মানুষের কথা
বিচিত্র মানুষের মন
সাইদুল হোসেন
টরন্টোতে আমি একসময় হস্পিটাল ভলানটিয়ার ছিলাম। রোগীদের এবং তাদের খোঁজে যারা হসপিটালে আসে তাদের সাহায্য করাই ছিল আমার কাজ। আমি বিভিন্ন ক্লিনিকে অথবা ইনফরমেশন ডেস্কে কাজ করেছি। তাই প্রতিদিনই অগণিত নারীপুরুষের সংগে আমার দেখা সাক্ষাৎ হতো, নানা প্রসংগ নিয়ে কথাবার্তা হতো এবং মজার মজার কাহিনীও শুনতাম। তারই কিছু এখানে তুলে ধরছি।
(এক)
সেদিন ফিজিওথেরাপি ক্লিনিকে কাজ করছিলাম। এক মহিলা তার স্বামীকে সংগে নিয়ে এলো, মহিলার হাতে হ্যান্ডলওয়ালা একটি লাঠি, তাতে ভর দিয়ে সে হাঁটে। লাঠিটা দেখলেই মনে হয় কোন একটা গাছের ডাল সেটা, শুধুমাত্র ছালটা তুলে নিয়ে প্রয়োজন মত লম্বাটা রেখে বাকিটা কেটে ফেলা হয়েছে। বেশ সুন্দর লাঠিটা কিন্তু মেশিনে তৈরী করা নয়। মহিলাকে বললামঃ আপনার হাতের লাঠিটা তো খুব সুন্দর, দেখে মনে হচ্ছে সেটা কোন একটা গাছের ডাল।
মহিলা বললেন : আপনার অনুমান সত্য। এটা আপেল গাছের একটা ডাল, আমার স্বামী এটাকে কেটেছেঁটে আমার প্রয়োজন মত তৈরী করে দিয়েছে। এটাতে ভর দিয়ে আমি আরামে চলাফেরা করি। And you know what? I can use it for other purposes too.
বললাম : For example?
হেসে দিয়ে তিনি বললেন : যদি স্বামী আমার কথা না শোনে তাহলে এই লাঠিটা দিয়ে শাসন করতে পারি।
বললাম : এমনটা তো আপনার স্বামীও করতে পারেন, নয় কি?
মহিলা তখন তার চোখ দুটো কুচকে তির্যক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন : তেমন সম্ভাবনা যে নেই তা নয়। তবে আমরা কেউ কখনো এটাকে একে অপরের উপর ব্যবহার করব না। স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কটা হচ্ছে ভালবাসার, বিশ্বাসের, পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতার, স্নেহের, লড়াই-মারপিটের নয় কখনো। আমরা দু’জনেই ভালবাসার বড় কাঙ্গাল।
বললাম : বড় খুশী হলাম আপনাদের ভালবাসার কাহিনী শুনে। ধন্যবাদ।
(দুই)
একদিন সার্জারি এন্ড ইন্টেনসিভ কেয়ার/ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের রিসেপশনে ভলানটিয়ারিং কাজ করছিলাম। এক মহিলা আমার ডেস্কে এসে বললেন যে তিনি ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের পেশেন্ট নারাইন সিংয়ের সংগে দেখা করতে চান। ফোন করে নার্সের পারমিশন নিয়ে মহিলাকে সেখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এসে আমাকে জানালেন যে রোগীর অবস্থা খুবই আশংকাজনক, ওর ছেলেমেয়েদের খবর দিতে যাচ্ছি। আপনার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। ঘন্টাখানিক পর মহিলা ফিরে আসলেন, তবে একা, সংগে কেউ নেই। একা কেন? ছেলেমেয়েরা কই? জানতে চাইলাম আমি।
মহিলা : ওদের খবর দিলাম কিন্তু কেউই আসতে রাজী হলো না, তাদের সময়ের অভাব, তাই আমাকেই ফিরে আসতে হলো। নারাইনের একটা মেজর সার্জারি হবে, সেটার জন্য Consent Form-এ আমাকেই sign করতে হবে।
রোগী আপনার কে হন? জানতে চাইলাম আমি।
মলিন হেসে মহিলা বললেন : বর্তমানে নারাইন আমার কেউ নয় তবে ৩৪ বছর আগে আমরা স্বামী-স্ত্রী ছিলাম। এখন আমার বয়স ৬৫ বছর। একত্রিশ বছর আগে ৬টি সন্তান রেখে অন্য এক নারীর জন্যে সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। আমি ওর সন্তানদের ভরনপোষণ, লালনপালন করতে থাকি। আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করিনি, সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। নারাইন সেই নারীকে বিয়ে করে, ওদের দুটি সন্তানও জন্মে, কিন্তু সে সুখী হয়নি। সেই স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে সে আমার কাছে ফিরে আসে, তার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চায়, কাকুতি-মিনতি করতে থাকে ওকে আবার বিয়ে করার জন্যে। আমি রাজী হইনি, তবে ওর দুর্দিনে আর্থিক সাহায্য চাইলে আমি তাকে বিমুখ করিনি কখনো।
নারাইন প্রচন্ড মাতাল, সর্বদা মদে ডুবে থাকে, ওর সর্ব রোগের মূলে হচ্ছে ঐ মদের নেশা। বহু চেষ্টা করেছি ওকে মদ খাওয়া ছাড়ানোর জন্যে কিন্তু কোনই লাভ হয়নি। মাতাল অবস্থায় সে আমার ঠিকানায় চলে আসত, সুস্থ অবস্থাতেও আসত, ঠেলেও বিদায় করতে পারতাম না। ওর মুখে শুধু এক কথা : “মম্তা, তুমি আমার কাছে ফিরে চল, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না”। আমি কিছুতেই রাজী হইনি, কিন্তু আমিই হয়ে পড়লাম ওর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু অথচ আমাদের মাঝে সামাজিক কোন সম্পর্কই নেই। ওর আচরণে ছেলেমেয়েরা অসন্তুষ্ট, বিরক্ত, আমার নিজেরও কোন আগ্রহ নেই, কিন্তু নারাইন সেসব বুঝতে রাজী নয়। আজ ৩৪ বছর ধরে এমনি করেই চলছে। ওর বয়স এখন ৬৬ বছর। এ জগতে ওর আর কেউ নেই। বাধ্য হয়ে আমাকেই ওর অপারেশনের কনসেন্ট ফরমে সাইন করতে হচ্ছে। তাই ফিরে এলাম।
(তিন)
এবার আরো কিছু ঘটনা।
ফ্র্যাক্চার ক্লিনিক। একই দিনে একে একে তিন জোড়া স্বামী-স্ত্রী এলো, সবাই বয়স্ক। প্রথম জোড়াকে গুড মর্নিং জানানোর পর মহিলাটিকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করলাম : Are you with him, ma’m? তিনি বললেন : No, he is with me.
কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় জোড়ার আগমন ঘটল। যথারীতি গুড মর্নিং জানিয়ে স্বামীকে উদ্দেশ করে বললাম : Is she with you, sir?
ভদ্রলোক হেসে দিলেন, বললেন : No, I am with her.
আরো পরে আসল তৃতীয় জোড়া। গুড মর্নিং বিনিময়ের পর মহিলাটিকে জিজ্ঞাসা করলাম : Are you with him, ma’m?
আমার প্রশ্ন শুনে তিনি তার স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন , তারপর হাসিতে মুখ ভাসিয়ে দিয়ে বললেন : No, sir, we are together.
আমি খুশী হয়ে বললাম : I like your answer ma’m. Thank you.
(চার)
কোন এক সমাবেশে এক ফিলিপিনো মহিলা এবং আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাশাপাশি বসেছিলাম। ফিলিপিনসের প্রধান ভাষা Tagalog আমি যৎসামান্য বলতে পারি একথা মহিলাকে জানালে খুব খুশী হয়ে নানা বিষয় নিয়ে আমার সংগে আলাপ জুড়ে দিলো। এক পর্যায়ে এসে জানতে চাইলো আমি কোন দেশের লোক। বললাম : বাংলাদেশ। আমি একজন বাংলাদেশী একথা শোনার পর সে আমাকে এই কাহিনীটা শোনালো।
আমার এক ঘনিষ্ট ফিলিপিনো বান্ধবী আজ ২২ বছর ধরে এক বাংলাদেশী ভদ্রলোকের সংগে লিভিং টুগেদার করছে, ওদের দুটি সন্তান- একটি ছেলে (১৮), একটি মেয়ে। মেয়েটির বয়স ১৩ বছর, সে খুব বুদ্ধিমতী। ওরা বাংলাদেশে ওদের দাদাদাদীর সংগে দেখা করতে গিয়েছিল এবছরই, কিন্তু মেয়েটি খুব মন খারাপ করে ফিরে এসেছে। কারণ হলো এই যে ওর দাদাদাদী ওর ভাইকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে, অনেক বেশী আদরযত্ন করেছে কারণ সে ছেলে; আর সে মেয়ে বলে আদরযত্ন ও গুরুত্ব অনেক কম পেয়েছে। This discrimination has hurt her so much, she has promised not to meet her grandparents in future. আর সে কখনো বাংলাদেশে যাবে না।
মহিলাকে বললাম : বাইশ বছর ধরে লিভিং টুগেদার করছে, ওদের তো এক হ্যাপি কাপল্ হওয়ার কথা। কিন্তু ওরা বিয়ে করছে না কেন?
মহিলা : লোকটি যে খুবই ভাল তাতে কোনই সন্দেহ নেই। বনিবনা না হলে তো : they could split anyday and go their own ways long ago; splitting is so easy because they are not legally married. Twenty- two years is a long time for waiting কেন যে আজো ওরা formally বিয়ে করছে না সেটা এক রহস্য বটে!
(পাঁচ)
তেইশ ও উনিশ বছর বয়সের দুই মেয়ে এবং ছ’বছর বয়সের এক ছেলেকে নিয়ে সিংগল মাদার এক মহিলার সংগে বেশ কিছুটা জানাশোনা ও হৃদ্যতা আছে, হসপিটালে নিয়মিতই দেখা হয়, গল্পগুজব করি। আমাকে সে খুব পছন্দ করে, ওর ব্যক্তিগত প্রসঙ্গও আলোচনা করে মাঝেমধ্যে। একদিন সকালে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : কেমন আছো? সে বললঃ ভালই আছি তবে এভাবে দিনগুলো আর কাটতে চায় না, একজন পুরুষের বড় দরকার (ওর ভাষায় I need a guy.) ছোট ছেলেটার বয়স ছ’বছর পার হয়ে গেল, ওর জন্মের পরই ওর বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সে ছিল আমার বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু মেয়ে দু’টির বাবা ছিল আমার বিবাহিত স্বামী, সেও আমাকে ছেড়ে চলে যায় অন্য এক মেয়ের জন্যে ছোট মেয়েটার জন্মের এক বছর পর। দীর্ঘ ছ’বছর ধরে একাকীত্বটা আমাকে বড়ই কষ্ট দিচ্ছে আজকাল। বয়সতো মোটে ৪৩ বছর, স্বাস্থ্যটাও বেশ ভাল আছে, অভাব শুধু একজন পুরুষ সংগীর।
জিজ্ঞাসা করলাম : ক্লাবে যাও না কখনো?
বলল : গেছি কিন্তু আর যাই না, সেখানের পরিবেশটা বড়ই নোংরা, পুরুষগুলো শুধু মেয়েদের দেহটা চায়, মনটা নয়; শয্যাসংগিনী চায়, জীবনসংগিনী নয়। আমি খুঁজি একজন জীবনসাথী ( life partner )। বড় শূন্যতায় ভুগছি, বড়ই কষ্ট!
(ছয়)
হসপিটালের ইমারজেনসি রুমে ভলানটিয়ারিং করছিলাম যথারীতি। এলো এক জ্যামাইকান বুড়ি, আমার সামনের সোফাতে বসতে দিলাম, লাইনে দাঁড়ানোর সামর্থ্য নেই। প্রায় সংগে সংগেই এলো এক ইটালিয়ান বুড়ি। দেখলাম দু’জনেই পূর্বপরিচিত। আলাপ জমে উঠল দু’জনের মাঝে। আমার সামনেই বসা ওরা, তাই ওদের সব কথাই স্পষ্ট কানে আসতে লাগলো। জানতে পারলাম জ্যামাইকান বুড়ির ১০টি সন্তান।
কিছুক্ষণ পর জ্যামাইকান বুড়ি গেল কফি আনতে। এরই ফাঁকে ইটালিয়ান বুড়ি আমাকে বলল : তোমাকে একটা কথা বলি, শোন। এই যার সংগে এতক্ষণ ধরে গল্প করলাম ওর ১০টা সন্তান। কালোদের মাঝে এমনটাই হয়। আমার যৌবনে যখন রেগিউলার জব করতাম তখন আমার এক জ্যামাইকান সহকর্মিনী ছিল, ওর ছিল ৮টি সন্তান। কিন্তু মজার কথা এই যে ওর সেই ৮টি সন্তানের বাবা ছিল ভিন্ন ভিন্ন ৮ ব্যক্তি (eight different guys ) অবাক হওয়ার মত ঘটনা বটে!
(সাত)
একদিন এক ফিলিপিনো মহিলা তার অপূর্ব সুন্দরী দু’টি ছোট ছোট মেয়েকে নিয়ে hearing test করানো জন্যে Audiology Clinic -এ এলো। সেক্রেটারী তখন কফি ব্রেকে গেছে। বললাম : আমার পাশে বস তোমরা। মহিলাকে বললাম : তোমার মেয়ে দু’টি তো খুবই সুন্দরী, মিষ্টি চেহারা; তবে তোমার চেয়ে ওরা অনেক বেশী ফর্সা। কি করে হলো?
বলল : ওদের বাবা একজন গ্রীক।
বললাম : তোমার হাজব্যান্ড তাহলে ফিলিপিনো নয়?
বলল : না, সে আমার হাজব্যান্ড নয়, বয়ফ্রেন্ড। আজ ১৪ বছর ধরে ওর সংগে আছি, ফরমাল ম্যারিজ আমাদের হয়নি, যদিও বরাবরই বলে যাচ্ছে ও অবশ্যই আমাকে বিয়ে করবে। লোকটা খুবই ভাল, সে আমাদের খুব কেয়ার নেয়, আমাদের কোন কষ্ট নেই। কষ্টটা হলো যে খবর পেয়েছি সে বিবাহিত, ওর স্ত্রী ও সন্তান আছে। তথাপি আমাকে সে আশ্বাস দিয়েছে যে সে অবশ্যই আমাকে বিয়ে করবে, আমাকে ছাড়া ওর জীবন অসম্পূর্ণ। তাই আশা করে আছি সে ওর কথা রাখবে, আমাকে বিয়ে করবে একদিন। জানি না আমি মিথ্যার পিছনে ঘুরে মরছি কিনা। ওকে ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্তও নিতে পারছি না।
মা
অসুস্থ কন্যাটির চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালের ক্লিনিকে এসেছিলেন এক মহিলা, ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় আমার ঠিক পেছনের চেয়ারটিতে বসেছিলেন বেশ কিছু সময়। আমি মেয়েটার অসুখের খবর নিতে গিয়ে ধীরে ধীরে আলাপ জমে উঠে এবং এক পর্যায়ে তিনি তার মতামত ব্যক্ত করলেন এই বলে যে, Mother’s role to care for her child never changes whether the child is inside her womb or outside. আরো জানালেন যে এটা তার তৃতীয় সন্তান, দু’টি ছেলে একটি মেয়ে। এবং সন্তানের স্বাস্থ্যের, চরিত্র গঠনের স্বার্থে তিনি সিগারেট খাওয়া ছেড়েছেন, মদ খাওয়া ছেড়েছেন, স্বামীকেও এই দু’টি বদভ্যাস থেকে মুক্ত করেছেন, নিয়মিত বাইবেল পড়েন, চার্চে যান, গরীব আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য করেন, সুযোগ পেলে হসপিটালের জন্যে ফান্ড রেইজিংয়েও অংশগ্রহণ করেন। তবে একটা মাত্র অভিযোগ নিজের বিরুদ্ধে : সন্তানদের ২৪ ঘন্টা কেয়ার নিতে পারেন না, বেবিসিটারের প্রয়োজন পড়ে। চাকরিটা এতই ভালো এবং boss’দের এপ্রিসিয়েশন এতই সিন্সিয়ার যে ঐকাজটা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। তাছাড়া সংসার চালাতে টাকাপয়সারও তো প্রয়োজন বটে।
বুঝতে পারিনি আমার পরীর মত সুন্দরী মেয়েটা এমন একটা মারাত্মক রোগ নিয়ে জন্মেছে। গডের ইচ্ছা বোঝা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাই বহু ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা যখন বলল যে মেয়েটা দুরারোগ্য Claustrophobia (abnormal fear of confined spaces) রোগে ভোগছে, তখন বহু কান্নাকাটির পর গডের কাছেই আত্মসমর্পণ করলাম। সদাই সন্ত্রস্ত থাকি মেয়েটা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত। সে এলিভেটরে চড়তে ভয় পায়, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, সংগের কাউকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকে বের না হওয়া পর্যন্ত, অথচ বয়স ওর এখন ১৪ বছর। যখনই জানায় যে আজ সে কোথাও যাবে যেখানে এলিভেটরে চড়তে হবে, তখনই আমরা কেউ একজন ওকে সংগে নিয়ে বের হই। অসুবিধা হয় আমাদের, বিশেষতঃ আমার, কারণ বেশীর ভাগ সময় তো আমাকেই সংগ দিতে হয়। কিন্তু কি করব, মেয়েটা তো আমার, আমি তো ওর মা, আমি ওকে না দেখলে দেখবে কে? কিন্তু আমি তো চিরকাল বেঁচে থাকবো না। এক সময়ে সে বিয়েশাদী করবে, নিজের সংসার হবে, তখন ওর পাশে দাঁড়াবে কে? তাছাড়া এই যুগে এলিভেটরে না চড়ে, প্লেইনে না চড়ে চলার উপায় আছে? মেয়েটার কথা ভাবলে নিজেকে বড় অসহায় লাগে, মরতে ভয় পাই।
মলিন মুখে কথাগুলো বললেন আমাকে মা তার ফুটফুটে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে এলিভেটর থেকে বের হয়ে আমাদের হসপিটালের বেইস্মেন্টে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যেতে যেতে। এলিভেটরে যাত্রী ছিলাম আমরা তিনজন মাত্র, মাকে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েটি এবং আমি। হেসে বলেছিলাম : মাকে এত ভালবাস তুমি? মেয়েটি নয়, জবাবটা দিয়েছিলেন ওর মা। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটির ভয় তখনো কাটেনি। ওর অসহায় মুখটা আমার মনটাকে ব্যথিত করে তুলল।
“The world of humanity has two wings- one is women and the other men. Not until both wings are equally developed can the bird fly.” -Abdul Baha (1844-1921)
A leader of the Bahai Faith
কথাটা খুবই সত্য, কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজ নারীদের গুরুত্ব বুঝতে এবং স্বীকার করতে নারাজ। ফলে আপ্রাণ সেবাদান এবং দায়িত্বের গুরুভার বহন করা সত্বেও নারীরা পৃথিবীর দেশেদেশে আজো অবহেলিত, নির্য্যাতিত; তার দুর্বল পাখা নিয়ে সে আর কতটুকুই বা সমাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে? সন্তানের গর্ভধারণ, জন্মদান, লালনপালন তো একমাত্র মায়েরই উপর বর্তায়, অথচ সেই মায়েরাই যথার্থ গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু তা সত্বেও মা তার সন্তানের জন্যে সব সুখ, সব বিলাস ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ করে না। একটা- Women’s Magazine পড়তে গিয়ে সন্তানের প্রতি মায়ের দায়িত্বের অতি সুন্দর একটা বিশ্লেষণ চোখে পড়ল। A mother’s role in her child’s life শিরোনামের নিচের এই কথাগুলোর উল্লেখ পেলাম :
Woman- she becomes qualified to do so many jobs as a result of her motherhood:
– comforter, disciplinarian, friend, counselor, chef, chauffeur, teacher, defense lawyer, theologian, physician, fashion consultant and the list goes on.
মায়ের দু’টি পাখার তলায় সদাই সন্তানদের নির্ভয় আশ্রয়, হোক সেই সন্তান সু অথবা কু; সব সন্তানই তার, এবং তিনি সব সন্তানেরই মা।
“What is the greatest thing your mother did for you?” এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে স্কুলের ছোটছোট বাচ্চাদের অনুভূতির প্রকাশ দেখুন।
1. Gave birth so that I could be alive (Jessie, grade-1)
2. Read me a story (George, Junior Kindergarten)
3. My mom picks up my toys (Jairo, grade 1)
4. Push me on the swing (Nia, Jr. KG)
5. Go to the park (Denika, Kindergarten)
6. Take me for walks (Jen,
Kindergarten)
7. Clean up my room (Jewel, Kindergarten)
8. My mom cooks my food (Giecel, grade-2)
9. Tuck me in at bed time (Rafael, Junior Kindergarten)
10. She gave me life (Kenneth, grade-2)
11. Ice cream (Shae-lynn, grade-2)
12. She gave birth to me (Tiandra, grade-2)
13. My mom loves me (Zion, grade-2)
14. My mom helps me with homework (Caroline, grade-2)
15. She loves me (Samuel, grade-3)
16. She gave me the best birthday present (Abigail, grade-3)
17. Gives me presents (Marcelo, Grade- 2)
18. Hugs and kisses (Sarah, grade-3)
এবার এক বৃদ্ধা মায়ের দুঃখের কাহিনী শুনিয়েই লেখাটা শেষ করছি।
একদিন এক ৭৫ বছরের বৃদ্ধা লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়াতে খুঁড়াতে আমাদের Fracture Clinic এসে আমার পেছনের চেয়ারটিতে ধীরেধীরে বসে হাঁপাতে লাগল। তাকে গুড মর্নিং জানিয়ে একটা নম্বরওয়ালা প্লাস্টিক কার্ড তার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললাম : এই তোমার সিরিয়াল নাম্বার। যখনই ভেতর থেকে সেক্রেটারী মহিলা এই নাম্বারটা ডাকবে, তুমি তার কাছে যাবে, তারপর সে তোমাকে ডাক্তারের কাছে পাঠাবে। সে বলল : থ্যাংক ইউ। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : এত দুর্বল শরীর নিয়ে তুমি একা এসেছ কেন? তোমাকে সংগে নিয়ে আসার কেউ কি নেই? তোমার ছেলেমেয়েরা? হাজব্যান্ড?
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললঃ হাজব্যান্ড হ্যাজ গান্ টু মীট হিজ ক্রিয়েটর, হি ক্যান নো মোর হেল্প মি। আর আমার সন্তানদের কথা জিজ্ঞাসা করছ? ওরা আছে, ছটি সন্তানের মা আমি, ওরা সবাই এই শহরেই বাস করে, কিন্তু আমার জন্যে ওদের সময়ের বড় অভাব। ওরা নিজেদের নিয়ে বড়ই ব্যস্ত। তাই Wheel-Trans -ই আমার একমাত্র ভরসা, ওরাই আমাকে আনা-নেয়া করে। দুঃখজনক পারিবারিক ইতিহাস। কিন্তু এটা আমার কাছে নূতন খবর নয়, অহরহ-ই এই চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটে আমাদের ক্লিনিকগুলোতে। বৃদ্ধ, অসুস্থ মা-বাবা প্রায়শঃ একাই হাসপাতালে আসেন চিকিৎসার জন্যে, কখনোবা তাদের একটি কন্যা সংগে থাকে, কখনোবা একজন নাতনি। ছেলে তার মা অথবা বাবাকে নিয়ে এসেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। হায়রে দুর্ভাগা মাতাপিতা! হায়রে নিষ্ঠুর সন্তান!
অন্যদিকে আমাদের ইসলাম ধর্ম অতি স্পষ্ট ভাষায় মুসলিমদের জানিয়ে দিয়েছে যে মা-বাবা তোমাদের জান্নাত (Paradise) মা-বাবাই তোমাদের জাহান্নাম (Hell ) এবং আরো বলেছে যে মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের জান্নাত (Paradise). আমরা এ বিষয়ে সতর্ক আছি কি? আমরা মা-বাবার প্রতি আমাদের কর্তব্য করছি কি?
সাইদুল হোসেন
মিসিসাগা