শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ইন্ধন ও উস্কানিতে লরি চালকদের উন্মত্ততা
খুরশিদ আলম
ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনের নামে জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে কানাডার রাজধানী অটোয়ার কেন্দ্রস্থলের রাস্তাঘাট ও পার্লামেন্ট ভবনের আশপাশের রাস্তাঘাট একেবারেই অচল করে দেন লরি চালকদের একটি দল। একই সাথে কানাডার অন্যান্য শহরেও চলে লরি চালকদের এই তান্ডব।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ভ্যাকসিন বিষয়ে নতুন একটি আইন জারি করলে লরি চালকদের একটি অংশ তার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে হাজির হন অটোয়ায়। প্রতিবাদের অংশ হিসাবে রাস্তায় নিজেদের লরি ও ট্রাক এলোপাথারিভাবে পার্ক করে গোটা অঞ্চলটাকেই কর্যত অবরুদ্ধ করে ফেলেন। সেখানে তাঁদের কয়েকজনের হাতে চরম অশ্লীল ভাষা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে যার টার্গেট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অন্যদিকে বিশ^যুদ্ধে নিহত কানাডিয়ান সৈন্যদের সম্মানে নির্মিত স্মৃতিসৌধে উঠে নাচানাচি করতেও দেখা গেছে লরি চালকদের কয়েকজনকে। এমনকি স্মৃতিসৌধের গোড়াতে মূত্রত্যাগ করতেও দেখা গেছে তাঁদেরকে!
ভ্যাকসিন বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে কানাডিয়ান ক্রীড়াবিদ, মানবতা কর্মী ও ক্যান্সার রিসার্স এ্যাক্টিভিস্ট টেরি ফক্স এর ভাস্কর্যের গায়ে ভ্যাকসিন বিরোধী পোস্টার সেঁটে দিতে দেখা গেছে তাঁদেরকে। কানাডার জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করার জন্য সেটি মাস্তুলে উল্টো করে বেধে টেরি ফক্স এর ভাস্কর্যের সাথে দাঁড় করিয়ে দেন তাঁরা। এতে নিন্দার ঝড় উঠে দেশজুরে।
সম্প্রতি কানাডায় কভিড-১৯ এর নতুন ভেরিয়েন্ট অমিক্রন এর প্রাদুর্ভাব অতি দ্রুত বেড়ে গেলে ফেডারেল সরকার নতুন এক আইন জারি করে লরি চালকদের জন্য। ঐ আইনে বলা হয়, লরি চালকরা মালামাল আনার জন্য সড়ক পথে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ফেরত আসার সময় করোনা ভ্যাকসিন নিয়েছেন এমন প্রমাণ দাখিল করতে হবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন আইন থেকে মুক্ত থাকার জন্য। গত ১৫ জানুয়ারী থেকে এই আইন কার্যকর হয়। আর তাতেই ক্ষেপে যান লরি চালকদের একটি অংশ যাঁরা ভ্যাকসিন নেননি। এদের সংখ্যাও খুব বেশী নয়। হিসাবে দেখা গেছে কানাডায় লরি চালকদের প্রায় ৯০% ইতিমধ্যে করোনার ভ্যাকসিন নিয়েছেন। বাকি যাঁরা ভ্যাকসিন নেননি তাঁরাই বিক্ষোভে অংশ নেন যাদের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে বলে অনুমান করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
কেউ কেউ অবশ্য আশংকা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, সীমান্তে ভ্যাকসিনের নতুন আইন চালুর ফলে গ্রোসারী স্টোরগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সংকট দেখা দিতে পারে। কিন্তু বাস্তব তা হয়নি। কারণ, প্রথমত বিক্ষোভে অংশ নেয়া লরি চালকরা সংখ্যার দিক থেকে কানাডার মোট লরি চালকদের তুলনায় ছিলেন একেবারেই নগণ্য। দ্বিতীয়ত, যাঁরা ভ্যাকসিন নিয়েছেন সেই ৯০% লরি চালক আন্দোলনে যোগ দেননি। তাঁরা নিয়মিত কানাডা আমেরিকার মধ্যে মালামাল পরিবহনে কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবহন মন্ত্রী ওমর আলঝাবরা বলেন, সীমান্তে ভ্যাকসিন বিষয়ে নতুন আইন চালুর ফলে দুই দেশের মধ্যে লরি চালাচলে কোন বিঘ্ন ঘটেনি বা হ্রাসও পায়নি। নতুন আইন জারির পরপরই তুষার ঝড় বয়ে গেলেও প্রথম সপ্তাহে প্রায় এক লাখ লরি দুই দেশের মধ্যে চলাচল করেছে এবং দ্বিতীয় সপ্তাহেও লরি চালাচলের এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনের নতুন আইন লরি চলাচলে কোন প্রভাবই ফেলেনি। প্রভাব ফেলেনি ভ্যাকসিন বিরোধীদের আন্দোলনের কারণেও।
এটি ছিল লরি চালকদের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকের পরিস্থিতি। কিন্তু পরবর্তীতে লরি চালকরা যখন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে অবস্থিত এ্যাম্বাসেডর সেতুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং দুই দেশের মধ্যে লরি চালাচল বন্ধ করে দেয় তখন পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এই সেতুটি দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রায় এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল এই সেতুটি লরি চালকদের আন্দোলনের ফলে। এর কিছুটা প্রভাব স্থানীয় বাজারে পরতে পারে বলে বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
উল্লেখ্য যে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনের নামে লরি চালকদের একটি অংশ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে, বাধ্য হয়ে অটোয়ার মেয়র প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। পরে অন্টারিও’র প্রিমিয়ারও গোটা প্রভিন্সে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। পাশাপাশি আন্দোলনকারীদেকে আন্দোলন বন্ধ করারও আহ্বান জানান। এমনকি প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টি অব কানাডার অন্তরবর্তীকালীন প্রধান ক্যান্ডিস বার্গেন-ও আন্দোলনকারীদেরকে ঘরে ফিরে যেতে বলেন যদিও তিনি শুরুতে তাঁদেরকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং পার্লামেন্টের সামনে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করেছেন।
কিন্তু এই জরুরী অবস্থা ঘোষণার পরও এখন পর্যন্ত (১৩ ফেব্রুয়ারি) পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটেনি। লরি চালকরা তাদের আন্দোলন ও অবস্থান চালিয়েই যাচ্ছেন কানাডার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে। আর তাঁদের এই কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য কয়েকটি দেশেও একই কায়দায় ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। অবশ্য ঐ সব দেশে কঠিন হস্তে সেই আন্দোলনকে প্রতিহত করা হচ্ছে। পারছে না শুধু কানাডা। কেমন যেন আদর করে আন্দোলনের নামে চরম অরাজকতা সৃষ্টিকারী লরি চালকদেরকে ধমক দেয়া হচ্ছে এবং শাসন করা হচ্ছে। আর এতে আশকারা পেয়ে লরি চালকরা তাঁদের উচ্ছৃংল কর্মকান্ড চালিয়েই যাচ্ছেন।
আন্দোলনের নামে অভদ্র ও অশালীন আচরণও করেছেন এই লরি চালকদের কেউ কেউ। ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন স্থানীয় লোকদেরকে। খাবার কেড়ে নিয়েছেন গৃহহীনদের কাছ থেকে। অথচ এই আন্দোলনের নামে তাঁরা চাঁদা তুলেছিলেন বিশাল অংকের অর্থ। দশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী! তারপরও গৃহহীনদের খাবার লুট করেছেন তাঁরা! স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন এই আন্দোলনকারীরা সামাবেশের আশপাশে যত্রতত্র মূত্রত্যাগ ও মলত্যাগ করে এলাকাটি নোংরা করে তুলেছেন।
আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে অটোয়ার স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোকদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম বিরক্তি। সেই সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের লোকজনও চরম বিরক্ত হয়েছেন আন্দোলনের নামে কিছু সংখ্যক লরি চালকের বিবেক বর্জিত আচরণে। এই লরি চালকরা রাত-দিন উচ্চ নিনাদে হর্ন বাজিয়েছেন যা তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করেছে স্থানীয় জনগণের মধ্যে। লোকজনের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছেন তাঁরা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের অবরোধের কারণে। ঐসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা বেতন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এদিকে প্রশ্ন উঠেছে, ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন মাত্র কয়েক হাজার লরি চালক ও তাঁদের সমর্থক। তাহলে এই বিশাল অংকের চাঁদা উঠলো কোথা থেকে? কারা দিলেন এই চাঁদা? এই প্রশ্নের জবাবে বিভিন্ন মহলের ইঙ্গিতটা ছিল কানাডার চরম ডানপন্থী রাজনীতিক ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রতি। ধারণা করা হচ্ছে, এদের উস্কানীতে এবং আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিতেই লরি চালকদের ক্ষুদ্র একটি অংশ অটোয়া অচল করার পরিকল্পনা নেন রাজনৈতিক উদ্দেশে। ভ্যাকসিন আইনের বিষয়টি ছিল উপলক্ষ্য মাত্র।
অন্যদিকে নেপথ্যের চাঁদা প্রদানকারীরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন কিছু প্রতারণামূলক কৌশলও। ‘GoFundMe’ একাউন্টে চাঁদা প্রদানকালে নিজেদের নাম গোপন করে এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নাম ব্যবহার করেছেন। এমনকি তাঁর স্ত্রী সোফি’র নামও।
আর শুরু থেকেই এই লরি চালকদের আচরণ এতটাই উন্মাদনায় ভরা ছিল যে, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে পার্লামেন্টের নিকবর্তী সরকারী আবাসস্থল থেকে অন্যত্র সরে যেতে হয়েছিল!
জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য এক ভাষণে বলেছেন, লরি চালকদের হুমকিতে তিনি ও তার সরকার ভীত নয়। এবং তাঁদের সঙ্গে কোন আলোচনায়ও বসবেন না তিনি। তিনি আরো বলেন, গত কয়েকদিন ধরে লরি চালকদের কারো কারো আচরণে কানাডিয়ানরা হতবাক এবং বিরক্ত হয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, যাঁরা স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরকে অপমান করে, তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং গৃহহীনদের কাছ থেকে খাবার কেড়ে নেয় আমরা তাঁদের ভয় পাই না। যাঁরা বর্ণবাদী পতাকা উড়িয়েছে তাঁদের কাছে আমরা নতি স্বীকার করবো না। যাঁরা ভাঙচুরে লিপ্ত বা আমাদের প্রয়াত বীর সৈনিকদের স্মৃতিকে অসম্মান করে তাঁদের কাছে পরাজিত হব না।’
অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড-ও চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন লরি চালকদের আচরণে। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা আমাদের সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভ অপবিত্র করেছেন, নৎসীদের সয়েস্টিকা প্রতীকসহ অন্যান্য ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার প্রতীক প্রদর্শণ করেছেন। অন্টারিওতে এবং কানাডায়ও এগুলোর কোন স্থান নেই, ভবিষ্যতেও স্থান হবে না।’
আন্দোলনকারী লরি চালকদের কারো কারো আচরণ ছিল অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ। কানাডিয়ান পতাকায় বড় বড় অক্ষরে অশ্লীল শব্দ ‘F*** Trudeau’ লিখে সেটি কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে তাঁদেরকে।
পুলিশ অবশ্য বলেছে যাঁরা সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভকে অপবিত্র করেছেন, টেরি ফক্সের ভাস্কর্যকে অবমাননা করেছেন তাঁদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
উল্লেখ্য যে, অটোয়ায় বিক্ষোভ চলাকালে লরি চালকদের কেউ কেউ এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, তাঁরা পুলিশকেও হুমকী এবং ভীতি প্রদর্শন করতে ছাড়েননি। হুমকী ও ভীতি প্রদর্শন করেছেন সাংবাদিকদের প্রতিও।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, প্রশাসনের কর্মকর্তারা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্ধ এতটা নমনীয় ভাব দেখাচ্ছেন কেন? স্থানীয় জনগণের চরম দুর্ভোগ লাগবে তাঁরা কেন জোরালো কোন পদক্ষেপ নেননি? লরি চালকরা তাঁদের তথাকথিত ‘Freedom to Choose’, ‘Freedom Not Fear’ এবং ‘Freedom for All.’ এর নাম করে স্থানীয় সাধারণ মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা হরণ করবেন, শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার স্বাধীনতা বন্ধ করবেন, ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চালানোর স্বাধীনতা বন্ধ করবেন এটা কোন নিয়ম? এক পক্ষ ‘কানাডিয়ান চার্টার অফ রাইটস’ এর দোহাই দিয়ে আন্দোলনের নামে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করবেন আর আরেক পক্ষ তার ক্ষতি বহন করবেন তা কি করে হয়?
আজ যদি আদিবাসীদের কোন সংগঠন বা কৃষ্ণাঙ্গদের কোন সংগঠন অথবা এশীয়দের কোন সংগঠন লরি চালকদের মতো এমন অযৌক্তিক দাবী নিয়ে এভাবে রাস্তায় নামতেন, রাজধানী অচল করে দিতেন, নিহত সেনাদের স্মৃতিস্তম্ভের পবিত্রতা নষ্ট করতেন, জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করতেন, প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য করতেন নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র সরে যেতে তাহলে প্রশাসন ও পুলিশ কি এতটা নমনীয়, স্নেহবান ও ভ্রাতৃবৎ আচরণ করতো? এরকম প্রশ্ন আজ অনেকেরই।
কানাডায় কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সিস্টেমিক রেসিজম যে আজও অব্যাহত রয়েছে এবং অন্যায় ও অযৌক্তিক আচরণ করেও শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে আজও যে ভ্রাতৃবৎ আচরণ পেয়ে আসছেন সেটি আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন লরি চালকেরা। কানাডায় মানবাধিকার নিয়ে সুদীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন যাঁরা তাঁরাও এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সিবিসি নিউজকে তাঁরা বলেন, ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট এবং মহামারী বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে লরি চালকদের একটি অংশ ও তাঁদের সমর্থকরা যে তান্ডব চালিয়েছেন সে বিষয়ে সরকার ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নমনীয় আচরণ দেখে তাঁরা আহত হয়েছেন।
এদেরই একজন জোয়ান জ্যাক। কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য এই আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সবার কাছেই সুপরিচিত। তিনি বলেন ‘লরি চালকদের প্রতি সরকার ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যে নমনীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সেটা ভিন্নরকম হতো যদি আদিবাসীরা এরকম সমাবেশ ও আন্দোলন করতো। এমনকি সেনাবাহিনীও ডাকা হতো আন্দোলন থামানোর জন্য।’
জোয়ান জ্যাকের মতোই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ে একজন মানবাধিকার কর্মী এলসা কাকা। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন বিরোধিতার নামে লরি চালকদের একটি অংশ কর্তৃক পরিচালিত বিক্ষোভ ও অরাজকতার প্রতি প্রশাসন যে নমনীয় আচরণ দেখিয়েছে তাতে আমি খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছি।’
জোয়ান জ্যাক ও এলসা কাকা উভয়ে বলেন, ‘ভ্যাকসিন বিরোধিতার নামে পরিচালিত লরি চালকদের বিক্ষোভের প্রতি সরকার এবং পুলিশ যে নমনীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা বেশ বেদনাদায়ক। পাশাপাশি যাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চাঁদা প্রদান করেছেন সেটাও বেদানাদায়ক।’
আমরা জানি কানাডার সিংহভাগ মানুষ ভ্যাকসিন আইনের পক্ষে। এমনকি সিংহভাগ লরি চালকও ভ্যাকসিন আইনের পক্ষে। লরি চালকদের প্রায় ৯০% ভ্যাকসিন নিয়েছেন। এখন গুটিকতক লরি চালক ভ্যাকসিনের বিষয়ে কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে অথবা নেপথ্যে থাকা কারো উস্কানিতে বা প্ররোচনার বশবর্তী হয়ে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবেন সেটা কি মেনে নেয়া যায়?
লরি চালকদের এই চরম দায়িত্বজ্ঞানহনী আচরণের কারণে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে, সরকারের তথা জনগণের টেক্স মানিতে চলা হাসপাতালে করোনা রোগীদের পিছনে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর দায়ভার কে নিবে? আর শুধুই কি হাসপাতালের ব্যয় বৃদ্ধি? এই লরি চালকদের সামাবেশকে সামাল দিতে গিয়ে প্রতিদিন শুধু অটোয়াতেই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পিছনে সরকারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৮ লাখ ডলার। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি কত হচেছ তার হিসাব তো কেউ করছেন না। ‘কানাডিয়ান চার্টার অফ রাইটস’ এর দোহাই দিয়ে এ কোন অরাজকতা কানাডার মত একটি সুসভ্য দেশে?
এদিকে কানাডার সাধারণ মানুষ যখন লরি চালকদের একটি ক্ষুদ্র অংশের অরাজকতায় অতিষ্ঠ এবং যারপরনাই ক্ষুব্ধ ঠিক তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্দোলনরত এই লরি চালকদের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন! তিনি এক সমাবেশে বলেন, ‘আমরা কানাডার সেই মহান লরি চালকদের জানাতে চাই যে আমরা তাঁদের সাথেই আছি।’
ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টমানের একজন। চরম দক্ষিণপন্থী বা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের নেতা হিসাবে তাঁর পরিচিতি সর্বজনবিদিত। এরকম একজন লোকের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার অর্থ দাঁড়ায় কানাডার এই লরি চালকদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের একটি সুগভীর যোগসাজস রয়েছে। গ্লোবাল নিউজ এর এক প্রতিবেদনে এরকমই একটি ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়। ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, লরি চালকরা যখন অটোয়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করে তখন একটি লরিতে ‘কনফেডারেট’ পতাকা উড়াতে দেখা গেছে। এই কফেডারেট পতাকা হলো যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রতীক। ঘৃণা-বিরোধী বিশেষজ্ঞরা বলেন, লরি চালকদের মিছিলটি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও ইসলাম বিরোধীদের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর এই মিছিলের যারা সংগঠক তাঁরাও সেই দলেরই।
‘কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্ক’ এর নির্বাহী পরিচালক ইভান বালগর্ড গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘মিছিলের সংগঠকরা প্রথম থেকেই অতি ডানপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা অতীতেও অতি ডানপন্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ইসলাম বিরোধী মন্তব্যও করেছেন।’
লরি চালকদের মিছিলটি যাঁরা সংগঠিত করেছেন তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম দেখা গিয়েছিল চাঁদা উঠানোর ‘GoFundMe’ পেজে। এই দুজন হলেন তামারা লিচ এবং বি.জে. ডিখটার। এদের মধ্যে ডিখটার ২০১৯ সালে পিপল’স পার্টি অফ কানাডা’র এক সমাবেশে শ্রোতাদের ‘রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের’ বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন লিবারেল পার্টি ভরে গেছে এই ইসলামপন্থীদের উপস্থিতিতে।
উল্লেখ্য যে, পিপল’স পার্টি অফ কানাডা’ হলো একটি চরম বর্ণবাদী রাজনৈতিক দল যাঁরা প্রচন্ডভাবে ইসলাম বিরোধী এবং একই সাথে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী।
বি.জে. ডিখটারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে। আর এই প্রতারক ব্যক্তিটি দায়িত্ব নিয়েছিলেন GoFundMe’র মাধ্যমে লরি চালকদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার। আন্দোলন চলাকালে GoFundMe’র মাধ্যমে ১০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই বিশাল অংকের অর্থ নিয়ে বি.জে. ডিখটার প্রতারণা শুরু করতে পারে এমন আশংকাও ছিল। তবে নানান বিতর্কের কারণে GoFundMe কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে লরি চালকদের জন্য সংগৃহীত তহবিল আটকে দিয়েছেন। এই চাঁদা যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের কাছে ফেরত পাঠানো হবে বলে GoFundMe কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও থেমে নেই চাঁদা উঠানো। এখন অন্য মাধ্যম ব্যবহার করে লরি চালকদের জন্য চাঁদা উঠানো হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং এই চাঁদার বিরাট একটি অংশ আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
লরি চালকদের যাঁরা সংগঠিত করেছেন তাঁদের মধ্যে আরেকজন হলেন প্যাট্রিক কিং। তাঁর নামেও অভিযোগ রয়েছে তিনি শ্বেতাঙ্গবাদী চরম দক্ষিণ পন্থীদের একজন সদস্য। ২০১৯ সালে এক টুইটার বার্তায় তিনি শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের সতর্ক করে বলেছিলেন, তাঁরা যদি এখনি পরিবর্তনের জন্য সজাগ না হন তবে হয়তো দেখা যাবে একসময় তাঁদের নামের সঙ্গে ইসলাম যোগ হয়েছে বা কোন চাইনিজ পদবী যোগ হয়েছে। অন্য এক ভিডিও বার্তায় দেখা গেছে প্যাট্রিক কিং বর্ণবাদী ষড়যন্ত্র তত্ব নিয়ে কথা বলছেন। টুইটারে পোস্ট করা অন্য এক বার্তায় তাঁকে আশংকা প্রকাশ করতে দেখা গেছে এই বলে যে, একটা এন্ডগেম এর পায়তারা চলছে। এই এন্ডগেম হলো- শ্বেতাঙ্গদের নিঃশেষ করে দেয়া। ফেসবুকে প্রদত্ত এক বার্তায় তিনি দাবী করেন কভিড-১৯ প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট কোন ভাইরাস নয়। এটি মানবসৃষ্ট জৈব অস্ত্র।
সুতরাং এখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, লরি চালকদেরকে সংগঠিত করার পিছনে কারা কাজ করছেন এবং কি তাঁদের উদ্দেশ্য। আর যে সকল লরি চালক তাঁদের প্ররোচনায় বা উস্কানিতে ভ্যাকসিন বিরোধী মিলিছে যোগ দিয়েছেন তাঁদেরই বা উদ্দেশ্য কি। দেখা গেছে এই ভ্যাকসিন বিরোধীদের সিংহভাগই শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির সদস্য এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদে বিশ^াসী। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে তাঁরা নানারকম কুসংস্কার ও অন্ধবিশ^াসে ভুগছেন।
আমরা জানি কানাডা একটি আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত ও মুক্তচিন্তার দেশ হলেও করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের অভাব নেই এখানে। এবং সেই সাথে করোনা বিষয়ে তাঁদের অবহেলা ও অজ্ঞতাতো আছেই। এ কথাটি এবার বেশ জোরালো ভাবেই প্রমাণ করে গেলেন লরি চালকদের একটি অংশ যারা প্রচণ্ডভাবে ভ্যাকসিন বিরোধী। নির্দিষ্ট এই পেশার লোক ছাড়াও ভ্যাকসিন বিরোধী আরো অনেকেই আছেন কানাডায়। আর এদের কারণেই কানাডায় করোনা নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বার বার।
আর এই সকল সমাবেশ ও বিক্ষোভে যাঁরা অংশ নিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে শতকরা নব্বুই থেকে পচানব্বুই ভাগ মানুষই ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত! সেখানে আফ্রিকান বা এশীয় বংশোদ্ভূত লোকদের উপস্থিতি তেমন লক্ষণীয় নয়। বিভিন্্ন মিডিয়ায় এই বিক্ষোভকারীদের যে সকল ছাবি ছাপা হচ্ছে সেগুলো লক্ষ্য করলেই এর প্রমাণ মিলবে। লরি চালকদের বিক্ষোভেও এই একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
লক্ষণীয় যে, ভ্যাকসিন বিরোধীরা সরাসরি বিক্ষোভ সমাবেশ ছাড়াও ফেসবুক, টুইটার-সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিন বিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই মানুষগুলো মিথ্যা ও আজগুবী তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন জনগণকে। তাঁরা বলার চেষ্টা করছেন ভ্যাকসিন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি নিতে বাধ্য করার অর্থ হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন। এমনকি তাঁরা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদেরকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আহ্বানও জানিয়েছেন এবং গণ-ভ্যাকসিন এর কার্যক্রমকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করছেন!
আগেই উল্লেখ করেছি, মূলত এই ভ্যাকসিন বিরোধীদের কারণে এবং কিছু সংখ্যক মানুষের অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে কানাডায় কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ বার বার বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে। একের পর এক আসছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ঢেউ। তাঁরা ভ্যাকসিন বিরোধিতার নামে কানাডায় নানান অরাজকতা সৃষ্টি করছেন, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছেন এবং একই সাথে ভ্যাকসিন বিরোধিতার অন্তরালে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের এই অপচেষ্টা কানাডায় একটি সুস্থ, সুন্দর ও সুগঠিত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় হিসাবে কাজ করবে এবং নিশ্চিতভাবেই কানাডার অগ্রযাত্রাকে ব্যাপক ভাবে ব্যহত করবে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ