টরেটক্কা টরন্টো
কানাডাতে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদের পুনরুত্থান -২
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২০২১ সালে অন্তর্বতীকালীন ফেডারেল নির্বাচনের ডাক দেয়ার কারণে লিবারেল পার্টিকে বেশ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাত্র দুই বছরের মাথায় এবং করোনাকালীন সময়ে কী উদ্দেশ্য এই অন্তর্বতীকালীন নির্বাচন তা অনেকের কাছেই বোধগম্য হয়নি। বিশেষ করে যখন নানা কারণে লিবারেলের জনপ্রিয়তা প্রায় তলানীতে এসে ঠেকেছে। প্যান্ডেমিকের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সারভাইভ করার জন্য লিবারেল সরকার বিভিন্ন রকম অর্থ সাহায্যের স্কীম চালু করে। এই স্কীমগুলোর অধীনে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্থ কানাডিয়ান নাগরিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে বিতরণ করা হয়। এই অর্থ বরাদ্দ নিয়ে নানা রকম অভিযোগ উঠে যার কারণে সরকার তথা লিবারেল পার্টির সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এর মধ্যে ‘উই চ্যারিটি’-এর ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেকটা কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতন ‘উই চ্যারিটি’-এর অর্থ কেলেঙ্কারিতে ট্রুডো পরিবারের নামও উঠে আসে। সেই কেলেঙ্কারির রেশ কিছুটা স্তিমিত হতে না হতেই সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ট্রুডো হঠাৎ করেই অন্তর্বতীকালীন নির্বাচনের ডাক দেন। কারণ হিসেবে তিনি অবশ্য উল্লেখ করেন যে নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করাই হচ্ছে তার লক্ষ্য। কেন তিনি ধারণা করছেন যে নির্বাচনে তার দল আবার সংখ্যা গরিষ্ঠতা ফিরে পাবে সেটার অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই ১১ই অগাস্টের ‘গ্লোব এন্ড মেইল’-এ অভিজ্ঞ লিবারেল সদস্য পিটার ডোনোলো ‘ভ্যাকসিন পাসপোর্ট নীতি ফেডারেল নির্বাচনে ট্রুডোর জয় এনে দিতে পারে’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের সাথে যোগসূত্র খুঁজে পান। কারণ এই আর্টিকেল প্রকাশের ঠিক তার চার দিন পর অর্থাৎ ১৫ই অগাস্ট ট্রুডো অন্তর্বতীকালীন নির্বাচনের ডাক দেন। তড়িঘড়ি করে ডাক দেয়া এই নির্বাচনে লিবারেল ‘ভ্যাকসিন পাসপোর্ট’-কে যে একটি ট্রাম্প-কার্ড হিসেবে ব্যবহার করবে সেটা সহজেই বোঝা যাচ্ছিল। অথচ মাত্র কিছুদিন আগে মে মাসে ইউ টিউবার ব্র্যানডন গোমেজ-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রুডো উল্লেখ করেন যে, কানাডাতে ‘ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট’ নীতি নেয়া হবে না বরং সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে উৎসাহিত করা হবে। স্বভাবতই তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় এন্টি-ভ্যাক্স গ্রুপ যে সরব থাকবে সেটা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছিল। আর সেই অনুমানকে সত্য প্রমাণ করে অন্তর্বতীকালীন নির্বাচনী প্রচারণার সময় লন্ডন অন্টারিও-তে একদল এন্টি-ভ্যাক্স ট্রুডোকে লক্ষ্য করে ‘গ্রাভেল’ বা ‘পাথর কনা’ ছুঁড়ে মারে যা কিনা সরাসরি ট্রুডোকে আঘাত করে। এই ঘটনারও কিছু দিন আগে অন্টারিও-এর বোল্টন শহরে এন্টি-ভ্যাক্স গ্রুপের সদস্যেরা ট্রুডোকে লক্ষ্য করে অশ্লীল লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে এবং তাকে ভারবালি অ্যাবিউজ অর্থাৎ গালাগালি করে। ফলশ্রুতিতে জনগণের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে লিবারেল দল বোল্টন শহরে তাদের পুর্ব নির্ধারিত নির্বাচনী র্যালি বাতিল করে দেয়। কিন্তু লিবারেল প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা এন্টি-ভ্যাক্সদের সাথে আলোচনাতে বসবে। কানাডার রাজনীতিতে সচারচর এই ধরণের হিংসাত্মক ঘটনা দেখা না গেলেও অতীতে কিন্তু ট্রুডোর বাবা পিয়ারে ট্রুডোকে ১৯৬৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় যখন কুইবেকের বিচ্ছিন্নবাদীরা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল তখন কিন্তু তিনি তার নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াননি।
২০২১ সালের নির্বাচনে অবশ্য ২০১৯ সালের ফলাফলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, মাঝখান থেকে জনগণের দেয়া ছয় শত দশ মিলিয়ন ট্যাক্স ডলারের শ্রাদ্ধ হয়েছে শুধু। কিন্তু তারচেয়েও বেশী ক্ষতি হয়েছে নির্বাচনের সময় দেয়া অঙ্গীকারমত এন্টি-ভ্যাক্সদের সাথে আলোচনার টেবিলে না বসে উল্টো ‘ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট’ নীতির ঘোষণা দিয়ে। ২০২২ সালের ১৫ই জানুয়ারী সরকার ঘোষণা দেয় যে কানাডা-আমেরিকার ক্রস-বর্ডার ট্রাক চালকদের পুরোপুরি ভ্যাকসিনেটেট হতে হবে নতুবা তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে দুই সপ্তাহের জন্য কোয়ারানটিনে থাকতে হবে। সরকারের এই ‘ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট’ নীতি বাতিলের দাবীতে একদল ট্রাক চালক অটোয়াস্থ পার্লামেন্টের সামনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান ধর্মঘটের হুমকি দেয়। কিন্তু ট্রুডো সেটাকে ‘স্মল ফ্রিঞ্জ’ বা নগণ্য একটি দলের অযৌক্তিক দাবী বলে সমস্যাটিকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। তিনি যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছিলেন যে, সিংহভাগ ট্রাক ড্রাইভার যারা কানাডা-আমেরিকার বর্ডার দিয়ে মাল পরিবহন করে থাকে তারা ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছে। ফলে নগণ্য এক দল লোকের কারণে ‘ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট’ বাতিলের প্রশ্নই আসে না। ট্রাক চালকদের সেই স্মল ফ্রিঞ্জ ক্রমেই সংঘবদ্ধ হয়ে ‘ফ্রিডম কনভয়’ নাম দিয়ে পার্লামেন্টের হিলের সামনে র্যালি করার জন্য প্রথমে ভ্যানকুভারে জমায়েত হয়। ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর অর্গানাইজাররা তাদের দাবী-দাওয়া এবং র্যালী চলাকালীন প্রটেস্টারদের কোড অব কন্ডাক্ট-এর বিশদ বিবরণ সহ একটি ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্টান্ডিং’ প্রকাশ করে। তারপর তারা তাদের পরিবার পরিজনসহ জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে অটোয়ার অভিমুখে রওনা দেয়। তাদের যাত্রাপথে আরও অনেকেই তাদের সাথে এই কনভয়ে যোগ দেয়। এই সময় ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর সাথে যুক্ত হয় বিভিন্ন গ্রুপের লোকেরা যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব এজেন্ডা এবং লীডারশীপ ছিল। এই লীডারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আফগান ভেটারেন জেরেমি ম্যাককেঞ্জি। ২০২১ সালের এপ্রিলে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী ‘ডায়াগনাল’ দলের ডি-ফ্যাক্টো নেতা জেরেমি তার অনুসারীদেরকে লাইফস্ট্রীমে বলেছিল, ‘চল যাই পার্লামেন্ট হিল পুড়িয়ে দিয়ে আসি’। এরপর পুলিশ তাকে অস্ত্র মামলায় ২০২২ সালের জানুয়ারীতে গ্রেফতার করলেও সে ছাড়া পেয়েই ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর সাথে যোগ দেয়। এই যোগ দেয়ার কারণ হিসেবে জেরিমি উল্লেখ করে যে, “আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েই আফগানিস্থানের যুদ্ধে গিয়েছিলাম, অথচ সেই যুদ্ধের উদ্দেশ্যের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। আজ আমি অটোয়াতে এসেছি যার উদ্দেশ্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত।” এ রকম আরেক জন লীডার হচ্ছে প্যাট্রিক কিং, যে কিনা ইতিপূর্বে তার একটি ভিডিওবার্তাতে উল্লেখ করেছিল যে, কোভিড ভ্যাকসিনের মাধ্যমে অ্যাংলো-স্যাক্সন রেসের ডিপপুলেশন করাই হচ্ছে কানাডিয়ান সরকারের উদ্দেশ্য। তার সেই বার্তা ছিল সুস্পষ্টভাবে কনসপিরাসি থিওরীর প্রপাগান্ডা। ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর প্রটেস্টাররা মূলত সবাই সাদা ওল্ড স্টক কানাডিয়ান। কিন্তু তাদের মাঝে মুষ্টিমেয় কিছু নন-হোয়াইট কানাডিয়ানকেও দেখা গিয়েছে। এ রকম একজন হচ্ছে গুরটেক সিং। সে তার সন্তানদেরকে ভ্যাকসিন দেয়ার পক্ষপাতী নয় এবং সে মনে করে কোনটি তার সন্তানদের জন্য মঙ্গলজনক সেটা সরকারের চাইতে তার ভালো জানা আছে। সেই কারণে গুরটেক সিং এসে যোগ দিয়েছে এই ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর অটোয়া অবরোধে। এভাবেই খুব তাড়াতাড়ি ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর ‘ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট’ বাতিলের দাবীর পাশাপাশি সরকারের পতনের দাবীও এসে যোগ হয়। ফলে ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর অর্গানাইজাররা তাদের ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্টান্ডিং’-টি তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলে। এখানে উল্লেখ্য যে, গভর্নর জেনারেল মেরি সাইমন একটি প্রেস নোটে জানিয়ে দেন যে তার অফিসে ই-মেইল করে কিংবা রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাবী জানিয়ে ফেডারেল গভর্মেন্টকে ডিসলভ করা যাবে না।
অটোয়ামুখী হাইওয়েতে ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর বিশাল ট্রাকের বহর দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা বেশ আটঘাট বেঁধেই রওনা দিয়েছে। পথে কোথাও বাধা না পেয়ে অর্থাৎ অটোয়াতে ‘ফ্রি এন্ট্রি’ পেয়ে ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর ট্রাক চালকেরা একে একে জমায়েত হতে শুরু করে পার্লামেন্ট হিলের সামনে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তখন তাদের সাথে আলোচনার টেবিলে না বসে উল্টো তার সরকারি বাসভবন ছেড়ে নিরাপত্তার অজুহাতে অজ্ঞাতবাসে চলে যান। এই সময় কনজারভেটিভ পার্টির বেশ কিছু প্রথম সারির নেতা প্রকাশ্যেই ট্রাক চালকদের দাবী দাওয়ার প্রতি সমর্থন জানান। পার্লামেন্ট হিলের সামনে অবস্থান নেয়ার শুরুতেই ট্রাক চালকেরা এবং তাদের সাথে যোগ দেয়া প্রটেস্টাররা তাদের প্রতিশ্রুত ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ ভেঙে ফেলে এবং মুহুর্মুহ হর্ন বাজিয়ে এলাকাবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে করে তুলে অসহনীয়। ফেস মাস্ক পরিহিত পথচারীদের বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা শুরু করে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট কিংবা রোড সাইড শপিং স্টোরগুলো বাধ্য হয় তাদের ব্যবসা বন্ধ রাখতে। এমন কী রিডু শপিং সেন্টার পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় কারণ প্রটেস্টাররা ফেস মাস্ক ছাড়াই সেখানে ভীড় করতে থাকে। সাধারণ মানুষেরা তাদের কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধাগ্রস্থ হয়। অটোয়ার সিভিল অর্ডার পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। এই সময় যখন প্রটেস্টারদের হাতে কানাডার পতাকার পাশাপাশি আমেরিকার ‘কনফেডারেট ফ্লাগ’ এবং ‘সোয়াস্টিকা’ দেখা যায়, তখন বোঝা যায় যে এই অটোয়া অবরোধের শিকড় উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী দলগুলোর আদর্শবাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ট্রাকের সামনে টাঙ্গানো একটি ব্যানারে লিখা ছিল ‘টেক দ্য রেড পিল এন্ড রোল অন’। ফার-রাইট গ্রুপের সদস্যরা এই ‘রেড পিল’-কে তাদের নিজস্ব কোড হিসেবে ব্যবহার করে থাকে যা সাড়া জাগানো হলিউড সায়েন্স ফিকশন মুভি ‘ম্যাট্রিক্স’ থেকে নেয়া। সেই মুভিতে দেখানো হয় যে নায়ক একটি ‘রেড পিল’ খাওয়ার পর বাস্তবতায় ফিরে আসে। ফার রাইটরা ‘রেড পিল’ কোড ব্যবহার করে তাদের অনুসারীদেরকে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠার সংকেত দেয়। ফার রাইটের সদস্যদের ছাড়াও কিউএ’নন (ছঅহড়হ) গ্রুপের সদস্যদের দেখা যায় এই ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর সাথে। এই কিউএ’নন গ্রুপের ‘কুইন অব কানাডা’ খ্যাত রোমানা ডিডুলো পার্লামেন্ট ভবনের সামনে ‘ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট’-এর প্রতিবাদ স্বরূপ একটি কানাডিয়ান পতাকাকে পুড়িয়ে দিয়ে তাদের সরব উপস্থিতির কথা সবাইকে জানিয়ে দেয়। উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদীদের অস্তিত্ব যখন প্রকট হয়ে দেখা যাচ্ছিল তখন সিটি কাউন্সিলর ম্যাথিউ লুলফ নিশ্চিত করেন যে, ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর সাথে ফার-রাইট গ্রুপের অনেক সদস্য মিশে আছে এবং তারা একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে হিংস্রতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ স্টেফানি কারভিন মনে করেন যে, কনসপিরাসি থিওরীতে বিশ্বাসীরা এবং উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদীরা অনেক দিন ধরেই কানাডাতে সরকার বিরোধী একটি অবরোধ করার পাঁয়তারা কষছিল এবং ‘ফ্রিডম কনভয়’ তাদেরকে সেই মোক্ষম সুযোগটা এনে দিয়েছে। অনেক ফার-রাইট এক্টিভিস্ট আবার আমেরিকার ক্যাপিটল হিল অবরোধ ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই অটোয়া অবরোধকে সেই দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। আর এই ব্যাপারে আমেরিকার ফার-রাইট গ্রুপদের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতা ছিল লক্ষ্য করার মতন। সেই কারণেই ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর অন্যতম অর্গানাইজার তামারা লিচ যখন ‘গো-ফান্ড-মি’-এর মাধ্যমে টাকা তোলার জন্য একাউন্ট খোলে, মুহুর্তের মধ্যেই সেখানে প্রায় দশ মিলিয়ন ডলার জমা পড়ে যার সিংহভাগই এসেছিল আমেরিকার সমর্থকদের কাছ থেকে। খোদ ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ফ্রিডম কনভয়’-কে সাপোর্ট করে ট্রুডো বিরোধী বক্তব্য দেয়। সে ট্রুডোকে ‘ফার-লেফট লুনাটিক’ বলে অভিহিত করে এবং ‘কোভিড ম্যান্ডেট’ দিয়ে কানাডার ইকোনমিকে ধ্বংস করার জন্য এককভাবে ট্রুডোকে দায়ী করে। এই সময় টেসলা কোম্পানীর কর্ণধার ইলোন মাস্কও ‘ফ্রিডম কনভয়’-কে অকুন্ঠ সমর্থন দেয় এবং ট্রুডোর দেয়া বক্তব্যকে ব্যঙ্গ করে বলে, হয়ত এই ‘স্মল ফ্রিঞ্জ’-ই নির্ধারণ করবে কে সরকার গঠন করবে। অটোয়ার ‘ফ্রিডম কনভয়’-কে কপিক্যাট অর্থাৎ অবিকল অনুকরণ করে পৃথিবীর আরো কিছু দেশে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদীরা কোভিড ভ্যাকসিন বাতিলের দাবীতে একত্র হতে থাকে। ফ্রান্সের সরকার যখন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের মাধ্যমে এ রকম একটি অবরোধের চেষ্টা নস্যাৎ করতে সমর্থ হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে লিবারেল সরকার কেন অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হল।
‘ফ্রিডম কনভয়’-এর কারণে সৃষ্ট শব্দদূষণে অতিষ্ঠ হয়ে ২১ বছর বয়সী অটোয়াবাসী জশি লি যখন অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে অন্টারিও সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিস-এ ক্লাস-একশন মামলা করার প্রস্তাব আনেন তখন কোর্ট থেকে একটি ইনজাংকশন জারি করা হয় যে, প্রটেস্টাররা কোন ধরণের হর্ন দিয়ে শব্দ করতে পারবে না। অটোয়ার জনজীবন যখন ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর অবরোধকারীদের উৎশৃংখলার কারণে পর্যুদস্ত, তখন অবরোধকারীরা নিজেদের জন্য হট টাব, কনসার্ট স্টেজ, কমিউনিটি কিচেন এবং তাদের বাচ্চাদের জন্য বাউন্সি ক্যাসেল বানিয়ে তাদের দখলকৃত এলাকাকে একটি প্রমোদ ভিলেজে পরিণত করে ফেলে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিটি কাউন্সিলর ক্যাথেরিন ম্যাককেনি মন্তব্য করেন যে, জনগণকে উপেক্ষা করে এই অবরোধকে চলতে দেয়া যায় না। তাই তিনি এই অবৈধ অবরোধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অটোয়ার পুলিশকে অনুরোধ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, অটোয়ার পুলিশ প্রধান পিটার স্লয়লি গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন যে ট্রাক চালকদের অবরোধ প্রতিহত করার জন্য অটোয়া পুলিশের পর্যাপ্ত রিজার্ভ কিংবা রিসোর্স নেই। তিনি মনে করেন একমাত্র মিলিটারিই পারবে তাদেরকে প্রতিহত করতে তবে সেটা হবে খুবই ভয়ঙ্কর কারণ ট্রাক চালকদের কাছে অস্ত্র রয়েছে। পুলিশের এই নিষ্ক্রিতা ছিল চোখে পড়ার মতন। তারা অবরোধকারীদেরকে অবৈধভাবে পার্কিং করার জন্য টিকেট দিতে পর্যন্ত অপারগ ছিল। এমন কী কিছু পুলিশকে বিক্ষোভকারীদেরকে মর্যাল সাপোর্ট এবং ‘গো-ফান্ড-মি’-তে চাঁদা দিতে দেখা গেছে। অটোয়ার নতুন অস্থায়ী পুলিশ চীফ স্টিফ বেল অবশ্য বলেছেন যে সেই সব পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের নিষ্ক্রিতার পাশাপাশি কনজারভেটিভ দলের বেশ কিছু সিনিয়ার লীডারদের নীরবতাও ছিল লক্ষ্যণীয় বিষয়। ঠিক দুই বছর আগে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উত্তরে ‘ওয়েটসুওয়েটএন’ টেরিটরিতে ইনডিজেনাস কম্যুনিটির এক্টিভিস্টরা যখন কোস্টাল গ্যাসলিংক পাইপ লাইনের কাজে বাধা দেয় তখন আরসিএমপি-এর পুলিশেরা কুকুর, হেলিকপ্টার এবং তাদের ট্যাক্টিক্যাল টীম নিয়ে এক্টিভিস্টদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে তাদেরকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়। পুলিশের এই হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ইনডিজেনাস কম্যুনিটি রেললাইনের উপর ব্লকেড তৈরি করে যা কিনা ছিল কানাডার অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কনজারভেটিভের বেশ কিছু সিনিয়ার লীডার বিশেষ করে পিয়ারে পলিয়েভার তখন ট্রুডোকে সেই ব্লকেড সরাতে অতিসত্বর ব্যবস্থা নিতে সরব ছিলেন। অথচ অটোয়ার ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর কারণে যখন উইনজরের অ্যাম্বাসেডার ব্রীজে ব্লকেড তৈরি হয় এবং বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছিল তখন সেই সব লীডারেরা ছিলেন নীরব। তবে অন্টারিও-এর প্রিমিয়ার কনজারভেটিভ দলের ডাগ ফোর্ড অবশ্য অটোয়া অবরোধের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিলেন।
অটোয়া অবরোধের অচলায়তন ঘোচাতে ট্রুডো অবশেষে ঘোষণা করেন যে, সরকার বাধ্য হবে ইমার্জেন্সি অ্যাক্ট জারি করতে। তার এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী ডায়াগনাল দলের ডি ফ্যাক্টো লীডার আফগান ভেটারেন জেরেমি ম্যাককেঞ্জি ট্রুডোকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ইউ ওয়ান্ট টু ড্যান্স? ওকে লেটস ড্যান্স’। অর্থাৎ সে তার অনুসারীদেরকে স্থান ত্যাগ না করার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। এই সময় অটোয়ার পুলিশকে রিইনফোর্স করা হয় এবং পিটার স্লয়লিকে স্থলাভিষিক্ত করে নতুন ইনটেরিম পুলিশ চিফের দায়িত্ব নেন স্টিভ বেল। তার নেতৃত্বে অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবেই অবরোধকারীদেরকে ধীরে ধীরে তাদের দখলকৃত জায়গা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। যারা ‘ফ্রিডম কনভয়’-কে চাঁদা দিয়েছিল তাদের ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়া হয়।
অর্গানাইজারদের অনেককেই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়। এক সময় অটোয়া দখলমুক্ত হয় ঠিকই তবে সেটার জন্য কানাডার সরকার এবং জনগণকে একটি বড় অংকের মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কানাডার ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সম্প্রতি ট্রুডো বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস-এ অবস্থিত ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু বক্তব্য শেষে সেখানকার বেশ কিছু উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী সদস্য তাকে কড়া ভাবে সমালোচনা করে তার ইমার্জেন্সি অ্যাক্ট দ্বারা ‘ফ্রিডম কনভয়’-এর অবরোধকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। তারা ট্রুডোর এই আচরণকে গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো