লতা মঙ্গেশকরের মহাপ্রয়ান
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ভারতীয় উপমহাদেশে সঙ্গীতপ্রেমী সবাই যাকে একনামে চিনেন তিনি হলেন লতা মঙ্গেশকর। সঙ্গীত জগতের সেরা কিংবদন্তীদের একজন ছিলেন তিনি। প্রায় ৭ দশকের সঙ্গীত জীবনে ২৭ হাজারের বেশি গানের রেকর্ডিং করেছিলেন তিনি। বাংলাসহ দেশের ৩৬টি ভাষায় এবং বেশ কিছু বিদেশি ভাষাতেও গান রেকর্ড করেছেন তিনি। ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ে ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই মহা কিংবন্তী।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ১৯৮৯ সালে ভারত সরকার তাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০১ সালে তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাবে ভূষিত করে।
কিংবদন্তী লতা সম্পর্কে অবাক করা কয়েকটি তথ্য
লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে কিছু অবাক করা ঘটনা তুলে ধরে ইত্তেফাকের অনলাইন সংস্করণ:
লতা নয়, ভালো নাম ছিল হেমা: লতা মঙ্গেশকরের নাম কিন্তু ছিল হেমা। পরবর্তীকালে তার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের ‘ভাওবন্ধন’ নাটকের লতিকা চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঁর লতা নামটি রাখা হয়।
কম বয়সে মেয়ের গানের প্রতিভা চোখে পড়ে বাবার: মঙ্গেশকর পরিবারের সকলেই কোনও না কোনও ভাবে শিল্পজগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীত পিয়াসী। অভিনয়ের পাশাপাশি গায়ক হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। একবার তিনি এক ছাত্রকে একটি বিশেষ রাগ অনুশীলনের কথা বলেন। এদিকে ছাত্রটি অনুশীলন করছে। এর মধ্যেই ছোট্ট লতা তার ভুল ধরিয়ে দেয়। সেদিন বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর বুঝতে পারেন, তার বড় মেয়ে গায়িকা হতে চলেছে। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর ছাড়াও লতা মঙ্গেশকর গানের তালিম নিয়েছিলেন আমানত খান, আমান আলী খানের মতো কিংবদন্তির কাছে।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম গান রেকর্ডিং: ১৯৪২ সালে মরাঠি সিনেমা ‘কিটি হাসাল’-এর জন্য স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং করেন লতা। কোনও অজ্ঞাত কারণে সিনেমাটি রিলিজ হলেও গানটি বাদ গিয়েছিল।
অভিনেত্রী হিসাবেও হাতেখড়ি হয়েছিল: ১৯৪২ সালে বাবার মৃত্যু আর অর্থনীতিক সংকটে ফেলে দিয়েছিল মঙ্গেশকর পরিবারকে। কিছুটা অর্থের প্রয়োজনেই প্রায় ছ’বছর পেশাদার অভিনয় জীবনে আটটি সিনেমায় অভিনয় করেন পাঁচ ভাই বোনের সবচেয়ে বড় লতা মঙ্গেশকর। তবে অভিনয়ের কেরিয়ার সে রকম এগোয়নি।
লতার প্রথম বড় সুযোগ: ‘মজবুর’ (১৯৪৮) ছবিতে প্রথম বড় সুযোগ পান লতা মঙ্গেশকর। এ ছবিতে ‘দিল মেরা তোড়া’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছিলেন তিনি। তবে তার প্রথম তুমুল জনপ্রিয় গান হলো ‘মহল’ (১৯৪৯) সিনেমার ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। এতে অভিনয় করেন প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেত্রী মধুবালা।
শুরুতে অনেকেই বলেছিলেন ‘বড্ড সরু গলা’: লতা মঙ্গেশকরের জীবনেও ব্যর্থতা এসেছিল। তাও কেরিয়ারের শুরুতেই। সেই সময় নুর জাহান, শাম সাদ বেগমের রমরমা সময়। একটু নাঁকি ভারি গলার চল তখন। অনেকেই বলেছিলেন, লতা মঙ্গেশকরের গলা বড্ড সরু। তবে ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ সিনেমার সুপারহিট ‘আয়েগা অনেওয়ালা’ গানের পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ওঁকে।
১৯৬২ সালে তাঁর খাবারে বিষ মেশানো হয়েছিল: ১৯৬২ সালে লতা মঙ্গেশকর যখন গুরুতর অসুস্থ হন। তখন জানা যায়, ওঁকে স্লো পয়েজন করা হচ্ছিল। পরিস্থিতি এতটাই চিন্তার হয়ে দাঁড়ায়, ওঁকে প্রায় তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হয়। বিপদ কেটে গেলেও অনেক দিন লাগে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে।
সাংসদ হিসেবে কোনও সুযোগ সুবিধা নেননি: লতা মঙ্গেশকরকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। অসুস্থতার জন্য তিনি রাজ্যসভার সেশনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু উনি এক টাকা বেতন বা বাড়ি ভাড়া বা কোনও বাড়তি সুবিধা নেননি, যা সাধারণত দেওয়া হয় সাংসদদের।
লতা মঙ্গেশকরের শেষ সাক্ষাৎকার
সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সাক্ষাৎকার অনেকবার নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে ভারতীয় সাংবাদিক খালিদ মোহাম্মদের। তবে শেষ সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনের নানা অজানা দিক খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেছেন লতা। দুই বছর আগে এ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন খালিদ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য কুইন্ট-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করে প্রথম আলো। এখানে তার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আপনি কি আপনার গত সাত দশকের অর্জনগুলোর দিকে কখনো ফিরে তাকিয়েছেন? সেখানে কি বেদনাদায়ক কিছু আছে? কোনো অপূর্ণ ইচ্ছা? কোনো তৃপ্তির অনুভূতি?
উত্তর : আমি খুব বেশি চিন্তাভাবনার মানুষ বলে নিজেকে বিবেচনা করি না। অতীতে বাস করে লাভ নেই। আত্মপ্রেমী মানুষই কেবল আজ ও আগামীকালকে উপেক্ষা করে অতীত নিয়ে পড়ে থাকেন। যত দিন আমার কণ্ঠস্বর আমাকে ছেড়ে না যাচ্ছে, তত দিন আমি গান গেয়ে যেতে চাই। গানই একমাত্র বিষয়, যা আমি পারি।
প্রশ্ন : আপনি কি পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের গায়িকা নূরজাহানের গায়কিতে প্রভাবিত হয়েছিলেন?
উত্তর : হ্যাঁ, আমাকে তাঁর সঙ্গে তুলনা করা হতো। আমি স্বীকারও করব যে তাঁর গান শোনার পর তাঁর গায়কি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : আপনি কি আপনার গানের সংগ্রহ ডিজিটাইজ করে সংরক্ষণ করেছেন?
উত্তর : আমি আমার সব ভিনাইল রেকর্ড, ক্যাসেট আর সিডি সংরক্ষণ করেছি, সংগীত কোম্পানিগুলো আমাদের কাছে যেগুলো পাঠায়। বাড়িতে কিছু রাখার মতো আর এক ইঞ্চি জায়গাও বাকি নেই। আমার নাতি-ভাতিজা ও নাতনি-ভাতিজিরা আমার সংগ্রহশালাটি ডিজিটাইজ করতে পারে। আমি অবশ্য ওদের কিছু বলিনি।
প্রশ্ন : আপনি ঠিক কী নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হন?
উত্তর : ওহ্, একেবারে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে, যার ফলাফল তেমন কিছুই না।
প্রশ্ন : ১৯৭০-এর দশকে লতা মঙ্গেশকরের একচেটিয়া প্রভাব নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। বিষয়টি আপনার জন্য বেদনাদায়ক ছিল?
উত্তর : আমি সহজে আহত হই না। দেখুন, এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট বিচক্ষণতা আছে যে একটি ইন্ডাস্ট্রি—যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র তৈরি করে—তার সবগুলো গান আমাকে দেওয়া উচিত বলে বোধ হয় আমি জবরদস্তি করতে পারি না।
প্রশ্ন : দশক ধরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে আশা ভোসলের অনুচ্চারিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে হরদম কথাবার্তা চলেছে।
উত্তর : দেখুন, কিছু লোক তাঁদের মজ্জাগতভাবেই বিতর্ক উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, লতা অমুক-অমুক গান আশার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। অথবা তার উল্টো। ঘটনা হলো, আমি ক্যাবারে গানগুলো না করে দিতাম। ওগুলো স্বাভাবিকভাবেই আশার কাছে চলে যেত।
চিরকুমারী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর
তিনি ছিলেন চিরকুমারী। ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ সফলতার পরও কেন একা ছিলেন এ সুর সম্রাজ্ঞী? এটা কী ছিল শুধুই সুর সাধনায় মগ্ন থাকার কারণে? নাকি অন্য কিছু? ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে যুগান্তর জানিয়েছে, গুঞ্জন ছিল লতা মঙ্গেশকর এক সময় কাউকে ভালোবেসেছিলেন; কিন্তু সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি।
তাই আর কারও সঙ্গে মালাবদলও হয়নি তার। আরও গুঞ্জন ছিল, তার সেই প্রেমিক ছিলেন রাজস্থানের (তৎকালীন রাজপুতনা) দুঙ্গরপুরের রাজ ঘরানার মহারাজ রাজ সিং। রাজ সিং নাকি বাবা-মাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কোনো সাধারণ ঘরের মেয়েকে রাজবংশের বউ করে আনবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা বজায় রেখেছিলেন রাজ সিং। তিনি কখনো বিয়েই করেননি। ২০০৯ সালে মারা যান রাজ সিং। এ রাজ সিং ছাড়া লতার দীর্ঘ জীবনে আর কারও সঙ্গে তার নাম জড়াননি। তবে এ গুঞ্জন মানতে নারাজ ছিলেন।
চিরকুমারী থাকার কারণ হিসাবে তিনি জানিয়েছেন, সংসারের দায়িত্ব কাঁধে থাকার কারণেই তিনি নিজের জীবন নিয়ে আলাদা করে ভাবার সুযোগ পাননি। বাবা দীননাথ মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা যান। এরপরই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল ১২ বছরের মেয়ে লতার কাঁধে। বাবার মৃত্যুর মাত্র সাত দিন পরই লতা গেলেন ‘প্যাহলি মঙ্গলার্গাও’ সিনেমার শুটিংয়ে। মারাঠি এ সিনেমায় অভিনয় আর গান গেয়ে ক্যারিয়ার শুরুর পাশাপাশি জীবন সংগ্রামও শুরু করেন কিংবদন্তি এ শিল্পী।
বাংলাতে ২০০টি গান রেকর্ড করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর
তারমধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য গানের তালিকা প্রকাশ করে উইকিপিয়িা যা নিচে তুলে ধরা হলো:
• আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের
• প্রেম একবারই এসেছিল
• রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে
• না যেও না রজনী এখনও
• ওগো আর কিছু তো নাই
• আকাশ প্রদীপ জ্বলে
• একবার বিদায় দে মা
• সাত ভাই চম্পা
• নিঝুম সন্ধ্যায়
• চঞ্চল মন আনমনা হয়
• বাঁশি কেন গায়
• যদিও রজনী পোহাল তবুও
• ও মোর ময়না গো
• কেন কিছু কথা বলো না
• আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
• চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়
• চঞ্চল ময়ূরী এ রাত
• কে যেন গো ডেকেছে আমায়
• আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন
• মঙ্গল দীপ জ্বেলে
উল্লেখযোগ্য হিন্দি গান
তাঁর গলায় পনেরো হাজারেরও বেশি হিন্দি গান রয়েছে। উইকিপিডিয়াতে উল্লেখ করা কিছু হিন্দি ছায়াছবির জনপ্রিয় গান :
• আয়েগা আনেওয়ালা (মহল)
• আজা রে পরদেসি (মধুমতী)
• পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া (মুঘল-ই-আজম)
• আল্লা তেরো নাম (হম দোনো)
• অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো
• লগ যা গলে (ওয়োহ কৌন থি)
• আজ ফির জিনে কি (গাইড)
• রহে না রহে হম (মমতা)
• তু জাঁহা জাঁহা চলেগা (মেরা সায়া)
• হোঁঠো মে অ্যায়সি বাত (জুয়েল থিফ)
• আ জান-এ যা (ইন্তেকাম)
• রয়না বিতি যায়ে (অমর প্রেম)
• তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই (আঁধি)
• চলতে চলতে, ইঁয়ুহি কোই (পাকিজা)
• দুনিয়া করে সওয়াল তো হাম বহু (বেগম)
• অ্যায় দিল এ নাদান রাজিয়া (সুলতান)
• নাম গুম জায়েগা (কিনারা)
• সুন সাহিবা সুন (রাম তেরি গঙ্গা মইলি)
• সিলি হাওয়া ছু গয়ি (লিবাস)
• ইয়ারা সিলি সিলি (লেকিন)
• দিল তো পাগল হ্যায় (দিল তো পাগল হ্যায়)
• তেরে লিয়ে (বীর জারা)
• দিল হুম হুম করে (রুদালি)
• জিয়া জ্বলে (দিল সে)
• তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম (ডি ডি এল জে)