মহামারীর প্রকোপ যখন অব্যাহত তখন পারিবারিক চিকিৎসকরা রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ‘খুবই উদ্বিগ্ন
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রোগীদের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত মানসিক চাপ নিয়ে কানাডার প্রতি ১০ জন পারিবারিক চিকিৎসকের মধ্যে প্রায় নয় জনই ক্রমবর্ধমান হারে উদ্বিগ্ন। আর টরন্টোতে কিছু চিকিৎসক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বেড়ে যাওয়া ও তা মহামারীর পরও স্থায়ী হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন সামান্থা বিটি।
কানাডার পারিবারিক চিকিৎসক কলেজ College of Family Physicians of Canada গত মে মাসে মহামারীর মধ্যে কাজ চালিয়ে যাওয়া ৩,৪০০ জন্য সদস্যের মধ্যে একটি জরিপ চালায়। যেহেতু স্বাস্থ্যসেবার সিংহভাগই পারিবারিক চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন, সেকারণে তাদের পর্যবেক্ষণ কানাডীয়দের অবস্থা সম্পর্কে এক ধরণের ব্যারোমিটারের কাজ করে। বলেন কলেজের গবেষণা পরিচালক স্টিভ স্লেড।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ পারিবারিক চিকিৎসক তাদের রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে “অত্যন্ত উদ্বিগ্ন” (আগের বছর এ ধরণের উদ্বেগ ছিলো ৮০ শতাংশের) এবং ৬৭ শতাংশ চিকিৎসক তাদের রোগীদের অ্যালকোহল ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের অভ্যাস নিয়ে একই রকমের উদ্বেগে আছেন।
উইমেন্স কলেজ হাসপাতালের ফ্যামিলি মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. নোয়াহ আইবারস বলেন, তার রোগীদের মধ্যে অনেকে একাকীত্ব ও উদ্বেগে ভুগছেন।
তিনি বলেন, “আমার দৈনন্দিন চিকিৎসা সেবার সময় রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ যে পরিমাণে ও যে গুরুতর পর্যায়ে দেখতে পাচ্ছি তা চমৎকৃত হবার মত।”
“আমি দায়িত্ব পালনকালে এবং তার পরও লোকেদের সম্ভব সর্বোত্তম সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। একদিকে এটি তাদের জন্য সেখানে হাজির থাকার একটি সুযোগ, বিশেষ করে যখন অনেকেরই সেবা পাবার অন্য কোনও সুযোগ নেই। অন্যদিকে, এটা মানসিক দিক থেকে ক্লান্তিকর।”
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সুলভ নয়
মহামারীর প্রকোপ মানুষের ধারণার চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে এবং বিশেষ করে দুঃস্থ, যেমন, যাদের আবাসন সুবিধা যথেষ্ট নয় এবং জাতিগত সম্প্রদায়ও নেই এমন বয়োবৃদ্ধদের ক্ষেত্রে অসমঞ্জস প্রভাব রেখে গেছে। বলেন ডা. অনেয়ি নরোম। তিনি অন্টারিওর কৃষ্ণাঙ্গ চিকিৎসক সমিতির সভাপতি এবং টিকা সমতা বিষয়ক কৃষ্ণাঙ্গ বিজ্ঞানীদের টাস্ক ফোর্সের সদস্য। মাদকাসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের (CAMH) উপদেষ্টা হিসাবে ডা. নরোম নিকোটিনে আসক্ত রোগীও দেখেন। তিনি রোগীদের সঙ্গে তাদের অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তি নিয়ে কথা বলেন। তিনি মহামারীর কারণে সৃষ্ট একাকীত্ব, একঘেয়েমি, মানসিক চাপ এবং অনিশ্চয়তায় ভোগা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
ডা. নরোম, যিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যামিলি মেডিসিন বিভাগের ইকুইটি ডাইভারসিটি ইনক্লুশনেরও প্রধান, বলেন, অনেকেই বলছেন, “এটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যারও মহামারী।”
“আর এদের চাহিদা পূরণের মত যথেষ্ট সংস্থান আমাদের নেই।”
টরন্টোতে কমিউনিটিভিত্তিক ফ্যামিলি মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. জাভেদ আলো, যিনি মূলত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে মানুষ যে আঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে, যেমন প্রিয় কারও মৃত্যু অথবা আর্থিক অস্থিতিশীলতা- ইত্যাদির একটি দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা থেকে যাবে তাদের সেরে ওঠা, মানিয়ে নেয়া ও চিন্তা করার প্রক্রিয়ার মধ্যে।
তিনি বলেন, এই সব রোগী দীর্ঘকালের জন্য ব্যথা ও মাদক ব্যবহারের সমস্যার উচ্চতর ঝুঁকিতে থাকবেন এবং এমনকি সমাজ ‘স্বাভাবিক’ হবার পরও চিকিৎসা সেবার দরকার হবে।
আলো বলেন, কিন্তু এই সহায়তা যে মাত্রায় দরকার এই মুহূর্তে সে পরিমাণে সুলভ নয়।
তিনি বলেন, “পারিবারিক চিকিৎসক হিসাবে আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছি সেটা হলো, পুরো ব্যবস্থাটিই এমন আলাদা ভাগে বিভক্ত যে, আমরা সাহায্য করার মত অবস্থায় নেই। আমরা সত্যিই একটি পীড়াদায়ক অবস্থার মধ্যে রয়েছি।”
ডাক্তাররা নিঃশেষিত অবস্থায়
জরিপে আরও দেখা গেছে, ১৫ শতাংশ পারিবারিক চিকিৎসক বলেছেন, তারা নিঃশেষিত – এই সংখ্যা ২০২০ সালের মে মাসে এই কলেজের জরিপের ফলের চেয়ে তিনগুণ বেশি।
গবেষণা পরিচালক স্লেড বলেন, “এটি এক বিরাট পরিবর্তন। আরও অনেক পারিবারিক চিকিৎসক আছেন যারা বলেছেন যে, তারা তেমন কিছুই করতে পারছেন না। তারা ক্লান্ত বোধ করছেন এবং মানিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে উঠছে।”
স্লেড বলেন, যদিও মহামারীর শুরুর দিকে রোগীরা তাদের পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে যেতে কমই আগ্রহী ছিলেন, সেই অবস্থা এখন আর নেই। এখন অর্ধেকের বেশি চিকিৎসক বলছেন তারা তাদের কাঙ্খিত সামর্থের অতিরিক্ত কাজ করছেন।
জরিপে দেখা যায়, পারিবারিক চিকিৎসকরা মহামারীর সময় বেশ কিছু নতুন ভূমিকাও রাখতে শুরু করেন যা তাদের কাজের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা কোভিড-১৯ পরীক্ষা কেন্দ্র ও টিকাদান কেন্দ্রে কাজ করেছেন। এক-চতুর্থাংশ উত্তরদাতা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নকারী গ্রুপে, ১৭ শতাংশ চিকিৎসা সেবা পৌঁছানোর নতুন উপায় খুঁজে বের করার কর্মসূচিতে এবং ছয় শতাংশ গবেষণায় অবদান রেখেছেন।
সর্বোপরি তারা অন্য সবার মতই একই রকমের যতনা ও অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে গেছেন।