প্রায় ৪০% কানাডীয় কর্মস্থলে বর্ণবাদের মুখোমুখি হন

শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কম চৌকস হিসাবে প্রতিপন্ন করতে সূক্ষ্মভাবে অবজ্ঞা প্রদর্শন অথবা সরাসরি অপমান করা হয়

টরন্টোর বে স্ট্রিটে অনেক বছর ধরে কাজ করার পর কারলিন পারসিল শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। অতিরিক্ত কাজ চাপানোর জন্য তার এই ধৈর্যহীনতা নয় বরং সহকর্মীদের পক্ষ থেকে সূক্ষ্ম অবজ্ঞাই হলো এর কারণ যা চূড়ান্ত পর্যায়ে তার জন্য কুফল ডেকে এনেছে।

পারসিল ২০১৭ সালে তার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “অফিসে আমাকে প্রায়ই ভীতিগ্রস্ত থাকতে হতো। আমি ঘুমের সময় কাঁদতাম। এটি আপনাকে ধসিয়ে দেয়ার মত ক্ষতিকর।”

আর এটি এমন এক বিষয় কানাডার অনেক অশ্বেতাঙ্গ নাগরিককে যার মুখোমুখি হতে হয়। বস্তুত, ২০১৯ সালে কানাডায় জাতিগত সম্পর্ক শীর্ষক এনভায়রনিকস ইনস্টিটিউটের এক গবেষণামূলক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রতি পাঁচজন কানাডীয়র মধ্যে একজন নিয়মিতভাবে অথবা বিভিন্ন সময়ে বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হন।

সমীক্ষায় অংশ নেয়া কানাডীয়রা যখন জানান যে, এধরণের ঘটনার “বেশিরভাগই ঘটে রাস্তায়”, তখন প্রায় ৪০ শতাংশ বলেন যে তারা কর্মস্থলে বৈষম্যের শিকার হন। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন মার্ক গলোম।

প্রতি পাঁচজন কানাডীয়র মধ্যে একজন নিয়মিতভাবে অথবা বিভিন্ন সময়ে বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হন। ছবি : আইস্টক

‘এটি এক স্থায়ী লড়াই’

এমনকি বর্তমানে একজন উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ক বক্তা এবং অশ্বেতাঙ্গ নারীদের পরামর্শ দানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি নেটওয়ার্ক সিস্টারটক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হয়েও পারসিল একই রকমের বিদ্বেষের শিকার হন বলে জানান। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি যখন কোনও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য হলে  প্রবেশ করেন তখন উদ্যোক্তারা তাকে মূল প্রবন্ধের উপস্থাপক হিসাবে ভেবে নিচ্ছেন এমনটা খুব কমই ঘটে।

তিনি বলেন, “এটি হলো একটি স্থায়ী লড়াই যা আমাদেরকে চালিয়ে যেতে হবে। এটি কেবল একবারের জন্য নয়।”

পুলিশ ও শিক্ষকদেরকে বৈচিত্র ও অসচেতনতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দানকারী টরন্টোর একজন কনসালট্যান্ট শাকিল চৌধুরী বলেন, কর্মস্থলে গুরুতর তিরস্কারের মত বেপরোয়া ঘটনা কমে আসছে।

তিনি বলেন, “চরম বর্ণবাদী ও চরম গোঁড়া মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই খুব কঠিন। আমি এমনও মনে করি না যে, প্রচুর সংখ্যক সংগঠনের মধ্যেও চরম ভাবাপন্ন খুব বেশি আছে। আমার মনে হয়, কর্মস্থলে যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলো আসলে অধিকতর সূক্ষ্ম।”

চৌধুরী বলেন, নারী ও অশ্বেতাঙ্গ লোকেরা যখন কোনও সভায় যোগ দেয় তখন তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা অথবা তাদের বক্তব্য না শোনার মত ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, একইভাবে, তারা কিংবা আদিবাসী মানুষেরা যে ধারণা তুলে ধরে তা কেবল তখনই গুরুত্ব পায় যখন কোনও শ্বেতাঙ্গ সে বিষয়ে উল্লেখ করেন।

তার ভাষায়, “ব্যক্তি বিশেষ হলো এমন একটি বিষয় যেখানে সংগঠিত আকারে না থাকলে আপনি নিজেকে তুলে ধরতে পারবেন না।”

গবেষক দলের নেতা কিথ নিউম্যান বলেন, সমীক্ষার ফলাফলের মধ্যে অন্যতম একটি অপ্রত্যাশিত বিষয় হলো এই যে, সব জাতিগত সম্প্রদায়েরই উল্লেখযোগ্য অংশ স্বীকার করেছেন যে, বর্ণবাদের অস্তিত্ব কানাডায় একটি বাস্তবতা। তিনি বলেন, “সমীক্ষায় অংশ নেওয়া শ্বেতাঙ্গদেরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ওই একই কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, এটি প্রণিধানযোগ্য, সম্ভবত কিছুটা বিস্ময়কর, কারণ সাধারণ ধারণা এমন যে, শ্বেতাঙ্গ কানাডীয়রা মনে করেন না যে, এমন কোনও সমস্যা আছে।”

বর্ণবাদের অস্তিত্ব কানাডার একটি বাস্তবতা। ছবি : leanincanada.com

বিস্মিত নন

এই সমীক্ষা পরিচালনায় এনভায়রনিকস-এর সহযোগী কানাডার জাতিগত সম্পর্ক বিষয়ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক লিয়ান মা বলেন, সমীক্ষার ফল দেখে তিনি বিস্মিত নন।

তিনি বলেন, “অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর গ্রুপগুলোর কাছ থেকে আমরা সব সময়ই যেসব কথা শুনে আসছি অর্থাৎ বর্ণবাদের শিকার হওয়া নিয়ে তাদের যেসব বক্তব্য শুনছি” এগুলি হলো সেটিই।

গবেষণাকর্মের প্রধান কিথ নিউম্যান বলেন, অপ্রত্যাশিত একটি ফল হলো, সব জাতিগত গ্রুপের কানাডীয়দের উল্লেখযোগ্য অংশ স্বীকার করেছেন যে, বর্ণবাদের অস্তিত্ব কানাডার একটি বাস্তবতা।

তিনি বলেন, সমীক্ষাটিও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে জনগণের অভিজ্ঞতা এবং বর্ণবাদ বিষয়ে তাদের ধারণা উঠে এসেছে।

তিনি বলেন, “এই ফল সঙ্গতিপূর্ণ। এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর এই অর্থে যে, জনগণ আপনাকে সত্য কথাটা বলছে, তারা কেবল ‘ওহ তারা তো নিছক ঘ্যানঘ্যানকারী’ এটুকুই বলছে না। সুতরাং এটি নিশ্চিত করছে যে কানাডায় বর্ণবাদ একটি বাস্তবতা।”

অবশ্য সমীক্ষায় কিছু আশাবাদী ফলও এসেছে। যেমন, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জন বলেছে, তারা অত্যন্ত আশাবাদী (১৪ শতাংশ) অথবা অনেকটাই আশাবাদী (৪৬ শতাংশ) যে, তাদের জীবৎকালে কানাডার সব অশ্বেতাঙ্গ নাগরিককে অন্যদের মতই সমমর্যাদায় দেখা হবে।

লিয়ান মা বলেন, “ঘটনা হলো এই যে, আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন যে, এখানে সমস্যা আছে এবং এ বিষয়ে আমরা কতটুকু উন্নতি করতে পারবো সে বিষয়ে আশাবাদও আছে। এটি অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে।”