ইসলামোফোবিয়া বন্ধ করতে এবার জাতিসংঘের উদ্যোগ
খুরশিদ আলম
জাতিসংঘ ১৫ মার্চকে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। গত ১৬ মার্চ, ২০২২ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এই প্রস্তাবটি পাশ হয়।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ইসলামবিদ্বেষী এক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ব্র্যান্টন টারেন্ট নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে বন্দুক হামলা চালিয়ে ৫১ জন মুসল্লিকে হত্যা করেছিল। এ জন্য দিনটি ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে বেছে নেয়া হয়। ঐ দিন যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশীও আছেন।
ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এরকম একটি দিবস ঘোষণার প্রস্তাব এসেছিল অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এর পক্ষ থেকে। ওআইসি’র পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
ওয়াশিংটন পোস্ট এর এক খবরে বলা হয়, ওআইসি’র ৫৭ টি সদস্য দেশ এবং চীন ও রাশিয়াসহ আটটি দেশ এই প্রস্তাবকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিল। বেশ কয়েকটি সদস্য দেশ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু আপত্তি জানিয়েছে ভারত, ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা।
ভারতের বক্তব্য হলো, ‘অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে এড়িয়ে শুধু একটি ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে তুলে ধরা উদ্বেগের।’ হিন্দুস্থান টাইমস জানায়, জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টিএস তিরুমূর্তি বলেন, ‘আমরা ইহুদি-বিরোধী, খ্রিস্টানফোবিয়া বা ইসলামফোবিয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত সমস্ত কাজের নিন্দা করি। তবে এই ধরনের বিদ্বেষ শুধুমাত্র আব্রাহামিক ধর্মের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়।’
তিরুমূর্তি জানান, ‘হিন্দুধর্ম পালনকারী ১.২ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ আছে বিশ্বে। বৌদ্ধধর্ম পালন করেন ৫৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এবং শিখ ধর্ম পালন করেন ৩০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ।’ তিনি বলেন, ‘হিন্দু বিরোধী বা শিখ বিরোধী মনোভাবের কী হবে তাহলে? অন্য ধর্মকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র একটি ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে স্বীকৃতি দেওয়া পুরোপুরি আলাদা জিনিস।’ এ প্রসঙ্গে আফগানিস্তানে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস, পাকিস্তানে গুরুদ্বারে হামলা, গুরুদ্বারে শিখ তীর্থযাত্রীদের খুনের উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি।
উল্লেখ্য যে, গত বছর ডিসেম্বর মাসে ধর্ম অবমাননার আভিযোগে শ্রীলঙ্কান এক নাগরিককে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়েছে পাকিস্তানে। স্থানীয় পুলিশ বলছে, পিটিয়ে মেরে ওই লোকের দেহে আগুন ধরিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ভয়েস অব আমেরিকা। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরবর্তী শিয়ালকোট শহরে এ ঘটনা ঘটেছে। শিয়ালকোটের এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ইসলামী আয়াতযুক্ত একটি পোস্টার ছিঁড়েছিলেন ওই শ্রীলঙ্কান নাগরিক। এমন অভিযোগে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে উন্মত্ত জনতা। পরে তাঁর দেহে আগুন দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই ঘটনাকে লজ্জাজনক আখ্যা দিয়ে জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এ ঘটনা পাকিস্তানের জন্য লজ্জার।
অন্যদিকে গরুর মাংস বিক্রির দায়ে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় ঝাড়খন্ড রাজ্যে আলিমুদ্দিন আনসারী নামে ৫৫ বছর বয়সী এক মাংস ব্যবসায়ীকে স্থানীয় লোজন পিটিয়ে হত্যা করেন। কয়েক বছর আগের ঘটনা এটি। উল্লেখ্য, হিন্দুরা গরুকে অত্যন্ত পবিত্র প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করেন। কট্টরপন্থী হিন্দুরা মনে করেন গরুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাঁদের ধর্মীয় দায়িত্ব। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে গরু হত্যাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ঝাড়খন্ড অন্যতম। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে গো-রক্ষার নামে বিভিন্ন গোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এঁরা গোমাংস থাকার অভিযোগে বিভিন্ন মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালায়। এধরনের হামলায় ভারতে প্রায় ১২ জন নিহত হয়েছেন। বেশিরভাগ সময়েই গুজবের উপর ভিত্তি করে মুসলমানদের উপর এসব হামলা চালানো হয়।
বস্তুত, ধর্মের নামে উন্মত্ততা বা এক ধর্মের মানুষ কর্তৃক অন্য ধর্মের মানুষকে অবমাননা করা কিংবা বিদ্বেষ ছড়ানো অথবা হত্যা করার নৃশংস ঘটনাসমূহ লিপিবদ্ধ হয়ে আছে মানব ইতিহাসের পাতায় পাতায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে ও পরে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় প্রায় দুই লক্ষ মানুষ মারা যান। কেউ কেউ অবশ্য দাবী করেন, দুই লক্ষ নয়, উভয় পক্ষের প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ সহিংসতার শিকার হয়ে মারা যান।
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ হয়েছিল সে অনেক দিন আগের কথা। কিন্তু সেই অঞ্চলের মানুষের চরম দুর্ভাগ্য এই যে, ধর্মের নামে আজো দাঙ্গা হয় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। দাঙ্গায় মানুষের মৃত্যুও ঘটে। এ সকল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ইসলামোফোবিয়া, হিন্দুফোবিয়া সবই আছে ঐ অঞ্চলে।
তবে বর্তমানে ইসলামোফোবিয়ার ব্যাপ্তিটাই ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকায় বেশী মাত্রায় দেখা দিয়েছে। কানাডায়ও এই ইলামোফোবিয়ার ব্যাপ্তি ঘটেছে অনেক। মূলত ৯/১১ এর পরই অন্যান্য দেশের মতো কানাডাও ইসলামোফোবিয়ার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই মাত্রায় নতুন ইন্ধন যোগান আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চরম মুসলিম বিরোধী হিসাবে খ্যাতি রয়েছে তাঁর। তাঁর এই মুসলিম বিরোধী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই কানাডার কুইবেক প্রভিন্সে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হাতে নিয়ে স্থানীয় এক মসজিদে প্রবেশ করে ৬ জন মুসল্লীকে হত্যা করেন। ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী এই ঘটনা ঘটে।
কানাডায় ঘটে যাওয়া কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও দেশটিতে ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধির পেছনে অবদান রেখে থাকতে পারে। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, রাজধানী অটোয়াতে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিল এক কনভার্টেড মুসলিম যুবক কর্তৃক। ঐ হামলায় নিহত হয়েছেন একজন তরুণ কানাডিয়ান সৈন্য। তারও আগে কুইবেকে একজন কানাডিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছেন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে। তিউনিশিয়ার এক মুসলমান যুবক গ্রেফতার হয়েছেন কানাডার ভিয়া (via) রেল সেতু ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করায়। পাকিস্তানী এক মুসলমান যুবক গ্রেফতার হয়েছেন টরন্টোর মার্কিন কনসুলেট অফিস উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করায়। মন্ট্রিয়লের বিমান বন্দর থেকে ১০ জন যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল যারা জঙ্গী সংগঠন ‘আইএস’ এর সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য দেশ ত্যাগ করতে যাচ্ছিল। সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আইএস’ এ যোগ দেওয়ার জন্য ৪ জন বাঙ্গালী তরুণ কানাডা ছেড়েছিলেন এমন খবরও রয়েছে। কয়েক বছর আগে টরন্টোতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৮ জন মুসলমান যুবক যাঁরা পার্লামেন্ট ভবন সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
ফ্রান্সের প্যারিসেও আমরা লক্ষ্য করেছি কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে ইতিপূর্বে। প্যারিসে বিদ্রুপাত্মক সাময়িকী শার্লি এবদোর কার্যালয়ে জঙ্গি হামলা থেকে এ পর্বের ভয়াবহতার শুরু। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারীতে পরিচালিত ঐ হামলায় ১২ জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর পরদিন প্যারিসেরই এক শহরতলিতে এক নারী পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন একটি ইহুদিদের খাবারের দোকানে হামলা চালিয়ে চারজনকে জিম্মি ও হত্যা করা হয়। তবে প্যারিসের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি ঘটে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে। একযোগে নগরের বাতাক্লঁ থিয়েটার হল, ফুটবল স্টেডিয়ামের সামনে ও একটি রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন ১৩০ জন। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় নিস শহরে রাতে বাস্তিল দিবসের উৎসবে জড়ো হওয়া জনতার উপর বেপরোয়া ট্রাক তুলে দেয় এক চালক। এতে শিশুসহ অন্তত ৮৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।
পাশ্চাত্যে ইসলামোফোবিয়ার ঘটনা বৃদ্ধির পিছনে এ সকল নৃশংস হত্যাকান্ড নিশ্চিভাবেই ভূমিকা রাখছে। তবে এ সকল অমানবিক ও নৃশংস ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আদর্শ বা বিশ^াস যাই থাকুক বা না থাকুক, মানুষ হত্যা করা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়, কানাডায় যাঁরা ইসলামোফোবিয়ায় ভুগছেন তাঁরা মনে করছেন মুসলিম সম্প্রদায় এদেশে ‘একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা হুমকি’ সৃষ্টি করছে। তাঁদের আরো ভয়, ইমিগ্রেশন এর মাধ্যমে এ দেশে আসা মুসলিমরা কানাডিয়ান সমাজে ইসলামের প্রভাব বিস্তার করতে পারে যার মাধ্যমে নারী অধিকার খর্ব হতে পারে। আবার অনেকে মনে করেন ‘ইসলামের ধর্মীয় মূল্যবোধ সহিংসতাকে উস্কে দেয়।’
দি কানাডিয়ান এনসাইক্লোপেডিয়া’র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এখানে অন্টারিও এবং কুইবেক প্রভিন্সে সবচেয়ে বেশী মাত্রায় ইসলামোফোবিক অপরাধ এর ঘটনা ঘটছে। কারণ, এই দুই প্রভিন্সে মুসলিমদের সংখ্যাও বেশী। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় গ্রেটার টরন্টোর মোট জনসংখ্যার ৭.৫%-ই মুসলিম ধর্মালম্বী। ২০১৬ সালে ‘ফোরাম রিসার্স’ পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে কুইবেক প্রভিন্সের ৪৮% অধিবাসী ইসলামকে ভাল চোখে দেখেন না। অন্টারিওতে এই হার ২২%।
দেখা গেছে কানাডায় হিংসাত্মকভাবে মৌখিক ও শারীরিক আক্রমণই ইসলামোফোবিয়া প্রকাশ করার একমাত্র উপায় নয়। চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া হলো আরেকটি উপায় যা মুসলিমরা অনুভব করেন। কুইবেকের লাভাল ইউনিভার্সিটির গবেষক জেন-ফিলিপ বিউরেগার্ড ইতিপূর্বে এ বিষয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন। ঐ গবেষণায় তিনি দেখতে পান যাদের নামের সাথে আরবীয় পরিচয়ের চিহ্ন আছে তাঁদেরকে সাক্ষাৎকারে ডাকার সম্ভাবনা দুই গুণ কম।
১০১৬ সালে ‘এনভাইরনিকস ইনস্টিটিউট’ কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে কানাডায় বসবাসরত এক তৃতীয়াংশ মুসলিম পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন হয় তাঁদের ধর্মবিশ^াসের কারণে বা তাঁদের জাতিগত উৎপত্তির কারণে অথবা ভাষার কারণে। এই বৈষম্যের ঘটনাগুলো ঘটেছে প্রধানত কর্মস্থলে বা অন্যকোন পাবলিক প্লেসে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ৯/১১ এর পর কানাডায় মুসলিম বিদ্বেষী অপরাধ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এর প্রমাণ মিলে ২০০৩ সালের একটি সমীক্ষা থেকে। ‘কানাডিয়ান ইসলামিক কংগ্রেস’ এর ঐ সমীক্ষায় বলা হয়, ২০০২ সালে তাদের কাছে ১৭০ টি মুসলিম বিদ্বেষী আপরাধের খবর আসে। কিন্তু ২০০০ সালে এর সংখ্যা ছিল ১১ টি। দুই বছরের ব্যবধানে কানাডায় মুসলিম বিদ্বেষী আপরাধের মাত্রা প্রায় ১৫০০% বৃদ্ধি পায়।
পরবর্তীতে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক রিপোর্টে দেখা যায় ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কানাডায় ইসলাম বিদ্বেষী ঘটনা ধীরে কিন্তু অব্যাহতভাবে বাড়তেই থাকে। ঐ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সালে কানাডায় ইসলাম বিদ্বেষী ঘটনা ঘটে ৩৬ টি যা পুলিশের কাছে নথিবদ্ধ করা হয়। ২০১৪ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৯ টিতে। কিন্তু ২০১৫ সালে এই সংখ্যা হঠাৎ করেই অনেকটা বেড়ে যায়। ঐ বছর পুলিশের কাছে ১৫৯ টি বিদ্বেষের ঘটনার রিপোর্ট করা হয়। বৃদ্ধির হার ৬০%। ২০১৭ সালে এসে এই বৃদ্ধির সংখ্যা আরো বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৪৯ টিতে। তার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার ছিল ১৫০%। স্ট্যাটিকস কানাডার বরাত দিয়ে গ্লোবাল নিউজ এই তথ্য জানায়।
তবে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় কানাডায় মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষী ঘটনার সংখ্যা গত তিন বছরে সামান্য কমে এসেছে। কিন্তু তাতে স্বস্তি পাবার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি এখনো। বরং সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্বেষী ঘটনায় নৃশংসতার মাত্রা আশংকাজনক ভাবে অনেক বেড়েছে। কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে ৬ জন মুসল্লিকে গুলি করে হত্যা, টরন্টোর নিকটবর্তী ইটবিককে একজন মুসল্লিকে মসজিদের সামনে গলা কেটে হত্যা করা এবং অন্টারিওর লন্ডন সিটিতে এক মুসলিম পরিবারের ৪ জনকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করার ঘটনা সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
মুসলিম বিদ্বেষী এক যুবক কর্তৃক লন্ডনে এক পরিবারের ৪ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর কানাডা জুরেই বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের পক্ষ থেকে জোর দাবী উঠে ইসলামোফোবিয়া বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করার জন্য। এরই প্রেক্ষিতে গত বছর কয়েকটি মুসলিম সংগঠনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার একটি জাতীয় শীর্ষ সম্মেলন এর আয়োজন করে। ঐ সম্মেলনে সরকার অনলাইনে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো এবং শিক্ষাদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইসলামোফোবিয়া বন্ধ করার জন্য এই পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক থোবানী বলেন এগুলো ‘ব্যান্ড-এইড’ ব্যবহার করে ক্ষত সারানোর সাময়িক বা ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।
ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর কানাডিয়ান মুসলিমস এর প্রধান নির্বাহী মোস্তফা ফারুখ বলেন, সহিংসতা ও ইসলামোফোবিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে। ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল পর্যায়ের সব নেতাকেই এগিয়ে আসতে হবে। একত্রিত হতে হবে সবাইকে নীতিতে প্রকৃত পরিবর্তন আনার জন্য।
উল্লেখ্য যে, ইসলামোফোবিয়াসহ অন্যান্য বিদ্বেষী বা বর্ণবাদী তৎপরতা বৃদ্ধির পিছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সাম্প্রতিককালে একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এবং বিদ্বেষী বা বর্ণবাদী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে এই মাধ্যগুলোর জোরালো কোন ভূমিকা নেই, নেই জোরালো কোন নিয়ন্ত্রণও। অনেক সময় বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়েও নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার চেষ্টা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
ইতিপূর্বে সিটিভি নিউজে প্রকাশিত নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে কানাডায় যাঁরা রক্ষণশীল তাঁরা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও।
যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়লগ এর সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টের অন্যতম লেখক জ্যাকব ডাভে সিটিভি নিউজ -কে বলেন ‘এর ফলে মনে হচ্ছে এটি সত্যিই এমন একটি বিষয় যেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে ব্যবহারকারীদের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছ যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে লক্ষ্য করে চরম নোংরা কায়দায় ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে।’
উল্লেখ্য যে, লন্ডনে মুসলিম পরিবারটি হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার পর সেখানকার ইসলামিক সেন্টার অফ সাউথওয়েস্ট অন্টারিও’র পার্কিং লটে অনুষ্ঠিত হয় তাঁদের জানাযা। এ সময় নিহতদের প্রতি সম্মান জানাতে পাশর্^বর্তী ফুটবল মাঠে জড় হয়েছিলেন অন্যান্য কমিউনিটির বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কানাডার ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল রাজনীতিবিদদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন লিবারেল পার্টি প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির সেই সময়কার নেতা এরিন ও’টুল, অপর বিরোধী দল এনডিপি’র নেতা জাগমিত সিং, অন্টারিও’র প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি প্রধান ও প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড এবং অন্টারিও’র প্রধান বিরোধী দল এনডিপি নেতা এন্ড্রিয়া হরওয়থ। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ শোকার্ত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন এবং যারা ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন তাঁদের তীব্র নিন্দা করেন।
জানাযা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, ‘কানাডায় ইসলামোফোবিয়া বিদ্যমান, বর্ণবাদ বিদ্যমান। কিন্তু এগুলোর শিকার হওয়া উচিত নয় করো। আমাদের সবাইকে একত্র হয়ে দাঁড়াতে হবে। ইসলামোফোবিয়া, বিদ্বেষ, সন্ত্রাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে বলতে হবে না না।’
একই অনুষ্ঠানে কনজারর্ভেটিভ পার্টির তখনকার নেতা এরিন ও’টুল বলেছিলেন, ‘কানাডায় ইসলামোফোবিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য দলীয় নেতাদেরকে রাজনীতি একপাশে রেখে এগুতে হবে।’
এনডিপি নেতা জাগমিত সিং বলেছিলেন, লন্ডনের এই হত্যাকান্ডের পর আমাদেরকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ‘আর কত লাশ পড়লে আমরা বাস্তব পদক্ষেপ নিব? প্রকৃত পরিবর্তন আনার জন্য আর কতজন মুসলিম ভাই ও বোনকে প্রাণ দিতে হবে? আমাদেরকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
আমরা জানি কোন অঘটনা ঘটলে জাতীয় নেতৃবৃন্দ জনসমক্ষে এসে জ¦ালাময়ী বক্তৃতা দেন। নানান প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদার কথা শুনান। এবং যথারীতি দুইদিন পর তা ভুলেও যান। কিন্তু বর্ণবাদ, বিদ্বেষী কর্মকান্ড, ইলামোফোবিয়া এগুলো এমন এক বিষয় যেটা গুরুত্বসহকারে না নিলে পরিনতি আরো খারাপের দিকে যাবে। জাগমিত সিং এর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আজকে আমরাও বলতে চাই, ‘আমাদেরকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে’।
আশার কথা এই যে, ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবার জাতিসংঘও সামিল হয়েছে। জাতিসংঘ হয়তো নির্দিষ্ট কোন দেশে সরাসির কোন সহায়তা করতে পারবে না। কিন্তু তাদের নৈতিক সমর্থন এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। আর এ সমর্থন নিয়ে কানাডার ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল সরকার সরকারসমূহ ইসলামোফোবিয়া বন্ধে জোরালো কোন পদক্ষেপ নিবে এমনটাই আশা আমাদের।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ