ইমিগ্রেন্টদের বিষয়ে ড্যাগ ফোর্ডের শিষ্টাচারহীন ও অপমানজনক মন্তব্য

খুরশিদ আলম

সম্প্রতি ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে শিষ্টাচারহীন ও অপমানজনক এক মন্তব্য করে অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এ জন্য তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বানও জানানো হয়। কিন্তু তিনি ক্ষমা চাননি। উল্টো দাবী করেছেন তিনি একজন ইমিগ্রেন্ট বান্ধব প্রিমিয়ার।

অন্টারিও’র স্কারবরোর সাউথওয়েস্ট এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপিপি (নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি) বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডলি বেগম ড্যাগ ফোর্ডের শিষ্টাচারহীন ঐ মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটি তার মতো অন্য যে সকল পরিবার আছে, যাঁরা একটি ভাল ভবিষ্যতের জন্য এদেশে এসেছেন, তাঁদের জন্য অপমানকর। তিনি ড্যাগ ফোর্ডকে এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানান।

ঘটনার শুরু গত অক্টোবর মাসে। ঐ সময় অন্টারিও’র উইন্ডসরে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ড্যাগ ফোর্ড বিভিন্ন শিল্পখাতে কর্মী স্বল্পতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই মুহুর্তে কয়েক লক্ষ কর্মীর প্রয়োজন অন্টারিওতে। আর এই কর্মী স্বল্পতা পূরণের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে ইমিগ্রেন্ট আনার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

তাঁর ভাষায়, ‘আমার কথা হলো, আপনি এ দেশে আসুন যেমনটা এসেছেন অন্যান্য নতুন ইমিগ্রেন্টরা। এসে মন প্রাণ দিয়ে কাজ করুন।’

এ পর্যন্ত তাঁর বক্তব্য ঠিক আছে। কিন্তু নিন্দার ঝড় উঠে যখন তিনি বলেন, ‘আপনি যদি মনে করেন এ দেশে এসে আপনি কেবল সরকারী ভাতা সংগ্রহ করবেন এবং কাজ না করে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াবেন তাহলে আপনার আসার দরকার নেই। আপনি অন্য কোন দেশে যান।’

বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে, আত্মীয়-পরিজনের মায়া ত্যাগ করে কানাডায় আসেন কেবল সরকারী ভাতা পাওয়ার জন্য এবং কাজ না করে এদিক সেদিক ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ানোর জন্য! এই উদ্ভট তথ্য ড্যাগ ফোর্ড কোথায় পেলেন? আর সরকারী ভাতা কত দেয়া হয় যা দিয়ে একটি পরিবার কাজ না করে আরাম আয়েসে কানাডায় বিলাসী জীবন যাপন করতে পারবে? আর চাইলেই কি কোন কর্মক্ষম ব্যক্তি সরকারী ভাতা পান এ দেশে?

আমরা জানি কানাডায় যারা নতুন ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসেন তাঁদেরকে মোটা অংকের অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হয় যাতে করে কাজ না পাওয়া পর্যন্ত নিজেদের ভরণ-পোষণ তাঁরা নিজেরাই চালিয়ে নিতে পারেন। এটি কানাডা সরকারেরই আইন।

ইমিগ্রেন্টদের বিষয়ে সম্প্রতি এক শিষ্টাচারহীন ও অপমানজনক মন্তব্য করায় প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এ জন্য তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বানও জানানো হয়। ছবি : ইউটিউব

যারা কানাডায় আসার সময় মোটা অংকের অর্থ নিয়ে আসতে পারেন তাঁরা নিশ্চই গরিব-দুঃখী কেউ নন। অকর্মণ্যও নন। বিভিন্ন পেশায় দক্ষ ও শিক্ষিত লোকদেরকেই কানাডায় ইমিগ্রেশন দেয়া হয়। এবং এই শ্রেণীর লোকেরা তাঁদের নিজ নিজ দেশে অর্থিকভাবেও অস্বচ্ছল নন। তাহলে তাঁরা কেন কানাডায় আসবেন সরকারী ভাতার লোভে, যে ভাতা দিয়ে কোন রকমে খেয়ে পরে চরম দারিদ্রতার মধ্যে দিনযাপন করতে হয়?

টরন্টো ভিত্তিক ‘maytree’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন তাদের ওয়েবসাইটে সরকারী ভাতা সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়, এখানে ৪ সদস্যের একটি পরিবার বেসিক সোস্যাল এসিস্টেন্স পান মাসে ১২৫০ ডলার। ফেডারেল চাইল্ড বেনিফিট দুই বাচ্চর জন্য মাসে ৯২৩.৫৮ ডলার। অন্টরিও চাইল্ড বেনিফিট দুই বাচ্চার জন্য মাসে ২৩৬.৪১ ডলার। জিএসটি/এইচএসটি ক্রেডিট মাসে ৭৩ ডলার। প্রভিন্সিয়াল টেক্স ক্রেডিট/বেনিফিট মাসে ১৪০.৭৫ ডলার। সব মিলিয়ে মাসে ভাতার পরিমান দাঁড়ায় ২,৬২৩.৭৪ ডলার।

অংকের হিসাবে অনেক অর্থই মনে হচ্ছে এটি। ড্যাগ ফোর্ড সম্ভত এই ফিগার দেখেই চমকে উঠেছেন। কিন্তু তিনি কি জানেন বর্তমানে টরন্টোতে ৪ সদস্যের জন্য দুই বেডরুমের একটি এপার্টমেন্টের ভাড়াই মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার ডলার! blogto.com এক জরিপে দেখা গেছে বর্তমানে টরন্টোতে দুই বেডরুমের একটি এপার্টমেন্টের ভাড়া মাসে ২৬৮৩ হাজার ডলার। আর স্কারবরো এলাকায় ১৯৬৭ ডলার। এটি গড় হিসাব। পরিবারের দুই সন্তান যদি ছেলে ও মেয়ে হয় এবং বয়স একটু বেশী হয় তবে তাঁদের প্রয়োজন দুই বেডরুমের স্থলে তিন বেডরুমের এপার্টমেন্ট। টরন্টোতে ৩ বেডরুমের এপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে গেলে মাসে ৩ হাজার ডলারেরও বেশী ভাড়া দিতে হবে। তাহলে ৪ সদস্যের একটি পরিবারকে টরন্টোতে সরকারী ভাতা নিয়ে বাস করতে হলে এপার্টমেন্টের ভাড়া বাবদই সব অর্থ দিয়ে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা খাবেন কি? আর অন্যান্য প্রয়োজনই বা মিটাবেন কি করে?

ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে ড্যাগ ফোর্ডের ঐ চরম অশোভন মন্তব্যে চটেছেন অন্টারিও’র প্রধান বিরোধী দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান এন্ড্রিয়া হরওয়াথ। চটেছেন অপর বিরোধী দল অন্টারিও লিবারেল পার্টির প্রধান স্টিভেন ডেল ডুকা-ও। এন্ড্রিয়া হরওয়াথ বলেন ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে ফোর্ডের এই মন্তব্য বর্ণবাদী আচরণ। ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে তিনি যা বলেছেন তা সত্য নয়। এটি চিন্তাহীনভাবে বাঁধাধরা একটি মন্তব্য। এই মন্তব্য তাঁর প্রত্যাহার করা উচিত এবং এরকম মন্তব্য করার জন্য তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

অন্টারিও লিবারেল পার্টির নেতা স্টিভেন ডেল ডুকা-ও ড্যাগ ফোর্ডকে এই ধরণের মন্তব্য করার জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যখন কেউ ভুল করে তখন ক্ষমা চাওয়াটা কোন দূর্বলতা প্রকাশ করে না। বরং তা শক্তিমত্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তাঁর মতে ড্যাগ ফোর্ড ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে একটি পুরানো ধ্যান ধারণার বশবর্তী হয়ে এ ধরণের মন্তব্য করেছেন। 

লিবারেল নেতা স্টিভেন ডেল ডুকা প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডের প্রতি আহ্বান জানান ইমিগ্রেন্টদের ব্যাপারে পুরানো ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে আসার জন্য। আধুনিক অন্টারিও’র দিকে দৃষ্টি ফেরানোর কথা বলে তিনি এর সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করারও আহ্বান জানান এবং বলেন, আসুন আমরা এগিয়ে যাই।

কিন্তু ড্যাগ ফোর্ড কারো কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা থেকে পিছিয়ে আসেননি। বরং দাবী করে আসছেন যে, তাঁর এই মন্তব্যের পর ইমিগ্রেন্টরাই নাকি তাঁর ফোনে ক্রমাগত ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে!

সিস্টেম এবিউজ কানাডায় যে একেবারেই হয় না তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু সেটা কি শুধু নতুন ইমিগ্রেন্টরাই করেন যেমনটা দাবী করছেন ড্যাগ ফোর্ড? মূলধারার কানাডিয়ানরা কি করেন না? সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি কানাডার তিনজন সিনেটরের নাম আলোচনায় এসেছিল যারা বিভিন্ন উপায়ে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছিলেন। এরা হলেন পামেলা ওয়ালিন, ম্যাক হারব এবং প্যাট্রিক ব্রাজিউ। পামেলা ওয়ালিন নামকরা সাংবাদিক ছিলেন সিনেটর হিসেবে যোগদান করার আগে। ম্যাক হারবেরও বর্ণাঢ্য অতিত ছিল। কিন্তু অর্থ লোভের কাছে তাঁরা হেরে গিয়ে আশ্রয় নেন সিস্টেম এবিউজের। সারা জীবন কঠোর সংগ্রাম করে যে সুনাম ও আভিজাত্য সঞ্চয় করেছিলেন তাঁরা, তা ধুলায় মিশিয়ে দিলেন বাড়তি কিছু অবৈধ অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে।

আমরা আরো দেখেছি কানাডার সাবেক এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জেন ফিলপট ইতিপূর্বে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন টেক্সপেয়ারদের অর্থে লিমোজিনে চড়ে বিলাস ভ্রমণের জন্য। তার বিরুদ্ধে যখন এই অভিযোগ উঠে তখন তিনি সত্য গোপন করে পার্লামেন্টকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়।

ফিলপট তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তাঁর ডিপার্টমেন্ট থেকে তাঁর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পার্লামেন্টকে জানানো হয়েছিল, ‘সরকারী কাজে ভ্রমণের জন্য মন্ত্রী দেশে বা দেশের বাইরে কোন লিমোজিন ভাড়া করেননি।’

কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে তিনি  গ্রেটার টরন্টোতে সফরের সময় মাত্র একদিনেই ১,৭০০ ডলার ব্যয় করেছেন একটি লিমোজিন সার্ভিস এর পিছনে। আর এই লিমোজিন সার্ভিসের মালিক এমন একজন ব্যক্তি যিনি ফেডারেল নির্বাচনের সময় তার পক্ষ হয়ে প্রচারকার্য চালিয়েছিলেন।

কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবরেও বলা হয় ফিলপট নায়েগ্রা ফসল এলাকায় আদীবাসীদের এক অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ইতিপূর্বে লিমোজিন সার্ভিসকে ১,৯৯৪ ডলার পে করেছেন। একই সময়ে টরন্টো পিয়ারসন বিমান বন্দরে আরো ২০ টি ট্রিপের জন্য এই একই লিমোজিন সার্ভিস কে তিনি ৩,৮১৪ ডলার পে করেছেন।

বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে ফিলপট পরে অনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান তাঁর ঐ বিলাসী ভ্রমণের জন্য।

এরকম হাজারে বা শতে এক-আধজন ভুল করলে বা সিস্টেম এর অপব্যবহার করলে ঢালাওভাবে কোন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠিকে দোষারোপ করা কি যৌক্তিক আচরণ? মোটেও না। কিন্তু ড্যাগ ফোর্ড সেটাই করেছেন। 

ড্যাগ ফোর্ডের ঐ শিষ্টাচারহীন ও অপমানজনক মন্তব্যের পর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও নিন্দা জানানো হচ্ছে। এরকমই এক সংগঠন ‘Canadians United Against Hate’ এর প্রতিষ্ঠাতা ফরিদ খান বলেন, ইমিগ্রেন্টদের বিষয়ে প্রিমিয়ার ফোর্ড এর মন্তব্য অগ্রহনযোগ্য এবং বিপজ্জনক। তাঁর উচিৎ দ্রুত এ বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

ফরিদ খান আরো বলেন, এটি শুধু যে আপত্তিকর তা নয়, তাঁর এই বক্তব্য বর্ণবাদী বিদ্রুপের সমান এবং বর্ণবাদীদের হাতে গোলাবারুদ তুলে দেয়ার মত ঘটনা। বর্ণবাদের বিরোধীতা করার ক্ষেত্রে কার্যত ড্যাগ ফোর্ডের কোন ভূমিকা নেই। বরং গত প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনের সময় বিদ্বেষপূর্ণ এবং বর্ণবাদী ধারণা প্রচারকারীদের তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন তাঁর দলে। তিনি অন্টারিও’ Anti-Racism Directorate এর ফান্ড-ও কর্তন করেছেন। তাঁর এই সমস্ত কর্মকান্ড প্রমাণ করে যে তিনি বর্ণবাদ এবং ইমিগ্রেন্ট বিরোধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনিচ্ছুক। কারণ তাঁরা তাঁর সমর্থক। এই প্রসঙ্গে ফরিদ খান Faith Goldy’র নাম উল্লেখ করেন যার সঙ্গে অতীতে ড্যাগ ফোর্ডের যোগাযোগ ছিল। কানাডিয়ান এই Faith Goldy একজন চরম ডানপন্থী ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শে বিশ^াসী রাজনৈতিক ভাষ্যকার।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ড্যাগ ফোর্ড অন্টারিও’র প্রিমিয়ার নির্বাচিত হওয়ার পর তৎকালীন হাফিংটন পোস্ট এর কলামিস্ট ডেভিড মাস্ট্রাচি লিখেছিলেন, ‘গত ৭ই জুনের নির্বাচনে প্রোগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ী হয়ে গত ১৫ বছরে এই প্রথম বারের মত ক্ষমতায় এলো। এই বিজয় পার্টির নেতা ড্যাগ ফোর্ডের জন্য দারুণ একটা বিজয় ছিল। এবং সেদিক থেকে এটা ছিল শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের বিজয়। কারণ হলো এই যে, ফোর্ড ছিলেন চরম ডান পন্থীদের পছন্দের প্রার্থী।’

তিনি আরো লিখেছিলেন, ‘‘আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে চরম বর্ণবাদী গ্রুপ Alt-right group এবং The Proud Boys ড্যাগ ফোর্ডকে Proud Boy of the month হিসাবে উল্লেখ করেছে। এখন এদের স্বপ্ন হলো ফোর্ড ‘Will Make Ontario Great Again’। এই জাতীয় স্লোগান নির্বাচনের আগে দিয়ে আসছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে।”

এবং ড্যাগ ফোর্ডের সমর্থক এই Alt-right group,The Proud Boys এরা সবাই চরম ভাবে ইমিগ্রেন্ট বিদ্বেষী। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই বলে যে, এই চরম ইমিগ্রেন্ট বিদ্বেষীরা ড্যাগ ফোর্ডের সমর্থক বা শুভাকাঙ্খী হলো কি কারণে? তাহলে কি ধরে নেয়া যায় যে ড্যাগ ফোর্ড আর Alt-right group,The Proud Boys এদের আদর্শ বা চিন্তা-ভাবনা একই রকম?

উল্লেখ্য যে, কানাডার ফেডারেল সরকার গত মে মাসে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ‘চৎড়ঁফ ইড়ুং’ কে সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কানাডায় এদের বেশ কয়েকটি শাখা রয়েছে বিভিন্ন প্রভিন্সে। দি কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবর থেকে জানা যায়, টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, মেনিটোবা, সাস্কাটুন ও ক্যালগারী-সহ বিভিন্ন স্থানে ৮টি শাখা বা চেপ্টার রয়েছে তাঁদের।

প্রাউড বয়েস এর জন্ম কানাডায়। এর জন্মদাতাও একজন কানাডিয়ান যার নাম গ্যাভিন ম্যাকিনেস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে এদের শাখা। চরম ডানপন্থী, ইমিগ্রেন্ট বিরোধী এবং নারী বিদ্বেষী এই গ্রুপের সদস্যরা সবাই পুরুষ। কানাডিয়ান মিলিটারীর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে “এই প্রাউড বয়েস একটি চরম রক্ষণশীল গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই ইসলাম বিরোধী এবং নারী বিদ্বেষী।” গ্লোবাল নিউজ এ সংবাদ জানায়।

ড্যাগ ফোর্ড কতটা ‘ইমিগ্রেন্ট বান্ধব’ তার আরেকটি নমুনা হলো, গত নির্বাচনে জীয় হয়ে তিনি নতুন যে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেছিলেন সেখানে ভিজিবল মাইনরিটি গ্রুপ থেকে স্থান পান মাত্র একজন। বিরোধী দলের অভিযোগ- ড্যাগ ফোর্ডের মন্ত্রী পরিষদ ডাইভার্সিটিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বিরোধী দল এনডিপি’র এমপিপি স্যারা সিং বলেছিলেন, প্রধানত পুরুষ ও শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত ড্যাগ ফোর্ডের মন্ত্রী সভা হৃদয়ভঙ্গকারী একটা বার্তা দিচ্ছে অন্টারিওতে।

আসলে ড্যাগ ফোর্ড বরাবরই ছিলেন বিতর্কের মধ্যে। গত প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনের আগেও তাঁকে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তিনি এক সময় ড্রাগ ডিলার ছিলেন এমন খবরও কানাডার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা গ্লোব এন্ড মেইলে প্রকাশিত হয়েছিল ইতিপূর্বে।

সেই ড্যাগ ফোর্ড এখন অন্টারিওর প্রিমিয়ার। তাঁর কাছ থেকে ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে ইতিবাচক কোন মন্তব্য কতটা আশা করা যায়? তিনি বলেছেন অন্টারিওতে কয়েক লক্ষ দক্ষ কর্মী প্রয়োজন বিভিন্ন শিল্পখাতে। অথচ আমরা জানি হাজার হাজার দক্ষ ও উচ্চ শিক্ষিত ইমিগ্রেন্ট অন্টারিতে নিজ নিজ পেশায় চাকরী পাচ্ছেন না নানারকম বাধার কারণে যার মধ্যে অন্যতম হলো বিদেশী ডিগ্রিকে স্বীকৃতি না দেয়া। ইমিগ্রেন্টরা তাঁদের নিজ নিজ দেশ থেকে বা অন্যকোন দেশ থেকে যে ডিগ্রি নিয়ে কানাডায় আসেন এবং তাঁদের যে কর্মদক্ষতা থাকে সেগুলোকে স্বীকৃতি দেয় না স্থানীয় প্রশাসন বা চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কথা উল্লেখ করেছেন এমপিপি ডলি বেগমও।

আসলে কানাডিয়ান এম্পøয়ারদের ধারণা, মানের দিক থেকে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমিগ্রেন্ট ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যন্য পেশাজীবীরা কানাডীয় পেশাজীবীদের তুলনায় তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর কিংবা তারো নিচে। এদের ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নেই এই অজুহাত তুলে কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।

বস্তুত কানাডার চাকরী বাজারে নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ ও অসম্মান করার এক বুলির নাম হলো ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’। লক্ষ লক্ষ পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদেরকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে চাকরীর বাজারে ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নেই এই অজুহাত তুলে। এটি শুধু অপমান ও অপদস্থ করা নয়, নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকারও লংঘন করা হচ্ছে এর মাধ্যমে। অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনও ইতিপূর্বে এর নিন্দা জানিয়েছে এবং তাদের নতুন এক পলিসিতে এই অভিমত দিয়েছে যে এটি নিশ্চিতভাবেই ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন।

অথচ আমরা জানি ইমিগ্রেন্টরা এক ধরনের অর্থনৈতিক উদ্দীপক। তাই চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া এই ইমিগ্রেন্টদের প্রতি। এ কথা বলেছেন স্কশিয়া ব্যাংকে কানাডিয়ান ব্যাংকিং এর গ্রুপ প্রধান ড্যান রিস। তিনি আরো বলেন, ইমিগ্রেন্টরা এদেশে এলে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁদের ভাষার বাধা, পেশাগত প্রত্যয়নপত্র পাওয়া, সামাজিক ও পেশাগত যোগাযোগের অভাব এবং আর্থিক বিষয়ে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের জীবনের এই রদবদল যেন নির্বিঘ্ন হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

কানাডায় ইমিগ্রেন্টরা যে শুধু দেশটির অর্থনৈতিক উদ্দীপক তা নয়। এ দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নেও এদের রয়েছে অবদান।  সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, কানাডা বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম শিক্ষিত দেশ। আর এর কৃতিত্ব প্রধানত ইমিগ্রেন্টদের প্রাপ্য। ঐ অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে ইমিগ্রেন্ট পরিবারের ৩৬% ছেলে-মেয়ের (যাদের বয়স ২৫-৩৫ এর মধ্যে) ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি রয়েছে। আর এই একই বয়সের মূলধারার কানাডিয়ান ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি রয়েছে ২৪% জনের। সম্প্রতি সরকারের এক অভ্যন্তরীন অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটির স্যোসলজি এ্যান্ড পাবলিক এ্যাফেয়ার্স এর অধ্যাপক জ্যাক জ্যাকব বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশী ইউনিভার্সিটি ডিগ্রিধারী রয়েছে কানাডায়। দৃশ্যত এর পিছনে অবদান রয়েছে ইমিগ্রেন্টদের বিশেষ করে যারা ২১ শতকের গোড়া থেকে কানাডায় এসেছেন তাঁদের।

আমরা জানি কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা গত প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছর ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সর্বশেষ হিসাব (২০১৬) অনুযায়ী দেখা যায় বর্তমানে কানাডার মোট জনসংখ্যার ২১.৯%-ই ইমিগ্রেন্ট।

কিন্তু কানাডায় ইমিগ্রেন্ট সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সেটা কানাডার জন্য সার্বিক দিক দিয়ে মঙ্গলই বয়ে আনছে। Environics Institute এবং Canadian Race Relations Foundation এর এক যৌথ জরীপে দেখা গেছে কানাডায় অধিকাংশ নাগরিক মনে করেন এখানে ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে না। জরীপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯০% ই মনে করেন কানাডায় জন্ম নেয়া একজন ব্যক্তি যতটা ভাল নাগরিক হতে পারবেন, কানাডার বাইরে জন্ম নেয়া একজন ব্যক্তিও এই দেশে এসে ততটা ভাল নাগরিক হতে পারবেন।

উল্লেখ্য যে, গত ২৯ জানুয়ারী কুইবেকে এক জনসভায় সেখানকার প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইয়ার্ড বলেন, ‘কয়েক জেনারেশন ধরে বসবাসরত কুইবেকের কিছু অধিবাসী কেন নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠতর মানুষ মনে করেন সাম্প্রতিক সময়ে আসা ইমিগ্রেন্টদের তুলনায়? আমরা সবাই কানাডায় এসেছি এখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে যোগ দিতে। কেউ আগে এসেছি, কেউ পরে এসেছি। এটাই শুধু পার্থক্য।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দশ জেনারেশন আগে এসেছি বলে যারা ৫ বছর আগে কানাডায় এসেছেন তাঁদের তুলনায় শ্রেয় হয়ে যাইনি।’

নতুন ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে উপরে উল্লেখিত প্রিমিয়ার ফিলিপ ও Environics Institute এর বার্তাসমূহ অন্টরিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডের সিলেবাসে যোগ করা জরুরী। কারণ তিনি জেনে হোক বা না জেনে হোক কিংবা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে হোক, ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা স্পষ্টতই অপমানজনক। তিনি স্বীকার করুন বা নাই করুন, এমন মন্তব্য করাটা মোটেও শোভন হয়নি। তিনি একটি প্রভিন্সের প্রিমিয়ার। তাঁর মুখ থেকে আরো দায়িত্বশীল কথা আশা করেন সবাই। বালখিল্যতা নয়। এরকম আচরণ তাঁর সম্মানকে নিচুতে নামিয়ে আনে। তাঁর মনে রাখা দরকার, মানুষের কাছে সম্মান পেতে হলে তাঁদেরকেও সম্মান জানাতে হয়।

নভেম্বর ২৫, ২০২১

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ