কানাডিয়ানদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষন্নতা, একাকীত্ব এখন সর্বোচ্চ

উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্নতায় ভোগার ঘটনা বেড়েছে কানাডার নারীদের মধ্যে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে এখন প্রাপ্তবয়স্ক কানাডীয়, বিশেষ করে নারী ও কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও একাকীত্বের বোধ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত জানুয়ারীতে প্রকাশিত টরন্টোর এডিকশন ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের (CAMH) এক রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন সারা জবাখানজি।

সমীক্ষার সহযোগী প্রধান এবং মানসিক স্বাস্থ্যনীতি গবেষণা ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডা. হেলে হ্যামিল্টন বলেন, “এই সমীক্ষার পুরো সময়জুড়ে ওমিক্রন পূর্ণ মাত্রায় সক্রিয় থাকায়, গত গ্রীষ্মে টিকাদান পুরোদমে শুরুর পর মানসিক বিপর্যস্ততার অপেক্ষাকৃত যে নিম্নতম স্তরের কথা বলা হয়েছিলো বহু মানুষের ক্ষেত্রেই তা দূরতম স্মৃতি হয়ে গেছে।”

রিপোর্টে বলা হয়, সমীক্ষায় অংশ নেয়া ২৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ মাঝারি থেকে গুরুতর উদ্বেগ বোধ করেন বলে জানিয়েছেন, যা ২০২১ সালের জুলাই মাসের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি।

কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে এখন প্রাপ্তবয়স্ক কানাডীয়, বিশেষ করে নারী ও কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও একাকীত্বের বোধ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ছবি: গেটি ইমেজ

এদিকে প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ নিঃসঙ্গতার বোধে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন, যা গত গ্রীষ্মের তুলনায় ১৮.৮ শতাংশ বেশি। প্রায় ২২.৩ শতাংশ বলেছেন তারা বিষণ্নতায় ভোগেন। গত গ্রীষ্মে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের হার ছিলো ১৮.৬ শতাংশ।

আগের সমীক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়সী কানাডীয়রা সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। তাদের ৩৩.৫ শতাংশ উদ্বিগ্নতায়, ২৯.১ শতাংশ নিঃসঙ্গতায় এবং ২৭.৭ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছেন।

১০০৪জন কানাডীয়কে নিয়ে ৭ থেকে ১১ জানুয়ারির মধ্যে এই সমীক্ষা সম্পন্ন হয়।

মাঝারি থেকে গুরুতর পর্যায়ের উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্নতায় ভোগার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে কানাডার নারীদের মধ্যে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেড়েছে সামান্যই।

সিএএমএইচ-এর মানসিক স্বাস্থ্য নীতি গবেষণা ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ পরিচালক সামান্থা ওয়েলস বলেন, “নারীদের মধ্যে এই ব্যাপক বৃদ্ধি সম্ভবত তাদের ওপর বাড়তি দায়িত্বের বোঝা চাপার প্রতিফলন; তাদেরকে সেবাযত্নের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সম্মুখ সারির কর্মী হিসাবে দায়িত্ব পালনে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হচ্ছে।”

কোভিড-১৯ এর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি আছে এমন কাজে নিয়োজিত কর্মীরাও “প্রতিকূল মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক বৃদ্ধির” বিষয়টি জানান। তাদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ মাঝারি থেকে গুরুতর উদ্বেগে ভোগার কথা জানান, যেটি গত গ্রীষ্মে ছিলো ২৩.৫ শতাংশ। এছাড়া ৩৫.৭ শতাংশ কর্মী বিষণ্নতায় ভোগেন বলে জানান, যেটি গত গ্রীষ্মে ছিলো ২৪.৮ শতাংশ।

কোভিড-১৯ এর সংস্পর্শে আসার ভীতি দ্বিগুণ হয়েছে

টরন্টোর এক সাইকোথেরাপিস্ট ও সমাজকর্মী জায়েল কিম বলেন, সমীক্ষার ফলাফলে তিনি বিস্মিত নন।

কিম বলেন, অন্য অনেক থেরাপিস্টের মত তিনি পূর্ণ সক্ষমতা দিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ শুরুর পর নিঃসঙ্গতার বোধ ও ভবিষ্যৎ কেমন হবে সে বিষয়ে না জানার কারণে তার গ্রাহকদের মধ্যেও তিনি একইরকম অনুভূতির ব্যাপক উত্থান লক্ষ্য করেছেন।

কিম বলেন, কোভিড-১৯ এর টিকা এসে যাওয়ায় এবং বিধিনিষেধ শিথিল করার পর গত বছর তার যেসব গ্রাহক আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন তারা এবারের ওমিক্রন তরঙ্গে মারাত্মক অসহায়ত্বের শিকার হন।

সিবিসি নিউজকে কিম বলেন, “মানুষ এখন আরও বেশি করে এমন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে, ‘এটা যদি কখনও শেষ না হয় তাহলে কী হবে?’ আমার মনে হয়, এটিই আসলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতে শুরু করে।”

এটি ছিলো সিএএমএইচ-এর মহামারিকালে কানাডীয়দের স্বাস্থ্য ও পানাসক্তি বিষয়ক (series on Canadians’ pandemic health and substance abuse) ধারাবাহিক সমীক্ষার নবম ও শেষ সমীক্ষা। ডেলভিনিয়া নামে একটি প্রযুক্ত গবেষণা ও ভোক্তাতথ্য সংগ্রহকারী কোম্পানির সহযোগিতায় এই ধারাবাহিক সমীক্ষা চালানো হয়।

সমীক্ষার ফলাফলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার অভিযোগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যাবার বিষয়টিও উঠে আসে: অংশগ্রহণকারীদের ২৪ শতাংশ বলেছেন, গত ১২ মাসে মহামারির সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু তা পাননি। তুলনায় গত গ্রীষ্মে পরিষেবা না পাওয়া মানুষের হার ছিলো ১৯.৫ শতাংশ।

‘নৈরাশ্যবাদ বেশি, দৃঢ়তা কম’

সিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, সমীক্ষায় অন্য যেসব তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে তাতে আভাস পাওয়া যায় যে, এক বছর আগে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবার ভয় এক বছর আগে যেখানে ছিলো ১৪.২ শতাংশ এখন সেটি দ্বিগুণ হয়ে ২৮.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

সিএএমএইচ-এর মনস্তত্ত্ববিদ ড. ডেভিড গ্র্যাটজার বলেন, “আমার মনে হয়, এই তরঙ্গটি বহু মানুষের কাছে আগেরগুলোর চেয়ে ভিন্নতর বলে মনে হয়েছে, যেন সবচেয়ে খারাপ সময় কেটে গেছে বলে মনে করার পর তাদের পায়ের নিচ থেকে মই সরিয়ে নেয়া হয়েছে।”

“আমি মানুষের মধ্যে আগের তরঙ্গগুলোর চেয়ে বেশি নৈরাশ্যবাদ এবং কম দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছি।”

গ্র্যাজার বলেন, রিপোর্টে যে পর্যায়ের উদ্বেগ ও বিষণ্নতার কথা উঠে এসেছে তার পেছনে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি আর্থিক চাপ, অর্থনৈতিক দুঃসময় এবং আবাসন সম্পর্কিত সমস্যারও ভূমিকা আছে।

তিনি বলেন, মহামারি পরবর্তী পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় তার প্রভাব মেকাবেলার প্রস্তুতি হিসাবে নীতিনির্ধারক ও সরকারগুলোকে অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তিনি বলেন, “বহু মানুষ উদ্বেগ ও বিষণ্নতার লক্ষণ এবং একইসঙ্গে মহামারির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন।” “মনে রাখতে হবে, মহামারি শুরুর আগে থেকেই আমরা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার মধ্যে ছিলাম আর সর্বশেষ কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতাল ছেড়ে যাবার পরই এই সঙ্কটের অবসান ঘটবে এমন না।”