টরেটক্কা টরন্টো

সামাজিকতা ও ধর্মপালন -৮

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ছোটবেলায় দেখেছিলাম বাংলাদেশে রেডক্রস সোসাইটি কিংবা ডায়াবেটিক সমিতির লটারি হত। এক একটি টিকিটের দাম ছিল দুই টাকা, কিন্তু প্রথম পুরস্কার ছিল এক লক্ষ টাকা। ১৯৭৫ সালে কিংবা সেই সময়কার এক লক্ষ টাকা ছিল অনেক টাকা, আজকের হিসেবে হয়ত পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। সেই সব লটারির একটি বিজ্ঞাপনের পাঞ্চ লাইন ছিল ‘যদি লাইগা যায়’। দুই টাকা দিয়ে এক লক্ষ টাকার হাতছানি। ফলে বিপুল পরিমানে বিক্রী হত সেই সব লটারির টিকিট। কোন পুরস্কার না পেলেও মানুষের মনে কোন আক্ষেপ থাকত না কারণ টিকিট বিক্রী থেকে যে লাভ হত সেটা ব্যয় হত মানুষের কল্যাণে। এটা ছিল পাবলিক ফান্ডের মাধ্যমে কোন জনকল্যাণ মূলক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি স্ট্রাটেজি। একই রকম একটা স্ট্রাটেজির দেখা পেয়েছিলাম সিঙ্গাপুরে। আমি সেই দেশটাতে প্রায় দশ বছর ছিলাম – ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। সেখানে আছে ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন নামক একটি প্রতিষ্ঠান যাকে সংক্ষেপে ‘এনকেএফ’ বলে ডাকা হত। ‘এনকেএফ’ সিঙ্গাপুরিয়ানদেরকে সুলভে কিডনি রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কিডনি ডায়ালাইসিস। আমার সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালে ‘এনকেএফ’-এর ফান্ডের একটি অংশ আসত পাবলিক ফান্ডিং-এর মাধ্যমে। বর্তমানে কীভাবে তাদের ফান্ডিং হয় সে বিষয়ে আমার তেমন কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে সেই সময় তারা বছরে একবার টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ফান্ড রেইজ করত। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু ২০০৫ সালে এসে জানা গেল যে ‘এনকেএফ’-এর সিইও মিস্টার টি টি দুরাই এই পাবলিক ফান্ডের টাকা তছরুপ করে বিলাসবহুল গাড়ী কেনা থেকে শুরু করে নিজ অফিসের বাথরুমে সোনার ট্যাপ পর্যন্ত লাগিয়েছে। এই নিয়ে টি টি দুরাই-এর বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকায় সেই মামলার চাঞ্চল্যকর বিবরণী প্রকাশ পেতে থাকে। মিডিয়াতে এই মামলাকে বলা হত ‘এনকেএফ সাগা’। অবশেষে দুরাইকে পদত্যাগ তো করতেই হয় সেই সাথে তার তিন মাসের জেল এবং চার মিলিয়ন ডলার জরিমানা হয়। সে অবশ্য তার কিছু অতি ধনী বন্ধুদের সহযোগিতায় জরিমানার টাকা পরিশোধ করে এবং তিন মাস জেল খেটে বেরিয়ে আসে। আসলে পাবলিক ফান্ডের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাটা যে কোন চ্যারিটি অর্গানাইজেশনের জন্য একটি অপরিহার্য্য বিষয়। কিন্তু চ্যারিটি অর্গানাইজেশনগুলি চাঁদা থেকে প্রাপ্ত টাকার একটি মোটা অংশ তাদের নিজস্ব খরচের জন্য ব্যয় করে থাকে যা কিনা তাদের পলিসিরই অংশ। ফলে আপনি যখন কোন চ্যারিটি অর্গানাইজেশনকে একটি টাকা দান করবেন, সেই টাকার হয়ত বারো আনাই চলে যাবে সেই অর্গানাইজেশনের ব্যয়ের খাতায় আর অবশিষ্ট চার আনা জুটবে যাদের জন্য আপনি টাকাটা দান করলেন। এছাড়াও অন্যের দেয়া টাকা হাতে পেয়ে অর্গানাইজেশনগুলির এক্সিকিউটিভরা আবার নানান ধরণের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। ‘সেইভ দ্য চিলড্রেন’ কিংবা ‘অক্সফাম’-এর কর্তা ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক স্ক্যান্ডালের খবরগুলি  আমাদেরকে এই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্পে হিউম্যান কর্নসান ইন্টারন্যাশনালের কুরবানির মাংস বিতরণ (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

কানাডা একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট। এদেশের অনেক সেবাই সরকার বিনামূল্যে নিশ্চিত করে থাকে যার ভেতর হয়ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা। টরন্টোতে আপনার যদি একটি বৈধ ওহিপ কার্ড থাকে তবে আপনি বিনামূল্যে একজন ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানের সাথে যে কোন রোগের জন্য কন্সাল্ট করতে পারবেন। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান আপনাকে যে সব টেস্ট করাতে দিবে সেগুলোও আপনি বিনামূল্যে করাতে পারবেন। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান প্রয়োজনে আপনাকে স্পেশিয়ালিস্ট ডাক্তারের কাছেও রেফার করতে পারেন, সেটাও হবে বিনামূল্যে। হাসপাতালের ইমারেন্সিতেও আপনি চিকিৎসা নিতে পারবেন বিনামূল্যে। কোন কারণে আপনাকে যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় কিংবা সার্জারী করাতে হয়, সেটাও ওন্টারিও হেলথ ইনস্যুরেন্স পলিসি বা ওহিপ কভার করবে। আসলে বিনামুল্যে এই স্বাস্থ্যসেবা যে শুধু টরন্টো কিংবা ওন্টারিও প্রভিন্সেই দেয়া হয় তা কিন্তু নয় বরং কানাডার সর্বত্রই বিনামূল্যে এই সেবা দেয়া হয়ে থাকে। হয়ত এই স্বাস্থ্যসেবার কারণেই অনেক ইমিগ্র্যান্টই দেশ হিসেবে কানাডাকেই বেছে নিয়েছেন। যদিও কানাডাতে ইনকাম ট্যাক্স প্রচুর তারপরও বিভিন্ন সামাজিক সেইফটি নেটের কারণে ইমিগ্র্যান্টের পছন্দের তালিকায় কানাডার অবস্থান শীর্ষ সারিতে। ইনকাম ট্যাক্স ছাড়াও সরকারের রেভিন্যু ইনকামের রাস্তা খোলা রয়েছে প্রচুর। বাড়ী, গাড়ী বেচাকেনা কিংবা বিভিন্ন ব্যবসা হাত বদলের সময়ও সরকার বিশাল অংকের ট্যাক্স আদায় করে থাকে। যাই হোক, সরকার যদিও ট্যাক্স পেয়ারের টাকা থেকে এই স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় ভার বহন করে থাকে তারপরও বিভিন্ন হাসপাতাল তাদের নিজ নিজ উদ্যোগে বিভিন্নভাবে জনগণের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। আমাদের বাংলাদেশের এক সময়ের রেডক্রস সোসাইটির লটারির মতন কানাডাতে একটি বহুল জনপ্রিয় লটারি হচ্ছে প্রিন্সেস মার্গারেট লটারি। এই লটারি থেকে সংগৃহীত অর্থ ক্যান্সার রিসার্চ সহ বিভিন্ন গবেষণায় ব্যয় করা হয়ে থাকে। কানাডার বিখ্যাত ম্যাকলিন’স পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে টরন্টোর সিককিডস আয়োজিত ২০১৬ সালের শীতকালীন লটারির টিকেট বিক্রির টাকার মোট আট পার্সেন্ট ব্যয় করা হয়েছে চ্যারিটিতে বাকী বিরানব্বই পার্সেন্ট ব্যয় করা হয়েছে পুরস্কার আর ম্যানেজমেন্টের পিছনে। এখানে উল্লেখ্য যে, সিককিডস-এর চ্যারিটি লটারির টিকেট বিক্রীর আয়ের উপর কোন ট্যাক্স নেই। এছাড়াও সিককিডস তাদের বার্ষিক ডোনেশন আয়ের তিরিশ পার্সেন্ট ব্যয় করে বিজ্ঞাপনের পিছনে। ‘ওন্টারিও লটারি এন্ড গেমিং কর্পোরেশন’ বা সংক্ষেপে ‘ওএলজি’ দ্বারা পরিচালিত ‘লোটো ম্যাক্স’ কিংবা ‘সিক্স-ফর্টি নাইন’ লটারি এ ব্যাপারে চ্যারিটি লটারি থেকে কিছুটা ভালো কারণ তারা তাদের আয়ের তেরো পার্সেন্ট ট্যাক্স দিয়ে থাকে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ‘লোটো ম্যাক্স’ কিংবা ‘সিক্স-ফর্টি নাইন’ লটারির প্রতি সপ্তাহেই একবার করে ড্র হয়। ‘যদি লাইগ্যা যায়’ এই মানসিকতায় বহু লোক বছরের পর বছর অনেকটা নেশার ঘোরের মতন এই সব লটারি কিনে তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করেন। দুই একজন ভাগ্যবানের ভাগ্য ফিরলেও তারা কিন্তু সেই টাকা বেশীদিন ধরে রাখতে পারেন না। এক সময় তারা সমস্ত টাকা খুইয়ে পথের ফকিরের মতন অবস্থায় চলে যান। দুই একজন অবশ্য ব্যতিক্রম যারা নিজেদের বুদ্ধিমত্তার কারণে লটারির টাকা ধরে রাখতে পারেন। ‘ওএলজি’ লটারির টিকেট থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে অবশ্য কিছু অংশ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে থাকে। 

কানাডাতে বেশ কিছু চ্যারিটিবল অর্গানাইজেশন আছে তার মধ্যে ‘ইউনাইটেড ওয়ে’, ‘ডব্লিউ ই বা উই চ্যারিটি’, ‘কভোনেন্ট হাউজ টরন্টো’, ‘স্যালভেশন আর্মি’ প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন কর্পোরেট অবশ্য এই সব চ্যারিটিবল অর্গানাইজেশনকে তাদের ‘গিভিং ব্যাক টু সোসাইটি’-এর কর্মসূচির পার্টনার করে নিয়েছে অনেকটা ‘উইন উইন’ সিচুয়েশনের কারণে। আমার বর্তমানের এমপ্লয়ারের পার্টনার হচ্ছে ‘ইউনাইটেড ওয়ে’। আমাদের বিভিন্ন টাউন হল মিটিং-এ ফান্ড রেইজ করার জন্য ‘ইউনাইটেড ওয়ে’-এর পক্ষ থেকে মোটিভেশনাল স্পীকাররা এসে তাদের বক্তব্য দেন। ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকেও আমাদেরকে ডোনেশন করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়। কেউ যদি কোন কিছু ডোনেট নাও করে তবুও তাকে ডোনেশনের জন্য নির্ধারিত ওয়েবসাইটে গিয়ে বলতে হয় যে আমি এ বছর কোন কিছু ডোনেট করছি না। কানাডাতে আমি যখন মাত্রই এসেছিলাম তখন সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম একটি স্টার্টআপ কোম্পানীতে। ইয়াং এন্ড ব্লোরের ইন্টারসেকশনে অবস্থিত এই কোম্পানীর সিইও ড্যারেন পার্কো একবার ক্রিসমাসের আগে আগে আমাদের কয়েকজন ভলান্টিয়ারকে নিয়ে গেল ‘কভোনেন্ট হাউজ টরন্টো’-তে। ডাউন টাউনের জেরাড স্ট্রীটে অবস্থিত ‘কভোনেন্ট হাউজ টরন্টো’ মূলত হোমলেস ইয়ুথদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও তাদের অন্যান্য সেবা মূলক কার্য্যক্রম রয়েছে। আমরা সেদিন সেখানে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে ক্রিসমাসের জন্য আগত গিফটগুলি সর্ট করেছি। আমাদের সময় এবং পরিশ্রম দিয়ে আমরা তাদেরকে সাহায্য করেছিলাম।

লিবারেল সরকারের সাথে কিছু ডিলিংসের কারণে সম্প্রতি ‘উই চ্যারিটি’ নিয়ে জোর গুঞ্জন শোনা গেল। কোভিড-এর কারণে পোষ্ট সেকেন্ডারি ছাত্রদেরকে আর্থিক সহায়তার জন্য লিবারেল সরকার নয় বিলিয়ন ডলারের একটি গ্র্যান্ট বরাদ্দ করে। এই গ্র্যান্ট থেকে নয় শত মিলিয়ন ডলারের দায়িত্ব দেয়া হয় ‘উই চ্যারিটি’-কে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের ভলান্টিয়ার ওয়ার্কের বিনিময়ে স্টুডেন্টদের মাঝে এই নয় শত মিলিয়ন ডলার বিতরণ করা। তারা অবশ্য এই নয় শত ডলারের ভিতর থেকে তাদের নিজস্ব খরচ হিসেবে সাড়ে তেতাল্লিশ মিলিয়ন কেটে রাখবে সে কথা আগাম জানিয়ে দিয়েছিল। যেহেতু ‘উই চ্যারিটি’-কে এই দায়িত্ব দেয়ার জন্য কোন কম্পেটেটিভ প্রসেস অর্থাৎ সমমানের অন্যান্য চ্যারিটি অর্গানাইজেশনকে কনসিডার করা হয়নি সেজন্য বিরোধী দল সরকারের এই ঘোষণায় দূর্নীতির সন্দেহ পোষণ করে। তার উপর যখন বেরিয়ে আসে যে ‘উই চ্যারিটি’-এর সাথে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো এবং অর্থমন্ত্রী বিল মনরো পারিবারিকভাবে জড়িত তখন ফেডারেল এথিকস কমিশনকে তদন্তে নামতে হয়। তদন্তে দেখা যায় যে ‘উই চ্যারিটি’ প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর মা মার্গারেটকে প্রায় সিকি মিলিয়ন ডলার দিয়েছে আটাশটি ইভেন্টে বক্তৃতা করার পারিশ্রমিক হিসেবে। এছাড়া ট্রুডোর ভাই আলেক্সজান্ডার পেয়েছে বত্রিশ হাজার ডলার আটটি ইভেন্টে অংশ নেয়ার জন্য। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে যে বিল মনরোর পরিবারের ইকুয়েটর এবং কেনিয়া সফরের খরচ ‘উই চ্যারিটি’ বহন করেছিল। যদিও এই সফরগুলির উদ্দেশ্য ছিল ঐ সব দেশে ‘উই চ্যারিটি’-এর কার্য্যক্রম পরিদর্শন করা, কিন্তু সেই জন্য ‘উই চ্যারিটি’-এর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করাটা বিধি সম্মত ছিল না। তদন্ত শেষে ‘উই চ্যারিটি’-এর সাথে সরকারের করা চুক্তিটি বাতিল করা হয় এবং সেই সাথে বিল মনরোকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরে আসতে হয়। যেহেতু ট্রুডোকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়নি, তাই অনেকে মনে করেন যে এই ঘটনায় বিল মনরোকে ‘স্কেপ গোট’ বানানো হয়েছে।

নর্থ আমেরিকা কিংবা ইউরোপে সাধারণত ক্রিসমাসের সময় চ্যারিটি অর্গানাইজেশনগুলি সক্রিয় হয়ে উঠে। বিভিন্ন মলে তখন দেখা যায় যে তাদের লোকজন সান্তা ক্লজ-এর সাদা বর্ডার দেয়া লালটুপি মাথায় দিয়ে মাঝে মধ্যে ঘণ্টা বাজিয়ে মানুষজনকে জানান দিচ্ছেন যে তারা চ্যারিটির জন্য টাকা সংগ্রহ করছেন। ক্রিসমাস ক্যারলের মৃদুমন্দ সুরের মূর্ছনার সাথে সাথে মানুষজনের ভিতর এক ধরণের কোমলতার সৃষ্টি হয়, ফলে তারা জেনারেসলি দান করা শুরু করে। এই সময় মানুষ মানুষকে ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলে উইশ করতে পছন্দ করে। মুসলমান হিসেবে আমরা কি ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলে অন্যকে উইশ করতে পারব কিনা এ ব্যাপারে অবশ্য নানা মুফতির নানা মত। তবে টরন্টোর উল্লেখযোগ্য মুসলিম ব্যক্তিত্ব ডক্টর শাবির আলী অবশ্য ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলাতে কোন দোষ দেখেন না। কেউ আমাকে ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলে উইশ করলে প্রত্যুত্তরে আমিও তাকে ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলে থাকি। আর আমি যদি কাউকে আগে উইশ করি, সেক্ষেত্রে বলে থাকি ‘হ্যাপি হলি ডেজ’। তবে যেটাই বলি না কেন, অবশ্যই হাসি মুখে বলে থাকি। কারণ হাদিসে আছে যে, মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলাটা একটি সাদাকা কিংবা চ্যারিটি। আর মুসলমানদেরকে সবসময়ই সাদাকা দেয়ার জন্য কোরান এবং হাদিসে তাগাদা দেয়া হয়েছে। সাদাকার বাইরে আর্থিকভাবে সামর্থবান মুসলমানদের উপর আরেক ধরণের চ্যারিটি ফরয বা আবশ্যিক করা হয়েছে, সেটা হলো যাকাত। কাদের উপর যাকাত দেয়াটা ফরয এবং যাকাতের পরিমান কীরূপ হবে সেটা যেমন ইসলামে নির্দিষ্ট করে বলা আছে, তেমনি কারা যাকাত পাওয়ার দাবীদার সেটাও বিশদভাবে উল্লেখ করা আছে সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে। ফলে মুসলমানেরা নিজ গরজে তাদের উপর নির্ধারিত যাকাত আদায় করে থাকেন। যাকাত কিংবা সাদাকা দেয়ার জন্য তাদের মনকে নরম করার জন্য আলাদাভাবে কোন আবহ তৈরি করার প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। তারপরও নর্থ আমেরিকাতে এসে দেখেছি মসজিদগুলিতে মোটিভেশনাল স্পীকারের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় ‘ডোনেশন ড্রাইভ’ যা কিনা নবীজির কিংবা সাহাবীদের আমলে হতো না। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই ডোনেশন ড্রাইভগুলি হয়ে থাকে চার্চ কিংবা চ্যারিটি অর্গানাইজেশনগুলির ডোনেশন ড্রাইভের অনুকরণে।

কানাডাতে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলামিক চ্যারিটি অর্গানাইজেশন রয়েছে যাদের মধ্যে ‘হিউম্যান কনসার্ন ইন্টারন্যাশনাল’, ‘ইসলামিক রিলিফ কানাডা’, ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্ড রিলিফ ফাউন্ডেশন’ বা সংক্ষেপে ‘আইডিআরএফ’ অন্যতম। এই অর্গানাইজেশনগুলি মূলত যাকাত এবং সাদাকা গ্রহণ করে বিভিন্ন দেশের দরিদ্র মুসলিমদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। আমাদের দেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ‘হিউম্যান কনসার্ন ইন্টারন্যাশনাল’-এর বিভিন্ন কার্য্যক্রম রয়েছে। যাকাত এবং সাদাকার অর্থ ছাড়া এই সব অর্গানাইজেশনগুলি কুরবানীর জন্যও টাকা গ্রহণ করে থাকে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি অর্গানাইজেশন কুরবানীর জন্য বাংলাদেশে তাদের কার্য্যক্রম চালু করেছে। আমি একই সাথে লক্ষ্য করে দেখেছি যে বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেকেই তাদের কুরবানী টরন্টোতেই দিতে আগ্রহী, যদিও কুরবানীর মাংস থেকে গরীবদের ভাগ বিতরণের সময় তাদেরকে বেশ বিপাকেই পড়তে হয়। তাদের দুইটি যুক্তি রয়েছে – এক, কুরবানী না হওয়া পর্যন্ত কুরবানী ঈদের দিন না খেয়ে থাকাটা উত্তম। বিদেশে কুরবানী দিলে সেই কুরবানীটা কখন হয় সেটার খবর যেহেতু পাওয়া যায় না ফলে তাদেরকে এই আমল থেকে বঞ্চিত হতে হয়। দুই, কুরবানীর মাংসে যে নিয়ামত থাকে সেটা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। আমি অবশ্য আমার কুরবানীর টাকা বাংলাদেশে আমার ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেই কারণ আমাদের দেশের গরীবেরা যেন আমার কুরবানী থেকে ভাগ পায়। একই ভাবে আমার যাকাতের টাকাও বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেই যাতে আমার গরীব আত্মীয়স্বজনেরা সেখান থেকে উপকৃত হতে পারে। ইসলামে বলা হয়েছে আমাদের সাদাকা এবং যাকাতের উপর আমাদের নিকট আত্মীয়স্বজনের হক সবচেয়ে বেশী। আমার স্ত্রী অবশ্য তার সাদাকা এবং কুরবানী যুদ্ধ নিপীড়িত সিরিয়া কিংবা প্যালেস্টাইনে পাঠিয়ে থাকে।

ইসলামিক চ্যারিটিগুলির বিরুদ্ধে যদিও ডোনেশনের টাকা নয়ছয় করার কোন অভিযোগ শোনা যায় না, তবে ‘কানাডা রেভিন্যু এজেন্সি’ বা ‘সিআরএ’ বেশ কিছু অর্গানাইজেশনকে নজরদারীতে রেখেছে। ‘সিআরএ’ সন্দেহ করছে যে তারা ডোনেশনের নামে বিভিন্ন মুসলিম মিলিট্যান্ট অর্গানাইজেশনের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে। এই অভিযোগে ২০১৮ সালে ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকা-কানাডা বা সংক্ষেপে ‘ইসনা-কানাডা’-কে এক বছরের জন্য তাদের চ্যারিটি কার্য্যকলাপ থেকে সাসপেন্ড করা হয় এবং একই সাথে তাদেরকে অর্ধ মিলিয়ন ডলার জরিমানাও করা হয়। ২০০৮ সালে ইসনা-কানাডা কাশ্মীরের ‘রিলিফ অর্গানাইজেশন ফর কাশ্মীরি মুসলিম’-কে এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার ডলার দান করে। ‘সিআরএ’ মনে করে এই টাকা আসলে পাকিস্তানের ‘জামাতে ইসলাম’-এর মাধ্যমে ‘হিজবুল মুজাহিদিন’ নামক এক মিলিট্যান্ট গ্রুপের কাছে চলে গেছে। উল্লেখ্য যে, এই ‘হিজবুল মুজাহিদিন’ আমেরিকা এবং ইউরোপে টেরোরিস্ট দল হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত। ইসনা-কানাডার চেয়ারপারসন ক্যাথরিন বুলক জানান যে, তাদের অজান্তে অতীতে এই ভুল হয়ে থাকতে পারে, তবে ভবিষ্যতে তারা এ ব্যাপারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করবে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল লিবার্টিজ মনিটরিং গ্রুপের এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ যে ২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের অডিট থেকে ‘সিআরএ’ এপর্যন্ত যতগুলি চ্যারিটি অর্গানাইজেশন বন্ধ করে দিয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগই হচ্ছে ইসলামিক চ্যারিটি অর্গানাইজেশন। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এখনও পর্যন্ত কোন অর্গানাইজেশন কিংবা কোন ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে ‘টেরোরিস্ট ফাইন্যান্সিং ক্রাইম’-এর চার্জ গঠন করা হয়নি। ফলে তারা মনে করে যে ইসলামিক চ্যারিটি অর্গানাইজেশনগুলি হয়রানি মূলক আচরণের শিকার হচ্ছে। ‘সিআরএ’ যদিও তাদের বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে অস্বীকার করেছে। ৯ জুন, ২০২১ সালের সিবিসি পত্রিকাতে রিপোর্টার জিম ব্রন্সকিল এই রিপোর্টের খবর প্রকাশ করেন। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো