কানাডায় বর্ণবাদ পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই
খুরশিদ আলম
কানাডায় বিভিন্ন বর্ণের মানুষের বাস। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাদা, কালো, বাদামী আর তামাটে বর্ণের মানুষ এসে ঠাই নিয়েছে এই দেশে। আর তাঁরা আসার আগে থেকেই এই দেশটিতে ছিল এবং এখনো আছে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়। কানাডার এই মানুষগুলোর মধ্যে শুধু বর্ণগত পার্থক্যই নয়, আছে শারীরিক ও অবয়বগত পার্থক্যও। আরো আছে ভাষার পার্থক্য, সংস্কৃতির পার্থক্য এবং ধর্মের পার্থক্য।
এই পার্থক্যকে এক কথায় ইতিবাচক উপায়ে বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা কখনো বলি কানাডা একটি মোজাইক কান্ট্রি, আবার কখনো বলি মাল্টি কালচারাল বা বহু সংস্কৃতির দেশ। কেউ কেউ এদেশটিকে একটি বাগানের সঙ্গেও তুলনা করেন। বাগানে যেমন অনেক জাতের এবং অনেক রঙের ফুল থাকে, কানাডায়ও তেমন অনেক জাতের এবং অনেক বর্ণের মানুষ আছে। অনেক জাতের ও অনেক বর্ণের ফুল থাকলে একটি বাগানের সৌন্দর্য যেমন বহুগুণে বৃদ্ধি পায় তেমনি অনেক জাতের ও অনেক বর্ণের মানুষ থাকলে একটি দেশের সৌন্দর্যও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সাধারণভাবে আমরা এটাই বিশ্বাস করি। আর এটাই তো হওয়া উচিৎ।
কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হলো, মানব জীবনে বর্ণ যেমন সত্য, তেমনি সত্য বর্ণ বৈষম্যও। আর এই বর্ণ বৈষম্য মানুষেরই সৃষ্টি! বর্ণের পাশাপাশি মানুষ নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে শ্রেণী, সেই সাথে শ্রেণী বৈষ্যম্য। এই মানুষই মানুষকে ঘৃণা করে, এই মানুষই মানুষকে শোষণ করে, নির্যাতন করে, পরাধীন বানায়। দাস বানায়। একশ্রেণীর অতিধার্মিক ধর্মগুরুরা অন্য ধর্মের মানুষদেরকে ঘৃণা করতে শেখায়!
আবার এই মানুষের মধ্যেই আছেন অনেক মহান ও হৃদয়বান ব্যক্তি যাঁরা নিজেরা ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষকে ভালবাসেন এবং অন্যকেও ভালবাসতে শেখান। শেখান মানুষকে সেবা করতে ও সম্মান করতে। মানুষের ধর্মতো তাই হওয়া উচিৎ। তা না হলে মানুষ কি ভাবে মানুষ হয়ে উঠে?
কিন্তু মানব জাতির চরম দুর্ভাগ্য এই যে, পৃথিবীর সব দেশে সব সমাজে বাস করেন এক শ্রেণীর বর্ণবাদী, শ্রেষ্ঠত্ববাদী, শোষক ও ঘৃণা বিস্তারকারী মানুষ। এবং আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এরাই সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ভার এদের হাতেই।
কানাডাও এর বাইরে নয়। এ দেশের সমাজেও বাস করেন এক শ্রেণীর বর্ণবাদী, শ্রেষ্ঠত্ববাদী, শোষক ও ঘৃণা বিস্তারকারী মানুষ। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা সমাজের ‘অভিজাত’ শ্রেণী হিসাবে পরিচিত। কিংবা বলা ভাল যে, ‘অভিজাত’ শ্রেণী হিসাবে তাঁরা নিজেদের জাহির করেন এবং সাধারণ মানুষকে তা মেনে নিতে বাধ্য করেন নানান কুটকৌশল অবলম্বন করে এবং ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে। আর অধিকাংশ সাধারণ মানুষও ঐ শাসক, শোষক এবং বর্ণবাদী শ্রেণীর মানুষের ক্ষমতা ও চাকচিক্যময় জীবন দেখে বিভ্রান্ত হন এবং একসময় ভাবতে আরম্ভ করেন তাঁরাই সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ, অভিজাত মানুষ এবং অনুকরনীয় মানুষ।
এই মানুষদের একজন উদাহরণ হলেন কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জন এ. ম্যাকডোনাল্ড। তিনি ছিলেন প্রচন্ডভাবে বর্ণবাদী। এ কথা তিনি নিজেও স্বীকার করে গেছেন। বর্ণবাদী মনোভাবের কারণে তিনি কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়কে ভাল চোখে দেখতেন না। চাইনীজদেরও ভাল চোখে দেখতেন না। ইউনিভার্সিটি অব রিজাইনা’র এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং লেখক জেমস ডাচেক লিখেছেন, ‘ জন এ. ম্যাকডোনাল্ড দেশটি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত ছিল আদিবাসীদের কোন স্থান নেই এই দেশটিতে। তাঁরা ডিসপোজএবল।’
তাঁর সময়কালে কানাডায় বসবাসরত চাইনীজদের বিরুদ্ধেও তিনি বর্ণবাদী আচরণ করেছেন। অবশ্য ম্যাকডোনাল্ড যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন কানাডায় বর্ণবাদকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হতো না। বর্ণবাদকে সমর্থন করার পিছনে ম্যাকডোনাল্ড এর যুক্তি ছিল এই রকম – আমি এরকম একটি দেশ চালাচ্ছি যে দেশটি বর্ণবাদী মানুষে ভরা। এ কারণেই আমি বর্ণবাদকে সমর্থন করে গেছি।
ম্যাকডোনাল্ড এর যুগ পার হয়ে গেছে প্রায় ১৩০ বছর আগে। কিন্তু বর্ণবাদ এখনো রয়ে গেছে দেশটিতে। তবে এ কথা ঠিক যে, আগের মতো এর ব্যাপকতা নেই। তবু বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রের ফাঁক-ফোকরে এখনো যে মাত্রায় বর্ণবাদ ও বৈষম্য লুকিয়ে রয়েছে তা অনেক মানুষকে পীড়া দেয়, অসম্মানিত করে এবং কাঁদায়।
গত ২রা নভেম্বর কানাডিয়ান সরকারের রেস রিলেশন ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত এক সমীক্ষা থকে জানা যায়, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক কানাডিয়ান মনে করেন দেশটিতে বিভিন্ন বর্ণগত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক গরীবি হালে বিদ্যমান। এখানকার কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠির সদস্যরা সম্ভবত বলতে পারেন যে বর্ণবাদ পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।
সমীক্ষাটি চালানো হয়েছিল Environics Institute এর সাথে যৌথ উদ্যোগে। ওতে দেখা গেছে সমীক্ষায় অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে ২৩% বলেছেন কানাডায় বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে সম্পর্কটা ‘সাধারণত খারাপ’। ২০১৯ সালে রেস রিলেশন ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত একই ধরণের সমীক্ষায় একই উত্তর দিয়েছিলেন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭%।
তবে সমীক্ষায় অংশ নেয়াদের মধ্যে অধিকাংশ (৬৪%) মানুষ বলেছেন বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে সম্পর্কটা ‘সাধারণত ভাল’। ২০১৯ সালের সমীক্ষায় এই একই উত্তর দিয়েছিলেন ৭১% অংশগ্রহণকারী। অর্থাৎ আগের তুলনায় কম মানুষ মনে করছেন সম্পর্কটা ‘সাধারণত ভাল’।
আর সমীক্ষায় অংশ নেয়াদের মধ্যে ১৩% বলেছেন তাঁরা বলতে পারছেন না সম্পর্কটা ভাল না মন্দ।
কানাডার রেস রিলেশন ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হাসিম বলেন, যখন আমরা বর্ণবাদের বিষয়ে কানাডিয়ানদের মধ্যে সচেতনতার মাত্রা কতটুকু সেদিকে তাকাই তখন আমরা নাটকীয় উত্থান দেখতে পাই।
তিনি আরো বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে আরও বেশি মানুষ কানাডায় বর্ণবাদের অবস্থা সম্পর্কে কঠিন সত্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। এখানে মনোভঙ্গ এবং নৈরাশ্যের একটি বৃহত্তর অনুভূতি কাজ করছে এবং আমি মনে করি আমরা যা দেখছি তা বর্তমান সময়েরই প্রতিফলন।
কানাডার রেস রিলেশন ফাউন্ডেশন এর রিপোর্টে বলা হয়েছে – কানাডায় বর্ণবাদ সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে ‘নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় হাই-প্রোফাইল বর্ণবাদী ঘটনার কারণে।’
রেস রিলেশন ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২০১৯ সালে যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল তার পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত কানাডিয়ানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপলিস এ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড এর নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। প্রত্যক্ষ করেছে মহামারী চলাকালে এশিয়ানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং এই মহামারী চলাকালেই প্রথমে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় অতীতে বন্ধ হয়ে যাওয়া কামলুপস রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠ থেকে ২১৫ জন আদিবাসী শিশুর গণকবর এবং তার কয়েকদিন পর সাচকাচ্যুয়ানে অতীতে বন্ধ হয়ে যাওয়া মেরিভ্যাল ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠ থেকে ৭৫১ জন আদিবাসী শিশুর গণকবর আবিস্কৃত হওয়ার ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছে। আর এই আবিস্কারের ফলে চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে কানাডার সরকার। সংকটের মধ্যে নিপতিত হয় কানাডার ভাবমূর্তি। অতীতের এই নৃশংসতার জন্য ইতিমধ্যে ক্ষমাও চান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এটি খুবই বেদনাদায়ক ও দেশের ইতিহাসে লজ্জাজনক এক অধ্যায়।
বর্ণবাদের আরেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গত ৬ জুন অন্টারিও’র লন্ডন শহরে। ঐদিন এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় প্রাণ হারান একটি মুসলিম পরিবারের তিন প্রজন্মের চার সদস্য। আর অল্পের জন্য বেঁচে যায় ৯ বছরের এক শিশু। তবে আহত হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। রাস্তা পারাপারের সময় অতর্কিতে তাঁদের উপর একটি পিকআপ ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যান নামের ২০ বছর বয়সী এক শে^তাঙ্গ যুবককে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে ৪ জনকে হত্যা ও আরেকজনে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। হামলার দুদিন পর কানাডার পার্লামেন্টে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, এটি সন্ত্রাসী হামলা। কোন সড়ক দুর্ঘটনা নয়। ইসলামবিদ্বেষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। কানাডার শে^তাঙ্গ বর্ণবাদী গোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
উল্লেখ্য যে কানাডায় মুসলিমদের উপর ভয়াবহ বর্ণবাদী হামলার এটি ছিল তৃতীয় ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী। ঐ দিন ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিবের নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন।
কানাডায় মুসলিম হত্যার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ইটোবিকোক এর একটি মসজিদের সামনে। গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর ঘটে এই নৃশংস হত্যার ঘটনা। নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আসলিম জাফিস। খুনী Von Neutegem আসলিম এর পিছন দিক থেকে এসে সহসা আক্রমণ করেন। খুনীকে পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে। কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, Von Neutegem ব্রিটেনের একটি বিদ্বেষী গ্রুপের অনুসারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একটি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গ্রুপেরও অনুসারী সে।
আর শুধু মুসলিম নয়, কানাডায় বর্ণবাদী আচরণের শিকার অন্য ধর্মের মানুষেরাও হচ্ছেন কমবেশী। এর মধ্যে ইহুদী ধর্মালম্বীরা আছেন প্রথম কাতারে। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক হিসাবে দেখা যায় ২০১৭ সালে ইহিুদীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধের ঘটনা ঘটেছিল ৩৬০টি। অন্যদিকে টরন্টো পুলিশ জানায়, ২০২০ সালে এই শহরে বর্ণবাদ বা ঘৃণাজনিত যত অপরাধের ঘটনা ঘটেছিল তার ৩০% এর শিকার হয়েছিলেন ইহুদী ধর্মলম্বীরা।
আরো দুর্ভাবনার বিষয় হলো, কানাডায় অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করে খোদ পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যও! দেখা গেছে, কানাডীয় নাগরিকদের প্রতি পাঁচজনে প্রায় দু’জন বিশ্বাস করেন, সারাদেশে কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী এবং অশ্বেতাঙ্গ মানুষের প্রতি পুলিশ বাহিনী যে আচরণ করে তাতে গুরুতর সমস্যা আছে। নতুন এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি অ্যাঙ্গুশ রেইড-এর ঐ সমীক্ষায় ৫,০০৫জন প্রাপ্তবয়স্ক কানাডীয় নাগরিকের মতামত নেয়া হয়। এতে দেখা যায়, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি সংখ্যক মানুষ (৬৩ শতাংশ) একমত যে পদ্ধতিগত বর্ণবাদ একটি গুরুতর সমস্যা এবং প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ বলেন, কানাডার পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী এবং অশ্বেতাঙ্গ লোকেদের প্রতি অন্তত কখনও কখনও অন্যায় আচরণ করে।
কানাডায় বিচার ব্যবস্থায়ও বিদ্যমান আছে বর্ণবাদ। স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত বছর নভেম্বর মাসে নোভা স্কশিয়ার প্রিমিয়ার স্টিফেন ম্যাকনিল বিচার ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদ থাকায় ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। কারণ এই বর্ণবাদ নোভা স্কশিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীদেরকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। সিবিসি নিউজে এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রিমিয়ার ম্যাকনিল বলেন, ‘পুলিশ থেকে শুরু করে কোর্ট পর্যন্ত আমাদের বিচার ব্যবস্থা কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটির অনেক সদস্যকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা যে ব্যবস্থার, নিজেদের গায়ের রঙের কারণে সেটিকে আপনারা ভয় করেন।’
তিনি আরো বলেন, তার সরকার নোভা স্কশিয়ায় ‘বিচার ব্যবস্থার পুনর্গঠনের’ চিন্তা করছে। এজন্যে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, আইনজীবী ও কমিউনিটির সদস্যদের নিয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমকে পুনরুদ্ধারের পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে যা নোভা স্কশিয়ায় জননিরাপত্তার রূপান্তর ঘটাবে।
গত বছরের এক রিপোর্টে দেখা যায়, হ্যালিফ্যাক্সে পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গদেরকে রাস্তায় শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অন্তত ছয়গুণ বেশি তল্লাশি করে। গত অক্টোবরে নোভা স্কশিয়ার বিচার বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, তিনি রাস্তায় তল্লাশি স্থায়ীভাবে বন্ধ করবেন। এক পর্যালোচনায় রাস্তায় তল্লাশি করার বিষয়টি অবৈধ হিসাবে চিহ্নিত হবার পর তিনি ওই ঘোষণা দেন।
আদিবাসী লোকেদের সঙ্গে যেন যথাবিহিত আচরণ করা হয় সেজন্যে নোভা স্কশিয়ার সরকারি কৌসুলী পরিষেবার পক্ষ থেকে গত বছর একটি নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। ঐ প্রভিন্সের জনসংখ্যার মাত্র তিন শতাংশেরও কম আদিবাসী। কিন্তু তাদের ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ জেলে বন্দি। এই পরিসংখ্যানের আলোকে ওই নীতিমালা প্রকাশ করা হয়।
আর শুধু নোভা স্কোশিয়ায়ই নয়। এই পরিস্থিতি কম বেশী অন্যান্য প্রভিন্সেও বিদ্যমান। বিদ্যমান অন্টারিওতেও। আমরা দেখেছি অন্টারিও’র পুলিশ বিভাগে পদ্ধতিগত বর্ণবাদ নির্মূলে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে অন্টারিওর মানবাধিকার কমিশন।
অন্টারিওর মানবাধিকার কমিশন (OHRC) গত জুলাই মাসে বলেছে, পুলিশ বিভাগে পদ্ধতিগত বর্ণবাদের অবসানে প্রাদেশিক সরকারকে একটি আইনী ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এ বিষয়ে কমিশন ১০টি পদক্ষেপের বিষয় প্রকাশ করেছে যা সরকারের করা উচিৎ বলে কমিশন মনে করে। এর মধ্যে রয়েছে, সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেবার আগে পুলিশ আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করছে কিনা তা দেখাশোনার মত একটি ব্যবস্থা চালু করা। সিবিসি নিউজের এক খবরে এ কথা বলা হয়।
কমিশন উল্লেখ করে যে, কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী ও অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে প্রায়শ অতিরিক্ত অভিযোগ দেওয়া হয়। অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে আছে, বর্ণভিত্তিক একটি বৃহত্তর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তদন্তে অধিকতর স্বচ্ছতা আনা এবং মানসিক স্বাস্থ্য, মাদকাসক্ত বা গৃহহীন ব্যক্তিদের সাহায্য কামনায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প সংখ্যক পুলিশ অফিসারের সাড়াদান নিশ্চিত করা।
অন্টারিওর মানবাধিকার কমিশন এর অন্তবর্তীকালিন প্রধান ইনা চাধা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘অন্টারিওর সর্বত্রই পুলিশি ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত অসাম্যের ব্যাপকতর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। পদ্ধতিগত বর্ণবাদ নির্মূল করতে আমাদেরকে অবশ্যই সেই ব্যবস্থা সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করতে হবে যে ব্যবস্থা বর্ণবাদের টিকে থাকার সুযোগ দিয়েছে। আর আমাদের সরকারে সেরকম ব্যক্তিদের প্রয়োজন যাঁদের রয়েছে দূরদৃষ্টি, সমতার নীতিতে অঙ্গীকার এবং বিদ্যমান পদ্ধতি পাল্টে দেওয়ার কঠিন কাজ হাতে নেওয়ার মত দৃঢ় মনোবল।’
কমিশন বলছে, তাঁরা গত কয়েক বছর ধরে টরন্টোতে বর্ণবাদের স্বরূপ এবং কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের প্রতি বৈষম্য নিয়ে বিশেষভাবে গবেষণা করেছেন। তাতে তাঁরা অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে এটাও দেখেছেন যে, টরন্টো পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ কোনও ব্যক্তির নিহত হবার আশঙ্কা অন্য যে কোনও জাতিগত সম্প্রদায়ের লোক বা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অনেক বেশি।
২০১৭ সালে কমিশন টরন্টো পুলিশ সার্ভিসে সরকারি তদন্ত শুরু করে। এক বছর পর বিশেষ তদন্ত ইউনিটের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রকাশিত কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে টরন্টোতে পুলিশের হাতে একজন কৃষ্ণাঙ্গের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা কোনও শ্বেতাঙ্গের চেয়ে ২০ গুণ বেশি ছিলো। কমিশন বলেছে, পুলিশি ব্যবস্থায় বর্ণবাদের অস্তিত্ব কেবল টরন্টোতেই সীমাবদ্ধ এটা বিশ্বাস করা হবে অতিশয় ‘সরল’ বিশ্বাস।
এদিকে গত ২১ জুন কানাডায় জাতীয় আদিবাসীজন দিবসে এঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউট তাদের এক সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে যাতে দেখা যায়, প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের সামান্য বেশি সংখ্যক কানাডিয়ান বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের দেশটি বর্ণবাদী। এমন বিশ্বাস পোষণকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৩৫ বছরের কম বয়সী নারী (৫৪ শতাংশ), অশ্বেতাঙ্গ (৪২ শতাংশ), ৩৫ থেকে ৫৪ বছরের নারী (৩৯ শতাংশ) এবং আদিবাসী জনগণের (৩৬ শতাংশ) মধ্যে।
তবে এতকিছুর পরও একটা বিষয় অস্বীকার করা যাবে না যে, কানাডা এখনো বিশে^র অনেক দেশের তুলনায় বসবাসের জন্য সেরা দেশ। অন্যতম শান্তির দেশ এই কানাডা। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় শ্রেষ্ঠ সন্দেহ নেই। ভারতের কথাই যদি ধরি তবে দেখবো সেখানে একই ধর্মের এবং একই বর্ণের মানুষের মধ্যেও জাত প্রথা তথা বর্ণবাদ কি ভয়াবহ রকমে বিদ্যমান!
কিন্তু সময় পেরিয়েছে। মানুষ এগিয়েছে। আমরা দেখেছি, শত বছর আগেও কানাডায় বর্ণবাদ বেআইনী ছিল না, মহিলাদের ভোটাধিকার ছিল না এবং তারও আগে দাস প্রথা ছিল বৈধ। আজ কানাডায় বর্ণবাদ বেআইনী, মহিলারা শুধু ভোটাধিকারই নয়, ক্ষমতার শিখরেও পৌঁছে গেছেন। দাস প্রথা এখন কল্পনার অতীত। কিন্তু তারপরও কিছু সমস্যা রয়েই গেছে। বিশেষ করে বর্ণবাদ বিষয়ে। এটিকে বাতির নিচে অন্ধকার বলবো না অন্য কিছু?
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কিছুদিন আগে ইসলামভীতিসহ সব ধরণের ঘৃণা ও বর্ণবিদ্ধেষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কানাডিয়ানদের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন, এই লড়াইয়ের মাধ্যমে আমরা এমন একটি কানাডা গড়ে তুলবো ‘যেখানে সবাই বৈচিত্র উদযাপন করবো, যেখানে আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবো।’
জাস্টিন ট্রুডোর এই স্বপ্ন এবং আমরা যারা সম্প্রীতি ও সৌহার্দের স্বপ্ন দেখি তাঁদের সবার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য রাজপথের আন্দোলন ও আইন প্রণয়নের পাশাপাশি চাই সু-শিক্ষাও। কারণ কেবল রাজপথে আন্দোলন করে বা সরকারী আইন করে কোন মন্দ বা অশুভ প্রথাকে শতভাগ বন্ধ করা যায় না। তার সাথে প্রয়োজন হয় সু-শিক্ষারও। এই সু-শিক্ষাটা শিশুকালে দিতে পারলে সবচেয়ে বেশী কার্যকর হয়। আর তা না করে যদি বিদ্ধেষের বীজ শিশুকালে মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় তবে তা পরবর্তী কালেও বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু যদি সৌহার্দের নীতিবচন ও ভালবাসার বাণী শিশুকালেই কারো মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তবে তা হয় চিরস্থায়ী। বর্ণবাদ নির্মূলে কানাডার নীতিনির্ধারকরা এই বিষয়টির প্রতিও নজর রাখবেন এটাই আমাদের আশা।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ