কানাডায় হত্যাকাণ্ড বেড়েছে
আলবার্টায় বন্দুক সন্ত্রাস ও নোভা স্কশিয়ায় নির্বিচার গুলির ঘটনায় এই বৃদ্ধি
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার নতুন উপাত্তে দেখা যায়, কানাডায় হত্যার ঘটনা এতটাই বেড়েছে যা এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে দেখা যায়নি। নরহত্যার হারের এই বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী আলবার্টার সহিংসতা এবং গত বছর নোভা স্কশিয়ায় সংঘটিত কানাডার সর্বকালের সবচেয়ে মারাত্মক গণহত্যায় ২২ ব্যক্তির মৃত্যু।
২০২০ সালে সারাদেশে ৭৪৩ টি হত্যার ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে। এটি ১৯৯১ সালের পর কানাডায় হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ সংখ্যা। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন উইলিস স্নোডন।
এই সংখ্যাটি ২০১৯ সালের হত্যাকাণ্ডের চেয়েও ৫৬টি বেশি। এই বৃদ্ধির ফলে নরহত্যার ‘হার’ সাত শতাংশ বেড়ে ২০২০ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১.৯৫ জন। এই হার ২০১৯ সালে ছিলো প্রতি লাখে ১.৮৩ জন।
হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান প্রণয়নে দুটি ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করেছে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা। প্রতিটি অঞ্চলে সংঘটিত হত্যার প্রকৃত সংখ্যার দিকে নজর রাখা এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক জনসংখ্যার মধ্যে সংঘটিত অপরাধের হারের হিসাব নেয়া।
গত বছর হত্যার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা ১৯৯১ সালের পর সর্বোচ্চ হলেও জাতীয় পর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের হার ছিলো ২০০৫ সালের পর সর্বোচ্চ।
পুরো কানাডার মধ্যে হত্যার সর্বোচ্চ সংখ্যার দিক থেকে টরন্টো সেন্সাস মেট্রোপলিটান এরিয়া (CMA) এবারও এগিয়ে রয়েছেÑ ২০২০ সালে এখানে নিহত হয়েছে ১০৫ জন। এর পরও কয়েক বছরের হিসাবে এই এলাকায় হত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কমেছে, আগের বছরের চেয়ে ২৫ টি হত্যাকাণ্ড কম ঘটেছে।
এর ফলে প্রাদেশিক পর্যায়ের হিসাবে হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি হ্রাস ঘটে অন্টারিওতে।
নোভা স্কশিয়ার ট্রাজেডি
নোভা স্কশিয়ায় মাত্র একটি হামলার ঘটনা হত্যার পরিসংখ্যান পুরোপুরি পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
২০২০ সালে সেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটে ৩৫টি। ১৯৬১ সালে প্রথম এ ধরণের হত্যার পরিসংখ্যান প্রকাশ শুরুর পর এটিই হত্যার সর্বোচ্চ সংখ্যা। এই প্রদেশে হত্যার হার ছিলো প্রতি লাখে ৩.৫৭ জন।
২০২০ সালের এপ্রিলে গ্যাব্রিয়েল ওয়ার্টম্যান নোভা স্কশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অগ্নি সংযোগ এবং বেশ কয়েক জায়গায় গুলিবর্ষণ করে। এতে ২২ ব্যক্তি নিহত ও আরও তিনজন আহত হয়।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা বলছে, ওই ঘটনা নোভা স্কশিয়ায় হত্যাকাণ্ড ঘটার অস্বাভাবিক সংখ্যা ও উচ্চ হারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে ওই প্রদেশে আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাবার ক্ষেত্রেও ঘটনাটির ভূমিকা ছিলো।
মহামারির মধ্যে অপরাধের ধরণ পাল্টেছে
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা বলছে, প্রতিটি অপরাধের পেছনেই জটিল কারণ থাকে, কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি কানাডাজুড়ে অপরাধের ধরনের ওপর বিপুল প্রভাব রেখেছে।
২০২০ সালে অপরাধের তীব্রতা সম্পর্কিত সূচক (CSI) আট শতাংশ কমেছে। এই সূচক দিয়ে কানাডায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে এমন সব অপরাধের পরিমাণ ও তীব্রতা পরিমাপ করা হয়।
বিপরীতে নরহত্যার হার বেড়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, ‘ভুক্তভোগীদের পরিষেবা দানকারী অনেকে এবং এ বিষয়ক অনেক প্রবক্তা পারিবারিক সহিংসতার ওপর মহামারির কারণে আরোপিত লকডাউনের বিধিনিষেধ এবং ঘরে থাকার নির্দেশের প্রভাবের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।’
‘পারিবারিক সহিংসতার জন্য ঝুঁকির বিষয় যেমন সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আয় কমে যাওয়া এবং চাকরি হারানো ইত্যাদি মহামারির সময় বেড়েছে। এর ফলে বাড়িতে উদ্বেগ উত্তেজনা সৃষ্টির এবং সহিংসতার বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।’
আলবার্টায় সহিংসতা
তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, ২০২০ সাল ছিলো আলবার্টায় হত্যাকাণ্ডের জন্য সর্বকালের সবচেয়ে মারাত্মক বছর। এ বছর এই প্রদেশে হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৩৬টি, এসব হত্যার অনেকগুলি ঘটে আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার হিসাবে, ১৯৬১ সালে প্রথম হত্যার পরিসংখ্যান সংগ্রহ করার কাজ শুরুর পর এটিই ছিল এই প্রদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
প্রতি লাখ মানুষের বিপরীতে ৩.১৪ জন হত্যার শিকার হওয়া আলবার্টার জন্য ২০১৫ সালের পর প্রাদেশিক পর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ হার।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা জানাচ্ছে, কানাডার সব সিএমএর মধ্যে এডমন্টন ও ক্যালগেরি পৌর এলাকায় হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২০ সালে ওই দুটি পৌরসভায় হত্যাকাণ্ড বেড়েছে এবং উভয় স্থানেই ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫টি করে হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটেছে।
এই বৃদ্ধির কারণ বহুলাংশে আগ্নেয়াস্ত্র-সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের বিস্তার। এডমন্টনে আগ্নেয়াস্ত্র-সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ড বেড়েছে ৯৭ শতাংশ, অন্যদিকে ক্যালগেরিতে বেড়েছে ৪৮ শতাংশ।
এডমন্টন পৌর এলাকায় (CMA) – যার মধ্যে বিউমন্ট, ফোর্ট সাসকাচেওয়ান, লেডুক এবং সেন্ট এলবার্ট-এর মত সন্নিহিত এলাকাগুলোও অন্তর্ভুক্তÑ ২০২০ সালে হত্যার ঘটনা ঘটে ৪৭টি। এতে করে হত্যার হার বেড়ে প্রতি লাখে ৩.১৯ জনে দাঁড়ায়, যা ২০১৯ সালে ছিলো ২.২১ জন।
ক্যালগেরি পৌরসভায় ২০২০ সালে হত্যকাণ্ড ঘটে ৩৯ টি, ২০১৯ সালে যেখানে প্রতি লাখে হত্যার হার ছিলো ১.৫৭জন, তা বেড়ে দাঁড়ায় ২.৫৩ জনে।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা জানাচ্ছে, সারাদেশে হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে হ্যান্ডগান। ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিক থেকে এই প্রবণতা দেখা যায়।
আলবার্টায় ২০২০ সালে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে যতগুলো হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ৪৫ শতাংশই ঘটে রাইফেল বা শটগান দিয়ে। গত বছর আলবার্টায় সংঘটিত ২৯টি হত্যাকাণ্ডই গ্যাং-সম্পর্কিত সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ত যা এই প্রদেশের মোট হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২০ শতাংশ। ২০১৯ সালে এই প্রদেশে গ্যাং-সম্পর্কিত সহিংসতায় নিহত হয় ২৪ জন।
আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা ও সমাজতত্ত্বের সহযোগী অধ্যাপক টেমিটোপি ওরিওলা বলেন, বন্দুকবাজির চলমান সহিংসতা যে বিপর্যয় ডেকে আনছে সেজন্যে কানাডার সরকারের উচিৎ বন্দুক কিনে নেয়ার কর্মসূচি (gun buy-back program) চালুর বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া।
তিনি বলেন, মানুষের হাতে থাকা উচ্চ ক্ষমতার অস্ত্রের সংখ্যা কমে এলে তা জীবন রক্ষায় সহায়ক হবে।
ওরিওলা সেইসব উপাত্ত তুলে ধরেন যেগুলি কানাডায় অপরাধের প্রতিষ্ঠা ও উদ্বেগজনক ধরণগুলো জোরদার করেছে।
ওরিওলার উল্লেখিত উপাত্তে আদিবাসী জনগণের প্রতিনিধিত্ব অন্যদের সঙ্গে তুলনা করার মতও নয়। ২০২০ সালে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আদিবাসীদের নিহত হবার হার আদিবাসী নয় এমন লোকেদের চেয়ে সাতগুণ বেশি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ২০২০ সালে যেসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সুরাহা হয়েছে তাতে প্রতি পাঁচজন নিহতের মধ্যে চারজনই তার খুনিকে চিনতেন। আগের বছরগুলিতেও একই ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, ‘পরিচিত মানুষের হাতেই বেশিরভাগ মানুষের নিহত হবার ঘটনা অব্যাহত আছে।’ আর ‘মহামারি সেই সম্ভাব্যতাকে কেবল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’