টরেটক্কা টরন্টো

সামাজিকতা ও ধর্মপালন -৬

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

“ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ,যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ”। প্রাচীন ভারতীয় চার্বাক দর্শন অনুযায়ী এই কথার মানে হচ্ছে, ঋণ করে হলেও ঘি খাও এবং পুরো জীবন সুখে কাটাও। চার্বাক দর্শন হচ্ছে এক প্রকার অনৈশ্বরিক দর্শন যার শেকড় প্রোথিত রয়েছে জড়বাদে। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে চার্বাক দর্শনের এই কথাটি আবার সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় দর্শন এনলাইটেনমেন্ট-এরও গোড়ার কথা। জগতে নিজেকে সুখী রাখাটাই হচ্ছে মুখ্য। নিজেকে সুখী রাখার জন্য আমরা কী উপায় অবলম্বন করছি সেটা বিবেচ্য নয় অর্থাৎ গৌণ। চার্বাক যেমন একটি বস্তুবাদী দর্শন, অনুরূপভাবে এনলাইটেনমেন্টও। রাষ্ট্রকে ধর্মীয় তথা চার্চের অনুশাসনের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে এই এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের উৎপত্তি হয় যা কিনা রেনেসাঁর ভিত্তিমূল বলে বিবেচিত। বলা হয়ে থাকে যে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে এনলাইটেনমেন্টের বিলুপ্তি ঘটে, কিন্তু আসলেই কি তাই? আজকের ভোগবাদী জীবনধারায় মানুষের মননে সেই চার্বাক কিংবা এনলাইটেনমেন্টের বীজ কিন্তু ঠিকই লুকিয়ে আছে। আর মানুষের মননে লুকিয়ে থাকা সেই বীজের খবর রয়েছে বড় বড় কর্পোরেটদের গোচরে। তাই তারা নিত্য নতুন পণ্য যেটার হয়ত তেমন কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই সেটাকে বাজারে এনে নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করছে কেনার জন্য। ‘ফেল কড়ি, মাখো তেল’-এর জমানায় নগদ কড়ি না থাকলেও অসুবিধা নেই। ক্রেডিট ব্যুরোর স্কোর দেখে ব্যাংক যোগান দিবে সেই কড়ি। ব্যাংক থেকে লোন নেয়াটা যত সহজ, শোধ করাটা কিন্তু তত সহজ নয়। রয়েছে নানা রকমের হিসাব নিকাশের মারপ্যাঁচ। শুনেছি আমাদের দেশে এককালে কাবুলিওয়ালা মহাজনেরা এসে মানুষজনকে টাকা হাওলাত দিত। তারা নাকি মাস শেষে সেই টাকার সুদ তুলে নিয়ে যেত, আসল টাকাটা চাইত না। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে আধুনিক ব্যাংকগুলোও কাবুলিওয়ালদের সেই পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছে। মাসিক কিস্তিতে পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য ‘এমোরটাইজেশন’ নামক গালভরা নাম দিয়ে যে হিসাব তারা করে, সেখানে কিন্তু প্রথমে তারা তাদের মুনাফাটাই আগে তুলে নেয়। ফলে বছরের পর পর টাকা শোধ দেয়ার পরও কিন্তু ঋণের ‘আসল’ টাকার অংকের তেমন রকমফের হয় না। তখন ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তির কাছে মনে হবে এ কোন ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’-র পাল্লায় পড়লাম। ফলে ব্যাংকের পাওনা মাসে মাসে শোধ দিতে গিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। কোন কারণে যদি মাসিক কিস্তি দেয়া বন্ধ হয়ে যায় কিংবা দেরী হয় ব্যাংক তখন সেই কাবুলিওয়ালার মূর্তি ধরে আবির্ভূত হয় দোরগোড়ায়। তাই কোনভাবেই যাতে সেই পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সেটারই সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয় মানুষকে। এক সময় আবিস্কার করে যে সে আধুনিক ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের দাসে পরিণত হয়েছে যেখান থেকে সহজে তার মুক্তি নেই। বলা হয়ে থাকে যে পশ্চিমা দেশে যদি কারো জব চলে যায় তবে প্রথমে সে হারায় তার গাড়ী, তারপর তার বাড়ী এবং অবশেষে তার নারী বা সঙ্গিনীকে। ‘ফাইন্যান্সিয়াল ফ্রিডোম’ শব্দটি তখন তাদের কাছে মধুর মনে হয় আর এই শব্দটিকে ভাঙ্গিয়ে এক শ্রেণীর ‘নন ফিকশনাল’ লেখক বাজারে বই লিখে অন্তত নিজেদের ‘ফাইন্যান্সিয়াল ফ্রিডোম’-কে নিশ্চিত করার তালে থাকেন।

টরন্টোস্থ আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিও এই কনজুমার ইকোনমির বাইরে নয়। এই কমিউনিটির বেশীর ভাগ সদস্যেরই অবস্থান কানাডার মিডল ক্লাস আর্থ-সামাজিক বলয়ে, যাদের নিজস্ব গাড়ী ও বাড়ী থাকাটাই এদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক। তবে দেখা গেছে যে টরন্টো শহরে অনেকেরই পেইড অফ গাড়ী থাকলেও পেইড অফ বাড়ী থাকা মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা হাতে গোনা। প্রায় সবাইকেই বাড়ী কেনার জন্য ফাইন্যান্সিং-এর দ্বারস্থ হতে হয়। কনজুমার ইকোনমির পাল্লায় পড়ে কয়েক বছর পর পর নতুন মডেলের গাড়ী কিংবা আরও বড় আকারের বাড়ী কিনতে যেয়ে নর্থ আমেরিকার মানুষেরা ‘কার লোন’ আর ‘হাউস লোন’-এর বোঝা টেনে যায় সারা জীবন, অনেকটা সেই ঋণ করে সারা জীবন ঘি খেয়ে যাওয়ার মতন। ইসলামে রিবা অথবা সুদ হারাম হওয়ার কারণে বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেকেই কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ী কিনতে আগ্রহী নন। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো রিবা যে শুধু ইসলামেই নিষিদ্ধ তা কিন্তু নয়, খ্রীস্টান এবং ইহুদী ধর্মেও নিষিদ্ধ। হিব্রু ভাষায় আরবী শব্দ ‘রিবা’-কে বলা হয় ‘রিবিট’। প্রাক ইসলামিক যুগে ধনী শ্রেণীর মানুষেরা  মাত্রারিক্ত সুদের বিনিময়ে ঋণ দিয়ে সমাজের ভালনারেবল শ্রেণীকে সারা জীবনের জন্য নিজেদের ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করে ফেলত। এটা ছিল এক অবর্ণনীয় জুলুম। সেই জুলুম রোধে জুডিও-খ্রীস্টীয় ধর্মেও আল্লাহ্‌ তা’য়ালা রিবাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। অর্থাৎ আব্রাহিমিক রিলিজিয়নের তিনটি শাখাতেই রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মগুলি এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। আবার মুসলমানদের ভেতর একটা শ্রেণীও এ ব্যাপারে উদাসীন যারা কনজুমার ইকোনমির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। তাদের ভেতর আবার অনেকেই কনজুমার ইকোনমিই যে মানুষের জন্য মঙ্গলজনক সেটাকে তারা অনেকটা বেদবাক্যের মতন মনে করেন। মুসলমানদের এক শ্রেণী আবার যারা ইসলামের যাবতীয় রীতি মেনে চলেন, কিন্তু বাড়ী কেনার ব্যাপারে কনভেনশনাল ব্যাংকের শরণাপন্ন হন। তারা মনে করেন জরুরতের কারণে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়ী কেনাটা জায়েজ। তাদের পক্ষে অবশ্য বেশ কিছু আলেমের ফতোয়াও রয়েছে। আরেক শ্রেণী মুসলিম মনে করেন যে কোন অবস্থাতেই কনভেনশনাল ব্যাংক থেকে বাড়ী কেনার জন্য লোন নেয়া যাবে না। কারণ কোরান শরীফের সুরা বাকারার ২৭৮ এবং ২৭৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে যে “হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ইমানদার হয়ে থাক। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও”।

ওমর কালাইর -সিইও, ইউএম ফাইন্যান্সিয়াল ইনক এবং ইউসুফ পাঞ্চভায়া -মুফতি, ইউএম ফাইন্যান্সিয়াল ইনক। ছবিঃ সিবিসি নিউজ পোর্টাল থেকে সংগৃহীত

যারা কনভেনশনাল ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়ী কিনতে নারাজ, তাদের ভেতর এক গ্রুপ অবশ্য শরীয়াহ কমপ্লায়েন্ট ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কোম্পানীর মাধ্যমে বাড়ী কিনেছেন কিংবা কেনার চেষ্টায় রয়েছেন। অপর গ্রুপটি আবার ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কোম্পানীগুলোকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন না। এই গ্রুপের লোকেরা হয় এক হাতে বাড়ীর চাবি আর অন্য হাতে বাড়ীর পুরো মূল্য পরিশোধ করে বাড়ী কিনবেন নতুবা নয়। কারণ সেটাই ইসলামের ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান। আর যদি সেটা সম্ভব না হয় তারা ভাড়া বাড়ীতেই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে প্রস্তুত। তবে যেভাবে বাড়ীর দাম আর সেই সাথে বাসা ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে, তাতে তাদের পক্ষে বাড়ী কেনা তো অসম্ভব এমন কী একটা ডিসেন্ড অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা বাসা ভাড়া করা পর্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ছে। আর ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পর তাদের জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা না থাকাতে সেই ভাড়া বাসাতে বাস করাটাও দূর্বিষহ হয়ে উঠছে। বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের ভিতর এক ধরনের হীনমন্যতা যে তৈরি হচ্ছে সেটা জেনে বুঝেই শুধুমাত্র পরকালের কঠিন শাস্তির ভয়ে দুনিয়ার এই দূর্ভোগকে তারা হাসিমুখে সহ্য করে যাচ্ছেন। তবে এই ছেলেমেয়েরা কিন্তু নর্থ আমেরিকার এডুকেশন সিস্টেমে বেড়ে উঠা জেনারেশন যারা ফেইথের ব্যাপারেও অনেক কিছু র‍্যাশনালি চিন্তা করে এবং প্রশ্ন করে। অতএব বাবা-মার রিলিজিয়াস ভিউজের কারণে তাদেরকে যে কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে সেটা কিন্তু তারা মুখ ফুটে না বললেও মনের গভীরে ঠিকই লালন করবে। নর্থ আমেরিকার ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম নয় বরং তাদের বাবা-মার চয়েজের কারণে তাদেরকে এই জীবন যাপন করতে হচ্ছে এ কথাটি হয়ত তাদের মনে গেঁথে যাবে। ভবিষ্যতে এই ব্যাপারটা তাদের জীবনে কীভাবে প্রতিফলিত হবে সেটা সময়ই শুধু বলে দিতে পারবে। আলজেরিয়া থেকে আসা অভিবাসী মুসলমানদেরকে বিভিন্ন সিস্টেমিক রেসিজমের বেড়াকলে ফেলে ফ্রান্স তাদেরকে ‘ঘেটো’-র জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছিল। সেখানকার তরুণ সমাজের ভেতর ঘেটোতে বেড়ে উঠার দাগ কিন্তু রয়েই গেছে।

ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কোম্পানীগুলো থেকে এই গ্রুপের লোকেরা যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সেটারও অবশ্য অনেক কারণ রয়েছে। ইসলামে ঋণের বিধান আছে শুধু ‘কর্জে হাসানা’ কিংবা ‘উত্তম ঋণ’-এর যেখানে ঋণের টাকার সম পরিমান টাকাই শোধ দেয়ার নিয়ম। যদিও এখন অনেকে সময়ের সাথে কাগুজে টাকা কিংবা ফিয়াট মানির ক্রয় ক্ষমতা যে কমে যায় সেটা কি ‘কর্জে হাসানা’-এর ক্ষেত্রে আমলে নিতে হবে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবে বাড়ী কেনার জন্য কোন ইসলামী ব্যাংক ‘কর্জে হাসানা’ দেয়ার জন্য বসে নেই। তারা এই ক্ষেত্রে যে বাড়ী ক্রয় করতে ইচ্ছুক তার সাথে একটি ব্যবসায়িক চুক্তির মাধ্যমে তাকে বাড়ীটি কিনে দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। এই চুক্তিটির বিভিন্ন প্রকার রকমভেদ আছে এবং তার কিছু আরবী নামও আছে। যেমন, মুদারাবা, মুশারাকা কিংবা মুরাবাহা। জর্ডানে অবস্থিত একটি শরীয়াহ বোর্ড আছে যারা ইসলামিক ব্যাংকিং-এর বিভিন্ন রকম ট্রানজেকশনের চুলচেরা গাইডলাইন তৈরি করেছে। এই বোর্ডটি ‘আইওফি’ (AAOIFI) নামে পরিচিত। কোন ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কোম্পানী যখন তাদের কার্যক্রম এই ‘আইওফি’-এর বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুসারে চলে তখন তারা হবে ‘আইওফি’ কমপ্লায়েন্ট। কোন কোন কোম্পানী আবার ‘আইওফি’ সার্টিফায়েড। টরন্টোতে এখনও কোন কোম্পানী দাবী করেনি যে তারা ‘আইওফি’ সার্টিফায়েড। এ নিয়ে আলোচনার সময় অনেক কোম্পানী শুরুই করে এভাবে যে, ‘রোম ওয়াজেন্ট বিল্ট ইন অ্যা ডে’। অর্থাৎ যেন শরীয়াহ কমপ্লায়েন্টের ব্যাপারেও একই লজিক প্রযোজ্য। তাদের কথার ধরন দেখে আমরা যেটা বুঝব, আজ তারা পুরোপুরি হালাল সার্ভিস দিতে না পারলেও ধীরে ধীরে তারা সে দিকে অগ্রসর হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে দিবেন। কিন্তু তারা কখনই খোলাসা করে বলেন না ঠিক কোন জায়গাতে তাদের সার্ভিস হালাল নয় এবং সেই গ্যাপ পূরণে তাদের রোড ম্যাপ কী। বেশ অনেক বছর আগে যখন নর্থ আমেরিকাতে মুসলিমদের সংখ্যা কম ছিল তখন হালাল মুরগী পাওয়াটা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। দিনে দিনে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আজকে নর্থ আমেরিকার অনেক নামীদামী গ্রোসারী স্টোরগুলোতেও সহজেই হালাল মুরগী পাওয়া যাচ্ছে। তাদের ভাষায় হালাল ফাইন্যান্সিং-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আজকে যদিও তারা শতভাগ হালাল মর্টগেজের ব্যবস্থা করতে পারছেন না, তবুও কনভেনশনাল ব্যাংকে না গিয়ে বেশ কিছুটা চড়া সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে হলেও তাদের কাছ থেকে বাড়ীর মর্টগেজ নেয়াটা মুসলিমদের কর্তব্য। বেশ কিছু স্কলার তাদের ইউ টিউব চ্যানেলে এ কথাটাই বলেছেন। এনালজি হিসেবে এসেছে হালাল ভার্সেস নন-হালাল মুরগী, স্বাদে কোন পার্থক্য না থাকলেও আছে সার্টিফিকেটের মাহাত্ম্য। আর ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কোম্পানীগুলো সেই হালাল সার্টিফিকেট দিচ্ছে যদিও তারা নিজেরাই ‘আইওফি’ সার্টিফায়েড নন। পশ্চিমা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে রিবা কিংবা ইন্টারেস্ট নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আজকাল ইউ টিউবে হর হামেশাই দেখা যাচ্ছে। পক্ষে এবং বিপক্ষে একেক মুফতির একেক মত। ফলে হালাল মর্টগেজ বলতে আমরা কি বুঝি এবং সেই সাথে সেই সার্ভিসটা আদৌ কি কেউ দিচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে একটা আবছায়া তৈরি হয়েছে। আর সেই আবছায়া থেকে একেক জনের ‘টেক অ্যাওয়ে’ আবার একেক রকম। একদল ভাবছে, ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কোম্পানী কীভাবে ফাইন্যান্স করছে সেটা তাদের ব্যাপার, আমরা তো আর ইন্টারেস্ট দিচ্ছি না। আরেকদল ভাবছে এটা আসলে ‘রিবা ইন ব্যাকডোর’ আর ফাইন্যান্সিং কোম্পানীগুলো এখানে ‘সিন ঈটার’ বা ‘পাপ খাদক’ হিসেবে কাজ করছে।

টরন্টোতে ২০০৮ এবং ২০০৯-এর দিকে ‘ইউএম ফাইন্যান্সিয়াল ইনক’ নামক একটি ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানী ‘সেন্ট্রাল ওয়ান’ ক্রেডিট ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে অর্থায়ন করে হালাল মর্টগেজের সার্ভিস শুরু করে। তারা একই সাথে আবার বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে কনভেনশনাল ব্যাংকের চাইতে অধিক মুনাফা দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে টাকা নেয়া শুরু করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই সবকিছু লেজে-গোবরে করে প্রায় ৩২ মিলিয়ন ডলারের মর্টগেজকে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ করে দিয়ে ‘ইউএম ফাইন্যান্সিয়াল’ নিজেকে দেওলিয়া ঘোষণা করে। তখন এই গ্রুপের অপেক্ষাকৃত তরুণ সিইও ওমর ফারুক কালাইর এবং হেড মুফতি ইউসুফ পাঞ্চভায়া-এর বিরুদ্ধে ‘ফ্রড’, ‘থেফট’, ‘লন্ডারিং দ্য প্রসিডস অব ক্রাইম’ সহ মোট ছয়টি ধারায় কেস হয়। দীর্ঘ আট বছর পর যদিও ওমর কালাইর এবং ইউসুফ পাঞ্চভায়া তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে অব্যহতি পান, কিন্তু আমানতকারীরা তাদের সর্বস্ব খুইয়ে ফেলেন ইউএম ফাইন্যান্সিয়ালের কাছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় এখানে যে ওমর কালাইর প্রায় দুই মিলিয়ন ডলারের গোল্ড বার কিনেন। পরবর্তীতে তিনি দাবী করেছেন যে মিশরে অবস্থিত কোম্পানীর মুফতিদের ফি এই গোল্ডবার দিয়ে পরিশোধ করেছেন। ‘ইউএম’-এর কেসের ফলাফলে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়েছে যে কানাডার প্রচলিত আইন দিয়ে ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কোম্পানীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করাটা অনেকটা অসম্ভব। এই কেসের বিচারক জাস্টিস জেন ফার্গুসন তার ভার্ডিক্টে উল্লেখ করেছেন যে কেসটি ছিল অসম্ভব জটিল এবং তাকে ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর উপর প্রচুর পড়াশুনা করতে হয়েছে। তিনি কোন উৎস থেকে ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করেছেন তা অবশ্য তিনি উল্লেখ করেননি।   

ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর মাধ্যমে বাড়ী কেনা কনভেনশনাল মর্টগেজের মতন স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড অথবা সহজ সাধ্য কেন নয়? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আজকের ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর সূচনা কীভাবে হয়েছিল সেই ইতিহাস জানাটা জরুরী। পেট্রো ডলারের প্রাথমিক যুগে অর্থাৎ সত্তুরের দশকের শুরুতে সৌদী আরবে যখন পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাংকগুলি এসে ব্র্যাঞ্চ খুলতে শুরু করে তখন ‘সুদ’ বা ‘রিবা’ ব্যাপারটা যেন একেবারে ঘরের ভেতর এসে হাজির হয়। এর আগে অটোমানদের আমলে চালুকৃত ওয়েস্টার্ন ব্যাংকগুলির কার্যকলাপের সাথে সাধারণ মুসলমানদের তেমন কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। কারণ তখন মুসলমানদের ব্যবসার পুঁজি সাধারণত আসত সমাবয় সমিতির মাধ্যমে। সৌদী ওলামাগণের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সৌদী বাদশাহ ফয়সলের উদ্যোগে সূচিত হয় ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর যাত্রা। যেহেতু আধুনিক অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর কোন ‘রেডি টু ইউজ’ ফর্মূলা হাতের কাছে ছিল না তাই বাদশাহের উৎসাহে তৈরি হল একটি আন্তর্জাতিক ওলেমাদের দল যাদের কাজ হল কনভেনশনাল ব্যাংকিং-এর বিভিন্ন মোড অব ট্রানজেকশন খতিয়ে দেখা এবং সে গুলোর প্যারালাল হালাল মোড অব ট্রানজেকশন তৈরি করা। অর্থাৎ ইসলামিক ফাইন্যন্সিং-এর যাত্রা শুরু হলো এমন একটা রেসের ঘোড়াকে দৌড়ে ধরাকে লক্ষ্য করে যে কিনা অনেক আগেই ছোটা শুরু করে দিয়েছে। সৌদি আরবে সে সময় ইংরেজী জানা ওলামা ছিল না তাই পাকিস্তান এবং মালেয়শিয়া থেকে বেশ কিছু ওলামাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এই মহৎ উদ্যোগে শরীক হওয়ার জন্য। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রথম ইসলামিক ফাইন্যন্সিং-এর রূপরেখা তৈরি হয় এবং সেই মোতাবেক ১৯৭৫ সালে চালু হয় দুবাই ইসলামিক ব্যাংক। এরপরে মালেয়শিয়া, পাকিস্তান সহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলিতে চালু হতে থাকে বিভিন্ন ইসলামিক ব্যাংক। ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর বিভিন্ন প্রকার মোড অব ট্রানজেকশনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলিকে শরীয়াহর দৃষ্টিতে বিচার বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ওলামা তাকি উসমানীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে তার গবেষণামূলক লিখিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। তবে এ কথা মনে রাখা ভালো যে ইসলামিক ফাইন্যান্সিং-এর রূপরেখা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে কিছু সংখ্যক ওলামাদের ইজতিহাদ বা ব্যক্তিগত মতামতের উপর। এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোন ইজমা বা ঐক্যমত্য তৈরি হয়নি। অনেকেই বর্তমান ইসলামিক ফাইন্যান্সিংকে পাশ্চাত্যের ব্যাংকিং ব্যবস্থারই ইসলামীকরণ বলে এর সমালোচনা করে থাকেন। বিশেষ করে ‘মুরাবাহা’ কিংবা ‘কস্ট প্লাস’ মোড অব ট্রানজেকশনকে শরীয়াহ সম্মত বলে মানতে তারা নারাজ। কারণ এই পদ্ধতিতে অংশীদারিত্বের কোন ব্যাপার নেই, বরং ক্রেতাকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের মধ্যে ফেলা হয় যা ইসলামের দৃষ্টিতে কতখানি জায়েজ তা প্রশ্নবিদ্ধ। ইন্টারেস্টিং বিষয় এই যে বর্তমানে দুনিয়াজোড়া ইসলামিক ব্যাংকিং-এর প্রায় শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লেনদেনই হয় এই মুরাবাহা পদ্ধতিতে।

এইসব জটিলতার কারণে যে গ্রুপটি আপাতত বাড়ী কেনা থেকে বিরত আছেন, তাদের সঞ্চয়ে বেশ কিছু টাকা অবশ্য অলস পড়ে থাকে। অলস টাকার যেহেতু যাকাত আছে,ফলে তারা সেই টাকাটা নিয়ে বেশ বিপাকেই থাকেন। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো