ভাইরাস অর্নিথিসাইরাস: সময়ের ঘেরাটোপ

হাসান জাহিদ

পত্রিকায় একটা ছবি দেখল অভীক। ছবিটা তাকে উতলা  করে তুলল।

বিস্তৃত প্রান্তরে নভোচারীদের মতো পোশাকাচ্ছন্ন এক মানব অন্য এক মানবকে কবরে ঠেলে দিচ্ছে। কোথাও কেউ নেই, শুধু প্রান্তরজুড়ে শেষবিকেলের ম্যাড়ম্যাড়ে রোদের আভা।

বহু যুগ পরে পৃথিবীতে পুনরাবৃত্তি হলো শোক গাথার এপিক। পুনর্জন্ম লাভ করল দূর অতীতের কোনো অতিমারী-উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে ম্যালেরিয়া কিংবা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্লেগের মতো কলেবরে।

অভীক নতুন কোনো খবরের জন্য আঠার মতো সেঁটে থাকল টিভির পর্দায়। একের পর এক বিজ্ঞাপনের কারণে সে চ্যানেল বদলাল। দেখতে লাগল প্রাণীদের নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র।

সাভানার তৃণভূমিতে হতভাগ্য এক ওয়াইল্ডবিস্টকে বসিয়ে তার নাড়িভুড়ি টেনে টেনে খায় একদল বুনোকুকুর। ওয়াইল্ডবিস্ট প্রকৃতির কাছ থেকে কোনো সাহায্য পেল না। প্রকৃতি তার নিয়ম ভঙ্গ করবে না।

আক্রান্ত জন্তুটির মতো ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে ঘাড় হেলে ঢলে পড়ছে একের পর এক মানব, পৃথিবীর সবপ্রান্তে।

অভীক রাতভর ১৯১৮ সালে সংঘটিত স্প্যানিশ ফ্লু সম্পর্কে আন্তর্জাল ঘাঁটল। একটা বিষয় অবাক করে তাকে-পাঁচকোটি মানুষ মারা যায়! সেটা ইতিহাসে তো জানামতে সবচেয়ে মহাবিপর্যয়কর। তাহলে পৃথিবীতে ‘স্প্যানিশ ফ্লু দিবস’ পালিত হয় না কেন!

অভীক সম্প্রতি মানব বিবর্তন ও সভ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়ছে। তার মনে হয়েছিল যে, হয়তো সারমেয়োখেকোর দেশে অবস্থানকালে তার ভয়াল-তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষ সম্পর্কে জানতে অবচেতন মন তাকে আগ্রহী করে তুলেছে।

উত্তর গোলার্ধে সাগর ঘেরা, লেকসমৃদ্ধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শীতলতম একটি দেশে এসে তার বোধোদয় হয় যে, সে জীবন-যৌবনের অতি মূল্যবান দশটি বছর ধ্বংস করে ফেলেছে।

…যেদিন সে তার স্বপ্নের দেশের একটি এয়ারপোর্ট লেস্টার বি. পিয়ারসনে নামল সেদিন সে অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল ঝকঝকে তকতকে এয়ারপোর্ট আর পরিপাটি মানুষগুলোকে।

এই দেশের মাটিতে পা দেবার পর লেক অন্টারিও’র লক নেস দানবের মতো অনেক মিথ তাকে ঘিরে রাখল। চুলে পাক ধরেছে ততদিনে। অবয়বে জীবনযুদ্ধের ছাপ, একাকী জীবনটাকে ঠেলেঠুলে একটা গুমোট বেইজমেন্টে বাস করে শরীর-মনের যা কিছু অবশিষ্ট সতেজতা ছিল, সব ঝরে গেল।

অভীকের অভিজ্ঞতা সারমেয়োখেকোদের স্থির অশুভ চাহনীর সামনে একটা জট পাকানো বিবমিষায় সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছিল। কানাডায় পদার্পণের পর সেই পিছুটান থেকে গিয়েছিল। তাই বাস্তবতা ও স্বপ্নের এক মিশ্র জগতে বাস করতে লাগল সে।

এখানে এসে সে বুঝতে পেরেছে যে শারীরিক পরিশ্রম কোনো দুঃস্বপ্ন নয়; বরং জীবনের একটি অংশ। কিন্তু তার ভূতপূর্ব দেশে এটা তার জন্য দুঃস্বপ্ন ছিল। সে সর্বক্ষণ তাড়িত ছিল আতংক ও অনিশ্চয়তায়। এখানের দৃশ্যপট অন্যরকম; জীবনের কাঠিন্যের মধ্যেও এক ধরনের আরামদায়ক কাঠামোয় সে নিজেকে ফেলতে পেরেছে। মজুরী ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা। সারাদিন পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে গা ছেড়ে দেয়ার প্রশান্তি।

…তারা তাকে পশ্চাৎদেশে লাথি মারত, এমনকি পেটাত। তার এক সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ নিরীহ সহকর্মী ভৌতিকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। তাকে আর পাওয়া যায়নি।

তীব্র শীতল দেশে পাড়ি দেবার আগে সে ছিল উষ্ণমণ্ডলীয় নিজ ভূমে। সেখানে সে ঢেলে দিল অবশিষ্ট কড়ি ছোটো দুই ভাইবোনের পেছনে। মিতা ডাক্তার হয়েছিল, আর সৌমিক সরকারি চাকুরে। অভীককে তারা উষ্ণ আলিঙ্গনে ভরিয়ে দিয়েছিল।

মিতার বিয়ে দিয়ে, সৌমিকের জন্য পাত্রী ঠিক করে সে পাড়ি দেয় লক নেস দানব ও পুরোনো বে স্টেশনে রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়ানো তরুণী অ্যাপারিশনের দেশে। নায়াগ্রার প্রপাতের স্রোত বয়ে চলে, টরোন্টোর ন্যাড়া গাছের শাখা-প্রশাখায় ভৌতিক শীতল হাওয়া বয়ে চলে, বাড়ি-রাস্তাঘাট ঢেকে যায় বরফে।

‘স্যাভেজ’ দেশ ত্যাগ করার পর সে কঠোর শ্রম থেকে বিরতি নিয়ে নিজ দেশে দুই বছর কাটায়। এই বিরতি তাকে আরেকটি দেশ কানাডায় পাড়ি দিতে শারীরিক-মানসিক কাঁচামাল যুগিয়েছিল।

***

আশির দশক। বাবা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন, যখন অভীক উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শাখের করাতে পড়ে সে, যখন টাকা ও মানসিক শক্তি দুটোরই প্রয়োজন ছিল, তখন নেমে এলো বিপর্যয়। সরকারি কোয়ার্টার ছাড়তে হলো। শুধু বাবার পেনশনের টাকায় ভর করে বাসা ভাড়া নিল। প্রবল সংকটে পড়তে হলো পরিবারটিকে। হাল ছেড়ে না দিয়ে অভীক প্রাইভেট টিউশন যুগিয়ে পড়ার খরচ যুগিয়ে চলল।

ফিলোসফিতে মাস্টার্স করে অভীক চাকরি জোগাড় করতে পারল না। শেষে সে পাড়ি দেয় দূরদেশে।

মায়ের টিউমার ধরা পড়েছিল। ‘অসভ্য’ দেশে অভীক ওভারটাইম করে মায়ের চিকিৎসার জন্য অর্থ পাঠিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। অভীক সেই দেশে অবস্থানকালেই মা পরলোকগমন করেন।

এখানে এই অস্থির ঠাণ্ডার দেশে বন্ধের দিনগুলোতে নিজকে আবদ্ধ রাখে বেইজমেন্টে. আর যৎকিঞ্চিৎ প্রশান্তি খুঁজে নেয় অভীক। বাড়িটির বয়স পঞ্চাশ বছর। বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা দম্পতির একমাত্র ছেলে স্যাম ভ্যাঙ্কুভারে একটা আর্ট গ্যালারিতে কাজ করে। যতবারই সে বাবা-মাকে দেখতে আসে, বাড়িটাকে নিয়ে সে ব্যঙ্গ করতে ভোলে না। আর প্রতিবার সে অভীকের সাথে দেখা করবেই।

যুবক স্যাম অভীককে বলে, “মম আর ড্যাড বিগত দশবছর যাবত বলে আসছেন এই বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। আজও তারা বাড়িটা বিক্রি করে উঠতে পারছেন না। বিষয়টা কেমন ফানি না? কী বলো অভীক?”

অভীক প্রতিবারই প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে হাসে। কোনো উত্তর দেয় না।

তার বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নমূলক পর্যায়ে এবং লিবিডো’র বিকাশের সময়ে, সে দশটি বছর কাটিয়েছে অন্য একটি দেশের অনুৎপাদনশীল বিরূপ পরিবেশে। দেশে, ছাত্রজীবনে সে অধ্যয়নশীল এবং উজ্জ্বল ছিল। এবং সে যথাযথভাবেই তার অহং, স্বাভাবিক বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পারছিল।

অধুনা সে নিজের ক্ষেত্রে দেখেছে মাঝেমধ্যে তার অতি স্বাভাবিক কোনো বিষয়ও কেমন গড়বড় হয়ে যায়। তবে সে বিশ্বাস করে-এটি কোনো মেডিক্যাল কন্ডিশন নয়। ফ্রয়েডীয়-পরবর্তী পরিবেশে এটি ‘ফ্রয়েডীয়’।

অভীক আধুনিক মানুষ সম্পর্কে আর্টিকেল পড়ছে। ‘আধুনিক’ মানুষ প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল এবং এর উৎপত্তিস্থল ছিল বতসোয়ানা।

পড়ার অবসরে তার মন চলে যায় সুদূরে-অতীতে তার নিজ বাসভূমে। অভাব-অনটন ছিল নিত্যসাথী। তবুও দুদণ্ড শান্তি ছিল। কী মিষ্টি ছিল তার ছোটো দুই ভাইবোন। অভীক মিতাকে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দিতে পেরেছিল। সৌমিকের পাত্রী দেখাও চূড়ান্ত করে ফেলেছিল, কিন্তু তার ইমিগ্রেশন পেপারস চলে আসায় অভীক তাড়াহুড়োয় পাড়ি দেয় সুদূর ক্যানেডার টরোন্টোতে, যেখানে পুরোনো বে স্টেশনে রাতবিরাতে ঘুরে বেড়ায় এক তরুণী ছায়ামূর্তি। যেখানে সাগরের জল আছড়ে পড়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে। বাড়িঘর-গাছপালা-সড়ক ব্যাবাক ঢেকে যায় বরফে।

বিগত দুইমাসে অভীককে ফোন করেনি মিতা। এর আগে সৌমিক তাকে জানিয়েছে মিতা বাচ্চা বিইয়েছে। বিশাল মাথা, ছোট্ট রোমশ শরীর তার। অ্যালিয়েনদের মতো ভাবলেশহীন চাহনী।

এসব কী শুনছে সে!

সৌমিক এটাও জানিয়েছে যে, মিতা ছেলেটাকে এক বুড়ি মহিলার কাছে রেখে গায়ে প্লাস্টিক জড়িয়ে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করে।

“আমাকে ফোন করে না কেন?” অভীক জিজ্ঞেস করে।

“কোভিড রোগীদের সেবায় সে খুব ব্যস্ত।” সৌমিক জানায়।   

দুইমাস আগে মিতা ফোন করেছিল; তার বাচ্চা সম্পর্কে একটি বাক্যও সে উচ্চারণ করেনি। সৌমিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে তার আস্কারা পেয়ে বউটা মাথায় উঠেছে। সবাই যখন ঘরে আবদ্ধ সেইসময় তার বউ বাইরে গিয়ে শপিং করছে। এখন সৌমিক বউকে আর ঠেকাতে পারছে না।

“বিনা মেঘে বজ্রপাত! চারিদিকে এসব হচ্ছেটা কী?”

২০১৯ সালের মধ্য জানুয়ারিতে অভীক ক্যানেডা থেকে প্রথমবারের মতো দেশে এসে মিতার বাসায় উঠেছিল। মিতা বড়ভাইকে ছোটো ভাইয়ের মতো শাসন-আদর করতে লাগল। এটাও সে জানাল যে, তার স্বাস্থ্যের সার্বিক অবনতি হয়েছে, ঠাণ্ডার দেশে ফিরে গিয়ে কাজ নেই। বরং এখানেই থাকুক সে।

সৌমিক মিতার বাসায় এসে দেখে গেল ভাইকে। সে নাক উঁচু বউকে নিয়ে বিপাকে আছে।

মিতা বলল, “এবার বিয়ে করো। এই দেশেই ঘরসংসার পাতো।”

“আর বিয়ে, বয়স হয়ে গেছে। তাছাড়া সেই দেশে এখনও থিতু হতে পারিনি। পার্টটাইম চাকরি করি। তবে পাসপোর্ট হয়ে গেলে ভালো থাকব। আর আমি সেখানে বিনে পয়সার স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছি। আমার যাযাবর জীবন, আজ এখানে তো কাল ওখানে।”

“তোমার পঞ্চাশও হয়নি; আর তুমি বলছো বয়স হয়েছে। আসলে আমাদেরকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের জীবনটা বিকিয়ে দিলে তুমি।”

মাথা নাড়ে অভীক, করুণ চোখে তাকায় মিতা। একজনের কান্না, অন্যজনের দৃঢ় চোয়াল ও ভগ্ন জীবন-যৌবনের স্থির দৃষ্টির আড়ালে পৃথিবীর একপ্রান্তে জন্ম নিল ড্রাকুলার অশুভ মন্তরের অধীন লক্ষ কোটি ভ্যাম্পায়ার।

অভীক যেদিন পিয়ারসনে নামে বাদুড়-সময়ে, ইমিগ্রেশন অফিসার কয়েকটি মামুলি প্রশ্ন করেন। অভীক কী কী জিনিস এনেছে। সে তার দেশে থাকাকালীন অন্য কোনো দেশে গিয়েছিল কিনা। কতদিন দেশে ছিল, কেন ছিল। ইত্যাদি।

অন্য একজন অফিসার বললেন, “আমি তোমাকে তোমার লাগেজ খুলতে বলেছিলাম।”

“হ্যাঁ শিয়োর,” অভীককে নার্ভাস দেখাচ্ছিল, এবং সে ব্যাগ খুলতে সময় নিল।

অফিসার তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবং বললেন, “তুমি কতদিন কানাডায়?”

“তিনবছর।”

“তুমি ব্যাগেজ খুলতে অনিচ্ছুক?”

“না, স্যার,” অভীক ইতস্তত করে চাবির জন্য তার পকেট হাতড়াতে লাগল। সে ঘামছিল।

অফিসার বললেন, “এটা এখানে,” তিনি ট্রে দেখিয়ে বললেন, “তুমি তোমার কোমরের বেল্ট আর চাবি ট্রে থেকে নাওনি।”

“আমি দুঃখিত, স্যার,” অভীক বলল এবং সে বেল্ট এবং চাবি তুলে ট্রলিব্যাগ খুলতে গেল।

“ঠিক আছে; তোমার ব্যাগ খোলার দরকার নেই। গো অ্যাহেড।”

“ধন্যবাদ, স্যার,” অভীক সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল।

“হ্যাভ আ গুড ডে।” অফিসার চোখ টিপে হাসলেন। অভীক ঘাবড়ে গিয়ে হেসে অফিসারকে আবার ধন্যবাদ দিল।

স্বদেশে কিছুদিন অবস্থানের পর তার আগমনের কদিন পরই ক্যানেডা স্তব্ধ হয়ে যায়। থমকে গেল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনযাত্রা। মুখ থুবড়ে পড়ে আধুনিকতা, সভ্যতা।

অতি উন্নত ও শক্তিশালী দেশের প্রশিক্ষিত পুলিসের কর্ণকুহরে ফ্লয়েডের আর্তনাদ পৌঁছেনি।

                “এই হত্যা প্রসঙ্গে আরেক কালো মহিলা কীভাবে এমন বক্তব্য দিতে পারে যে, উদার সরকার নাকি তাকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে।” রাসেল বলেছিল।

                অভীক বলল, “এটা অ্যালিবাই। ফ্লয়েড যদি টেরর হয় তো মার্কিন কালো মহিলার ওই বক্তব্য কাউন্টার-টেরোরিজম। আর সে কাজ করছে মার্কিন প্রশাসনের জন্য শ্যাডো ক্যাবিনেটের মতো। আমাদের ব্যাকহোমে যেমন কোনো মামলায় সাক্ষী কিনতে পাওয়া যায় তেমনি একজন সাক্ষীকে হয়তো কিনে ফেলেছে তারা।”

                অভীক গৃহবন্দি। তার রুমমেট অলি একদিন বলল, “আমার কাল রাত থেকে জ্বর, সর্দিকাশিও আছে।”

অভীক বলল, “তুমি মাইকেল গ্যারন হাসপাতালে যাও।”

                “আচ্ছা,” বলে অলি বের হয়ে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এলো। হাতে অনেক খাবারদাবার। সরকারের নির্ধারিত ফ্রি ফুড সেন্টার থেকে নিয়ে এসেছে।

অভীক তার নামে আসা পত্র ও বিল দেখছিল। ক্যানেডা রেভিনিউ’র পত্র, মোবাইল ফোনের বিল ও সবশেষে স্বদেশ থেকে আসা পত্রটা পড়ছিল। এইসময় অলি এলো।

“আমার বোন মিতা মারা গেছে।” অভীক হাত উঠিয়ে অধৈর্য কন্ঠে বলল, “গতরাতে, সে যখন হাসপাতালে ডিউটি করছিল।”

অলি সরে গেল নিঃশব্দে।

                অভীক একটু নিঃশ্বাস নিতে বাইরে বের হলো। গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে বাষ্প। মিতার মায়াময় চাহনী আর আদুরে মুখখানা তার চোখের সামনে ব্যথাতুর হয়ে দুলতে থাকে। দুই চোখ জ¦ালা করে অশ্রু গড়ায়।

                সে শেয়াল-হরিণ ও র‌্যাকুনদের দখলে চলে যাওয়া প্রশস্ত রাস্তাটা দেখে। সে আকাশের দিকে তাকায়, টরোন্টোর এমন কালো আকাশ সে আগে দেখেনি। মনে হলো আকাশসীমা দখলে নিয়ে নিয়েছে অসংখ্য বাদুড় প্রজাতি।

***

ক’দিন পর হাসিব তাকে ফোন করে রাগতস্বরে বলল, “কতিপয় নোংরা লোক ভাইরাসের নতুন ভেরিয়েশন ছড়াচ্ছে।”

“কেন, কী হয়েছে?” অভীক জিজ্ঞাসা করল।

“এই লোকগুলো রাজনৈতিক ক্যাচালে লিপ্ত হয়ে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সরকারের পক্ষ এবং বিরোধী দল-তারা ড্যানফোর্থের এক কোণে জড়ো হয়েছিল।”

অভীক বলল: “কান্ট্রিস্টাইলের কফি আড্ডাতে তাদের আলোচনা মূলত কেন্দ্রীভূত হয় অতীতে তারা যা করেছিল এবং ভবিষ্যতে তারা কী করবে ইত্যকার বিষয় নিয়ে। আশ্চর্যজনকভাবে, প্রায়শই তারা তাদের বর্তমান ‘বীরত্বপূর্ণ’ ক্রিয়াকলাপগুলো লুকিয়ে রাখে।”

অন্যপ্রান্তে হাসিব বিকট শব্দে হেসে উঠল।

এখানে আগমনের পর সব তার গুলিয়ে যাচ্ছিল। দেশের কথা, এমনকি ‘স্যাভেজ’ দেশটির কথাও মনে পড়ত।

কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ প্রোগ্রামে ঢোকার পর তার ঘোলাটে ভাব কাটতে থাকে। সেখানে একজন বাঙালি তার সাথে পড়তেন, তার নাম আশিকুর। পুরো প্রোগ্রামে মাত্র দুইজন বাঙালি। বাকিরা সব ক্যানেডীয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় ও চিনা।

একদিন লং উইকএন্ডের প্রাক্কালে আশিকুর বলল, “অভীক এখানকার কালচারটাকে ভালোভাবে জানা দরকার।”

“কেন, কোনো প্ল্যান আছে আপনার?”

“হ্যাঁ। আমরা একদিন মাসাজ পারলারে ঢুঁ মারব।”

“মাসাজ পারলার কি কালচারের অন্তর্ভুক্ত?”

“হ্যাঁ।”

“ধরলাম, আপনার কথা ঠিক। কিন্তু এরচেয়ে বড় কিছু করা যায় না? ধরুন কোনো মিউজিয়ামে ঘুরে আসা যায়।”

“আপনি অবিবাহিত, আপনার সমস্যা কোথায় যেতে?”

“আমার সমস্যা নেই, সমস্যা আপনার। আপনি বিবাহিত, বউ আছে ঘরে। আপনি কেন যাবেন?”

“শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। এটা তো আর বাংলাদেশ না যে বউ আমার শরীর বানিয়ে দেবে। সে খুব ব্যস্ত থাকে।”

আশিকুরের পাল্লায় পড়ে অভীক গিয়েছিল। পারলার থেকে বের হয়ে অভীকের মনে হলো সে ‘অর্ধ মানব, অর্ধ-শকুনমুখী অর্নিথাইরাস’ গোত্রের এক খেচর দানব।

একদিন জ¦রে পড়ে অভীক। পরদিন সে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে গেল। ইন্ডিয়ান মাঝবয়সী মহিলা। অভীকের কাছে মনে হয়েছে ফ্যামিলি ডাক্তারদের এমনই হওয়া উচিত। কেয়ারিং, বন্ধুবৎসল ও স্নেহপ্রবণ। বেশ সময় নিয়ে তিনি প্রতিবারই অভীককে দেখেন।

“গত দুইদিন ধরে প্রস্রাবে জ¦ালাপোড়া, আর জ¦র।”

ডাক্তার টেস্ট দিলেন। আর আপাতত টাইলেনল খেতে বললেন। তিনি মাউথপিসে প্রেসক্রিপশন বললেন, সেটা লেখা হয়ে গেল কম্পিউটারে। প্রিন্টআউট নিয়ে তিনি বললেন টেস্ট করিয়ে আবার আসতে।

অভীক ইতস্তত করছিল।

তিনি বললেন, “কিছু বলবে অভীক?”

“হ্যাঁ, আমি ইম্পোটেন্ট।”

“মানে?”

অভীক সেদিনের ঘটনা খুলে বলল।

ডাক্তার বীণাপানি বললেন, “দ্যাট ডাজনট নেসেসারিলি মিন ইয়ু আর ইম্পোটেন্ট। আমার সন্দেহ হচ্ছে তোমার ইউরিন ইনফেকশন হয়েছে। টেস্ট করিয়ে কাল এসো, রেজাল্ট দেখে মেডিকেশন দেব, আর তোমার ‘ইম্পোটেন্ট’ হবার গল্প শুনব।”

অভীক খুশি মনে বের হয়ে আসে।

***

ডাক্তার বীণাপানি বললেন, “অভীক তোমার একটা ভালো মন ও অ্যাসথেটিক্স আছে। তুমি হাইলি এডুকেটেড।

যাইহোক, তোমার ইউরিন ইনফেকশন হয়েছে। বেশি করে ক্র্যানবেরি জুস খাবে। আর আমি অ্যান্টিবায়োটিক দিলাম।

আমি তোমাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পাঠাবো। যদিও আমার বিশ্বাস তুমি ইম্পোটেন্ট নও। এটা বছরের পর বছর তোমার অনভ্যস্ততার ফল। আর ব্যাক হোমে তোমার ভূমিকার আমি যথেষ্ট প্রশংসা করি। দুই ভাইবোনকে মানুষ করেছ, আর নিজকে বঞ্চিত করেছ।

তোমার বিয়ে বা সংসার কপালে জোটেনি। আমি মনে করি, তুমি একজন বান্ধবী জোগাড় করো বা বিয়ে করো।”

“ধন্যবাদ ডক্টর, তুমি আমাকে নিয়ে অনেক ভাবো। আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে।”

“আর হ্যাঁ। একটু নিয়মের মধ্যে থাকবে। ঘুম আর পরিশ্রম দুটোই জরুরি।”

অভীক যেন কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। আসলে কোনো রোগের ক্ষেত্রে বা সমস্যা কারুর সাথে শেয়ার করতে হয়।

সুখ বা দুঃখ-যে কোনো অনুভূতিতেই অভীক ভাবতে থাকে যে সে মধ্য ক্রিটেসিয়াস যুগের শকুনমুখী অর্নিথিসাইরাস প্রজাতির দানব-পাখির মতো ঠাণ্ডা-বিষণ্ন আকাশে উড্ডয়নশীল। (চলবে)

হাসান জাহিদ

টরন্টো

আশির দশকের গল্পকার। কানাডায় তিনি সাংবাদিকতা ও কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে গ্রাজুয়েট।