ভাইরাস অর্নিথিসাইরাস: সময়ের ঘেরাটোপ

(দ্বিতীয় পর্ব)

হাসান জাহিদ

সে পরিণত হলো সাংঘর্ষিক দ্বিসত্তাধারী লক্ষ-উদ্দেশ্যবিহীন ব্যক্তি। সে যেন নিজের সাথে যুদ্ধ করছে, এক প্রকার অন্তর্দ¦ন্দ্ব তাকে নিগৃহীত করে চলে। তার ভেতরে বর্তমান ও অতীতÑএই দুই পরাশক্তির যুদ্ধ চলমান। পুরোনো ব্যথা-বেদনা ফিরে এসেছে নতুন রূপে ও আঙ্গিকে।

                স্যাভেজ দেশে তার মতো সংগ্রামরত-অত্যাচারিত-ভীত-দিশাহারা রুমমেট শামিমকে সে স্বপ্নে দেখল রাতে। শামিম প্রায় উনিশ বছরের নিতান্তই ছেলে মানুষ আক্ষরিক অর্থেই। তেমনি নিরীহ-গোবেচারা আর নিরপরাধী। গেদা ছেলেটা বাবা-মা, পরিবার-পরিজন ছেড়ে ভিনদেশে এসেছিল একমুঠো খাবার যোগাতে, দেশে অভাবী পরিবারের মুখে অন্ন সংস্থান করতে।

                এমন অনভিজ্ঞ-নিরীহ ছেলেটা সবসময় ভীত থাকত। অভীক ছেলেটাকে পছন্দ করত। শামীম প্রায়ই বলত যে, অনেকদূর পড়ালেখা করে পিএইচডি লাভ করার বাসনা তার ছিল। সেইসাথে দোষারোপ করত নিজের মন্দ নসীবকে।

                “ধৈর্য ধরো, কিছু অর্থ উপার্জন করে তারপর ভালো কোনো দেশে গিয়ে ভালো জব করো।” অভীক তাকে বলত।

                একরাতে শামিমকে উদ্বিগ্ন দেখা গেল। ডিনারে বসে শামিম বলল, “আমি ওদেরকে ভয় পাচ্ছি।”

                “কাদেরকে?”

“রাস্তার ওই মাথায় কিছু বিজাতীয় লোক। তারা আমার দিকে কেমন অশুভ দৃষ্টিতে তাকায়। আমাকে দেখলে নিজেদের ভাষায় ফিসফিসিয়ে কীসব বলে।”

                “হুম। সাহস রাখো। ওদের দিকে তাকিয়ো না। সোজা হেঁটে চলে যাবে; কোনোভাবেই ঘাবড়াবে না।”

                শামিম ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে শুতে চলে গেল তার কামরায়। 

পরদিন শামিম কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে এলো না।

আর কখনও সে ফিরে আসেনি।

অভীক পুলিসকে জানিয়েছিল। তার খোঁজ পেতে নানা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। অগত্যা সে আবার পুলিসকে জানালে তারা বলল যে, তারা চেষ্টা চালাচ্ছে শামিমকে খুঁজে বের করতে।

সে মানব বিবর্তন ও সভ্যতা সম্পর্কে বই পড়া শেষ করেছে। রাত জেগে বই পড়ে পড়ে তার মনে হতে লাগল যে সে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে বিচরণ করেছিল। অভীক অতি কল্পনায় আক্রান্ত হয়।

সে মিত্রশক্তির পক্ষ নিয়ে নিজকে শকুনমুখী দানব খেচরে পরিণত করে আকাশে উড়তে উড়তে বোমা ফেলতে লাগল অক্ষশক্তির বিভিন্ন ঘাঁটিতে।

রাতভর জেগে থেকে, একটি অসভ্য দেশে অবস্থানকালীন সঞ্চিত ভয় সঞ্চালিত করে, তাকে ধারন করে অভীক অবাস্তব কিছু অনুভবের বেড়াজালে জড়িয়ে গেল। তার মনে হয়, ভয় তার শরীরে বিদ্যমান অসংখ্য ধমনীর একটি অন্যতম অনুষঙ্গ।

একরাতে সে জোরে হেসে উঠল, এবং অলি তার ঘরে ছুটে এলো।

“আধুনিকতার সংজ্ঞা কি?” অভীক অলিকে জিজ্ঞাসা করল।

“আপনি আমাকে যেভাবে জিজ্ঞেস করলেন আমিও ঠিক সেভাবেই ভাবছিলাম। আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখেছি।” অলি একটা চেয়ার টেনে বসল।

“আধুনিকতা মধ্যযুগীয় বর্বরতার ছায়া, এমনকি সেই বর্বরতাকেও ছাপিয়ে গেছে।”

“ঠিক, স্বৈরশাসকরা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে সক্রেটিসকে হত্যা করার পথ খুঁজে পেয়েছিল। মানুষ ততদিনে যথেষ্ট সভ্য হয়ে উঠেছিল কিন্তু তারা বর্বরদের মতো কাজ করেছিল।”

“হ্যাঁ।” অভীক অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে, “কিন্তু সক্রেটিস কেন তোমার মনে এলো?”

“কিছুদিন আগে আমি প্রথমবারের মতো হেমলক গাছ দেখেছিলাম থমসন পার্কে। আমি আমার বান্ধবীকে সাথে নিয়ে পার্কে গিয়েছিলাম। আমরা পিকনিক টেবিলে বসে সক্রেটিসকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা করেছি।”

“তোমার বান্ধবী আছে?”

“আমার স্ত্রী আছে কিন্তু সে আমার কাছ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। আমি তাকে এখানে আনতে পারছি না। আমি একটা মেয়ে বন্ধু খুঁজছিলাম। সে নেপালি মেয়ে।”

অলি অভীকের বিছানায় বইয়ের স্তূপ দেখছিল। সে একটা বিশেষ বই দেখছিল। অভীককে জিজ্ঞাসা করল বইটি সম্পর্কে।

“এইজেস অভ গাইয়া। লিখেছিলেন জেমস লাভলক, যিনি ষাটের দশকে একটি নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেনÑগাইয়া তত্ত্ব। গ্রিক দেবী গাইয়ার নামে নামকরণ করা হয়। আমি একদিন গাইয়া তত্ত্ব সম্পর্কে বলব তোমাকে।”

“আপনি একটি দশক যে দেশে বাস করেছিলেন সেই দেশ আপনাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। আপনার সেখানে যাওয়া উচিত হয়নি। আমি বলতে চাইছি, অসভ্যতার কিছু নমুনা দেখার পর, আপনার আরও আগে ফিরে আসা উচিত ছিল। অলি অভিযোগের স্বরে বলল।

“হ্যাঁ, আমি ভুল করেছিলাম, এবং আমি তার ফল ভোগ করছি। আমি এখনও জানি না শামিম বেঁচে আছে না মারা গেছে।”

“তাকে অবশ্যই কুত্তাখেকোরা খেয়ে ফেলেছিল,” অলি যোগ করল “বরং আমার নরখাদকেরা বলা উচিত।”

ভোরে কেউ দরজায় সশব্দে ধাক্কা মারছিল। অভীক দরজা খুলল। সে বৃদ্ধ দম্পতিকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। বৃদ্ধ চিৎকার করে বললেন, “তুমি কি মনে করো যে আমাদের ঘ্রাণশক্তি নেই?”

“না,” অভীক উত্তর দিল।

“আমাদের শ্রবণশক্তি কম, কিন্তু ঘ্রাণ পাই।” বৃদ্ধা বলেন, “গন্ধের অভাব মানে করোনাভাইরাসের অন্যতম লক্ষণ। আমরা গন্ধ পাচ্ছি।”

“তুমি কেমন মানুষ? দিনরাত একটি নন-ভেন্টিলেটিং রুমের ভিতরে ধূমপান করছো? তোমার সাহস হয় কী করে?” লোকটি রুক্ষ কণ্ঠে বললেন।

অলি জেগে উঠে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়Ñ“আমরা ক্ষমা চাইছি, এবং আমরা আর ভিতরে ধূমপান করব না।”

অভীক বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি খুব দুঃখিত।”

“তোমার অপকর্মের জন্য তুমি অবশ্যই লজ্জিত হবে, শুধু দুঃখপ্রকাশ কাজ করবে না।” বুড়ি বললেন।

“আমি যা করেছি তার জন্য লজ্জিত; আমি আর ভিতরে ধূমপান করব না, আপনাকে আশ্বস্ত করছি, ম্যা’ম।”

“একজন ধূমপায়ী হঠাৎ করে তার অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে না; তুমি বরং আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।”

“না স্যার, নিশ্চিতভাবে, আমরা ভিতরে ধূমপান করব না। আমি বরং ঘর থেকে বেরিয়ে যাব যদি আমার ধূমপান করতে ইচ্ছে করে।”

“হ্যাঁ স্যার, নিশ্চিতভাবে,” অলি মরিয়া হয়ে শব্দগুলি উচ্চারণ করল, “দয়া করে আমাদের ক্ষমা করুন।”

“নিশ্চিতভাবে, হ্যাঁ? কখনও না?” বৃদ্ধ তার বড় হাতের তালু অভীকের কাঁধে এত দ্রুত রাখলেন যে একটি চড়ের মতো শব্দ শোনা গেল।

“কখনও না, তাই না?”

অভীক মাথা নেড়ে কাঁধের ওপর বৃহৎ একটি হাত থেকে মুক্তি পেতে কিছুটা সরে গেল।

দম্পতি চলে গেলেন। অলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আর অভীক তার দিকে করুণ চোখে তাকাল, “অলি, আমি শীঘ্রই মারা যাব। কল্পনা করো, যখনই আমার ধূমপান করার প্রয়োজন হবে, ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাস্তায় নামতে হবে আমাকে। আমি আমার খাবারের আগে এবং পরে পড়ার সময় বা লেখার সময় খুব ঘনঘন ধূমপান করি। সবসময় আমার সিগারেট দরকার। আমার চিন্তাভাবনার পূর্ণতা আনতে আমার ধূমপান দরকার। একটি সমস্যা সমাধানের জন্য আমাকে ধূমপান করতে হয়। আমার ঘুমের আগে এবং পরে এটি প্রয়োজন। আমি কীভাবে বেঁচে থাকতে পারি?”

একরাতে অভীক এতটাই অস্থির হয়ে উঠল যে সে বেইজমেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো এবং হতাশায় নির্জন রাস্তায় হাঁটছিল। 

সে জানত না কেন একটি মোহনীয় কিশোরীর মুখ হঠাৎ তার মনে উঁকি দিল।

কিছু সময়ের জন্য, সে এমনকি মনে করতে পারেনি যে এটি কার মুখ হতে পারে, এবং মুখটি কোথায় দেখেছে। সে বারবার ভাবছিল এবং অতীতের দীর্ঘ ঘটন-পর্বে ফিরে গিয়েছিল। যা যা মনে আসছিল, স্মরণ করতে লাগল। আর তার এই স্মৃতিচারণে একের পর এক সিগারেট ধ্বংস হতে লাগল।

এক পর্যায়ে সে মেয়েটিকে মনে করতে পারে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার গন্ড বেয়ে। অভীক সারারাত আচ্ছন্ন হয়ে ছিল।

সে অর্থ উপার্জনের জন্য এবং পরিবারের জন্য যে সময় ব্যয় করেছিল তা চিরতরে চলে গেছে। এটা ফিরিয়ে আনা যাবে না। তার ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা রোমান্টিসিজম-নান্দনিকতা দুমড়েমুচড়ে

গেছে সেই কোন্ কালেই।

তার কর্মক্ষেত্রের সুপারভাইজার তাকে পিছন থেকে লাথি মারে, সে প্রতিবাদ করে। কেন সে তখন সেই দেশ ছেড়ে আসেনি?

অবচেতন মন উত্তর দিয়েছিল: তার অভিজ্ঞতার অভাব ছিল এবং অনিশ্চয়তাকে ভয় পেত। যদি সে সেই দেশ ছেড়ে দেশে ফিরে চাকরি করত, তবে সে নির্ভরশীল ভাই এবং এক বোনের দায়িত্ব পালন করতে পারত না।

   অভীক তার দেশে ফিরে আসে, এবং একটি শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করে কারণ তার ভাইবোনদের পড়াশোনার জন্য অর্থ সরবরাহ করতে পারছিল বিদেশি মুদ্রা দিয়ে।

তারপর আবারও যাযাবর জীবনের দিকে বাঁক নেয়া।

অভীক হেসে উঠল, “আরে অলি, আমাদের ধূমপানের দুঃসাহসিক অভিযানের কী হলো? তুমি বলেছিলে তোমার কাছে সমাধান আছে।”

“ইতোমধ্যে সমাধান হয়ে গেছে,” অলি বলল।

“সমাধান হয়েছে! কীভাবে? তুমি মজা করছো।”

“আমি মজা করছি না; আপনি প্রায় দুইমাস ধরে বেইজমেন্টে ধূমপান করছেন না, যার অর্থ আপনি ইতোমধ্যে বাইরে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অনুশীলন একজন মানুষকে নিখুঁত করে তোলে।”

তারা বাইরে এসে সিগারেট ধরাল।

“অবশ্য আমার মাথায় আরেকটা আইডিয়া আছে।”

“কী সেটা?” আগ্রহে অভীক অলির দিকে ঝুঁকল।

“আমরা বেইজমেন্টের ভিতরে ধূমপান করব।”

“তুমি ঠিক আছো?” অভীক ভাবল, চলমান সমস্যায় অলি হয়তো বেসামাল হয়ে আছে।

 “আমি ঠিক আছি, ভাই। বিকারগ্রস্ত নই।” অলি হঠাৎ রাগতস্বরে বলে উঠল, “বুড়াবুড়ি

আমাদের সব আওলা করে দিয়েছে। গতরাতে যখন আমি আমার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেছিলাম ফোনে, তখন আমার ফাঁপর লাগছিল, ধূমপান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি তা করতে পারিনি।”

“হুম, কিন্তু আমাকে বলো আমরা কীভাবে ভিতরে ধূমপান করব।”

“তারা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে। তাদের আসলে গন্ধের অনুভূতি নেই; বিষয়টা  হলো, তারা জানে যে আমরা ধূমপান করি, এবং সেদিন তারা কেবল ঝোপ বুঝে কোপ দিয়েছে। আপনি জানেন, তারা দুজনেই ধূমপায়ী, আমি তাদের বারান্দায় বসে ধূমপান করতে দেখেছি।”

“কিন্তু আফটার অল, তারা বাইরে ধূমপান করেন,” অভীক বলল।

“কে জানে, তারা ভিতরেও ধূমপান করতে পারেন। আমরা অভিযোগ করব যে তাদের সস্তা ব্র্যান্ডের ধোঁয়া আমাদেরকে অতীষ্ঠ করে তুলেছে, আমরা জোর দিয়ে বলব যে তারা ভিতরে ধূমপান করেন।”

অভীক হেসে বলল, “তুমি খুব মজার এবং হিউমারাস। কিন্তু আমরা কীভাবে গন্ধ পাচ্ছি যে তারা ধূমপান করছে। ধূম্র নিচে আসে না, ওপরে যায়।”

“এটা আমাদের কাছে আসে কারণ আমরা ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি। এবং আমাদের নাসারন্ধ্র উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন।”

অভীক হাসিতে ফেটে পড়ল, এবং পেট টিপে সে সাইডওয়াকে বসে পড়ল।

“তাহলে আমরা বেইজমেন্টে বিড়ি ফুঁকব?” অভীক তখনও হাসছিল আর কাশছিল।

“না। প্রথমে আমরা অভিযোগ করব, যদি এটি কাজ না করে তবে আমরা ধূমপান শুরু করব; তবে দুজনে একসাথে নয়।”

“আমরা যদি অভিযোগ করি, তাহলে কী হবে? তারা কি আমাদেরকে ধূমপান করতে দেবে?”

“নিশ্চিত নই, তবে এটি একটি অজুহাত হবে, আমি খোঁড়া অজুহাত বোঝাতে চাইছি। এটা তাদের দুর্বল করে তুলবে।”

“তাছাড়া, আরেকটি বিকল্প আছে এবং এটি খুব কার্যকর হবে।”

“কী?”

“এখন থেকে আমরা তাদের গতিবিধি দেখব। যখনই তারা বাইরে থাকবে, আমরা ধূমপান শুরু করব, এবং তাদের ফিরে আসার আগে, আমরা এয়ার ফ্রেশেনার স্প্রে করব। এটা ডলার স্টোরে খুব সস্তা।”

“আর আমার একটা আইডিয়া আছে।” অভীক যোগ করল, “প্রায়শই তারা লং ট্রিপে যায়, এবং কোনো কোনো উইকএন্ডে তারা তাদের ছেলেকে দেখতে ভ্যাঙ্কুভারে যায়। আমরা অবাধে ধূমপান করতে পারি।”

“তারা আগামী এক বা দুইমাসের জন্য যে কোনো দীর্ঘ ভ্রমণ করবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ,” অলি উত্তর দিল ভাবুক ভঙ্গিতে।

“তাহলে কী সিদ্ধান্ত?”

“আমরা প্রথম প্রক্রিয়া প্রয়োগ করব, অর্থাৎ, আমরা অভিযোগ করব। যদি এটি কাজ না করে তবে আমরা ধূমপান করব এবং স্প্রে করব। আপনি আপনার বিছানা জানালার কাছে. মানে বেইজমেন্টের ফোকরের কাছে স্থানান্তর করেন, যাতে সিগারেটের ধোঁয়া বের হবার একটা আউটলেট খুঁজে পায়।”

“ওকে, ডান।” অভীক খুশি মনে বলল।

***

তার কানে ভেসে আসে অলির কক্ষ থেকে গোঙানির শব্দ। গোঙানির স্বরেই অলি বলল, “আসবেন না অভীক ভাই। আমার ভীষণ জ্বর।”

অভীক ফোন করল একটা বিশেষ নাম্বারে। মুহূর্তেই হাজির হলো সুসজ্জিত প্যারামেডিক্স বহর। তারা অলিকে নিয়ে ছুটে গেল হাসপাতালে।

১০

একসময় খুলল কান্ট্রিস্টাইল, আড্ডা বা আলাপ আগের মতো জমল না। ক্রেসেন্ট টাউন থেকে হাসিব এসে যোগ দেয়। অলিবিহীন সতেরোটি দিন পার করেছে অভীক। এরমধ্যে দেশ থেকে অলির বাবা-মা-বোন অভীককে ফোন করে কেঁদেছেন। তারা জানালেন, অলির বউটা নাকি বাপের বাড়িতে চলে গেছে।

তাদেরকে কোনো প্রকার সান্ত¦না দেবার ভাষা অভীকের ছিল না।

শপিংমল, চেইন স্টোর, ডাউনটাউন, পানশালা আর ডানডাস স্কোয়্যারে, নায়াগ্রা ফল্সে মানুষের ভিড়, কেউ পড়তে পারছে না কারুর চোখের ভাষা। কেউ জানে না কে কোন্ ভাইরাস বহন করছে।

অভীক বললো, ‘খুব আনন্দিত হবার কিছু নেই, আপাতত ঠেকা দেয়া গেছে।’

‘এখন স্ট্র্যাটেজি হবে কন্ট্রোল, প্রি-কশন নয়। ঢিলেঢালা কন্ট্রোল, ইকনোমিতে ধস নেমেছে। আর কত লকডাউন দিয়ে থাকবে।’ মামুন বিড়বিড় করে বলল।

***

অভীক ফোন করল হাসিবকে। জানতে চাইল যে, বিশ্ব নেতাদের মাথায় প্রতি একশ’ বছরের ট্রেন্ড কাজ করেনি?

“তাই তো, ঠিকই তো,” হাসিব বলল, “তারা হয়তো ভেবেছিলেন ২০১৯ সালটা ব্যতিক্রম হবে।”

“হুম, একটু শপারস’ ড্রাগ মার্টে যাব প্রেসারের ওষুধ আনতে, তবে ভয় করছে। ড্যানফোর্থের ওই দিকটায় নাকি বাদুড়ের উৎপাত শুরু হয়েছে।”

“মাস্ক লাগিয়ে, হাতে গ্লাভস পরে, হেঁটে হেঁটে চলে আসুন। আমিও যোগ দেব আপনার সাথে।”

***

প্রেসারের ওষুধ আনতে শপার’সে যাওয়া হয়নি; বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। ঝড়-বৃষ্টি-তুষারপাতে ক্যানেডীয়রা অভ্যস্ত এবং তাদের প্রস্তুতিও থাকে; কিন্তু এখন ভিন্ন সময়, রাহুর গ্রাসের সময়।

বহু আগে বলা হাসিবের একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে অভীক শরীর ঝাঁকিয়ে হেসে নিল। একদিন ম্যাকডোনাল্ডসে আটকা পড়ল দুজন। হঠাৎই ভয়ঙ্কর তুষারপাত শুরু হলো, সেইসাথে ঝড়ো হাওয়ার মতো যমদূত বাতাস।

‘শুরু হলো মাসিক।’ হাসিব বলল, ‘প্রাকৃতিক এই বিষয়টি বড় বিরক্তিকর, মেয়েদের জন্যও, টরোন্টোর জন্যও।’

অগত্যা বৃষ্টিই দেখছিল অভীক; নৈর্ব্যিিক্তক বৃষ্টি, কোনো ভাবোদয় হলো না অভীকের। এইসময় ম্যাসেঞ্জারে একটা কল এলো। একটা মেয়ে ফোন করেছে। নাম ডালিয়া।

“কেমন আছেন?”

“ভালো, আপনি?” অভীক বলল।

“এই সময় যতটুকু ভালো থাকা যায়, ততটুকুই আছি।”

“হুম। পরম পবিত্র আত্মা সবাইকে ভালো রাখুন।”

“আচ্ছা, আপনি কি খুব নিঃসঙ্গ?” মেয়েটি বলল, “মনে হয় আপনি খুব একাকী।”

“এখন সবাই-ই একা।”

“তা জানি, আমি বলছি আপনি মহামারীর অনেক আগে থেকেই নিঃসঙ্গ।” ডালিয়া জবাব দিল।

“প্রতিটি মানুষই নিঃসঙ্গ কোনো না কোনো ভাবে। আপনি কি নিঃসঙ্গ?”

“আমি নিঃসঙ্গ।”

“আপনি কী জন্য কল করেছেন জানতে পারি?”

“পারেন। আসলে আমার একজন বন্ধু দরকার।”

“আমার চেনা এমন বন্ধুহীন কোনো বন্ধু নেই যে, আপনার বন্ধু হতে বলব।”

“আপনিই তো আমার বন্ধু হতে পারেন।”

“আপনি চেনেন আমাকে?”

“ভালো করেই, ফেসবুকে আপনার স্ট্যাটাসগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে আপনার একজন প্রকৃত বন্ধু দরকার। সঙ্গিনী দরকার। আসলে আপনাকে আমি অনেকদিন ধরে রীতিমতো রিসার্চ করে আসছি।”

“কেন?”

“সত্যি বলতে কি, আমি একজন প্রকৃত বন্ধু খুঁজছি। আপনাকে আমার কাছে খুব ব্যতিক্রমী একজন মনে হচ্ছে।”

“আমি আসলে কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিনি; আপনার বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারব কিনা জানি না; মেয়েদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নেই। আমি বিয়ে করিনি।”

“প্রেম করেননি?”

“না।”

“বিয়েও করেননি, প্রেমও করেননি? কোনো মেয়ে প্রেম নিবেদন করেনি আপনাকে, বা আপনার কোনো মেয়েকে ভালো লাগেনি?”

“আমার টাইম ম্যাশিন বলেÑকোনো একটি মেয়ে কোনো এক অতীতে আমার প্রেমে পড়েছিল; কিন্তু সেটা যে প্রেম আমি বুঝিনি।” (চলবে)

হাসান জাহিদ

টরন্টো

আশির দশকের গল্পকার। কানাডায় তিনি সাংবাদিকতা ও কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে গ্রাজুয়েট।