিন্যাস, কলকারখানাগুলোকে পুনর্জীবিতকরণ এবং সমাজে মহিলাদের জন্য সমাধিকার প্রতিষ্ঠা করা ছিল তার লক্ষ্য। ভূমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টি ধনীদের কাছ থেকে ভূমির মালিকানা কেড়ে নিয়ে গরীব চাষিদের মাঝে বণ্টন করে দেয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া স্বাভাবিক কারণেই স্বতঃফূর্ত ভাবে ঘটেনি, বরং প্রচুর রক্তক্ষয়ী ঘটনার মাধ্যমে এই ভূমি পুনর্বণ্টন কার্য সম্পন্ন হয় এবং বাধ্য হয়েই চেয়ারম্যান মাও-কে বলতে হয় যে, এটা কোনভাবেই একটি ‘ডিনার পার্টি’-এর মতন সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। কলকারখানাগুলিকে উৎপাদনমুখী করার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখাপেক্ষী হন এবং তাদের পরামর্শে হাতে নেয়া হয় ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের কারণে চীনের তৃণমূল পর্যায়ে যদিও কলকারখানা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল, তবে এর খেসারত দিতে হয়েছিল কৃষির ফলনে। এই সময় প্রচুর চড়ুই পাখি নিধন করা হয় তারা নাকি খাদ্যশস্য খেয়ে ফেলে এই অভিযোগে। কিন্তু পাখীরা যে কীট পতঙ্গ বিনাশেও বিরাট ভূমিকা রাখে সেটা তখন আমলে নেয়া হয়নি। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপন্ন না হওয়াতে শুরু হয় দেশব্যাপী বিরাট দূর্ভিক্ষ। সেই দূর্ভিক্ষে মারা পড়ে হাজার হাজার মানুষ। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রচুর সংখ্যক চড়ুই পাখী আমদানী করে প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে বটে, তারপরও বেইজিং পরিণত হয় একটি পাখী বিহীন শহরে। বেইজিং-এ অবস্থানকালীন সময়ে প্রকৃতিতে তেমন কোন পাখী আমার চোখে পড়েনি, তবে বিকেল হলেই দেখতাম চাইনিজ বৃদ্ধের দল সাইকেলের পিছনে নীল রঙের মোটা কাপড় দিয়ে মোড়ানো পাখীর খাঁচা নিয়ে পার্কে জড়ো হচ্ছে। সেখানে তারা পাখী সহ খাঁচাকে কাপড়ের আবরণ মুক্ত করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিত। প্রকৃতির ছোঁয়া পেয়ে পাখীগুলি খাঁচার ভেতরই চঞ্চল হয়ে উঠত এবং সেই সাথে চারিদিক তখন পাখীর কলতানে মুখরিত হয়ে উঠত। সেই মনোরম পরিবেশে বৃদ্ধরা একত্রে বসে আড্ডা দিত কিংবা চাইনিজ দাবা নিয়ে মেতে থাকত।
১৯৫২ সালে চীনের বেইজিং শহরে অনুষ্ঠিত ‘এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন’-এ পাকিস্তান দলের সদস্য হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যোগ দেন। সম্মেলন শেষে প্রায় এক মাসব্যাপী তিনি এবং তার সফরসঙ্গীরা চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির কল্যাণে চীন সফর করার এক অনন্য সুযোগ পান যার অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নামক বইটিতে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি নয়াচীনের জীবনযাত্রার প্রকৃত চিত্রকে অনুধাবন করার জন্য প্রায়ই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছেন, দোভাষীর মাধ্যমে ট্রেনের টিকেট কালেক্টর থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের সাথে আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি সব সময়ই অনুভব করেছেন যে চীনের জনগণ অনেকটা তোতা পাখীর শেখানো বুলির মতন কম্যুনিস্ট পার্টির স্তুতি গেয়ে চলেছে। হয়তবা বেফাঁস কিছু বলে বিপদে পড়তে চায় না বলেই। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে চীনের দোকানগুলিতে কোন বিদেশী পণ্য পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলেন যে দেশপ্রেমের কারণে চীনারা বিদেশী পণ্য কিনতে আগ্রহী নয়। একবার দাড়ি কামানোর ব্লেড শেষ হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন পড়ে ব্লেড কেনার। কিন্তু সমস্ত দোকান চষেও কোথাও তিনি ব্লেড খুঁজে পেলেন না। কিছু কিছু দোকানে যদিও বা পেলেন তবে সেগুলো ছিল অনেক পুরাতন এবং জং ধরা। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে বর্তমানে চীনে ব্লেড তৈরির কারখানা নেই, অতীতে ব্লেড আসত বিদেশ থেকে। যেহেতু চীন নিজে ব্লেড তৈরি করছে না, তাই জনগণও ব্লেডের পরিবর্তে ক্ষুর দিয়েই ক্ষৌরকর্ম সেরে নিচ্ছে। চীন যখন ব্লেড তৈরি করতে সমর্থ হবে তখন জনগণও আবার ব্লেড দিয়ে দাড়ি কামাবে। চীনের মতন বৃহৎ একটি দেশের জনগণের ভেতর ত্যাগের এই মনোভাব জাগ্রত করা কোন সহজ কাজ নয়। কেবলমাত্র শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতাই পারেন এই অসাধ্য কার্য সম্পাদন করতে। চীনের সেই শক্তিশালী নেতাই হচ্ছেন চেয়ারম্যান মাও। আজকে বিশ্বের তাবৎ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ যে চীনে তৈরি হচ্ছে তার মূলে রয়েছে সেই সময়কার ত্যাগ এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে ‘মেইড ইন চায়না’ লোগো হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। নয়াচীনের যে পরিবর্তনটি বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করেছিল সেটা হচ্ছে নারী স্বাধীনতা। কম্যুনিস্ট চায়নাতে নারীদেরকে সমাজে সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠিত দেখে তিনি আপ্লুত হন। বিভিন্ন কল কারখানায় কিংবা বড় বড় কৃষি খামারে নারীদেরকে পুরুষদের পাশাপাশি সব ধরণের কাজ করতে দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। আমি যখন প্রথম চীনে যাই তখন মহিলাদেরকে বড় বড় বেন্ডি বাস চালাতে দেখে আমিও কিন্তু কম বিস্মিত হইনি। কম্যুনিস্ট সরকার সমাজ থেকে গনিকাবৃত্তিকে নির্মূল করতে সমর্থ হয়েছে জেনে বঙ্গবন্ধু জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন কীভাবে তা সম্ভব হয়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁকে জানান যে আইন করে নয় বরং সমস্যার মূলে গিয়ে তারা সমাধান করেছেন বলেই মহিলাদেরকে এই অসম্মানজনক পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তারপরও যে দুই একজন এই পেশাতে নিয়োজিত ছিল তাদেরকে আইনের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়েছে। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য সদ্য জন্ম নেয়া পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার জনগণের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের একটি মূল্যবান দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’-এর ব্যর্থতার জন্য চেয়ারম্যান মাও দায়ী করলেন ক্যাপিটালিজমকে যা কিনা সমাজের আনাচে কানাচে এখনও রয়ে গেছে। ক্যাপিটালিজমের শিকড় নির্মূল করার জন্য তিনি সমাজ থেকে চারটি এলিমেন্ট দূর করার নির্দেশ দিলেন। এগুলো হচ্ছে, পুরাতন প্রথা, পুরাতন সংস্কৃতি, পুরাতন অভ্যেস এবং পুরাতন চিন্তাধারা – একত্রে এই গুলোকে ‘ফোর ওল্ডস’ বলে উল্লেখ করা হত। আর এই ফোর ওল্ডস দূর করার জন্য তিনি টিন এজ বালক বালিকাদের সমন্বয়ে ‘রেড গার্ডস’ নামের একটি পেটোয়া বাহিনী তৈরি করেন। তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় চেয়ারম্যান মাও-এর বাণীসমূহের সংকলন ‘রেড বুক’। এই ‘রেড বুক’ তখন অনেকটা ধর্মীয় পুস্তকের ন্যায় পূজনীয় হয়ে উঠে। এছাড়া চীনের সমস্ত ইউনিভার্সিটি সহ বড় বড় অফিস আদালতের প্রাঙ্গনে স্থাপন করা হয় চেয়ারম্যান মাও-এর ‘লার্জার দেন লাইফ’ সাইজের মূর্তি, যা তাকে অনেকটা ঈশ্বর সমতূল্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। এই ভাবেই শুরু হয় বহুল আলোচিত ‘কালচারাল রেভ্যুলেশন’ বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব যাকে চাইনিজে বলা হয় ‘ওয়েন হুয়া তা গ মিন’। এই বিপ্লবের ফলে সমাজে একটি বড় ধরণের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় যার মূল কারণ ছিল ‘রেড গার্ড’-দের অপরিসীম ক্ষমতা। এক সময় এই ‘রেড গার্ড’-দের ভিতর একটা বেপরোয়া ভাব চলে আসে এবং পার্টির হাই কমান্ডও তখন তাদেরকে আর বাগে আনতে পারেনি। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে চীনের যে সমস্ত বড় আকারের ক্ষতিগুলি হয়েছিল তার ভিতর অন্যতম হচ্ছে অনেক ধরণের ভ্যালুয়েবল কালচারাল হেরিটেজের বিলুপ্তি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ললিতকলা চর্চায় পিছিয়ে পড়া। রেড গার্ডের সদস্যরা সবচেয়ে বেশী খড়গহস্ত হয়েছিল ইসলাম সহ বিভিন্ন ধর্মীয় বিধান পালনের ক্ষেত্রে। কারণ চেয়ারম্যান মাও-এর বেশ কিছু ধর্ম বিরোধী বাণী ছিল যার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকরটি ছিল, ধর্ম হচ্ছে বিষবৎ পরিত্যাজ্য। এই কালচারাল রেভ্যুলেশনের কারণে চাইনিজ মুসলিমদের ভিতর ধর্মীয় শিক্ষা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, ফলে এক জেনারেশন পরেই চাইনিজ মুসলিমদের একটি বড় অংশ অন্যান্য চাইনিজ এথেনিক গ্রুপের সাথে মিশে যায়। ১৯৯২ সালে হংকং-এর এক কফি শপে মেইনল্যান্ড চাইনিজ এক চিত্রশিল্পীর সাথে আলাপচারিতার সময় সে আমার মুসলিম পরিচয় জানতে পেয়ে আমাকে জানালো যে তারও একটি মুসলিম নাম আছে। বাবা মা’র দেয়া সেই নামটা ছাড়া ইসলাম সম্পর্কে তার আর কোন জ্ঞান ছিল না। এভাবে কালচারাল রেভ্যুলেশনের কারণে প্রচুর সংখ্যক চাইনিজ মুসলিম আজ ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত। এই সময় চীনের ছিং ডাইনেস্টির শেষ সম্রাট পুঈ-কে ‘প্রতি বিপ্লবী’ হিসেবে চিহ্নিত করে রেড গার্ডদের সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা ট্রৌ এনলাই-এর সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে পুঈ-কে যদিও জন সম্মুখে হিউমিলেট করা হয়নি তবে তার রচিত ‘ফ্রম এমপেরর টু সিটিজেন’ বইয়ের সমস্ত কপি প্রকাশ্যে আগুনে পোড়ানো হয়। রেড গার্ডের সদস্যরা পুঈ-কে সংশোধন শিবিরে প্রেরণ করে এবং পরবর্তীতে তাকে একজন মালি হিসেবে কাজে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৭ সালে পুঈ একষট্টি বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কালচারাল রেভ্যুলেশনের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য চীনকে পরবর্তীতে বেশ চড়া মাশুল দিতে হয়েছে। যদিও চেয়ারম্যান মাও দাবী করেন যে কালচারাল রেভ্যুলেশনের কারণে চীনে নারীদের সমাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যদিও অনেকেই এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন।
এই কালচারাল রেভ্যুলেশনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৭৬ সালে চেয়ারম্যান মাও-এর মৃত্যুর মাঝ দিয়ে। তবে তার মৃত্যুর আগে আগে অর্থাৎ কালচারাল রেভ্যুলেশনের শেষভাগে উত্থান ঘটে কুখ্যাত ‘গ্যাং অব ফোর’-এর যারা কিনা প্রচ্ছন্নে বসে ‘কালচারাল রেভ্যুলেশন’-এর কলকাঠি নাড়াচ্ছিল। এই গ্যাং অব ফোর-এর নিয়ন্ত্রণ ছিল চেয়ারম্যান মাও-এর অভিনেত্রী স্ত্রী চিয়াং ছিং-এর হাতে। চেয়ারম্যান মাও-এর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী চিয়াং ছিং কম্যুনিস্ট পার্টির ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালের ৬ই অক্টোবরে ‘ক্যু-ডা-তা’-এর অভিযোগে ‘গ্যাং অব ফোর’-এর সাথে তাকেও গ্রেফতার করা হয় এবং বেইজিং-এর ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন ‘ছিন চেং’-এ অন্তরীণ করে রাখা হয়। ‘গ্যাং অব ফোর’-এর এই পতনের সংবাদে সেই সময় চীনের জনগণের মাঝে স্বস্তির পরিবেশ ফিরে আসে। ১৯৮০ সালে প্রকাশ্যে চিয়াং ছিং সহ ‘গ্যাং অব ফোর’-এর বিচার শুরু হয়। বিচারে ‘গ্যাং অব ফোর’-এর সদস্যরা নিজেদের দোষ স্বীকার করলেও চিয়াং ছিং করেন নি। তিনি কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে বলেন যে, তিনি যা কিছু করেছেন সবই তার প্রয়াত স্বামী মাও সেতুং-এর নির্দেশেই করেছেন। তিনি তার সরকারি আইনজীবিকে বরখাস্ত করে নিজেই আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন।
নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তিনি এক সময় আদালতে বলেছিলেন যে, তিনি ছিলেন চেয়ারম্যান মাও-এর পোষা কুকুর, মাও তাকে যাকে কামড়াতে বলতেন তিনি তাকেই কামড় দিতেন। যাই হোক, বিচারের রায়ে তাকে প্রথমে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও পরে তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড করা হয়। তিনি কারান্তরীণ থাকাকালীন বেশ কয়েকবার মাও-এর সংরক্ষিত দেহকে দেখার আবেদন করেন কিন্তু প্রতিবারই কর্তৃপক্ষ তার আবেদন নাকচ করে দেয়। একসময় তার গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে, তখন তাকে মানবিক কারণে ১৯৯১ সালে মুক্তি দেয়া হয়। সেই সময়কালটা ছিল ‘থিয়েন আন মেন ম্যাসাকার’ পরবর্তী সময় যখন চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির লীডারশীপ নিয়ে বেশ টানাপোড়ন চলছিলো। মুক্তির কিছুদিন পরেই তিনি হাসপাতালের বাথরুমে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল সাতাত্তর বছর। এইভাবেই রেড চায়নার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শেষ দৃশ্য মঞ্চায়িত হয় এবং যবনিকাপাত ঘটে একটি কালো অধ্যায়ের। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো