তাসের আড্ডা-২১

শুজা রশীদ

“শালা পুটিন ইউক্রেন আক্রমণ করেই বসল তাহলে,” জালাল মুখখানা খুব ব্যাজার করে বলল। “ভেবেছিলাম হয়ত ফাউ ফুটানি দেখাচ্ছে ইউক্রেনকে একটু ভয় পাওয়ানোর জন্য। কন্তু এখন তো দেখছি ব্যাটা প্রথম থেকেই এই প্ল্যান নিয়েই এগুচ্ছিল।”

                ওন্টারিওতে কোভিড সংক্রান্ত বিধি নিষেধ স্বল্প পরিমাণ শিথিল হবার ফলে এই সপ্তাহে আবার রনিদের তাসের আড্ডা ভার্চুয়াল থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছে। এখনও ভাইরাসে যথেষ্ট মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে এবং বেশ কিছু মানুষ প্রতিদিন মারাও যাচ্ছে, কিন্তু তারপরও যেহেতু প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ নিদেন পক্ষে একটা ভ্যাকসিন নিয়েছে সেই কারণে সরকারকে একরকম বাধ্য হয়েই নিয়ম কানুন শিথিল করতেই হচ্ছে।

                রনি বলল, “অচিন্তনীয়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এইভাবে কোন যথাযথ কারণ ছাড়া আর কোন দেশ অন্য একটি দেশকে আক্রমণ করেনি। ইউরোপে তো নয়ই।”

                সাইদ বলল, “ভুলে যেও না আমেরিকা আফগানিস্তান এবং ইরাক আক্রমণ করেছিল। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে টেররিস্ট আক্রমণের পর আফগানিস্তান আক্রমণ করার পেছনে তাদের যুক্তি ছিল সেখানে তালেবানরা ওসামা বিন লাদেন সহ অন্যান্য আল-কায়েদার নেতাদেরকে ছত্রচ্ছায়া দিচ্ছিল।  কিন্তু ইরাক আক্রমণের পেছনে যুক্তি তত দৃঢ় ছিল না। সাদ্দাম হোসেন নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরী করছে শুধুমাত্র সেই সন্দেহে ভুলভাল ইন্টেলিজেন্সের উপর নির্ভর করে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সুতরাং, রাশিয়া আর অভিনব কিইবা করছে? ইউক্রেন একবার ন্যাটোতে যদি কোনভাবে যোগ দিয়ে ফেলে তাহলে সেখানে কিছু করাটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এখনই মোক্ষম সময়।”

                জিত বলল, “রাশিয়াও কিন্তু আফগানিস্থান আক্রমণ করেছিল ১৯৭৯ সালে তৎকালিন কমিউনিস্ট সরকারের সমর্থনে। দশ বছর ধরে মুজাহিদিনদের সাথে যুদ্ধ করে নাস্তানাবুদ হয়ে হেরে ফিরে গিয়েছিল।”

                কবীর বলল, “ইউক্রেন কি পুটিনের আফগানিস্থান হয়ে যেতে পারে? আফগানিস্তানে ১৫০০০ রাশিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছিল এবং ৬০০০০ আহত হয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে লেজ গুটিয়ে পালানোর বছর তিনেকের মধ্যেই ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। আফগানিস্তানে যারা যুদ্ধ করেছিল তাদেরকে মানুষজন পরবর্তিতে অপ্রীতিকর দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে।”    

                জালাল বলল, “কিন্তু সেই সময়ে আফগানিস্তানকে আমেরিকা সরাসরি সাহায্য করেছিল, তাই না? আমেরিকার সাহায্য না পেলে তো মুজাহিদিনরা রাশানদেরকে হারাতে পারত না।”

                সাইদ বলল, “আসলে আমেরিকা সরাসরি ঐ যুদ্ধে জড়ায় নি। তারা পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছিল। রাশিয়া আফগানিস্তানে ঢোকার দুই সপ্তাহর মধ্যে জিমি কার্টার পাকিস্তানের জিয়াউল হকের সাথে একজোট হয়ে সেখানে আফগানিস্তানী যোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। পাকিস্তানের আই এস আই হয়ে ওঠে মুজাহিদিনদের প্রধান সহকারী শক্তি। আমেরিকা এবং সৌদি আরব পর্দার আড়াল থেকে অর্থ আর সরঞ্জাম দিয়ে পূর্ণ সহায়তা করে যায়। ব্রিটেনও অস্ত্র এবং ট্রেনিং দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ করেছিল আফগানিস্তানীরাই। যথাযথ হিসাব পাওয়া কঠিন কিন্তু এক মিলিয়নের মত আফগানরা নিহত হয়েছিল, কয়েক মিলিয়ন বাস্তুছাড়া হয়েছিল। সে তুলনায় তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ক্ষয়-ক্ষতি ছিল যৎসামান্য। এখন কথা হচ্ছে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এবং সাধারণ মানুষ জন কি একই ভাবে হাতে অস্ত্র তুলে নেবে? ন্যাটো-ইবা কতখানি সাহয্য করবে? এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। কিন্তু অধিকাংশটাই নির্ভর করবে ইউক্রেনের মানুষজনের মনবলের উপর।”

                লাল ভাই এইবারের আড্ডায় আসতে পেরেছে। সে জানিয়ে দিয়েছিল ভার্চুয়ালে তার পোষাবে না। এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, সবার কথা শুনছিল। এবার বলল, “এরা যে সব দেশ মিলে স্যাংশন দিচ্ছে, তাতে কাজ হবে না?”

ইউক্রেনে রাশিয়া কর্তৃক হামলার প্রতিবাদে টরন্টোতে প্রতিবাদ মিছিল। ছবি: কাবিলান মৌলিধরন / গ্লোবাল নিউজ

                জিত বলল, “স্যাংশনে কিছু কাজ অবশ্যই হবে। ইতিমধ্যেই রাশিয়ার শেয়ার মার্কেটের মূল্য প্রায় ৪০% কমে গেছে। আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাশিয়ান ব্যাংকিং সিস্টেম এবং রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যবসা বন্ধ করেছে কিংবা করবার পদক্ষেপ নিচ্ছে। রাশিয়ার ধনকুবেরদের উপরেও খড়্গ নামানো হয়েছে। এরাই পুটিনের অর্থের যোগান দেয়। তারপর সুইফট মেসেজিং সিস্টেম থেকে রাশিয়ার বেশ কিছু ব্যংককে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে রাশিয়ার ব্যবসা-বানিজ্যে এই স্যাংশনের একটা বড়সড় বিরুপ প্রতিক্রিয়া তো পড়বেই। কিন্তু সমস্যা হল, স্যাংশনের ফলাফলটা ঝট করে হয় না। সময় লাগে।”

                রনি বলল, “পুটিন তো এখন আবার নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ভয় দেখাচ্ছে।”

                “সরাসরি না দেখালেও একটু বাঁকা করে তো দেখাচ্ছেই,” সাইদ বলল। “সে বলছে পশ্চিমা শক্তিগুলো নাকি উগ্র, বিধ্বংসীমূলক মন্তব্য করেছে তাই সে রাশিয়ান ডিটার‌্যান্স ফোর্সকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে। নিউক্লিয়ার অস্ত্রও তার মধ্যে পড়ে। সে কোন যথাযথ কারণ ছাড়া আক্রমণ করেছে একটা সার্বভৌম দেশকে, এখন চেষ্টা করছে একটার পর একটা অজুহাত বের করে সেটাকে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রমাণ করতে।”

                জালাল বলল, “রাশিয়ান সাধারণ মানুষেরা কি সত্যি সত্যিই এই যুদ্ধ চায়? মনে তো হয় না। সেখানে শহরে শহরে মানুষজন রাস্তায় নেমেছে প্রতিবাদ করতে। কয়েক হাজার মানুষ নাকি গ্রেফতারও হয়েছে। পুটিন কি জনমতের মূল্য দেবে না?”

                জিত হাসল। “রাশিয়ানদের চিনতে আপনার এখনও বাকী আছে। হ্যাঁ, সেখানে বেশ কিছু মানুষ প্রতিবাদে মুখর কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না, যখন থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের চারদিকে সৈন্য সমাবেশ করতে শুরু করেছে তখন থেকে পুটিনের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। ২০২১ এর আগস্টে ওর জনপ্রিয়তা ছিল ৬১%। এখন সেটা ৬৯%। তার বিরোধীদের সংখ্যা সেই সময়ে ছিল ৩৭%। এখন সেটা কমে এসেছে ২৯% এ।”

                সাইদ বলল, “তার কারণ সরকারী মাধ্যম গুলোতে সমানে মিথ্যা প্রচার চালানো হয়েছে। ইউক্রেনকে দেখানো হয়েছে প্রাক্তন রাশিয়ার একটা অংশ যা এখন শত্রুর সাথে হাত মেলাতে চায়। সাধারণ মানুষের দেশাত্ববোধকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে মিথ্যা বানোয়াট তথ্য দিয়ে। কিন্তু ইতিহাসে দেখা গেছে এই জনপ্রিয়তা খুব বেশিদিন থাকবে না। রাশিয়ানরা হয়ত ভাবছে যেহেতু রাশিয়ার সামরিক শক্তি ইউক্রেনের চেয়ে অনেক বেশী, এটা ঠিক তথাকথিত যুদ্ধের মত হবে না। ঝট করেই শেষ হয়ে যাবে। কেউ বুঝতেও পারবে না। প্রাণহানির সম্ভাবনা কম। কিন্তু এই যুদ্ধ যদি কোন কারণে গড়াতে থাকে আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্যাংশন বজায় থাকে তখন মানুষের টনক নড়বে। কারণ সত্যি কথা হচ্ছে রাশিয়া যতই তড়পাক রাশিয়ার অর্থনীতি বেশ ছোটই। জি ডি পি র‌্যাঙ্কিংয়ে তারা ১১ নাম্বারে। কানাডা ১০ নম্বরে। অথচ রাশিয়ার জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে প্রায় একশ মিলিয়ন বেশী। কিন্তু ওদের একটা বড় জোর হচ্ছে তেল এবং গ্যাস। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে জার্মানী তার উপর অনেক নির্ভরশীল। ইচ্ছা করলেই সব সম্পর্ক তারা ছিন্ন করে চাইবে না। তাতে তেল এবং গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে পৃথিবীময়। বিরুপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।”

                কবীর যোগ করল, “আবার একদল বলছে তেল এবং গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে তখন রাশিয়া হয়ত চীনের কাছে বেশী দামে বিক্রী করে আরোও বেশী উপয়ার্জন করবে।”

                রনি হতাশ কন্ঠে বলল, “বিশ্ব অর্থনীতি এখন খুবই জটিল। সব কিছু এমনভাবে প্যাঁচানো যে একদিকে টান দিলে অন্য দিকেও তার প্রভাব পড়ে। কিন্তু তাই বলেতো এমন একটা অন্যায় মেনে নেয়া যায় না।”

                লাল ভাই বলল, “এই খবর শোনার পর আমার শুধু মনে হচ্ছে কোন কারণে যদি ভারত বাংলাদেশ আক্রমণ করে বসে তাহলে তো এইরকমই হবে অবস্থাটা, তাই না? রাশিয়ার কছে ইউক্রেন যেমন ভারতের পাশে আমরাওতো তেমনই চুনোপুটি, তাই না?”

                সাইদ বলল, “ভারতের বাংলাদেশ আক্রমণ করবার কোন কারণ এখন নেই পরবর্তিতেও কখন হবার কোন সম্ভাবনা দেখি না। আর সামরিক শক্তির দিক থেকে তুলনা করলে রাশিয়া ইউক্রেনের চেয়ে কম করে হলেও পাঁচগুণ বেশী শক্তিশালী। ভারতের সামরিক শক্তি আমাদের চেয়ে দশগুণের বেশী হবে।”

                জালাল বিরক্ত কন্ঠে বলল, “লাল ভাই, আপনার যত উল্টাপাল্টা কথা। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে আপনি খামাখা বাংলাদেশ-ভারত টানছেন কেন?”

                লাল ভাই লজ্জিত কন্ঠে বললেন, “কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বলি নাই। তুলনাটা মাথায় এলো তাই বলে ফেললাম। তা আজ আপনাদের তাস খেলা হবে না?”

                জালাল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “নাহ, তাস খেলার মন পাচ্ছি না। আমার কিছু পরিচিত মানুষজন আছে যারা ইউক্রেনের। একজনের সাথে আলাপ হল। খুবই ভেঙে পড়েছে। তার পরিবারের সবাই সেখানে। আমরাতো এখানে বসে খবর পড়ছি, টিভিতে বিস্ফোরণ দেখছি কিন্তু যারা সেখানে আছে তাদের জীবনের তো এই মুহুর্তে কোন নিরাপত্তা নেই।”

                আজকের জমায়েত হচ্ছে রুমা-সাইদের বাসায়। মেয়েরা কাছেই আরেক টেবিলে গোল হয়ে বসে আড্ডা মারছিল। রুমা রান্নাঘরের প্রশস্ত কোয়ার্টজের কাউন্টারের উপর খাবার দিয়েছে। বুফে। সে এসেছিল ছেলেদেরকে খাবারের ডাক দিতে। যুদ্ধের কথা শুনতেই থমকে দাঁড়াল।  “এই পুটিন লোকটা কি অসভ্য বলেন তো? এমনিতেই সবাই এই কোভিড নিয়ে তটস্থ হয়ে আছে। এখন শুরু হল আরেক ঝামেলা। কত মানুষ মারা যাবে কে জানে? আমরা কি কিছু করতে পারি না?”

                রনি বলল, “কানাডা তো ইতিধ্যেই ৪০০ রও বেশী রাশিয়ান ব্যক্তি এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে স্যাংশন করেছে। রাশিয়ায় কানাডিয়ান রফতানি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কানাডিয়ান আর্মড ফোর্সেস ইউক্রেনে মিলাটারি ট্রেনিং দিচ্ছে। কানাডিয়ান সরকার একটা ম্যাচিং ফান্ড প্রোগ্রাম শুরু করেছে। ইউক্রেনের জন্য যে কোন অর্থ দান করলে সরকার সম পরিমাণ অর্থ সেই ফান্ডে দেবে। আর কিছু না করতে পারলেও সেই ফান্ডে আমরা যে যা পারি দিতে পারি। সেই অর্থ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদেরকে সাহায্য করবার জন্য ব্যবহার করা হবে।”

                বেলা আর লতা এসে রুমার সাথে যোগ দিল।

                বেলা বলল, “এতো কিছুর মধ্যে আমাদের কানাডায় ট্রাক পার্টি যা করল তিন-চার সপ্তহ ধরে সেটা ঝট করেই চাঁপা পড়ে গেল। আমাদের পুলিশ বাহিনী যে এতো দূর্বল সেটা আমি আগে কখন ভাবিনি।”    

                রনি বলল, “আরে কানাডা কি চীন নাকি যে প্রতিবাদ করছে বলে তাদের উপর ট্যাংক তুলে দেবে?”

                বেলা চোখ পাকাল। “এই, ওরা যখন রাস্তা ঘাট বন্ধ করে অটোয়াতে বারবিকিউ করছিল আর প্যপ প্যাপ করে হর্ন বাজাচ্ছিল তখন তো তোমার মাথায় মনে হয়ছিল আগুণ ধরে গেছে। এখন আমি বলছি বলে উল্টো সুর তুলছ?”

                রনি দূর্বল গলায় বলল, “আরে, দিনে পর দিন যখন রাস্তা ঘাট বন্ধ করে মানুষের জীবন দূর্বিষহ করে তুলছিল তখন তো আর সেটা প্রতিবাদ ছিল না। তখন হয়ে গিয়েছিল অবরোধ। সেটা কোন অবস্থাতেই আইন সঙ্গত ছিল না। যে কারণে প্রথম দিকে কিছু মানুষ হয়ত ওদেরকে অল্প বিস্তর সমর্থন করেছিল কিন্তু পরে অধিকাংশ কানাডিয়ানরাই ওদের বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। আমিও তাদের দলে ছিলাম।”

                সাইদ বলল, “বেলার প্রশ্ন ছিল আমাদের পুলিশ কেন আরোও আগেই কিছু করল না? তাদেরকে তিন সপ্তাহ কেন অপেক্ষা করতে হল? তাদের অক্ষমতার জন্যই এই সামান্য কারণে প্রধান মন্ত্রীকে এমার্জেন্সী ঘোষনা করতে হল। আমার ধারণা পুলিশ অকারণে বেশী ভয় পেয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করবার অধিকার আমাদের গণতান্ত্রিক পন্থার এক নাম্বার অধিকার। কিন্তু রাস্তা ঘাট বন্ধ করে একটা শহরকে অবরুদ্ধ করবার অধিকার কারো নেই। সুতরাং ট্রাকার এবং তাদের সমর্থনকারীরা যারা অবরোধের সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে এরেস্ট করবার অধিকার পুলিশের ছিল। কিন্তু পুলিশ চীফ ভয় পাচ্ছিল পরিস্থিতি যদি খারাপ দিকে মোড় নেয় তাহলে তার পক্ষে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তার ভয় অমূলক ছিল কিনা বলা কষ্ট।”

                লতা বলল, “কবীর তো বলে যে এটা আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির কিছু নির্বাচিত নেতাদের উষ্কানীতে হয়েছে। তারা নিজেরা ভ্যাক্সিনের বিরোধীতা করেছে, এখন আমাদের দেশে এসে একটা ঝামেলা পাকিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে যে কানাডিয়ানরাও তাদের সাথে একমত।”

                জিত বলল, “কবীর একেবারে ভুল বলে নি। এই অবরোধ করবার জন্য যত টাকা উঠেছিল তার প্রায় অর্ধেক নাকি এসেছে আমেরিকার ডানপন্থীদের কাছ থেকে। ঐ টাকা না আসলে এদের পক্ষে কি এইভাবে দিনের পর দিন গ্যাঁট মেরে বসে থাকা সম্ভব হত?”

                লাল ভাই বলল, “ট্রুডো ঠিকই করছে। এমার্জেনসী এক্ট ঘোষণা দেবার পরইতো অবস্থা একটু ভালোর দিকে গেল। ওদের টাকা পয়সা আসার পথ বন্ধ হয়ে গেল। ওদের নেতারাও লেজ গুটিয়ে পালানো শুরু করল।”

                সাইদ বলল, “এমার্জেন্সী এক্ট ঘোষণা করার পেছনে সেটাই ছিল প্রধান কারণ। ওদের টাকা পয়সা আসার রাস্তা বন্ধ করা, ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়া। তবে মোদ্দা কথা হল, অবৈধ অবরোধকারীদের সরানোর দায়িত্ব পুলিশের উপরেই বর্তায়। তা সেটা শান্তিপূর্ণভাবেই হোক আর হাত ময়লা করেই হোক।”

                বেলা বলল, “ঐ ট্রাকাররা সারা দেশব্যাপী যা করছিল যেমন এম্ব্যাসাডর ব্রিজ বন্ধ করে দেয়া – এটাতো পুরো দস্তুর টেররিজমের মত। যদি একদল মুসলমান এইভাবে কোন একটা ব্রিজ বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করত তাহলে তো আমার ধারনা সাথে সাথে আর্মি চলে আসত তাদেরকে টেররিস্ট আখ্যা দিয়ে। আসত না?”

                জালাল মাথা দোলাল। “কথাটা মন্দ বলেন নি। এই ট্রাকাররা যা করেছে সেটাতো এক রকম মানুষের মনে আতংক সৃষ্টি করবার জন্যই।”

                রুমা বলল, “এইসবের ফলে অনেকের মনেই আমাদের পুলিশের উপর আর আগের মত আস্থা নেই।  সামান্য প্রতিবাদ ঠেকাতে যদি আর্মি ডাকতে হয় তাহলে এতো টাকা পয়সা দিয়ে পুলিশ রাখার দরকার কি?”

                সাইদ বলল, “পুলিশের কাজ হচ্ছে আইন শৃংখলা রক্ষা করা। অনেক সময় কোন প্রতিবাদের পেছনে যদি রাজনৈতিক কারণ থাকে তখন তাদেরকে একটু সাবধানে এগুতে হয়। এই পুরো ব্যাপারটার পেছনে ছিল কোন এক মহলের ষড়যন্ত্র যারা এই ভাইরাস নিয়ে রাজণীতি করতে নেমেছে। যেখানে প্রায় আশি ভাগ মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে এবং তেমন কোন সমস্যাই হয় নি, সেখানে কিছু মানুষ অকারণে এর বিরোধীতা করছে সেটাইতো একটা হাস্যকর ব্যাপার। তারা রাস্তায় না নেমে যদি ভ্যাকসিন নিয়ে নিত তাহলে আমাদের জীবন আরোও অনেক তাড়াতাড় সহজ স্বাভাবিক হয়ে যেত।”

                রনি তিক্ত কন্ঠে বলল, “এক দল মানুষ আছে তারা হচ্ছে সব কিছুতে না-না করতে পছন্দ করে। তাদেরকে আপনি বিজ্ঞান কিংবা যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝাতে পারবেন না। নিজের ব্যক্তি স্বাধীনতার ধোঁয়া তুলে তারা যখন অন্যদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করে তখন তারা এমন ভাব করে যেন সেটাই স্বাভাবিক।”

                জিত বলল, “আচ্ছা, এই এন্টাই ভ্যাকসিন নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন এর উপর একটা জোক বলি”।

                এক ইঞ্জিনিয়ার আর এক এন্টাই-ভ্যাক্সার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা নদীর তীরে এসে হাজির হয়েছে। নদীতে কুমীর কিলবিল করছে। নদীর উপরে একটা নড়বড়ে সেতু।

                এন্টাই-ভ্যাক্সার ইঞ্জিনিয়ারকে জিজ্ঞেস করল, “এই সাঁকো ব্যবহার করে আমাদের নিরাপদে অন্য পারে যাবার সম্ভাবনা কতখানি?”

                ইঞ্জিনিয়ার সাঁকোর অবস্থা বিবেচনা করে প্রচুর হিসাব কিতাব করে বলল, “৯৯.৯৭%।”

                এই কথা শুনে এন্টাই-ভ্যাক্সার ঠোঁট উল্টাল। “১০০% না? যাহ্, তাহলে আমি ঐ সাঁকো ব্যবহার করব না।”

                ইঞ্জিনিয়ার অবাক হয়ে জানতে চাইল, “এ ছাড়া তো আর কোন উপায় নেই। ওপারে যাবে কিভাবে?”

                হাসল এন্টাই-ভ্যাক্সার। “কেন, সাঁতার কেটে!”

শুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

টরন্টো