টরেটক্কা টরন্টো

কানাডাতে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদের পুনরুত্থান -১

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

২০০২ সালের নভেম্বর মাস। আমরা তখন সিঙ্গাপুরে থাকি, কানাডার ইমিগ্রেশনের দরখাস্ত করে অপেক্ষায় আছি কখন ভিসার জন্য ডাক পড়বে। ঠিক ঐ সময়টায় চীনে এক নতুন ধরণের রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে যার নাম আগে কখনও শোনা যায়নি। রোগটি হচ্ছে ‘সিভিয়ার অ্যাকুট রেসপারেটরি সিনড্রোম’ বা সংক্ষেপে ‘সার্স’। ফ্লু-এর সিনটোম দিয়ে অর্থাৎ জ্বর-জ্বর ভাব, মাসল পেইন, কাশি এবং গলা ব্যথা দিয়ে শুরু হলেও অল্প কিছুদিনের ভিতর সার্স আক্রান্ত রোগীর তীব্র শ্বাস কষ্ট দেখা দিতে পারে এবং শেষে নিউমোনিয়াতে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। চীনের কোয়ানতং প্রদেশের ফোশান শহরে সার্সের প্রাদুর্ভাব হলেও অল্প সময়ের ভিতর রোগটি চীন সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। সেই ধারাবাহিকতায় এক সময় সিঙ্গাপুরেও সার্সের ঢেউ এসে পড়ে। সিঙ্গাপুর সরকার সার্সের প্রকোপ থেকে তার জনগণকে রক্ষার জন্য বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়। প্রথমত স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, শপিং মল সহ সমস্ত পাবলিক প্লেসে ঢোকার মুখে ইনফ্রারেড ক্যামেরার মাধ্যমে কারো জ্বরের উপসর্গ আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য বুথ বসায়। দ্বিতীয়ত প্রতেক হাউজহোল্ডে বিনামূল্যে দুটি করে ডিজিটাল থার্মোমিটার হোম ডেলিভারি দেয়, যাতে করে সবাই প্রতিদিন নিয়ম করে দুই বেলা নিজের জ্বর নিজেই পরীক্ষা করতে পারে। কেউ যদি মনে করে তার জ্বর এসেছে তবে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে সেলফ-কোয়ারাইনটিনে থাকতে হবে। কিন্তু এত সব সাবধানতা নেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ২৩৮ জন এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ৩৩ জন। এই রোগীদের সিংহভাগই ছিল এথেনিক চাইনিজ। শুধুমাত্র চাইনিজরা কেন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সেটা নিয়ে তখন বেশ জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে যায়। এথেনিক ইন্ডিয়ান এবং মালেয়রা তাদের খাবারে কারি পাউডার বা হলুদের মসলা ব্যবহার করে যা কিনা চাইনিজদের খাবারে থাকে না। এক সময় মনে করা হয় যে খাবারে হলুদের মসলার থাকার কারণেই ইন্ডিয়ান কিংবা মালেয়দের সার্স স্পর্শ করতে পারছে না। তাই চাইনিজরাও তাদের খাবারের মেন্যুতে ইন্ডিয়ান কারি যোগ করে নেয়। এই খাবারের জন্য কিনা জানি না, স্বাস্থ্য সচেনতার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে সার্স কিন্তু মোটেই প্রবেশ করেনি। ইন্ডিয়াতে মোট ৩ জন আক্রান্ত হলেও কেউ মারা যায়নি। চীন এবং হংকং-এ সার্সের ক্যাজুয়ালিটি ছিল সবচেয়ে বেশী। তারপরে ছিল তাইওয়ান এবং কানাডা। সেই সময় অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা হয় যে সার্স একটি কৃত্রিমভাবে ল্যাবে তৈরি করা ভাইরাস যার লক্ষ্য হচ্ছে এথেনিক চাইনিজ। এই ধারণা থেকেই ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’-এর আশঙ্কা যে সত্যি সেটা আলোচনায় চলে আসে এবং নানা রকম কনসপিরাসি থিওরীর জন্ম নিতে থাকে। এই সময় মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেইটসকেও নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায় কারণ তিনি তখন তার কমপিউটারের ব্যবসা ছেড়ে পৃথিবী থেকে পোলিও রোগ দূর করার জন্য ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণায় অর্থ যোগান দেয়া শুরু করেছেন।

সেন্ট্রাল ভার্জিনিয়ার শার্লটসভেলে কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট লি-এর স্ট্যাচু অপসারণ ঘটনার প্রতিবাদে উগ্রবাদী ফার-রাইট এবং এন্টি-ফ্যাসিস্ট অ্যাক্টিভিস্টের সদস্যদের মুখোমুখি অবস্থান (ছবি: ইন্টারনেট)

২০১৭ সালে চাইনিজ সায়েন্টিস্টরা সার্স ভাইরাসের উৎপত্তি হিসেবে চীনের ইউননান প্রদেশের ‘হর্স শু’ বাদুরকে শনাক্ত করেন। সার্স এপিডেমিক যদিও ২০০৪ সালেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে দেখা দেয় নতুন আরেক ভাইরাস যা কিনা সার্স ভাইরাসেরই নতুন একটি রূপ। সার্সের চেয়ে অনেকগুণ ভয়াবহ এই ভাইরাসটিকে প্রথমে করোনা ভাইরাস বলে অভিহিত করা হলেও পরে কোভিড-১৯ নামেই পরিচিতি পায়। ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের সাথে সাথেই উহান শহরে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং পুরো শহরকেই লক-ডাউন করে দেয়া হয়। এই লক-ডাউনের আগে আগে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইট উহান থেকে প্রায় একশত বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনে। বাংলাদেশের কৌতুহল প্রিয় জনগণ কোভিডের শঙ্কাকে থোড়াই কেয়ার করে তাদেরকে এক নজর দেখার জন্য নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে ভীড় জমায়। উহান শহরে লক-ডাউন দিয়েও শেষ রক্ষা হয় না, চীনের গণ্ডী পেরিয়ে কোভিড এক সময় ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, আমেরিকা সহ এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশে। এশিয়ার বাইরে প্রথম কোভিড রোগীর খোঁজ পাওয়া যায় ইটালীতে। দুইজন চাইনিজ ট্যুরিস্টের মাধ্যমে সেখানে কোভিডের অনুপ্রবেশ ঘটে। যেহেতু এই ভাইরাসটি অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে, তাই অল্প দিনের ভেতরই ইটালীতে কোভিড এপিডেমিকের আকার ধারণ করে। ইটালীর সরকার যখন লক-ডাউনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসবে সন্ধ্যা ছয়টায় রেস্টুরেন্ট, সিনেমা, শপিং মল, জিম ইত্যাদি বন্ধের ঘোষণা দেয় তখন দেশের বিভিন্ন শহরে পুলিশের সাথে ইটালিয়ান জনগণের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এই সংঘর্ষ জেলখানাতেও সংক্রামিত হয়। এক সময় এই সব সংঘর্ষে উস্কানীদাতা হিসেবে ফার-রাইট এবং মাফিয়া দলের নাম সংবাদপত্রে আসা শুরু করে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে ‘ফার-রাইট’ হচ্ছে উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গবাদীদের দল যার উৎপত্তি হয়েছে ২০১০ সালে আমেরিকান হোয়াইট ন্যাশনালিস্ট রিচার্ড স্পেন্সার-এর তৈরি করা ‘অলটারনেটিভ রাইট’ ওয়েব ম্যাগাজিন থেকে। এই সময় ফার-রাইটের জনপ্রিয়তা ইউরোপে বেড়ে যায় এবং তারই সূত্র ধরে ২০১১ সালে নরওয়ের নাগরিক অ্যান্ডার্স বেহরিং ব্রেইভিক প্রথমে ওসলোতে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে আটজন নিরীহ নরওয়েজিয়ান নাগরিককে হত্যা করে। এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টার ভেতর সে পুলিশের ছদ্মবেশে ফেরি করে উটোয়া দ্বীপে যায় এবং সেখানে ইয়ুথদের একটি ক্যাম্পে নির্বিচারে গুলি করে আরও ঊনসত্তুর জনকে হত্যা করে। তার ভাষ্যমতে সে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে মুসলিম ইনভেশন থেকে ইউরোপের কালচারকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। মিডিয়াতে তাকে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ বলে উল্লেখ করার চেষ্টা করা হলেও সে যে ‘ফার-রাইট’ মতাদর্শ দ্বারা র‍্যাডিক্যালাইজড সে বিষয়ে সবাই একমত। তাকে যখন কোর্টে আনা হয় তখন তার হাতে ‘স্টপ ইয়োর জেনোসাইড এগেনস্ট আওয়ার হোয়াইট নেশনস’ লিখা একটি স্লোগান ছিল। ফার-রাইটদের ধারণা পৃথিবী থেকে সাদা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা চলছে চারিদিকে, তাই এখনই সময় এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। আমেরিকার হোয়াইট ন্যাশনালিস্টদের মাঝে সেই রুখে দাঁড়ানোর স্বপ্নবীজ বপন করে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান দিয়ে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসে প্রথম যে কাজটি করেন সেটা ছিল বিভিন্ন মুসলিম দেশের নাগরিকদের আমেরিকাতে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী করা।

ফার-রাইট পন্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াতে কানাডার রাইট উইং এক্সট্রিমিস্ট (আরডব্লিউই) গ্রুপ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে যার বহির্প্রকাশ ঘটে হঠাৎ করেই হেইট ক্রাইমের সংখ্যার অত্যাধিক বৃদ্ধির মাধ্যমে। ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে কুইবেকের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে এক হোয়াইট ন্যাশনালিস্ট গুলি করে ছয় জন মুসলিমকে হত্যা করে এবং আরও উনিশ জনকে আহত করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জ্ঞাপন করে কোন মন্তব্য না দেয়াতে সাদা ন্যাশনালিস্টদের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে যায়। ট্রাম্প ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে সেন্ট্রাল ভার্জিনিয়ার শার্লটসভেলে কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট লি-এর স্ট্যাচু অপসারণ ঘটনায় উগ্রবাদী ফার-রাইট কিংবা নিউ-নাজি গ্রুপকে সরাসরি দোষী না করে বরং তার রেটোরিক মার্কা বক্তব্যে তাদেরকে ‘নাইস পিপল’ বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য যে শার্লটসভেলের সিটি কাউন্সিল যেখানে রবার্ট লি-এর স্ট্যাচুটি ছিল সেই ‘লি পার্ক’-টির একটা নতুন নাম প্রস্তাব করে। তার প্রতিবাদে ফার-রাইট গ্রুপ ‘ইউনাইট দ্য রাইট’ শিরোনামে একটি র‍্যালির আয়োজন করে যেখানে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব রিচার্ড স্পেন্সার সহ প্রাক্তন ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের হেড ডেভিড ডিউক বক্তব্য রাখবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সাদা ন্যাশনালিস্টদের এই র‍্যালির প্রতিবাদে বিভিন্ন চার্চ গ্রুপের সদস্য, সিভিল রাইট নেতৃবৃন্দ এবং এন্টি-ফ্যাসিস্ট অ্যাক্টিভিস্টরা সেই র‍্যালির স্থানে অবস্থান নেয়। এই সময় ঘটনাকে আরও জটিল করে দেয় যখন শ্বেতাঙ্গবাদীদের সমর্থনে একদল মিলিশিয়া বাহিনীও যোগ দেয় এবং নাজিদের কুখ্যাত ‘ব্লাড এন্ড সয়েল’ স্লোগান দিতে থাকে। এই সময় জেমস ফিল্ডস নামের এক শ্বেতাঙ্গবাদী র‍্যালির প্রতিবাদে যারা অবস্থান নিয়েছিল তাদের উপর গাড়ী চালিয়ে দেয়, ফলে হিথার হেয়ার নামের এক তরুণী ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এই ঘটনায় ট্রাম্প যখন সরাসরি কাউকেই দায়ী না করে উভয় পক্ষেই ‘নাইস পিপল’ রয়েছে বলে বক্তব্য দেন তখন সাদা ন্যাশনালিস্টরা বুঝতে পারে যে ট্রাম্প হচ্ছে তাদেরই লোক। ফলে তারা তাকে তাদের নেতা হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। ফার-রাইটদের সমর্থন করে ট্রাম্পের দেয়া বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে কানাডাতে হঠাৎ করেই হেইট ক্রাইমের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন পলিটিক্যাল র‍্যালিতে ‘মেইক কানাডা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানের দেখা মেলে যা কিনা ছিল এদেশে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদের পুনরুত্থানের সুস্পষ্ট লক্ষণ। ধীরে ধীরে এই শ্বেতাঙ্গবাদ এতটাই উগ্র আকার ধারণ করে যে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ‘কানাডিয়ান আর্ম ফোর্সেস’-এর রিসার্ভিস্ট সদস্য ম্যানিটোবার কোরে হুরেন তার জীপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল বাসভবন রিডো হলের গেট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে গ্রেফতার করার জন্য। তার সাথে চারটি আয়েগ্নাস্ত্রও পাওয়া যায় যার মধ্যে একটি ছিল রেস্ট্রিক্টেড ক্যাটেগরির। এই ঘটনার কিছু আগে ২০২০ সালের জানুয়ারীতে ‘কানাডিয়ান আর্ম ফোর্সেস’-এর ম্যানিটোবারই আরেক রিসার্ভিস্ট সদস্য প্যাট্রিক ম্যাথুউসকে আমেরিকার কোর্ট নয় বছরের জেল দেয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে হোয়াইট ন্যাশনালিস্টদের নিষিদ্ধ সংঘঠন ‘দ্য বেইজ’-এর সদস্য এবং রিচমন্ড ভার্জিনিয়ার এক র‍্যালিতে গণহত্যা চালানোর পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিল।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল কোভিড বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে না কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই এই ধারণা পাল্টে যায়। ফলে এই ভাইরাসের প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে মুখে মাস্ক পড়া এবং একে অপরের থেকে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। অল্প সময়ের ভিতর এই নতুন ভাইরাসটি সারা পৃথিবীতে আলোচনার ঝড় তুলে এবং পৃথিবী জোড়া প্যান্ডেমিকের আকার ধারণ করে। এই সময় একান্ত জরুরী না হলে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ট্র্যাভেল করার উপর কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করা হয় যাতে কোভিড এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। ফলে এভিয়েশন ইন্ড্রাস্ট্রি ভীষণভাবে বাণিজ্যিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একে একে লক-ডাউনের ঘোষণা দেয়া শুরু হয় এবং সমস্ত নন-এসেনশিয়াল বিজনেস যেমন রেস্টুরেন্ট, কফি শপ, জিম, শপিং মল, সিনেমা বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখন পুরো পৃথিবীব্যাপী এক বিশাল অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়ে যায়। সিনেমা হল বন্ধ হওয়াতে বিখ্যাত জেমস বন্ড মুভি ‘নো টাইম টু ডাই’-এর মুক্তির তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে জেমস বন্ডের মুভি সিনেমা হলে গিয়ে দেখে থাকি। তার উপর এটা ছিল আমার প্রিয় তারকা ড্যানিয়েল ক্রেগের সর্বশেষ জেমস বন্ডের চরিত্রে অভিনয়। পরে যদিও ছবিটি হলে মুক্তি পায় কিন্তু কোভিডের কারণে আমার আর দেখা হয়ে উঠেনি। এই দুঃখ আমার থেকেই যাবে। কানাডার সরকার ২০২০ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনির্দিষ্ট কালের জন্য লক-ডাউনের ঘোষণা দেয়। এই লক-ডাউনের ফলে অনেক কানাডিয়ানেরই ইনকাম বন্ধ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো জরুরী ভিত্তিতে ‘কানাডা ইমার্জেন্সি রেসপন্স বেনিফিট’ বা ‘সিইআরবি’-এর আওতায় যারা লক-ডাউনের কারণে ইনকাম হারিয়েছে তাদেরকে অর্থ সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা করে অনেকেরই প্রশংসা কুড়ান। কানাডার জনগণ যত সহজে এই লক-ডাউনকে বরণ করে নিয়েছিল, পার্শ্ববর্তী দেশ আমেরিকাতে কিন্তু তা হয়নি। সেখানকার ফার-রাইট বা শ্বেতাঙ্গবাদীদের বিশ্বাস যে কোভিড বলে কিছু নেই, বরং ছয়ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কারণ যাতে সরকার ফাইভ-জি টেকনোলজির মাধ্যমে সবাইকে ওয়াচ করতে পারে। আবার কোভিডের টীকার নাম করে প্রত্যেকের শরীরে মাইক্রোচীপ ঢুকিয়ে দেয়া হবে যাতে সবাইকে ডিজিটালি ওয়াচ করা যায়। খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের সাথে গলা মিলিয়ে জানান দেন যে কোভিড হচ্ছে একটি হোক্স। তিনি নিজে যেমন প্রথম প্রথম মাস্ক পরতে রাজী হননি তেমনি সবাইকে মাস্ক না পরার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করেছেন। তিনি আবার কোভিডের একটি টোটকা চিকিৎসা হিসেবে ম্যালেরিয়ার ঔষধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন খাওয়ার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করেন। তার এই টোটকা চিকিৎসার কারণে তার সাথে বাংলাদেশের সদ্য প্রয়াত আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জয়নাল হাজারীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জয়নাল হাজারী এক ভিডিও বার্তায় চিকিৎসকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা যেন করোনা আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসকে ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দেয়, তাহলে হয়ত তারা করোনামুক্ত হতে পারবে। মেধার দিক থেকে দেখা যাচ্ছে তাদের দুইজনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে এই সময় হোয়াইট হাউজের ‘করোনা ভাইরাস টাস্কফোর্স’-এর লীড মেম্বার এন্থনি ফাওচি আমেরিকানদের কাছে নিরলস এবং নির্ভীকভাবে কোভিড সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরেন। এই কারণে তিনি বেশ অনেক বারই ট্রাম্পের রোষানলে পড়েন। উল্লেখ্য যে এন্থনি ফাওচি এক প্রেস কনফারেন্সে উল্লেখ করেন যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কোভিড চিকিৎসায় কোন কাজে লাগে না।  

এক পর্যায়ে ট্রাম্প কোভিডকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলে অভিহিত করে চাইনিজ আমেরিকানদেরকে বিপদের মধ্যে ফেলে দেন। দেশ জুড়ে তখন এশিয়ান অর্থাৎ চাইনিজদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ বেড়ে যায়। সেই সূত্র ধরেই ২০২১ সালের মার্চ মাসে একুশ বছর বয়সী হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট রবার্ট অ্যারন লং জর্জিয়া স্টেটের আটলান্টা শহরের তিনটি স্পা-তে আক্রমণ চালিয়ে মোট আটজনকে হত্যা করে যাদের মধ্যে ছয়জনই ছিল চাইনিজ আমেরিকান। তবে এই ঘটনার প্রেস ব্রিফিং-এর সময় আটলান্টার চেরোকি কাউন্টির শেরিফ ক্যাপ্টেন জে বেকার যখন উল্লেখ করেন যে, দিনটি রবার্ট অ্যারনের জন্য হয়ত একটি খারাপ দিন ছিল তাই সে এই হত্যাকান্ড চালিয়েছে। বেকার তার বক্তব্যে একজন হোয়াইট সুপ্রিমিস্টের ভায়োলেন্ট কাজকে র‍্যাশনালাইজড করার জন্য যে চেষ্টা করেছেন সেজন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে এবং তাকে পুলিশ মুখপাত্রের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। গার্ডিয়ান পত্রিকাতে আরওয়া মাহদাউয়ি বেকার-এর এই উক্তির বিরুদ্ধে একটি আর্টিকেল লিখেন সেখানে তিনি প্রশ্ন করেন রবার্ট অ্যারন যদি একজন মুসলিম হত তবে কি বেকার একই সাফাই গাইত। তবে বেকার-এর এই সাফাই আমাকে বিখ্যাত হলিউড মুভি ‘মিসিসিপি বার্নিং’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। অ্যালেন পার্কারের পরিচালনায় ১৯৮৮ সালে নির্মিত মুভিটির কাহিনী গড়ে উঠেছে একটি সত্যি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৬৪ সালে মিসিসিপিতে ক্ল-ক্লাক্স-ক্লানের সদস্যদের হাতে দুইজন সাদা অ্যাক্টিভিস্ট ও একজন কালো ছেলে খুন হয়। সেই খুনের তদন্তের জন্য ওয়াশিংটন থেকে দুইজন সাদা এজেন্ট আসে। তারা এসে দেখতে পায় কিভাবে মিসিসিপিতে পুলিশ থেকে শুরু করে মেয়র এমন কি জাস্টিস নিজেই ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানদের অপকর্মের সহযোগিতা করে আসছে। ২০২১ সালে চেরোকি কাউন্টির শেরিফ ক্যাপ্টেন জে বেকার যখন প্রেস ব্রিফিং-এ খুনী রবার্ট অ্যারনের পক্ষে সাফাই গাইলেন, আমার কাছে মনে হল আমি যেন ‘মিসিসিপি বার্নিং’ মুভিটির ১৯৬৪ সালের ঘটনাটার আধুনিক ভার্সন দেখছি। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো