কোভিড-১৯ এখনও অন্টারিও’র স্বল্প আয়ের এলাকায় কঠিন আঘাত হানছে
চিকিৎসকরা উদ্বিগ্ন যে রোগটি দরিদ্র, জাতিগত বাসিন্দাদের এলাকাগুলিতে ঘনীভূত হতেই থাকবে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক॥ ২০ মার্চ, ২০২২ : অন্টারিওর নিম্ন আয়ের এলাকাগুলি মহামারির প্রতিটি ঢেউয়ে কোভিড-১৯ এর আঘাত সহ্য করেছে। প্রদেশের সর্বশেষ তথ্যে এ কথা বলা হয়েছে। গত ১৭ মার্চ প্রকাশিত এক নতুন নথিতে অন্টারিওর কোভিড-১৯ বিজ্ঞান উপদেষ্টা পরিষদ বলছে, এমনকি অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে সৃষ্ট পঞ্চম তরঙ্গের ক্ষেত্রেও এই অনুসন্ধান স্পষ্টই দৃশ্যমান ছিল।
পঞ্চম তরঙ্গে নিম্ন আয়ের মহল্লাগুলিতে মৃত্যুর হার ছিল সর্বোচ্চ আয়ের এলাকাগুলির চেয়ে দ্ইু থেকে আড়াই গুণ বেশি, যা আগের তরঙ্গগুলির মৃত্যুহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন মুরিয়েল ড্রেইসমা।
উপাত্তে দেখা যায়, অন্টারিওর নিম্ন আয়ের মহল্লাগুলো মহামারির পাঁচটি তরঙ্গেই সর্বোচ্চ মৃত্যুহারের রেকর্ড করেছে। এসব তথ্য দিয়ে ডাক্তাররা বলছেন, তারা উদ্বিগ্ন একারণে যে, সরকারের তিনটি স্তরের প্রতিটিই সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হলে অন্টারিওর দরিদ্র ও জাতিগত জনগোষ্ঠীর এলাকাগুলোতে কোভিড-১৯ অব্যাহত এবং সামঞ্জস্যহীনভাবে জনগণের ক্ষতি করতে থাকবে।
অন্টারিওর কোভিড-১৯ মডেলিং কনসেনশাস পরিষদের সদস্য লরেন সিপ্রিয়ানো বলেন, দুই বছরেরও বেশি আগে মহামারী যখন প্রথম অন্টারিওতে আঘাত হানে তখন থেকেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সিপ্রিয়ানো ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির শালিচ স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড ডেন্ট্রিস্টি এবং আইভে বিজনেস স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক।
তিনি বলেন, “এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে অনেকেই কোভিডের সেই প্রাথমিক দিনগুলি থেকে কথা বলছেন।”
সিপ্রিয়ানো বলেন, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একটি বড় মহামারীর আঘাত থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় অন্টারিও তা এখনও শিখতে পারেনি। তিনি বলেন, অসাম্য দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই প্রবণতাগুলো অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়।
কোভিড-১৯ এর প্রভাব কমাতে পদক্ষেপ দরকার
সিপ্রিয়ানো বলেন, কর্মকর্তারা কর্মস্থল ও বিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর ভেন্টিলেশন সুবিধা নিশ্চিত করে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার উচ্চতর মান ধরে রাখার মাধ্যমে এবং টিকাদানের প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রান্তিক ও জাতিগোষ্ঠীর কমিউনিটিতে সরবরাহ দিয়ে নিম্ন আয়ের মহল্লাগুলোতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব কমাতে পারেন।
সিপ্রিয়ানোর মতে, নিম্ন আয়ের মানুষদের কর্মস্থলে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেশি এবং কোভিড-১৯ এর টিকার তৃতীয় ডোজও তারা পেয়েছেন কম। প্রায়শই তাদের বসবাস হলো এপার্টমেন্টে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে যেখানে পরিবারের সদস্য সংখ্যাও বেশী।
উচ্চতর আয়ের লোকেদের বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ যেমন বেশি তেমনই অফিসেও তারা প্রশস্ত স্থানে, বায়ু চলাচলের যথেষ্ট সুবিধা নিয়ে কাজ করতে পারেন। বিপরীতে নিম্ন আয়ের মানুষদের বেশিরভাগই আবশ্যকীয় কাজে সম্মুখ সারির কর্মী যাদেরকে কর্মস্থলে প্রচুর মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় অথবা তাদের এমন পরিবেশে কাজ করার সম্ভাবনা বেশি যেখানে বায়ু চলাচলের সুবিধা তেমন নেই।
একইভাবে নিম্ন আয়ের লোকদের একটির বেশি কাজে নিয়োজিত থাকার সম্ভাবনাও বেশি। তাদেরকে কাজে যাওয়া আসার জন্য গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয় এবং কাজের মধ্যেই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবতাও তাদের ক্ষেত্রে বেশি। অসুস্থতাজনিত ছুটিও তাদের কমই জোটে কিংবা চাকরি হারানোর ঝুঁকি ছাড়াই একদিন অসুস্থতার ছুটি নেবার মত পরিস্থিতিও তাদের কম।
সিপ্রিয়ানো বলেন, নিম্ন আয়ের কমিউনিটিগুলোই কোভিড-১৯ এ প্রথম সংক্রমিত এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগের পদক্ষেপে প্রভাবিত হয়। নিম্ন আয়ের এলাকার লোকেরাই সবচেয়ে বেশি চাকরি হারিয়েছেন অথবা কোনওরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছাড়াই তাদের চাকরি পাল্টে গেছে। আর তাদেরই অনেক বেশি সংখ্যায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অস্থায়ী কাজে যোগ দিতে হয়েছে যার ফলে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা বেড়েছে।
বিজ্ঞান পরিষদ সারাক্ষণ ভালো মানের মাস্ক ব্যবহার, অসুস্থ হলে ঘরে অবস্থান করা এবং টিকার সব ডোজ গ্রহণের সুপারিশ করেছে।
সিপ্রিয়ানো বলেন, “প্রত্যেকেই মাস্ক পরতে পারে। কারণ আমাদের বিভিন্ন সমাজে এখনও প্রচুর কোভিড ভাইরাস রয়ে গেছে।
মৃত্যুহারের পার্থক্য ‘বিস্ময়কর,’ বলছেন ডাক্তাররা
ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য নেটওয়ার্কের সোশ্যাল মেডিসিন বিভাগের নির্বাহী পরিচালক এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার চিকিৎসক ডা. এন্ড্রু বুজারি বলেন, স্বল্প আয়ের মহল্লায় কোভিড-১৯ এর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাবের বিষয়টি পুরো মহামারিকালেই ছিল আলোচিত বিষয়।
তিনি আরও বলেন, “নিম্ন ও উচ্চ আয়ের এলাকায় মৃত্যুহারের পার্থক্য “বিস্ময়কর।”
তিনি বলেন, “সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় স্বীকার করতেই হবে তার একটি হলো, পুরো মহামারীকালজুড়েই মৃত্যুহারের এই পার্থক্য বলবৎ ছিল। এটি দুর্বল ব্যক্তিগত পছন্দ বা ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়। এটি ছিল প্রকৃতই সেই ঝুঁকি সম্পর্কিত যা জনগণের ওপর চেপে বসেছিল।”
ডা. বুজারি বলেন, বৃহত্তর টরন্টো এরিয়ার স্বল্প আয়ের এলাকার মধ্যে পড়ে ব্রাম্পটন শহর, স্কারবরো অঞ্চলের অংশবিশেষ এবং টরন্টোর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। এসব এলাকার মহল্লাগুলোতে অশ্বেতাঙ্গ জনগণের বসবাস বেশি, রয়েছে অধিকতর অর্থনৈতিক বঞ্চনা, বেশি সংখ্যক অভিবাসী, উদ্বাস্তু ও নবাগত এবং আবাসনের ঘনত্ব।
এখন কোভিড-১৯ এর সঙ্গে বসবাসের শিক্ষা নেবার কথা বলা হচ্ছে। আর ডা. বুজারি বলেন, এ কথার অর্থ হলো সামাজিক নিরাপত্তা জাল জোরদারের প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়া এবং দায়িত্বটা ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া। যেসব মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন তারা ঘরে অবস্থান করার মত সুবিধাপ্রাপ্ত নন। তারা আবশ্যকীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত বলে পুরো মহামারীকালে আবাসনে থেকে বা আবাসন ছাড়াই সামনের কাতারে থেকে কাজ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, প্রাপ্ত তথ্য জানার পরও, সমাজ কোভিড-১৯ এর সঙ্গে বসবাস করা শিখতে পারে এমন ধারণা তুলে ধরার অর্থ হলো, বিদ্যমান অবস্থা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু আসলে তা নয়। তিনি যোগ করেন, এর অর্থ হলো, কোভিড-১৯ এবং দীর্ঘমেয়াদী কোভিড স্বল্প আয়ের এলাকাগুলোতে কেন্দ্রীভূত থাকবে।
তিনি বলেন, “যদি দেখা যায়, নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে যেসব বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেগুলি নেওয়া হচ্ছে না, তাহলে আমাদের যা বলার সেটা হলো, আমরা মেনে নিচ্ছি, এবং দরিদ্র ও জাতিগোষ্ঠীর মহল্লাগুলোতে কোভিডের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব মেনে নিতেই থাকবো।
বুজারি বলেন, বাস্তব পদক্ষেপ বলতে তিনি বোঝান ভেন্টিলেশন ও বায়ু পরিশ্রাবণে বিনিয়োগ, অসুস্থতায় সবেতন ছুটি, টিকা ও উচ্চমানের মাস্ক পাওয়ার সুযোগ এবং সহায়ক আবাসনে থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা।
তিনি বলেন, “আমরা যদি এসব অত্যন্ত গুরুতর স্বাস্থ্যগত অসাম্যের নিরসন না করি তাহলে, বিপুল সংখ্যক মানুষ পেছনে পড়ে থাকবেন এবং তাদেরকে মহামারী পরিস্থিতির চেয়েও অনেক বেশি খারাপ স্বাস্থ্যগত অবস্থার মুখে ঠেলে দেয়া হবে।
টরন্টোর ইউনিটি হেলথ বিভাগের সেন্ট মাইকেলস হাসপাতালের পারিবারিক চিকিৎসক ডা. দানিয়াল রাজা বলেন, যথেষ্ট সংখ্যক সবেতন অসুস্থতাজনিত ছুটি মঞ্জুর, খণ্ডকালীন চাকরির পরিবর্তে পূর্ণকালীন স্থায়ী চাকরি দেয়া এবং উদ্বাস্তুদের পারমানেন্ট রেসিডেন্সির মর্যাদা দেয়া হলেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।
তিনি বলেন, ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতি, উভয় দিক থেকেই সমস্যা সমাধানের মত নীতিগত উপকরণ আমাদের আছে।’
ডা. রাজা বলেন, দুঃস্থ মানুষদের কোভিড-১৯ থেকে রক্ষার জন্য যেসব সামাজিক, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনেতিক নীতি প্রয়োজন সেগুলি সাধারণভাবে রোগ-ব্যাধি ও ভগ্নস্বাস্থ্য থেকে লোকেদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নীতির অনুরূপ। তিনি বলেন, “আমাদের এসব নীতিমালা বাস্তবায়নের দিকে অব্যাহত মনোযোগ দিতে হবে।”