মানুষের কথা

সাইদুল হোসেন

বার্ধক্যের দিনগুলি

জরাগ্রস্ত দেহ, রোগ-যন্ত্রণা ও হতাশা নিত্যসংগী! তৎসংগে মৃত্যুর মৃদু পদধ্বনি!

বার্ধক্য মানুষের জীবনে একটা অপ্রতিরোধ্য পর্যায় যা এড়ানোর কোনই উপায় নেই যদি না কোন কারণে ইতিপূর্বেই মৃত্যু ঘটে। মৃত্যু যেমন অবধারিত, বার্ধক্যও তাই – সে আসবেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবিরাম অগ্রগতির ফলে সারা বিশ্বেই আজ উন্নততর চিকিৎসা পাচ্ছে জনগণ, বহুক্ষেত্রেই জটিল রোগ নিরাময় অথবা অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু (longevity/life span) ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে দেশেদেশে। অধিকতর স্বাস্থ্যকর খাদ্যপানীয় ও বাসস্থানের প্রাপ্তি (availability) ও -better lifestyle-মানুষকে ক্রমে দীর্ঘজীবী করে তুলছে। বয়োবৃদ্ধদের (senior-দের) সংখ্যা তাই ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বয়স ৮০ অথবা ৮৫’র উর্ধে অথচ দৈহিক-মানসিক অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী এমন নারী অথবা পুরুষের দেখা পাওয়া মোটেই আশ্চর্য অথবা অকল্পনীয় কিছু নয় এযুগে।

এখন প্রশ্ন ঃ দীর্ঘজীবী বৃদ্ধ জনগণ কি সুখে-আনন্দে তাদের জীবনটা উপভোগ করছে অথবা করতে পারছে? তাদের পরিবার-পরিজন তাদের কি দৃষ্টিতে দেখছে? দেশের সরকারইবা কি ভাবছে তাদের নিয়ে?

মৃত্যুর উপর কারো হাত নেই, সে যেকোন বয়সেই এসে উপস্থিত হতে পারে। তা সত্ত্বেও মানুষ দীর্ঘ জীবন কামনা করে। এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ, পরিবারের আপনজনদের স্নেহ-ভালোবাসা, বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি, ধন-সম্পদ, সন্তানদের উন্নতি ইত্যাদি দীর্ঘ দিন ধরে উপভোগ করার বাসনা নরনারীর হৃদয়ে সদাজাগ্রত থাকে। মৃত্যুর পরের জীবন তো অজ্ঞাত, অজানা। অজানার প্রতি ভীতি মানুষের একটা সহজাত ধর্ম। তাই সে মৃত্যুকে ভয় পায়, মরতে চায় না, দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু একথাটাও তো সত্য যে দীর্ঘ জীবন কোন অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। কালের প্রভাবে সে জরাগ্রস্ত হবেই, দেহ ক্রমে দুর্বলতর হবে, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হবে, শ্রবণশক্তি কমতে থাকবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার ক্ষমতা হতে থাকবে সীমিত, দাঁতগুলো একেএকে সব পড়ে যাবে, হুঁশ-জ্ঞান (sensation) কমতে থাকবে, স্মৃতিশক্তি কমতে থাকবে, খাদ্য-পানীয় সহজে হজম হবে না, ঘনঘন অসুস্থ হয়ে পড়বে, পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি এবং আরো কত কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে সে! এদের কোনটাকেই রোধ করা যাবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে elder abuse-এর শিকারও হতে হবে। রিটায়ারমেন্টের পর আয় কমে যাবে, তাই সংগে যুক্ত হবে আর্থিক দুশ্চিন্তাও।

মানুষের গড় আয়ু ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে দেশেদেশে। ছবি : এজাজুল হক চৌধুরী

তাহলে দীর্ঘজীবী হয়ে লাভ কি? এমন আকাঙ্খাইবা মনে মনে পোষণ করার হেতু কি? এসব কথা কি আমরা কখনো ভেবে দেখি?

উপরে আলোচিত প্রসংগগুলো নিঃসন্দেহে নেতিবাচক চিন্তা (negative thoughts). তাহলে কি ইতিবাচক (positive) কোন চিত্র নেই মানুষের জীবনে? আছে, অবশ্যই আছে। তবে যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সদা-সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে সেটা হচ্ছে এই In all matters of life, play it safe and learn to live happily. Always carry a positive attitude. An optimist wins, a pessimist loses. চলুন তাহলে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া যাক একবার।

বার্ধক্যে সস্তোষজনক দৈহিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যে কৈশোরে এবং যৌবনে বেশ কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, কিছু নীতি-নিয়ম মেনে চলতে হবে (যাকে আমরা investment for the old age বলতে পারি) যার সুফল শেষজীবনে ভোগ করা যাবে। সেগুলো হবে এরকম Ñ

১)  মানুষ হিসাবে একজন আশাবাদী হতে হবে; নিরাশাবাদী বা হতাশ চরিত্রের লোকেরা সচরাচর নানা অসুস্থতা ও অস্থিরতায় ভোগে থাকে। আশাবাদীরা অধিক সুখী নিরাশাবাদীদের তুলনায়, scientific experiments একথা বারবার প্রমাণ করেছে।

২)  স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়ম-নীতিগুলো মেনে চলতে হবে, কর্মে-আহারে-নিদ্রায়-বিশ্রামে-বিনোদনে অর্থাৎ জীবনের সকল সক্রিয় কর্মকান্ডে তা করতে হবে। নিজেদেরকে সুস্থ রাখতে হবে। সাধ্যমত সকাল-বিকাল বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করাও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। কৈশোরে-যৌবনে নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চা বার্ধক্যে সুস্থ থাকার চাবিকাঠি। সুনিদ্রা হয় তেমন ব্যবস্থা করতে হবে তবে অবশ্যই sleeping pills খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যাবে না।

৩)  যৌবনে ও প্রৌঢ় বয়সে disciplined and punctual lifestyle বার্ধক্যে রোগ প্রতিরোধের ভূমিকা পালন করে থাকে। ঐ বয়সে দৈহিক উচ্ছৃংখলতা ও অবৈধ আচরণ অকালবার্ধক্য ডেকে আনে। সেই বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে।

৪)  নিজ ধর্মে অটুট বিশ্বাস রেখে নিয়মিত ধর্মচর্চা অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে বার্ধক্যে অধিকতর সুস্থ ও শান্তিময় জীবনের অধিকারী হওয়া সম্ভব। নিয়মিত প্রার্থনা দেহ-মনে প্রশান্তি এনে দেয়, রোগ-ব্যথার তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে। Power of prayer একটা প্রমাণিত সত্য, সেটাকে হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ধার্মিক লোকেরা অধিকতর সুখী একথা scientific experiments বারবার প্রমাণ করেছে। স্রষ্টার উপর সর্বদা বিশ্বাস ও ভরসা রাখতে হবে। তাঁর নির্দেশ মত জীবন যাপন করা মানসিক শান্তি লাভের জন্যে অপরিহার্য।

৫)  খোশ মেজাজ বজায় রাখা, খুঁতখুঁতে স্বভাব বর্জন করা, রাগ দমন করা, দীর্ঘ সময় ধরে টিভির সামনে বসে না থাকা, সদা প্রসন্ন থাকার চেষ্টা করা, অল্পেতে তুষ্ট থাকা, পরছিদ্রান্বেষী না হওয়া, ধর্মীয় বইপুস্তক পড়া, অসৎসঙ্গ থেকে দূরে থাকা, উত্তম সব বই পড়া, মুভি দেখা ও গান শোনা Ñ এই ধরনের কাজকর্ম দুশ্চিন্তাহীন জীবন যাপনে প্রভূত সাহায্য করে থাকে। সব সময়েই একটা competitive lifestyle ঠিক নয়, এতে tension বাড়ে, জীবন অসুখী থাকে।

৬)  অপরাধমূলক কাজ থেকে দূরে থাকা। এটা একটা প্রমাণিত সত্য যে অতীতে কৃত অপরাধের অনুশোচনা বৃদ্ধকালে অপরিসীম মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে; কোন কোন ক্ষেত্রে জটিল মানসিক রোগেরও সৃষ্টি করে। কষ্ট দেয়। অপরাধের গ্লানিমুক্ত জীবন হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়, অনুশোচনার যন্ত্রণা থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

৭)  একটি স্বার্থপরতাশূন্য, পরহিতাকাঙ্খী, সংবেদনশীল, দয়ালু ও নিষ্কলংক চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। তাহলে স্রষ্টার আশীর্বাদ ও মানুষের ভালোবাসা লাভ করা যাবে। তাদের শুভেচ্ছা হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেবে, দেহও সুস্থ থাকবে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে, সংগে সংগে অন্যদেরও শুভ কামনা করতে হবে। হিংসুকজন সর্বদা অতৃপ্ত, অসুখী, এই সত্যটা মনে রাখতে হবে। নীচতা অশান্তি ডেকে আনে। You reap what you sow. (অর্থাৎ যেমন বীজ বপন করবেন তেমন ফসল উঠাবেন।)

৮)  আর্থিক স্বচ্ছলতার চেয়ে বড় বন্ধু মানুষের জীবনে আর কেউ-ই নয়। উপার্জনশীল জীবনেই বার্ধক্যের জন্যে profitable investment করে রাখতে হবে যাতে তখন সন্তানদের উপর নির্ভরশীল হতে না হয়, তাদের অপমান-অবহেলা সহ্য না করতে হয়, কারণ বৃদ্ধ মা-বাবাকে সন্তানেরা তাদের উপর একটা বোঝা বলে গণ্য করে থাকে। দুুর্দিনের সঞ্চয় করুন (Make provisions for the rainy days), আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিতে হবে।

বার্ধক্যে পৌঁছার আগেই বাড়ির mortgage ইত্যাদি pay off করে দিয়ে ঋণমুক্ত হয়ে যাওয়াটা বাঞ্ছনীয়। পেনশনের আয় থেকে অথবা সঞ্চয়ের interestথেকে ঋণ পরিশোধ করতে হলে আর্থিক অনটনে ভুগতে হবে, সংসারের খরচ মিটাতে হিমসিম খেতে হবে। দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা বাড়বে। অসুস্থতা ডেকে আনবে।

নিজেদের বাড়ি না থাকলে ভাড়া করা বাড়িতে অথবা শারীরিক কোন সমস্যা থাকলে ওল্ড এইজ হোমেও থাকার ব্যবস্থা করা যায় যদি তেমন savings অথবা ইনভেস্টমেন্ট ইনকাম থাকে। তাছাড়া সরকারী চিকিৎসার সুবিধা তো রয়েছেই।

বৃদ্ধকালে আর্থিক সামর্থ্য থাকলে কেউ দুর্ব্যবহার করতে সাহস পাবে না, বরং সমীহ করে চলবে।

৯)  নিয়মিত কিছু পড়াশোনার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সম্ভব হলে কিছু লেখালেখি করা, যথা দৈনিক ডায়েরী অথবা জার্নাল লেখা। একটা intellectually productive lifestyle এ অভ্যস্থ হতে পারলে ভালো। সাময়িক পত্র-পত্রিকায় লেখা যায়, বই লিখে পাবলিশ করা যায়। বড়ই তৃপ্তিদায়ক অভ্যাস এগুলো। এই অভ্যাসগুলো যৌবনে গড়ে তোলা দরকার, তবে অবসর জীবনেও উদ্যম থাকলে তা করা অসম্ভব নয়। তাছাড়া এসব কাজে ব্যস্ত থাকলে অযথা idle time worries and anxieties থেকেও মুক্ত থাকা যায়, সময়টা ভালো কাটে। সাধ্যমত কিছু সমাজসেবা করা; হাসপাতালে, লাইব্রেরীতে ভলানটিয়ারিং করাটাও উত্তম কাজ। সম্ভব হলে নিজেদের পরিমন্ডলে ধর্মীয় অথবা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে কোন একটা বিষয়ের উপর আলোচনা করা অথবা বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ খুঁজে নেয়াটাও উত্তম কাজ। শ্রোতাদের প্রশংসা মনকে আনন্দ দেয়, তৃপ্ত করে। তাসের আড্ডা অথবা রাজনীতি চর্চা অথবা গীবত চর্চার চেয়ে এসব কাজ বহুগুণে উত্তম।

১০)  সদাসর্বদা জীবনের প্রতি একটা positive attitude গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। সুখ-দুঃখ জীবনেরই অংশ, এরা আসবেই, এদের সহজভাবে গ্রহণ করে নেয়াটা দুঃখের যন্ত্রণা কমানোর একটা শক্তিশালী হাতিয়ার। সহনশীল চরিত্র গড়ে তোলা, সামান্য অসুখে অথবা কোন দুঃসংবাদ শুনলেই বা সমস্যা দেখা দিলেই অস্থির হওয়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া ইত্যাদির স্বভাব থাকলে সেসব বর্জন করে ধৈর্যশীল হওয়াটাও লাভজনক। আত্মবিশ্বাসটা গড়ে তুলতে হবে। পরনির্ভরশীলতা চিরদিনই নিজস্ব দৃঢ় ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার পরিপন্থী, একথাটা মনে রাখতে হবে।

রোগে আক্রান্ত হলে যথাসময়ে অবশ্যই চিকিৎসা করাতে হবে, তবে অধৈর্য হয়ে হা-হুতাশ করাটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়, এটা দুর্বল চিত্তের লক্ষণ। এতে রোগ সারে না। বার্ধক্যে কিছু অসুস্থতা ও সমস্যাকে স্বাভাবিক ভেবে তাকে সহজভাবে গ্রহণ করাটাও কিছু দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার অন্য একটি উপায়।

সর্বাবস্থায় সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণে রেখে সুখ-দুঃখ সবই তাঁর ইচ্ছা এই মনোভাব পোষণ করতে হবে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এই attitude-টা দুঃখযন্ত্রণার তীব্রতা কমিয়ে দেয়।

সব ব্যাপারেই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাড়াহুড়া করলে কাজে ভুল হবে, সমস্যাটা বাড়বে। শুভাকাঙ্খীদের সংগে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়াটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ। রিটায়ারমেন্টের পর কোন ধরনের risky investment না করাটা বিচক্ষণতার পরিচয়।

১১)  সিনিয়র সিটিজেনদের চিকিৎসার ব্যয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে যা পাবলিকের উপর ট্যাক্সের বোঝা না বাড়িয়ে বহন করা দেশের সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কিছু কিছু চিকিৎসার খরচ ক্রমশঃই সিনিয়র সিটিজেনদের উপর চাপানো হচ্ছে। বৃদ্ধদের এই খরচটা বহন করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতিবাদ নিষ্ফল। এতে শুধু অশান্তিই বাড়বে।

নোট ঃ বার্ধক্যের নানা সমস্যা সমাধানের যেসব উপায় আলোচনা করা হলো তার অনেকগুলোর সুবিধাই বর্তমানের বৃদ্ধেরা কাজে লাগাতে পারবেন না একথা সত্য, কারণ তারা যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি, কিন্তু তাই বলে সম্পূর্ণরূপে হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। ইংরেজীতে damage control বলে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, তারা সেটাকে কাজে লাগাতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতি ও নিজ নিজ সামর্থ্য বিবেচনা করে যতটুকু সম্ভব অন্ততঃ ততটুকুর কন্ট্রোল নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারলেও শেষ রক্ষা বা damage control-এর কাজটা অনেকখানি করে ফেলা যাবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।

বার্ধক্যের বিষয়ে আরো কিছু কথা

অবসর জীবন

অবসর। বাংলা ডিকশনারী খুলে দেখতে পেলাম যে অবসর কথাটা বহু অর্থেই ব্যবহার করা চলে, যথাঃ ছুটি; অবকাশ; ফুরসত; কর্ম অথবা চাকরি থেকে বিদায়; সুযোগ; ফাঁক।

সচরাচর কোন কাজ থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে সেই ক্ষণটুকুতে আমরা একটু বিশ্রাম নিই, হারানো উদ্যম বা শক্তিকে ফিরে পেতে যাতে আবার পূর্ণ উদ্যমে কাজে মনোনিবেশ করতে পারি। সেই বিরতিকালটুকুই অবসর।

অন্যদিকে বহু বছর কোন চাকরি অথবা পেশায় নিয়োজিত থেকে পরিপূর্ণ বয়সে পৌঁছে সেই কর্মজীবন থেকে পুরোপুরি বিদায় গ্রহণ করা হলে তখন শুরু হয় অবসর জীবন। চাকরির/পেশার সব দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে চিরতরে মুক্তি নিয়ে নিরুপদ্রব অবসর, well-earned rest. Retirement. দৈনন্দির ছুটোছুটির অবসান। বিশ্রাম আর বিশ্রাম। আ-হা ! কি আরাম!

অবসর বিনোদন একটা অতি পরিচিত কথা যা বেশ গুরুত্বসহ দেখা দেয় retirement এর পর কারণ হাতে তখন প্রচুর সময় যা কাটানোর পন্থা খুঁজে বের করতে হয়। অনেক অর্থবিত্তের মালিক হলে অবশ্য দুশ্চিন্তার কিছু নাই কারণ পয়সা খরচ করে চিত্ত বিনোদনের অসংখ্য রাস্তা খোলা রয়েছে- দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, Cruise, পছন্দমত কোন শহরে বা দেশে গিয়ে দীর্ঘদিন বসবাসের ব্যবস্থা সহজেই করা যায়। কটেজে গিয়ে প্রকৃতির শোভার মাঝে বাস করাটাও অনেকের পছন্দ।

ঘরকুনো স্বভাবের হলে অথবা আর্থিক অনটন থাকলে ঘরে বসেই বই পত্রপত্রিকা পড়ে, টিভি/ইন্টারনেটে খবর-খেলাধুলা-সিনেমা-নাটক-নাচগান ইত্যাদি দেখে, এখানে-ওখানে ইনডোর গেইমস খেলে, আড্ডা দিয়েও সময় কাটিয়ে দেন বহুজন। তারা তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও মূল্যবান সময়টাকে কোন সৃজনশীল অথবা সমাজসেবা কাজে না লাগিয়ে এসবের অপচয় করেন। অথচ একটা কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকাটা দেহ ও মন দুটিকেই সুস্থ রাখে।

অন্য একদল আছেন যারা নানা ধরনের সমাজ সেবামূলক কাজে লেগে পড়েন। তারা চার্চ, হসপিটাল, নার্সিংহোম, পাবলিক লাইব্রেরী, স্কুল, ফুড ব্যাংক অথবা অন্যত্র ভলানটিয়ারিং করাটা অবসর কাটানোর পন্থা হিসেবে বেছে নেন। নিষ্কর্মা হয়ে ঘরে বসে থাকাটা তাদের কাছে time, expertise and energ ‘র অপচয় বলে মনে হয়। তারা কর্ম-চঞ্চলতা, সেবা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন।

আমার বয়স এখন ৮৯। আমিও একজন সিনিয়র সিটিজেন, আট বছরের অধিককাল নর্থ ইয়র্কের (টরন্টো) একটা বড় হাসপাতালে ভলানটিয়ার হিসাবে কাজ করেছি। সাড়ে চারশ নারীপুরুষ ভলানটিয়ারের মাঝে ৮০-৯০ বছর বয়সের বেশ কিছু ভলানটিয়ার ছিল আমার সহকর্মী। এদের মাঝে এমনও ছিলেন যারা ৩০-৪০ বছর ধরে ভলানটিয়ারিং করে গেছেন আনন্দের সংগে। আমার স্ত্রীও একজন ভলানটিয়ার ছিলেন। আমরা গর্বের সঙ্গেই ভলন্টিয়ারিং করেছি।

অবসর জীবন সম্পর্কে একটা অভিমত আমার খুব পছন্দ। কথাটা এই I have retired from work but not from life. I must pay back my debt to the society in whatever meaningful manner I can.  অবসর জীবনে এই ধরনের attitude and engagement অতি প্রশংসনীয়।

বহুজনেরই সাধ থাকে কবি-সাহিত্যিক হওয়ার, চিত্রকর হওয়ার কিন্তু কর্মজীবনে সেটা করার সুযোগ হয়ে উঠে না। অবসর জীবনে সেই পুরানো ইচ্ছাটাকে পূর্ণ করার সুযোগ এনে দেয়। এবং বাস্তবে তারা সেই সব চর্চা করে সুনাম কামিয়েছেন এমন দৃষ্টান্তÍ বিরল নয়।

ধর্ম মানুষের জীবনে বিরাট এটা ভূমিকা রাখে। কিছু অবসরভোগী অধিকতর ধার্মিক হয়ে পড়েন এবং ধর্মচর্চা বা প্রচারে মনোনিবেশ করে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন।

অবসরপ্রাপ্তদের মাঝে এমনও লোক আছেন যারা তাদের ফ্রি টাইমটার সুযোগ নিয়ে নিজেদের বাড়ি-ঘরের উন্নতি সাধনে নেমে পড়েন। কন্ট্রাক্টর-ঠিকাদার- রাজমিস্ত্রিদের সংগে সর্বক্ষণ লেগে থাকেন যাতে কাজে কোন ত্রুটি না থাকে অথবা কোন কিছুর অপচয় না ঘটে। পাখীপালন, ফুলের বাগান, ফলের বাগান, পুকুরে মাছের চাষ করা নিয়েও অবসর কালটা কাটান কিছু সৌখিন ও অর্থবান সিনিয়র সিটিজেন। অন্যদিকে আর্থিক অনটনে ভোগেন এমন অবসরপ্রাপ্ত লোকেরও অভাব নেই এই সংসারে; তাদের জীবন বড় কষ্টের।

চাকরির নিয়মিত আয়টা নেই অথচ দৈনন্দিন খরচের তালিকাটা খাটো করা সম্ভব হচ্ছে না। সংসারের বোঝাটা ভারী। এদের প্রায় সবাই নূতন চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন যদিও তারা বয়সের ভারে নত অথবা তাদের আধুনিক technology’র সার্টিফিকেট বা বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। তবু তারা ছোটাছুটি করতে থাকেন সামান্য কিছু হলেও একটু বাড়তি আয়ের আশায়। এদের ভাগ্যে অবসর বিনোদন লেখা নেই, এরা সব হলেন কম ভাগ্যবানদের দলে। এরা পরিশ্রম করা থেকে মুক্তি পান না সহজে। মাসিক পেনশনের টাকাটা যথেষ্ট নয় তাদের জন্যে।

অবসরপ্রাপ্ত জীবনের একটা বেদনাময় দিকও রয়েছে যে জন্যে রিটায়ারমেন্টটাকে পুরোপুরি আশীর্বাদ বলে গণ্য করা যায় না। বেদনার প্রধান কারণটা হলো ক্ষমতার, প্রতিপত্তির, পদ মর্যাদার লোপ, চেয়ারটা দখলে থাকাকালীন মান- সম্মান ও দাপটের অনুপস্থিতি। গুরুত্বহীন জীবন।

তারপর রয়েছে পদমর্যাদার সংগে প্রাপ্ত আর্থিক সুযোগ-সুবিধার (সরকারী বাড়ি, গাড়ি, ড্রাইভার, টেলিফোন ইত্যাদির) অনুপস্থিতি। আছে রুটিনবদ্ধ কর্মচঞ্চল জীবনের গতিরুদ্ধ হয়ে পড়ার ফলে মানসিক শূন্যতা। আছে স্বাস্থ্যহানি ও রোগব্যাধির আবির্ভাব। আছে আর্থিক দুর্ভাবনা অনেক ক্ষেত্রে। সবাইতো আর শেষজীবনের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জমাতে বা ইনভেষ্ট করতে পারেন না।

অপর একটা বাস্তব দিকও রয়েছে বৃদ্ধদের জন্যে দুর্ভাবনার।

অতীতে মানুষের আয়ু ছিল কম, রিটায়ার করার পর বেশী দিন বেঁচে থাকতেন না অনেকেই, মৃত্যু এসে জীবনের প্রদীপ নিভিয়ে দিতো। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে মানুষের গড় আয় (Life expectancy) অনেক বেড়ে গেছে আজকাল; নারীপুরুষ উভয়েই হয়ে পড়েছে দীর্ঘজীবী পৃথিবীর সব দেশেই। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘজীবন আশীর্বাদ নয় মোটেও। বাধর্ক্য, জরা ও রোগব্যাধি তো অপ্রতিরোধ্য; বাড়ে দৈহিক দুর্বলতা ও তৎসংগে পরনির্ভরশীলতা; বাড়ে অর্থের অনটন।

সামাজিক দৃষ্টিভংগীর আমূল পরিবর্তনের ফলে পারিবারিক দায়দায়িত্ব কাঁধে নিতে সন্তানেরা আজকাল আর আগের মত আগ্রহ বা নৈতিক দায়িত্ব বোধ করে না। স্বামী-স্ত্রী ও তাদের একটি-দুটি সন্তান, যত দায়িত্ব-কর্তব্য শুধু এদের কেন্দ্র করেই (nuclear family), মা-বাবা এই পরিবারের কেউ নয়,এই হলো বর্তমান পারিবারিক মূল্যবোধ। ফলে স্বভাবতই সন্তানেরা আর তাদের বৃদ্ধ অসহায় মা – বাবার প্রতি তেমন দায়িত্ব-কর্তব্য বোধ করে না, দেখায়না শ্রদ্ধা বা সহানুভূতি। যদিও বছরে একদিন করে Mother’s Day অথবা Father’s Day পালন করতে তেমন কোন আপত্তি নেই তাদের। অবহেলাই বর্তমান যুগে বৃৃদ্ধ মা-বাবার ভাগ্যলিপি। বাড়ে তাদের মানসিক যন্ত্রণা, বাড়ে তাদের দৈহিক যন্ত্রণা। বড় দুঃখময় জীবন এমন সব হতভাগ্য বাবাদের, মায়েদের। দীর্ঘ জীবনটা তখন একটা অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

তবে একটা শুভ পরিবর্তনও চোখে পড়ছে যা ক্রমশঃ প্রসারিত হচ্ছে। পরিবর্তনটা হয়তো আপনাদেরও চোখে পড়ে থাকবে। আর সেটা হলো বিবাহিত হোক, অবিবাহিত হোক আর্থিকভাবে সচ্ছল মেয়েরা তাদের বৃদ্ধ ও অসহায় মা-বাবার সাহায্যে এগিয়ে আসছে, নিষ্ঠুর ভাইদের স্থান দখল করে নিচ্ছে দয়ালু – হৃদয়বান বোনেরা। বিরাট ভরসার কথা বটে। অথচ আজো বহু পরিবারেই মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে মা-বাবার মুখ কালো হয়ে যায়, তাদের পুত্র সন্তান চাই।

সাইদুল হোসেন

মিসিসাগা