মানুষের কথা

সাইদুল হোসেন

আশার কথা

আশা। আশা নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে শত নিরাশার মাঝেও। যে আশা ছেড়েছে, নৌকা বাওয়া বন্ধ করেছে, তার নৌকা ডুবতে আর বাকি নেই। আশাই জীবন। Hope springs eternal in human heart.আশাই শক্তি, আশাই সাহস, আশাই আলোময় দিগন্তের পথপ্রদর্শক। ঘোর অন্ধকারেও আশার বাণী হৃদয়কে উদ্ধুদ্ধ করে, উজ্জ্বল আলোর রেখার মত পথের সন্ধান দেয়। “যে জন ডুবল সখি তার কিবা আর আছে বাকি গো!” কিছুই না। তরী ডুবলে তা ভাসানো কঠিন, তাই আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে শত বাধার মাঝেও তরী বাইতে যাতে সে ভাসমান থাকে, ডুবে না যায়। ডুবন্ত মানুষ বাঁচতে চায়, তাই সে হাতের কাছে খড়কুটো যাই পায় তাই আঁকড়ে ধরে যাতে সেটাকে অবলম্বন করে সাঁতরে সে তীরে উঠতে পারে, শক্ত মাটির সন্ধান পায়। মানুষ সহজ ও আয়েশী জীবন ভোগ করতে চায়, কিন্তু বিপদ দেখা দিলে বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে ভয় পায় না। কেন? কারণ আর কিছুই না, সে নির্বিঘ্ন জীবন নিয়ে আবার বেঁচে থাকতে চায়, জীবনকে উপভোগ করতে চায়। কারণ সে আশাবাদী, নিরাশার কালিমা তার স্বভাব বিরুদ্ধ।

এখানে এসে একটা প্রশ্ন মনে জাগতে পারে : আশা কি?

আশা কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নয়, তাকে চোখে দেখা যায় না, হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয়া যায় না। আশা হলো মনে একটা তীব্র অনুভূতি যা মানুষের মনে-মস্তিষ্কে হেরে না গিয়ে, হাল ছেড়ে না দিয়ে, উত্তম একটা কিছু করার প্রেরণা জাগায়, সামনে এগিয়ে যাবার শক্তি ও সাহস জোগায়। আশার শক্তি অসীম, তা না হলে রোগ-জরা-মৃত্যু, ঝড়-তুফান-ভূমিকম্প-জলোচ্ছ্বাসে সর্বস্ব হারিয়েও মানুষ নিজেকে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারত না, নূতন করে সৃজনশীল কিছু করতে পারত না। একটা কোটেশান দিই : ‘Hope injects tension into our beings-the tension of the bow that stretches to propel the arrow. The tenser the string, the more powerful the shot..’ বলেছেন Maurice Lamm.

আমি একটা হাসপাতালের বিভিন্ন ক্লিনিকে একজন ভলানটিয়ার হিসাবে কাজ করি। আমার কাজ পেশেন্ট এবং অন্যান্য ভিজিটরদের সঠিক ইনফরমেশান দেয়া, সঠিক স্থানে চিকিৎসার জন্যে পাঠানো অথবা সংগে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া। একটা ক্লিনিকে একটা যুবতী ষ্টাফ মেম্বার প্রায়ই একটা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে কাজে আসে যাতে বড় বড় অক্ষরে ছাপানো রয়েছে : LOVE, HOPE, HOPE, LOVE. এই যুবতীটিকে আমার খুব ভাল লাগে। “তুমি এই টি-শার্টটা এত ঘন ঘন গায়ে দিয়ে কাজে আস কেন?” আমার এই প্রশ্নের জবাবে সে একদিন বলল : I love this T-shirt because it encourages me to LOVE others and to maintain the HOPE that someday others will love me too! এর কথাগুলো আমার কাছ বড়ই sincere বলে মনে হলো এবং এরপর থেকে আমি ওকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখি।

এবার আশা পূরণ নিয়ে কিছু কথা। শুধু আশা করে সুদিনের আশায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে কি আশা পূরণ হবে কখনো? না, অবশ্যই না। আশা পূরণের জন্যে প্রয়োজনীয় চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে, বিবেক-বুদ্ধি খাটাতে হবে এবং হয় নিজেই সুযোগ সৃষ্টি করে নিতে হবে অথবা সুযোগ দেখা দিলে যথাসময়ে সেটাকে সদ্ব্যবহার করতে হবে। এবং এও জানা কথা যে সুযোগ জীবনে বারবার আসে না, সে দেখা দেয় ক্ষণিকের তরে। তাই সদাসতর্ক থাকতে হবে যাতে সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে না যায়। আবারো একটা কোটেশন দিই : I hope I have good luck in life – but that I do not depend on it. (Maurice Lamm).

তবে কখনো হতাশ হবেন না কারণ হতাশা নিরাশাবাদের জন্ম দেয় এবং নিরাশাবাদীরা অসুখী, জীবনে ওরা কিছুই অর্জন করতে পারেনা। তদুপরি ওদের স্বভাবই এমনি যে ওদের সংস্পর্শে গেলে অন্যদের মাঝেও হতাশার বীজ ছড়িয়ে দেয়।

আশাবাদী হোন। আশা এবং নিরলস চেষ্টা জীবনে সাফল্য ডেকে আনে। আশাই জীবনে সাফল্য লাভের চাবিকাঠি।

মনের খবর

মন। মন এক আশ্চর্য, রহস্যময় সৃষ্টি বিধাতার। অদৃশ্য, ধরাছোঁয়ার অতীত, আকৃতিবিহীন কিন্তু প্রকৃতি তার অতি চঞ্চল। দ্রুততম তার গতি-এই মুহূর্তে এই মাটির ধরায় অথচ পর মুহূর্তেই সে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহতারকানিবাসী অথবা গভীর সাগর তলায় বিচরণশীল। নিকটতম যেমনি, দূরতমও ঠিক তেমনি। মনের গভীরতা বা প্রসারতা মাপা মানুষের অসাধ্য। কোমলতায় ফুলের পাপড়িসদৃশ, কঠোরতায় সে সুকঠিন, দুর্ভেদ্যশিলা। কাছে টানতেও জানে, দূরে ঠেলে দিতেও জানে। হাসতে জানে, হাসাতেও জানে; কাঁদতে জানে, আবার কাঁদাতেও জানে। ভালবাসতে জানে, ঘৃণা করতেও জানে। কল্পনা করা মাত্র যে কোন সুদূর দূরত্বেই তৎক্ষণাৎ পৌঁছতে পারে। পারে সে সুদূর অতীত এবং অনাগত ভবিষ্যতেও অনায়াসে ভ্রমণ করতে। পারে সে সবই কিন্তু পারে না সে শুধু অন্যের মনের খবরটুকু জানতে। এখানেই সে অসহায়। এক মনের খবর অন্য মন জানতে পারে না। যাতায়াত সম্ভব নয় দুই মনের মাঝে। এ এক রহস্য বটে।

মন এক অদৃশ্য বস্তু যার সঠিক অবস্থান কারো জানা নেই, তবে ধরে নেয়া হয় যে মানুষের হৃদয়ের মাঝেই তার মনের বসতি। হৃদয় ও মন বলে বাংলা ভাষায় দু’টি কথা চালু আছে বটে কিন্তু দুটো শব্দই সমার্থক, হেরফের কিছু নেই। প্রয়োগের হেরফের মাত্র।

মনের খবর কেউ জানে না যার মন সেই ব্যক্তি এবং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া। অনুমান করে মনের সঠিক খবর জানার কোন উপায় নেই যদিও চোখ মনের আয়না বলে একটা কথা চালু আছে বটে। Psychoanalysis এর সাহায্য নিয়ে, thought- reading করে মনের কথা আঁচ করার চেষ্টা করা যেতে পারে কিন্তু সেটা নিতান্ত-ই অনুমান-নির্ভর। পুরোপুরি science নয়। কাজেই মনের খবর দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে অজানাই থেকে যায়। কখনওবা কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে সন্দেহ হলে অপরাধীকে Lie detector মেশিনের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রশ্ন করে জবাব আদায় করে এবং তার তাৎক্ষণিক আচার-আচরণ-পরিবর্তন লক্ষ্য করে সত্যমিথ্যা যাচাই করার চেষ্টা করা যায় বটে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও মনের খবরটা অনুমানই করা যায় মাত্র। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় না। সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

মন দেয়া যায়, মন নেয়া যায়। প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে মন দেয়া-নেয়া চলে। কিন্তু একথাটাও সত্য যে মনের ইচ্ছেটা বা অনুভূতিটা যখন মুখের ভাষায় রূপান্তরিত হয় একে অপরের কাছে, তখনই শুধু প্রেমের গোড়া পত্তন ঘটে। অনুক্ত প্রেম জমাট বাঁধে না। সেটা একতরফা প্রেমে বা Platonic love-এ পরিণত হয়ে অপূর্ণ থেকে যায়; পরিণতির সুখ, মিলনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থেকে যায় দু’পক্ষই। একের মনের খবর অপরকে দিলে তবেই সাড়া মেলে, তার আগে নয়।

মন দিয়ে অনুভব করা যায় যেমনি, মন দিয়ে দেখাও যায় তেমনি। কথায় বলে মনশ্চক্ষু দিয়ে দেখা। তবে এদেখা চোখে দেখার মতো চাক্ষুশ দেখা নয়, গভীরভাবে অনুভব করা, হৃদয়ঙ্গম করা, ইংরেজীতে বলতে গেলে visualization and realization আখ্যা দেয়া যেতে পারে। অন্তর্দৃষ্টি বা introspection-ও বলা চলে। কিন্তু এই মনশ্চক্ষুতে দর্শনই হোক অথবা অন্তর্দৃষ্টিই হোক এটা শুধু নিজেকে বিচার করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অন্যের ব্যাপারে অচল। তবে একথাও সত্য যে মনশ্চক্ষু খুলে গেলে নিজের দোষত্রুটিগুলো চোখে পড়ে, সাদাকালো, সত্যমিথ্যার ব্যবধানটা স্পষ্টতর হয়, চরিত্রটা শোধরে নিজেকে একজন উন্নততর চরিত্রের মানুষে পরিণত করার চেষ্টা করা যায়।

মন বিহঙ্গ উড়ে উড়ে চলে, সে চলার কোন শেষ নেই। সে বিহঙ্গ সদা নিঃসঙ্গ কারণ সৃষ্টিগত ভাবেই সে একা। তার ভুবনে সে একাই বাস করে, অন্য কারও প্রবেশাধিকার সেখানে নেই। তার ভাবনা-চিন্তা-কল্পনা শুধুই তার। তার মনের খবর অন্যের জানার কোন উপায় নেই। মন তার একাকীত্বের বোঝা একাই বয়ে বেড়ায়। সেই বোঝা কখনও বেদনার, কান্নার; কখনোবা তা আনন্দের। তবে ইচ্ছে করলে সে তার বোঝা হাল্কা করতে পারে যদি সে তার গোপন কথাটা দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বলে, তার আনন্দ-বেদনার ভাগ দেয়।

মন কখনো ঘুমায় না, সে সদা জাগ্রত। সে কল্পনার জাল বোনে, সে স্বপ্ন দেখায়। হয়তো সেই স্বপ্নের মাধ্যমে সে তার নিজস্ব ভুবনের খবর জানাতে চায় মনের মালিককে। যদিও যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নানা সমাজে স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে বহু গবেষণামূলক, বহু কল্পনানির্ভর ধর্ম-বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তবুও স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা কেউ জানে না; তাই স্বপ্নকে সচরাচর অলীক, অবাস্তব বলেই উড়িয়ে দিতে চায় মানুষ। অবশ্য কেউ কেউ যে সিরিয়াসলি নেয় না তা নয়; তারা তখন স্বপ্নের ব্যাখ্যার খোঁজে মোল্লা-পুরোহিতের বাড়িতে গিয়ে ধর্ণা দেয়। স্বপ্ন একেবারেই অর্থহীন এই ধারণাটা সম্ভবতঃ ঠিক নয়; স্বপ্নের একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা থাকা উচিৎ। ভোলা মন, খোলা মন, সরল মন, গরল মন, জটিল মন, কঠিন মন। মনের প্রকৃতি বহু ধরনের, তার ব্যবহারও তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন। Human behavior is unpredictable- মানুষের ব্যবহার কখন কেমন হবে সে সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। কারণ মনটা মানুষের তৈরী কোন মেশিন নয় যে তার ব্যবহার সব সময় একই রকম হবে। তার আবেগ-ইমোশন আছে, উঠানামা আছে, তাই সে কখনো কখনো অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত ব্যবহারও করে বসে যার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না- নিজের কাছেও না, অপরের কাছেও না।

মনের খবর জানতে হলে মনমোহন হতে হবে। মনকে মোহিত করে যে পরুষ  সে হয় মনমোহন; মনকে মোহিত করে যে নারী সে হয় মনমোহিনী। পুরুষরা প্রায়শঃই মনমোহিনী নারীর কাছে তার হৃদয়কে উন্মুক্ত করে মনের কথা অকপটে বলে ফেলে। সেই নারী তখন পুরুষটির মনের খবর জেনে ফেলে। কিন্তু সেই নারীর মনের খবর জানতে হলে অপেক্ষা করতে হয়। কখনো সেই অপেক্ষা অপেক্ষাই থেকে যায়। বিষাদময় কালক্ষেপণ।

“হলে হলে হো যায়েগা পেয়ার, চলি আ,

হলে হলে হো যায়েগা পেয়ার।”

হিন্দি মুভির গান। সেটার অর্থ হল “ধীরে ধীরে প্রেম জমে উঠবে, বন্ধু, ধীরে ধীরে, কাছে আস।” চাই ধৈর্য, তাহলেই অপর পক্ষের মনের খবর জানার আশা থাকে।

মন ছলনা করতেও জানে। মনের প্রকৃত অনুভূতিটাকে চেপে রেখে মুখের ভাষায় অথবা চেহারাতে সম্পূর্ণ বিপরীত একটি অভিব্যক্তি প্রকাশ করে শ্রোতা-দর্শককে ধোঁকা দেয়া মনের পক্ষে মোটেও কঠিন কাজ নয়। অভিনয় করা অতি সহজ তার পক্ষে কারণ মনের প্রকৃত খবরতো কারো জানার উপায় নেই। তাই মুখের কথাকেই বিশ্বাস করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

কিছু মন আছে সদা-সতর্ক, নিজের খবর রাখে আবার অন্যের খবরও রাখতে চেষ্টা করে। কিছু মন আছে খেয়ালি, আপন ভাবনায় নিমজ্জিত। এদেরকে উর্দু-হিন্দি ভাষায় বলা হয় “মন-মৌজি আদমী”, এরা সাধারণতঃ সিরিয়াস চরিত্র নয়, হাসিখুশি মানুষ। এদের ভাবখানা হচ্ছে “আপনি ধুনমে রাহতা হু” অর্থাৎ আমি আমার আপন ভুবনে বিচরণ করি, বাইরে কি হচ্ছে তা নিয়ে আমার কোন দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ নেই। আমার কাছে কোন খবরবার্তা নেই, বাবা।

মন নিয়ে পাঁচালী এখানেই শেষ করা যাক।

আনন্দের তালাশে

মানুষ মাত্রই আনন্দের পিয়াসী, তাই সে রাতদিন আনন্দের তালাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু আনন্দ ব্যয়সাপেক্ষ, আর কিছু আনন্দ চোখ-কান খোলা রাখলে নগণ্য অথবা বিনা খরচেই উপভোগ করা যায়। আনন্দের বহু রকমফের আছে। নির্মলানন্দ এবং কলুষিত আনন্দ হচ্ছে আনন্দের দু’টি চরিত্রগত ধরণ। আমি এখানে নির্মলানন্দ বা বিমলানন্দ যা মনকে অথবা দেহকে কলুষিত করে না সেই বিষয়েই কিছু আলোচনা করবো।

আনন্দের অপর একটি রূপও রয়েছে Ñ সরব আনন্দ ও নীরব আনন্দ। সরব আনন্দ হচ্ছে গান শোনা আর নীরব আনন্দ হচ্ছে বই পড়া; অঝোরে বৃষ্টিপাত অথবা তুষারপাত দেখা; সারিবদ্ধ পাখীদের ডানা মেলে নির্মল আকাশে উড়ে যেতে দেখা; গোধূলিবেলা সূর্যাস্ত দেখা; আকাশে রঙধনু দেখা দিলে তার অতুলনীয় সৌন্দর্যের ছটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করা; খালের-নদীর বা হ্র্র্রদের স্বচ্ছ পানিতে ছোটবড় নানা ধরনের মাছের খেলা লক্ষ্য করা; পুকুরের অথবা নদীর পানিতে দলবদ্ধ রাজহাঁস অথবা অন্যান্য প্রকার হাঁসদের ডুব-সাঁতার কাটা দেখা; পার্কে গাছের ছায়ায় বসে ছোটছোট শিশুদের চঞ্চল ছুটাছুটি দেখা ইত্যাদি।

আনন্দ উপভোগের আরো বহু ধরণ রয়েছে। যথা তাস হাতে নিয়ে একা একা Solitaire or Patience ইত্যাদি খেলা; বাগান চর্চা (gardening) করা; গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়া; বাইসাইকেল চালানো; গাছপালাভর্তি কোন Trail ধরে একা অথবা দু’জনে মিলে পথ চলা; সাঁতার কাটা; একাএকা সংগীত চর্চা করা; পাখীদের খাবার দেয়া; বড়শি দিয়ে মাছ ধরা; কাগজ-কলম হাতে নিয়ে word making অথবা crossword খেলা ইত্যাদি। উদ্ভাবনী শক্তি খাটিয়ে বহু ধরনের নির্মলানন্দ লাভের পন্থা খুঁজে নেয়া যায়। প্রিয়জনের সংগে দীর্ঘস্থায়ী টেলিফোনালাপও তো অপার আনন্দদায়ক।

ব্যক্তিগতভাবে আমি আনন্দ পাই পড়াশোনা করে, গল্প-প্রবন্ধ-কবিতা লিখে এবং গান শুনে। নূতন কিছুই নয়, শত-সহস্র নরনারী এটা অহরহ করে থাকেন। গান আমাকে আকর্ষণ করে, গানের কথা, সংগীত (music), গায়ক-গায়িকার মিষ্টি কণ্ঠ আমাকে মুগ্ধ করে; আমি সেই সবের সৌন্দর্যে ও বৈচিত্র্যে বিমুগ্ধ হই, তার ভাষা যা-ই হোক না কেন।

অতি সম্প্রতি সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের লেখা একটা গান শুনে আমার খুবই ভালো লেগেছে। আমি জানতাম না যে গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি গানও লিখতেন। আমার ছোট ছেলের মুখে শুনলাম যে তিনি বহু উত্তম গান রচনা করে গেছেন। নিচের গানটা সে-ই তার computer-এ বাজিয়ে শোনালো আমাকে একদিন। সুরকার এবং গায়ক S. I. Tutul.

‘ও কারিগর, দয়ার সাগর,

তুমি দয়াময়,

চান্নি পসর রাইতে যেন

আমার মরণ হয় ॥’

অপূর্ব সুন্দর, মিষ্টি, হৃদয়কে অভিভূত করে এমন একটি ইংরেজী গানের সন্ধান পেলাম চাইনীজ মুভি Crouching Tiger Hidden Dragon দেখতে গিয়ে। মূলতঃ action movie কিন্তু দু’জন নরনারীর প্রেমকে ঘিরে সেই কাহিনীটা হৃদয়স্পর্শী ও খুব উপভোগ্য। গানটার আকর্ষণে আমি অবসর পেলেই মুভিটাকে আবার দেখি। বিষাদময় একটা প্রেমের গান Ñ নারী কণ্ঠে – But hauntingly sweet! বারবার শুনেও আশ মেটে না। গানটা এরকম –

A LOVE BEFORE TIME

If the sky opened up for me,

And the mountains disappeared,

If the seas run dry

And turn to dust,

And the sun refused to rise,

I would still find my way

By the light

I see in your eyes.

If the world I know fades away

But you stay.

As the earth reclaims us too

And the cycle starts a new,

We will stay always in love.

In the love that we have shared.

Before time.

If the thieves take away

Every memory that I have,

I would still know the way

That would lead me

Back to your side.

Before time.

The North Star may die

But the light

I see in your eyes

Will burn there always

Lit by the love

We have shared

Before time.

One shining light

Will still remain.…………

আরো বহু সুন্দর সুন্দর কথা আছে গানটাতে। আমার এক ভাগ্নে Internet থেকে পুরো গানটা আমাকে একটা CD-তে তুলে দিয়েছে। বারবার সেটাকে বাজাই, আর ভাগ্নেকে ধন্যবাদ জানাই। ভাগ্নে জানালো যে গানটা মূলতঃ চাইনীজ ভাষার, কিন্তু সুর-তাল না বদলে সেটাকে English translation করে মূল সুরেই গাওয়া হয়েছে। সে চাইনীজ গানটাও CD -তে তুলে দিয়েছে। চমৎকার adaptation.

আনন্দের আরো একটি রূপ হচ্ছে কারো ভালোবাসা বা শ্রদ্ধার পাত্র হওয়া। এবার দু’জন অপরিচিত, অনাত্মীয়, অবাংগালী নারীর আমার প্রতি তাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কাহিনী শোনাচ্ছি। আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

দু’জন নারী, দু’জনই আফগান। নাম তাদের মাসুদা ও জোহাল। মাসুদার বয়স চল্লি­শের উর্ধে, ১৪ এবং ১০ বছর বয়সের দুই কিশোরী কন্যার মা। অতি সুন্দর হিজাব পরে চলাফেরা করে মা ও মেয়েরা। মাসুদার সংগে পরিচয় আমাদের এলাকার মসজিদের লাইব্রেরীতে। সেখানে সেদিন লাইব্রেরী এসিস্টেন্ট দু’টি মহিলাকে উদ্দেশ করে কোন একটা বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখছিলাম। আমার বক্তব্য শুনে মাসুদা খুব মুগ্ধ। ইসলাম ধর্মের উপর ইংরেজীতে লেখা আমার দুটি বই আমি মাসুদাকে গিফ্ট হিসেবে দিয়েছি। সালাতের উপর গবেষণামূলক বড় একটি English বইও দিয়েছি। তারপর থেকেই তিনি আমার এক গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে গেছেন। প্রতি শুক্রবারে জুমার নামাযের পর দেখা হলেই তার গাড়িতে করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটা আমার বারবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। গাড়িতে বসে টুকটাক নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। তার

বক্তব্য হচ্ছে আপনি আমার একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, পিতৃস্থানীয়। আপনাকে এটুকু ইয্যত দেখানো তো আমার জন্যে ফরয। দয়া করে কোন আপত্তি জানাবেন না।

সুতরাং আপত্তি আর জানাই না। মাসুদার অপ্রত্যাশিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আনন্দটুকু হাসিমুখেই উপভোগ করে যাচ্ছি। আল্লাহ তার মংগল করুন।

এবার জোহালের কাহিনী। মেয়েটির বয়স ২২-২৩ বছর। উর্দু ভাষাটা ভালো মতই জানে, সে পাকিস্তানে লেখাপড়া করে বড় হয়েছে। কারণ ওর বাবা ওর ৪০দিন বয়সে সপরিবারে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যায় এবং সেখানে ওরা দীর্ঘ ২০ বছর বাস করার পর ক্যানাডাতে ইমিগ্রেশন নিয়ে এসেছে। দুই-তিন বছর মাত্র হলো। মেয়েটি একটি হালাল ফুডস্ স্টোরে কেশিয়ার হিসেবে কাজ করে। সেখানেই প্রথম পরিচয় আমাদের। ঘনঘন সেই স্টোরে যেতে হয় তাই পরিচয়টা আরো গাঢ় হয়েছে। গেলেই নিজের সুখ-দুঃখের কথা বলে। অতি নম্রভদ্র ব্যবহার।

জোহাল খুব সুন্দরী যুবতী, পাক্কা হিজাবী। নিয়মিত প্রতি শুক্রবারে মসজিদে গিয়ে সে জুমার নামায পড়ে। ক্যানাডিয়ান ড্রেসে (পড়নে প্যান্ট, গায়ে একটা Top) ওকে দু’দিন দেখেছি হিজাব ছাড়া, খুবই attractive লাগছিল। সেই ড্রেস যেন সে আর কখনো না পরে, বখাটে ছেলেদের প্রলোভন দেখিয়ে নিজের কোন বিপদ যেন ডেকে না আনে সে বিষয়ে ওকে দু’বারই সতর্ক করে দিয়েছি। এতে আমার প্রতি জোহালের শ্রদ্ধা আরো বেড়েছে।

ওর মা-বাবা-ভাই-বোনদের সংগেও পরিচয় হয়েছে। ওর বাবা আমাকে দেখলেই আসসালামু ’আলাইকুম বলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। শপিং কার্ট ভর্তি গ্রোসারি নিতে গিয়ে দেখা হলেই বলেন : সাইদ ভাই, অর্ধেক তুমি নিয়ে যাও।

যখন বলি : কেন নেবো?

বৃদ্ধ জবাব দেয় : সিধি বাৎ, আপ মেরে ভাই হো না? ইসমে আপকা ভী হক্ হ্যায়। (এতো সহজ কথা। আপনি তো আমার ভাই! এতে আপনারও অধিকার রয়েছে!)

এবার জোহালের কথা বলে শেষ করি।

ওদের স্টোরে গ্রোসারি কিনে যখনই পেমেন্ট করতে যাই, সে আমার হাত থেকে টাকা নিতে চায় না, বলে, আমিই দিয়ে দেবো।

কেন তুমি দেবে? জানতে চাই আমি।

বাহ্-রে, তাতে কি? মনে করুন আপনার আদরের ছোট মেয়েটা অথবা আদরের একটা নাতনি, যে রেগিউলার একটা জব করে, সে গ্রোসারিটা কিনে দিয়েছে। এমনটা হতে পারে না কি?

জোহালের ছেলেমানুষি ব্যবহারে আমি হাসি কিন্তু ওর সরলতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করে। ওকে আমার গ্রোসারির বিল দিতে দিইনা কখনো, দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। মিষ্টি কথা বলে ওকে নিরস্ত করি। কিন্তু আমি জোহালের সরলতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাটুকু হৃদয় দিয়ে উপভোগ করি। আল্ল­াহ ওর মংগল করুন।

সাইদুল হোসেন মিসিসাগা