মানুষের কথা

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সুন্দরকে ভালোবাসে না এজগতে এমন ব্যক্তির দেখা পাওয়া ভার, হোক সে নারী অথবা পুরুষ। সৌন্দর্যের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। গুণহীনা নারীও তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে পুরুষের মন জয় করতে পারে অনায়াসেই। মাকাল ফলের রঙ্গে আকৃষ্ট হয়ে তাকে ঠোকরায় অনেক পাখিই, কিন্তু তার বিস্বাদ অভ্যন্তরের দেখা পাওয়া মাত্র তার কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ দূরে সরে যায় সেই পাখি।

মানুষের বেলায়ও তাই। রূপমুগ্ধ পুরুষ তখন সেই নির্গুণ নারীকেই কাছে পেতে চায়, তার ব্যাকুলতার প্রকাশ হিন্দি ভাষায় দাঁড়ায়ঃ পহেলি দরশন ডারি, বাদ গুণ বিচারি। অর্থাৎ শুরুতে তো সৌন্দর্যটা উপভোগ করে নিই, সেই নারীর গুণের বিচার না হয় পরেই করা যাবে।

ফুল, পাখি, সবুজ ঘাস-বনানী, নীলাকাশ, বিশাল-বিস্তৃত সমুদ্র, কবিতা, গান, হাসি এবং ক্ষেত্র বিশেষে নারীর কান্নাও সুন্দর। নিষ্পাপ শিশুটি কোলে নিয়ে যুবতী মা’টি আরো বেশী সুন্দর। শতাব্দী-পুরাতন লেখা সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “পালামৌ” প্রবন্ধে পড়েছিলাম স্কুল-জীবনে যে “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”।

নারীর সৌন্দর্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, ধ্বংস ডেকে এনেছে দেশে দেশে এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। Greek Poet Homer-এর Iliad and Odessey- মহাকাব্যে Helen of Troy-এর কাহিনীতে দেখা যায় যে দশ বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ধ্বংসলীলার পেছনে কারণটাই ছিল Sparta রাজ্যের Menelaus-এর স্ত্রী Helen -এর সৌন্দর্য, এবং সেই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে Troy রাজ্যের রাজকুমার Paris কর্তৃক Helen-কে অপহরণ।

অতীতের ভারতবর্ষের ইতিহাসেও দেখা যায় সেই গ্রীসের বিষাদময় ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন খালজি (১২৯৬-১৩১৬ খৃষ্টাব্দ) চিতোরের রাজা রানা রতন সিংহের স্ত্রী পদ্মিণীর সৌন্দর্য খ্যাতিতে লুব্ধ হয়ে তাকে লাভ করার উদ্দেশ্যে চিতোর রাজ্য আক্রমণ করেন (১৩০২-১৩০৩ খৃষ্টাব্দ)। যুদ্ধে রাজা পরাজিত হন, কিন্তু আলাউদ্দীন খালজির লালসার শিকার না হয়ে পদ্মিণী জলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

মনে প্রশ্ন জাগে ঃ সৌন্দর্য বস্তুটা আসলে কি? কি দেখে মোহিত হয়ে আত্মহারা হয় একজন পুরুষ অথবা নারী? কি ছিল তালাকপ্রাপ্ত সেই আমেরিকান মহিলা Mrs Wills Warfield Simpson এর মাঝে যা দেখে The King of Great Britain and Ireland (1936) Edward VIII (1894-1972) মাত্র ৩২৫ দিন রাজত্ব করার পর সেই মহিলাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন? কত বড় sacrifice সাধারণ এক মহিলার জন্যে!

অথচ অনেক ক্ষেত্রেই তো বাস্তব চিত্র এমন দেখা গেছে যে যার জন্যে এত উন্মাদনা, পাগলপারা আচরণ সে অন্যের চোখে তেমন আকর্ষণীয়া/ আকর্ষণীয় নয় মোটেই। তাহলে কেন এমন উন্মাদনা? এর একটা উত্তর হলোঃ Beauty is in the eyes of the beholder অর্থাৎ সেই সৌন্দর্যটা শুধু তারই চোখে পড়ে যে প্রেমিকের দৃষ্টি নিয়ে দেখে। সে দেখে তার মনের মাধুরী মিশিয়ে। মানতে হবে যে কথাটাতে খানিকটা সত্য আছে বৈকি।

অন্য ধরণের সৌন্দর্যও উপভোগ করে থাকে সৌন্দর্যপিপাসু জনেরা। বন জঙ্গলের, সাগর-নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অতীতের বিখ্যাত (অক্ষত অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত) স্থাপত্যের সৌন্দর্য, বন-জঙ্গলে মানুষের, পশুপাখির সৌন্দর্য-এসব দেখেও মুগ্ধ হওয়ার লোক আছে। সম্ভবতঃ ১৯৫০ এর দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনী পড়েছিলাম এধরনের নানা সৌন্দর্যের মনোমুগ্ধকর বর্ণনায় ভরা গ্রন্থ ‘রম্যানি বীক্ষ্য’ যার অর্থ সম্ভবতঃ ‘সৌন্দর্য দেখে এলাম’। অতি চমৎকার এক ভ্রমণকাহিনী। তবে লেখকের নামটা মনে নেই, দুঃখিত।

কল্পনায় সৌন্দর্য সৃষ্টি করেও আনন্দ পাওয়া যায়, অপরকেও আনন্দ দেয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর্ম Mona Lisa (১৫০৩ খৃষ্টাব্দ)।

আবার কিছু লোক আছে যারা স্রষ্টার মাঝে সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ায়, সেই অনিন্দ্যসুন্দরের মাঝে নিজেদের মনপ্রাণ সঁপে দিয়ে বিলীন হয়ে যায়।

সুন্দরকে আপন করে পেতে সব মানুষেরই একটা আকুতি থাকে হৃদয়ের গভীরে, তাই তারা নিয়ত খুঁজে বেড়ায় আকর্ষণীয় জীবনসাথী, তারা কামনা করে ফুটফুটে সুন্দর সব সন্তান। এটা তাদের সৃষ্টির আনন্দ। দেশে বিদেশে মানুষ সংগ্রহ করে নানা রঙের, নানা ডিজাইনের পোশাক ও অলংকার, নিজেদের সেসব দিয়ে সাজাতে ভালবাসে তারা। বিত্তবানেরা আকর্ষণীয় ডিজাইনের বাড়িঘর বানায় প্রভূত অর্থ ব্যয় করে এবং সুন্দর সুন্দর চিত্রকলা, ভাস্কর্য, কার্পেট ও অন্যান্য সুদৃশ্য দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে ঘরবাড়ি সাজায়। তারা নিজেদের ড্রইংরুমে/লিভিংরুমে কাঁচের একুয়ারিয়াম ভর্তি করে সুদৃশ্য রঙ্গীঁন মাছের খেলা দেখে, উপভোগ করে।

গরীবের ঘরেও সুরুচি এবং সৌন্দর্য চর্চা থেমে নেই। তারাও যথাসাধ্য চেষ্টা করে নিজেদের দেহে এবং ঘরের পরিবেশে সৌন্দর্যের আর্বিভাব ঘটাতে। কেউ সাধ্যানুসারে কিনে নেন আবার কেউ (মহিলারা) তাদের সেলাই এবং বোনা সূচিকর্মের নিপুণতা দিয়ে ঘরবাড়ি সাজাতে চেষ্টা করেন। নিজেদের ও সন্তানদের সুন্দর পোশাক-অলংকারে সাজিয়ে আত্মীয়-বন্ধুদের সামনে তুলে ধরেন।

নিজেদের সুন্দর করে সাজিয়ে কোন বিশেষ নারী অথবা পুরুষকে আকর্ষণ করার চেষ্টা একটা নিপুণ কলাও বটে। তারা কোন ফাংশানে সুযোগ পেলে “মনের মতো সাজো”-Dress As You Like – প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আনন্দ বোধ করেন কারণ সেখানে নিজেদের সৃজনশীলতা প্রদর্শনের সুযোগ পাওয়া যায়।

সৌন্দর্য সৃষ্টি অথবা উপভোগ করার আকাক্সক্ষা ও চেষ্টা মানুষের এক মজ্জাগত স্বভাব। কারণ সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ সুন্দরের পূজারী। সুন্দরের জয় হোক।

পরিচয়

পরিচিত জনের ছড়াছড়ি সমাজে। আত্মীয়-বন্ধু-সহপাঠি-সহকর্মী-পড়শী সবাই আমাদের পরিচিত। তারা কে, কি করে, কোথায় থাকে, কি তাদের পেশা ইত্যাদি মোটামুটিভাবে আমরা জানি। তেমনি অন্যেরাও আমাদের বিষয়ে জানে। এটাই সমাজের স্বাভাবিক চিত্র। পরিচয়ের গভীরতা প্রমাণ করতে গিয়ে কখনোবা বলে থাকিঃ তোমাকে জানতে আমার আর বাকি নেই।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? তার সবকিছু আমি বাস্তবিকই জানি কি?

এখানে এসে থমকে দাঁড়াতে হয়, সরাসরি “হ্যাঁ, জানি” বলতে বাঁধে কারণ আমরা তো শুধু তাদের বাইরের চেহারাটাকে (public face টাকে) দেখি ও চিনি। কিন্তু তাদের অন্তর? তাদের ভেতরের চেহারাটার (hidden face টার) দেখাতো পাইনা কোনদিন। আমাদের পরিচয়টা তাই অসম্পূর্ণ, আংশিক। তাদের মনের নিভৃতে কি চিন্তাধারা বিরাজমান, কি তাদের প্রকৃত চরিত্র তাতো আমাদের সম্পূর্ণ অজানা। যার ফলে পরিচিত কারো সম্পর্কে অস্বাভাবিক কিছু খবর শুনলে অবাক হই, প্রশ্ন করি ঃ সে এমনটা করল? কি করে পারল? ঠিক এখানে এসেই আমাদের পরিচয়ের ধারণাটা হোঁচট খায়।

মানুষের সাধারণতঃ দু’টি রূপ, দু’টি চেহারা, যার একটা অপরটা থেকে ভিন্ন। একটা হলো তার বাইরের চেহারা, সামাজিক চেহারা, public face, তার চলনবলন, ব্যবহার, হাসিমুখে হাই-হেল্লো, সালাম, নমস্কার, কেমন আছেন? পরিবারের সবাই ভালো তো? ইত্যাদি। এটা হলো তার people-pleasing face..

অপর রূপটা বা চেহারাটা থাকে চোখের আড়ালে লুকানো। সেটা তার মানসিক গঠন যা কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ ও মাৎসর্য এই ছয় রিপু দ্বারা প্রভাবিত চিন্তাজগৎ। মানুষের অভ্যন্তরে এই ছ’টি রিপু অনবরত তার উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্যে প্রতিযোগিতা/লড়াই করে যাচ্ছে, তার চরিত্রটা গঠন করে যাচ্ছে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে। এটা হলো তার আভ্যন্তরীণ চেহারা, hidden face, এটাকে দেখা যায় না যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগছে অথবা সে বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে। মানুষের প্রকৃত পরিচয়টা জানার সমস্যাটার উদ্ভব এখানেই।

মানুষ মাত্রই তার ভেতরের রূপটাকে ঢেকে রাখতে চায় কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দু’টি রূপের মাঝে বিরাট একটা ব্যবধান থাকে। যাকে দেখে মনে হয় তিনি একজন উত্তম লোক, হয়ত খোঁজ নিলে জানা যাবে যে এটা তার মুখোশ, পারিবারিক পরিবেশে তিনি একজন অত্যাচারী  স্বামী ও পিতা, লেনদেনের ক্ষেত্রে অতি লোভী ও স্বার্থপর, অথবা এমনি ধরনের নিকৃষ্ট চরিত্রের লোক তিনি। স্বভাবতঃই তিনি তার প্রকৃত চরিত্রটাকে ঢেকে রেখে তার বাহ্যিক people-pleasing face-টা দেখিয়ে বেড়ান। লোক সমাজে কে নিজের আপত্তিকর ব্যবহার প্রকাশ করে হেয় প্রতিপন্ন হতে চায়?

কিছু লোকের দেখা পাওয়া যায় যারা নিজেদের অন্যদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রাখতে চায়, লোকজনের সঙ্গ তেমন পছন্দ করেনা, সামাজিকতা এড়িয়ে চলে। এর একটা হেতু এমন হতে পারে যে কোন বিশেষ কারণে সে হীনমন্যতায় ভুগছে (কোন রোগব্যাধি, কোন অপরাধের লজ্জা, অথবা অন্য কোন কলংক যা সে ঢেকে রাখতে চায়)। এই ধরনের লোকদের পরিচয় সর্বদাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

সমাজে কিছু লোক আছে যারা অতি সাধারণ, সাধাসিধা অর্থাৎ অর্ডিনারী লোক বলে মনে হয়, এদের নিয়ে কোন ঔৎসুক্য মনে জাগে না। কিন্তু সময় বিশেষে অন্য লোকের মুখে অথবা পত্রপত্রিকায় অথবা টিভি’র পর্দায় এদের সম্পর্কে অতি প্রশংসনীয় সব কর্মকান্ডের, অবদানের, স্যাক্রিফাইসের খবর প্রকাশিত হয়ে আমাদের বিস্মিত করে তোলে, তারা প্রশংসার পাত্র রূপে দেখা দেয়। আমরা তাদেরকে নূতন দৃষ্টিতে দেখি, নূতন ভাবে পরিচয় লাভ করি এবং তাদের শ্রদ্ধা করতে শুরু করি। এরা হচ্ছেন অপর শ্রেণী যারা তাদের মহৎ গুণাবলী জনসাধারণের চোখের আড়ালে রাখতে চান। এরা হলেন সব নীরব কর্মী, মহৎ হৃদয়ের অধিকারী, সমাজের গর্বের বস্তু। এরা নিজের ঢোল নিজে কখনো বাজান না।

আমাদের পরিচয় হলো যে আমরা মানুষ, সৃষ্টির মাঝে আমরাই সেরা। আমাদের বুদ্ধি আছে, বিবেক-বিবেচনা আছে, ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দের পার্থক্য আমরা বুঝি, দয়া-মায়া-সহানুভূতি-উদারতা, পরের দুঃখ ঘুচাতে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি আমাদের সহজাত গুণাবলী। পশুত্ব আমাদের ধর্ম বা প্রকৃতি নয়, তাই আমরা মানুষ। মনুষ্যত্বের নানা গুণের অধিকারী হয়ে আমাদের পরিচয়ের গন্ডিটা ক্রমেই প্রসারণের চেষ্টা থাকতে হবে। কর্মেই মানুষের পরিচয়, বংশ মর্যাদার নয়। জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা যে মানুষ তার প্রমাণ দিতে কুন্ঠা বোধ করি অথবা অবহেলা করি। বিবেকের তাড়নাটার টুঁিট চেপে ধরে রাখি, ফলে বহু অন্যায় ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। আমাদের এই অসমর্থনযোগ্য ব্যবহারের পেছনে কাজ করে আমাদের বিভেদপ্রবণ সামাজিক কাঠামো, যথা ধর্মীয় বিভেদ, ধনী-দরিদ্র বা শিক্ষিত-অশিক্ষিতের বিভেদ, রাজনৈতিক বিভেদ, আপন-পরের বিভেদ, কুসংস্কার ইত্যাদি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই, সব মানুষ সমান এই মহাসত্যটাকে আমরা বেমালুম ভুলে যাই। ফলে দেশে ও সমাজে শতরকম প্রতিরোধযোগ্য অন্যায়-অত্যাচার অহরহ ঘটে যাচ্ছে, আমরা চোখ-কান বন্ধ করে না দেখা না শোনার ভান করে থাকি। মানুষ হিসেবে এমন বিবেকহীন নীরবতা মোটেই কাম্য নয়, নয় তা প্রশংসনীয়।

দান, দয়া, উদারতা, কুসংস্কারহীনতা হচ্ছে মহৎ গুণ যা আমাদের মাঝের মনুষ্যত্বের বিকাশ; এগুলো হতে হবে সর্বব্যাপী, শ্রেণী-গোষ্ঠী-ধর্ম নির্বিশেষে হতে হবে তার প্রয়োগ এবং তাতেই সেই ব্যক্তির সত্যিকারের পরিচয়টা সর্ব সাধারণের সম্মুখে ফুটে উঠবে। আমরা সবাই সমভাবে এসব মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে পারবো এমনটা বলা যাবে না, তবে নিজেকে একজন উত্তম মানুষ বলে সমাজে পরিচিত/প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা থাকলে এবং চেষ্টা থাকলে সেই লক্ষ্যের দিকে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের সবারই সেই বাসনা এবং সাধনা থাকা বাঞ্ছনীয়।

টীকা ঃ                সর্বশেষে একটা হিন্দি মুভির সংলাপ : 

                তাসবীরসে শকল্‌কা পাতা লাগ্তা হ্যায়, আকল্‌কা নেহী (ফটো দেখে মানুষের চেহারাটা বোঝা যায় বটে কিন্তু তার জ্ঞান-বুদ্ধির পরিমাপ করা যায় না।) অর্থাৎ ফটো দেখার চেয়ে চাক্ষুস পরিচয়টা অধিকতর জরুরী। কথাটা সত্য। শুধু ফটো দেখে বিয়ের পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনের বহুল প্রচলিত প্রথাটার ত্রুটিটা (defect/disadvantage) এই সংক্ষিপ্ত সংলাপ থেকে স্পষ্ট ধরা পড়ে। সুতরাং পরিচয়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বয়সের হিসাব

আপনার বয়স কত এখন? হাউ ওল্ড আর ইউ নাও? প্রশ্নটা জটিল নয় মোটেও অথচ এর উত্তর পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম।

অতীতের বাংলাদেশে আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে গ্রামের কোন বুড়ো বা বুড়িকে এই প্রশ্নটা করা হলে সচরাচর এই ধরণের উত্তর পাওয়া যেতো-

–              পাঁচ কম চার কুড়ি (৭৫) বছর।

–              তিন কুড়ি (৬০) বছর পার হয়ে গেছি, অথবা

–              দুই কুড়ি দশ (৫০) বছর।

৫০/৬০/৭০ সংখ্যাগুলোর সংগে ওদের পরিচয় ছিল না কারণ ওরা ছিল অশিক্ষিত জনগণ। এবং “কুড়ি” বা ২০ সংখ্যাটাকে গণনার ক্ষেত্রে একটা standard unit বলে গণ্য করা হতো বিভিন্ন ধরণের লেনদেনের ক্ষেত্রে, যেমন এক কুড়ি আম অথবা এক কুড়ি কৈ মাছ ইত্যাদি।

অপরদিকে অন্য ধরনের উত্তরও শোনা যেতো।

–              বড় বানের বছর (বন্যার বছর) আমার জন্ম।

–              দুর্ভিক্ষের বছর আমার জন্ম, অথবা

–              বড় ভূমিকম্পের বছর আমার জন্ম।

অর্থাৎ বিশেষ কোন অতি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংগে সম্পর্ক স্থাপন করে বয়সের হিসাবটা বের করতে হতো।

জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ করে বার্থ সার্টিফিকেট দেশের সরকার তখন ইস্যু করতো না। যারা প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হতো বিদ্যালাভ করার জন্যে তাদের মা-বাবা একটা তারিখ বলে দিত এবং সেটাই Admission Register-এ লিখে নেয়া হতো এবং ভবিষ্যতেও তার জন্মতারিখ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অথবা বিশেষ প্রয়োজন হলে একজন এডভোকেটের মাধ্যমে affidavit করে একটা বার্থ সার্টিফিকেট তৈরী করে নেয়া হতো যা দেশের সরকারের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিল। পাসপোর্ট ইত্যাদিতে সেই তারিখটাই ব্যবহার করা হতো।

এখন যুগ পালটে গেছে। বার্থ সার্টিফিকেট আজকাল অনায়াসেই পাওয়া যায় যদি শিশুর জন্ম তারিখটা সংশ্লি­ষ্ট সরকারী অফিসে যথাসময়ে জানিয়ে দেয়া হয়। এটা বর্তমান যুগে পৃথিবীর সর্বদেশেই একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে। এটা ছাড়া সবকিছুই অচল, সকল সুযোগ-সুবিধা হাতের নাগালের বাইরে থেকে যায়। কোন দেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হলে এই বার্থ সার্টিফিকেটই হচ্ছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দলিল। হাসপাতালে শিশুটির জন্ম হলে বার্থ সার্টিফিকেট হাতে পাওয়া সহজ হয়।

“আপনার বয়স কতো হলো?” এই প্রশ্নটার নানা ধরনের উত্তর বর্তমান যুগেও পাওয়া যায়। কোন নারীকে এই প্রশ্ন করাটা একটা অভদ্রতা। যদি করাও হয়, সেই নারী মিষ্টি হেসে বলবেন ঃ অনুমান করে নিন। অথবা কিছুই না বলে চুপ করে থাকবেন। আধুনিকাদের মুখে কখনো কখনো ইংরেজী ভাষায় রহস্যময় একটা উত্তরও শোনা যায় Twenty-nine and counting অথবা 33 and counting  অর্থাৎ আপনি অনুমান করে নিন।

পুরুষদের মাঝেও কখনো কখনো বয়সটা না বলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। “আমার বয়স জেনে আর কি হবে?” জাতীয় উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে যান কেউ কেউ। আবার কারো কারো মাঝে প্রসংগ/মওকা পেলেই কেউ প্রশ্ন না করলেও নিজের প্রবীণত্বটা জাহির করার আগ্রহটা বড় প্রবল।

অনেকদিন একটা কিছু নিয়ে আলোচনা চলাকালে এক ভদ্রলোক বারবার বলতে লাগলেন ঃ “বয়স হয়ে গেছে তো, সব কিছু মনে থাকেনা; বয়স হয়ে গেছে তো, সবকিছু মনে থাকেনা”। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ঃ জানতে পারি কি আপনার বয়স কত? তিনি বললেন ঃ সাতান্ন বছর। শুনে বললাম ঃ আমার বয়স এখন ৭৫ বছর, আমি তো নিজেকে বৃদ্ধ বলে মনে করি না। শুনে তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন ঃ কি! ৭৫ বছর!!

বৃদ্ধ স্বামীস্ত্রী উপস্থিত। আমাদের মাঝে সম্পর্কটা অতি মধুর। দু’জনকেই জিজ্ঞাসা করলাম ঃ আগামী জন্মদিনে বয়স কত হবে আপনাদের? মহিলা বললেন ঃ আমায় বয়স এখন ৭৭ বছর। স্বামী মহাশয় চুপ। জিজ্ঞাসা করলাম ঃ আপনি চুপ কেন? এবারো জবাব দিলেন তার স্ত্রী। বললেন ঃ ও আমার চেয়ে বয়সে ছোট একথাটা প্রকাশ করতে সে লজ্জা পায় বিয়ের পর থেকেই। অথচ সব জেনেশুনেও বিয়ের আগে প্রেম করার সময় হুশ ছিল না বাবুর। যত লজ্জা সব এখন, বলে তার বক্তব্য শেষ করলেন মহিলা।

বিষয়টা আর কিছুই নয়, আমাদের চিরাচরিত সামাজিক প্রথা বা কালচারের প্রকাশ মাত্র। স্ত্রীর বয়স স্বামীর চেয়ে কম হয়ে থাকে এটাই আমাদের Indian subcontinental culture, নিতান্ত ব্যতিক্রম ছাড়া, যা এই দম্পতির ক্ষেত্রে ঘটেছে। তাই এই লজ্জার অনুভূতি বৃদ্ধের মনে।

এক জানাশোনা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম ঃ আপনার সহকর্মিনী অমুকের (অপর এক মহিলা) বয়স কত? তিনি বললেন ঃ “আমরা দু’জনই সমবয়সী”। অতএব দু’জনের বয়সই অজ্ঞাত রয়ে গেল।

অন্য ঘটনা।

ভদ্রলোকের বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হবে অচিরেই। তার মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানের ইচ্ছা বেশ ঘটা করে তার ৫০ তম জন্মবার্ষিকীটা উদযাপন করা। কিন্তু তিনি নারাজ। কি কারণ? না, এটা আমার গোপন খবর, একান্তই আমার এবং আমার পরিবারের, আমার বয়সটা তাই বাইরের কাউকে জানাতে চাই না। বেশ তাই হোক। চুপচাপ ঘরোয়া অনুষ্ঠানই করা হলো।

২০১২ সনের ঘটনা। একই পরিবারের তিন সদস্যেরই বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে সে বছরের কোন এক মাসে, তারিখগুলো খুবই কাছাকাছি। তিনটা আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান বড় খরচের ব্যাপার, তাছাড়া পরিশ্রমেরও। জাঁকজমক করেই জন্মবার্ষির্কী পালনের ইচ্ছা তিন জনেরই। তাদের বয়স অন্যদের জানাতে কোন আপত্তি নেই। সুতরাং চিন্তাভাবনা  শুরু হয়ে গেল – কি করা যায়? একের ভেতরে তিন করা হবে, না আলাদা আলাদা করা হবে? শেষে অবশ্য একই তারিখে উদযাপন করা হলো বেশ ঘটা করে।

এবার একটা joke শুনুন।

বৃদ্ধা নানীকে ছ’বছর বয়েসী নাতনি জিজ্ঞাসা করল ঃ নানী, তোমার বয়স কত?

নানী ঃ আমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছি তো, বয়সটা মনে করতে পারছি না।

নাতনি ঃ নো প্রোব্লেম! তোমার প্যান্টিজের ভেতরে দেখ, পেয়ে যাবে। আমারগুলোর ভেতরে লেখা আছে 5 to 6!

বাংলা ভাষা ও বাংগালী

পরীক্ষার রেজাল্টস্ হাতে বাড়ি ফিরল ছেলে,

বাপ-মা শুধায়, কোন বিষয়ে কত নম্বর পেলে?

হিস্ট্রিতে, মম্, এইটি-ফোর

ম্যাথ্সে নাইন জিরো,

মা বললে, ফ্যান্টাসটিক! ইউ আর মাই হিরো!

সাইন্সে, ড্যাড, নট সো ফেয়ার

ওনলি সিকস্টি-নাইন,

ইংলিশেতে নাইন্টি-টু,

অলটুগেদার ফাইন!

জিওগ্রাফির পেপারটাতে হান্ড্রেডে হান্ড্রেড,

ডুবিয়ে দিল বেঙ্গলীটাই

ভেরি পুওর গ্রেড।

ছেলের মাথায় হাত রেখে মা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে,

নেভার মাইন্ড, বেঙ্গলীটা না শিখলেও চলে।

বাপ বললে, বেশ বলেছ বঙ্গমাতার কন্যে,

বাংলা-টাংলা তো আমার মত অশিক্ষিতের জন্যে।

বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ নেহাৎ ছিলেন বোকা,

না হলে কেউ সখ করে হয় বাংলা বইয়ের পোকা!

মা বললে, চুপ করো তো! ওর ফল্টটা কিসে?

স্কুলে কেন বেঙ্গলীটা শেখায় না ইংলিশে?

কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ ইষ্ট ইয়র্কের (টরন্টো) গাওয়ার ষ্ট্রীটের হারমনি হল সিনিয়র্স ক্লাবের প্রবীণতম সদস্য আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহাদেব চক্রবর্তী মহাশয় এই কবিতাটা একদিন আমাকে তাঁর স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন এবং আমি সেটা সংগে সংগে লিখে নিয়েছিলাম। (চলবে)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা