প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮৮
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
আজকের দিনটি দারুন আলোকিত। শীতের সময়ে প্রখর রোদের তাপ খুবই ভাল লাগে। রোমে আজ আমাদের তৃতীয় দিবস। আজ আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড ‘আনা’ আগে থেকেই বলে রেখেছে, আমাদের একটি মজার রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করাবে। তার নাকি খুব পরিচিত।
আমরা সকাল সকাল উঠে পড়ি, ট্যুরে এসে। অটোমেটিক্যালি, কাউকে ডাকতে হয় না। আর রায়হানের একটি সুন্দর অভ্যাস-গত ২০ বছর ধরে, সে খুব ভোরে সাওয়ার নিয়ে একবারে রেডী হয়ে নেয়। আমার স্বামী কাজিমও তাই করলো। আমিও আমার মত রেডী হলাম। ভোরে উঠে নামাজ পড়ে টুকটাক, কুকিজ, চিপস খেয়েছি। এবারে সেই রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে চলছি।
মজার ব্যাপার, আগে থেকেই শুনেছিলাম, রোমে ট্যুরের উদ্দেশ্যে এলে বাস বা গাড়িতে ঘোরা সম্ভব নয়। সত্যিই ব্যাপারটি সেইরকমই। বাসে উঠার কোন সুযোগই নাই। এখন আমরা চলেছি, ‘Piazza del Popolo’ পাশেই। লাঞ্চ খাবার পর ওটা দেখবো। আনা আগেই রায়হানের কাছে অর্ডার নিয়ে, খাবারের অর্ডার দিয়ে আমাদের জন্য রেস্টুরেন্টের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
এটা ‘রেস্টুরেন্ট’ না বলে একটা ‘হাউজ’ বলা ভাল। মূলতই এটা একটা হাউজ। এখানে কোন বয় বা বেয়ারা নাই। একটি পুরানো আমলের হাউজ। বেজমেন্টে স্বামী-স্ত্রী থাকে। প্রথম ফ্লোরটি একটি রেস্টুরেন্ট এর মত করে সাজিয়েছে। বেশ বয়স্ক তারা। আনা আমাদেরকে নিয়ে ভেতরে একটি রুমে বসালো। আমরা আসার সাথে সাথেই তারা দুজন এসে একটি পানীয় দিয়ে আমাদের সুন্দর ভাবে অভিবাদন করে গেল। মহিলাটি থ্যাংক ইউ ছাড়া আর কিছু বলতে পারে না। তবে লোকটি টুকটাক ইংরেজী বলতে পারে। এটি একটি জুস। হাতে করেছে। নানান রকম ফলের জুস। তবে এর মধ্যে কিছু পাতারও ফ্লেভার পাচ্ছিলাম। যাইহোক প্রায় ১৫ মিনিট পর আগুন গরম (রীতিমত ধোঁয়া উঠছিল) প্লেটে খাবার এলো। ৪ প্লেট। আনা একদম রাজী ছিল না আমাদের সাথে খেতে। তবে কাজিম তাকে আদরের ধমক দিয়ে রাজী করিয়েছিল। ৪ প্লেটেই পাস্তা। এই পাস্তাটি একেবারেই অন্যরকম। অনেকটা লম্বা বাসমতির মত। অথবা তার থেকে একটু লম্বা। তার মধ্যে কিউব করে কাটা ফিস। কোন সবজি নাই। তবে নানান কিসিমের পাতার ব্যবহার আছে। রোজমেরী চিনতে পারলাম। আরো দুটি পাতা পেলাম। এত সুন্দর গন্ধ। এবং মহিলার রান্নায় রীতিমত যাদু আছে। সম্ভবত ফিসটা আগে থেকে মেরিনেটিং করা ছিল। নরম এবং খুবই সুস্বাদু ফিস। মসলা খুব কম ইউজ করেছে। অনিয়ন এবং গারলিক এবং অল্প গোলমরিচ। তবে সামনে সস দিয়েছে ৩/৪ রকমের। আমার স্বভাব হলো নতুন কোন রান্না হলে তার স্বাদের থেকেও আমার বেশী প্রচেষ্টা থাকে রান্নাটি কি ভাবে সে করেছে। তাই আমি এক্সট্রা সস খাই না। অনেক যত্নে মহিলা রান্না করেছে। খাবার শেষে রায়হান ২০ ইউরো টিপসও দিল। তারা খুবই খুশী হলো। এবং আমরা বললাম, আগামীকাল পথে পড়লে আবার আসবো। যদিও আর যাওয়া হয়নি।
পেট ভরে টায় টায় অবস্থা। এবারে বেশ রোদের আনন্দ নিতে নিতে আমরা ধীরে সুস্থে ‘Piazza del Popolo’ এর মধ্যে প্রবেশ করলাম। বৃহৎ জায়গাটি। এটি মূলত একটি শুভ প্রবেশদ্বার। শতাব্দী ধরে তাদের চিরন্তন প্রথাগত একটি প্রবেশ দ্বার। এটা ‘ডেল বাবুইনো’ হয়ে ডি রিপেটা’ হয়ে তারপর ‘ডেল কার্সো’ করে একটি ঐতিহাসিক প্রবেশদ্বার করেছে। তিনটি সম্পূর্ণ উল্টো রাস্তাকে একটি কেন্দ্রের মধ্যে মিলিত করেছে আশ্চর্যভাবে। পোপ চতুর্থ পিয়াস এটি বিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এন্ধেলোকে দিয়ে সমাপন করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে শিল্পী মাইকেল এন্ধেলো কাজটি ‘নান্নি ডি বাকসিও বিগিও’র কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। এর ভিতর প্রবেশ করলে স্তম্ভিত হতে হয়। এর আভ্যন্তরীন অংশে খোদাই করা বার্তা। যদিও আমরা সেটা পড়তে পারছিলাম না। সম্ভত সেটা হিব্রু ভাষা হতে পারে। যিশুর কোন বার্তা। অসাধারণ। কি জীবন্ত। মনে হচ্ছে এতটুকু পুরানো কিছু নয়। এইমাত্র কেউ লিখে রেখে গেছেন। অথচ এর খোদাই করা অংশটি লেখা হয়েছিল ১৬৫৫ সালে। রোমে সুইডেনের ক্রিস্টিনার আগমন উপলক্ষে। এটি খোদাই করেছিলেন আলেক্সান্ডার বানিনি। তবে এর ডিজাইন করেছিলেন কার্লো রাইনাল্ডি। তবে এটার ফিনিশিং এর কাজ করেছিলেন জিয়ান লরেন্ধো বানিনি। প্রতিটি স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে কোন বিখ্যাত কর্নারে। মানুষের স্ট্যাচু। এবং সেগুলো এতটাই জীবন্ত যেন এখুনি নেমে এসে আমাদেরকে হ্যালো বলবে। আমি ছবি তুলছিলাম একটার পর একটা। রায়হান বললো, মামনি ছবি তুলে সময় নষ্ট না করে দু চোখ ভরে দেখো। ১৫ থেকে ১৬ শতাব্দীর শেষ অবধি অসংখ্য স্থপতি একে পরিবর্তিত এবং পরিমার্জিত করেছে। দেখতে দেখতে একটি জায়গাতে আনা দাড়িঁয়ে পড়লো। আমাকে বেশ কেমন যেন একটি কণ্ঠে বর্ণনা করলো -যেখানে ব্যাসেলিকা’র স্ট্যাচু দাড়িঁয়ে আছে (এটা অবশ্যই একটি কিংবদন্তি), সেখানে আত্মঘাতি সম্রাট নিরো’র অভিশপ্ত সমাধি রয়েছে যার ছ্ইা নাকি একটি আখরোটের নীচে একটি পোরফাইরির কলসে কবর দেওয়া হয়েছিল। গীর্যার মূল বেদীর কাছে বেস রিলিফ’রাও দেখলাম গল্পটি ট্যুরিস্টদের কাছে ফলাও করে বলছে।
জানিনা, আনা’র কণ্ঠে কি ছিল? ঘৃণা? নাকি কেবল ঐতিহাসিক তথাকথিত স্মৃতিচারণ? প্যারিসেও নিরো’র প্রাসাদ রয়েছে। যদিও আমার যেতে ইচ্ছা করেনি। মজার ব্যাপার যখন, আনা নিরো’র গল্পটি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলছিল, আমি যেন হঠাৎ করে নিরো’র বেহালার সুর শুনতে পেলাম। আমার শরীরে লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। আসলে ইউনিভার্সিটিতে আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল ইতিহাস। সে কারণে নিরো’র কিংবদন্তির প্রচুর গল্প জানা ছিল। জানিনা সেটা সত্যি নাকি মিথ্যা? পৃথিবীর ৪/৫ জন নিষ্ঠুর রাষ্ট্রপ্রধান বা সম্রাটের মধ্যে নিরো ছিল অন্যতম। কথিত আছে তার আমলে কোন জেল ছিল না বললেই চলে। তার একটি বিশাল, নিজের লোকদের দ্বারা বানানো দীঘি ছিল। যার মধ্যে বিশাল আকারের কুমিরগুলো (কেউ কেউ বলে কমোট) ছিড়ে খুড়ে খেতো তার কথিত অপরাধীকে। এবং এই দৃশ্য অবলোকনের পর নিরো এতটাই মজা পেত যে তখুনি ঐ দীঘির পারে বসে করুন সুরে তার বিখ্যাত বেহালা বাজাতো। কি অদ্ভুত! কি আশ্চার্য? শুনেছি হিটলার, ইবনে বতুতা এরা সব মানুষকে এই রকম ঘৃন্য সাজা দিয়ে বেহালা বাজাতো। একদিকে কি ভয়াবহ, ঘৃন্য নরহত্যা অন্যদিকে বেহালার অপরূপ সুরের মূর্ছনা! কি অসাধারণ বৈপরিত্রের মিশ্রণ।
আগামীকাল আমাদের রোমে শেষ দিন। এরপর পরশু চলে যাবো মিলান এ। আজ তাই রোমে সিটি ট্যুরটা করতেই হবে। আগামকালের ট্যুরের প্লান আগে থেকে করা আছে। তাই আমরা আরো তিনটি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান ট্যুর করে নিলাম।
এরপর আমরা The Colosseum দেখতে গেলাম। এটা এখন কেবল স্মৃতি। তবু এরা ধরে রাখতে জানে। আমাদের ওদিকে হলে এর অস্তিত্বও থাকতো না। ‘কলোসিয়াম’ পন্স মিলভিয়াসে ম্যাকেনটিয়াসের বিরুদ্ধে কনস্টাইন প্রথম বিজয়ের সম্মানে নির্মিত হয়েছিল। এর নির্মান সন দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! এটা ৩/৫ খ্রীষ্টব্দে নির্মিত হয়েছিল। কলোসিয়ামের বেশ কাছেই হলো ‘ Arch of Constantine’ এটাও রোমের একটা বিজয়ী খিলান। এটাও যুদ্ধের ঘটনা। তবে এই যুদ্ধের পরই ইটালীতে চিরস্থায়ী খ্রীষ্ট ধর্ম চিরস্থায়ী জুরে বসে। গোটা রোমান সাম্রাজ্য জুরে একটি ধর্ম পতাকা আজ অবধি শৈর্য-বীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা হলো খ্রীষ্ট ধর্ম। এবং এই খিলানটিও ৩১৫ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হয়।
রোম ট্যুর করার একটাই সুবিধা হলো (আমার কাছে মনে হলো) দ্রষ্টব্য স্থানগুলো খুব দূরে দূরে নয়।
এরপরই আমরা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটা স্থান পরিদর্শনে গেলাম। এখানে গিয়ে দেখি প্রচুর ট্যুরিস্টে ভরা। প্রায় সন্ধ্যা তখন। এটি টুরিষ্ট এরিয়া বিধায় আলোগুলো এখানে নিভে যাচ্ছে না। তবে প্রয়োজনের তুলনায় আলোর উজ্জলতা কম। Trajan’s Market বিশ্বের প্রথম শপিং মল। সত্যি বলতে এর নির্মান এবং ইত্যাকার বিষয়গুলো পড়তে পড়তে আমার শরীর ছম ছম করছিল। আমার ভেতরে যেতে ভয় করছিলো। এটি নির্মান হয়েছিল রোমান সাম্রাজ্যের সময়। এটি ১০৭ থেকে ১১০ খ্রীষ্টব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। এবং সেই সময় গোটা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি এরকম শপিং মল ছিল না। একমাত্র রোমান সাম্্রাজ্যের পক্ষেই সম্ভব ছিল এরকম একটি পরিকল্পনার। এবং এই পরিকল্পনাটি এসেছিল সম্রাট ট্রাজানের মস্তিস্ক থেকে। আমি এটি দেখতে দেখতে অভিভূত হলাম এবং বর্তমানের আসম্ভব আধুনিক শপিং মলগুলোতে তার ছায়াই দেখতে পেলাম। শপিং মলটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত। সম্রাট ট্রাজান তার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়ন করার জন্য দামেস্কের এ্যাপোলোডোরাস-কে নিযুক্ত করেন। এই শপিং মলটি নামও সম্রাট ট্রাজানের নামানুসারেই হলো। এবং বর্তমান শপিং মল গুলোর মতই সবচেয়ে উপরিভাগটি অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এছাড়া সবচেয়ে নীচের তলাটি গ্রেট হল হিসাবে ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ ঐ গ্রেট হলে কনসার্ট বা বিভিন্ন রকম বক্তৃতা
সভা হতো। এছাড়া অন্যান্য তলাতে দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদেরকে তাদের পন্য বিক্রির অনুমতি দেওয়া হতো। এই দোকনগুলিকে ‘টেবারনে’ বলা হতো। মলের উপরে যে গুম্বুজ দেখা যায়, সেটি থেকে বাতাস এবং সূর্যের আলোকে দোকান গুলিকে আলোকিত করাবার জন্য নির্মান করা হয়।
একটা অতি বিস্ময়কর অনুভূতি নিয়ে ট্রাজান শপিং মল দেখে বের হলাম। বুঝতেই পারিনি এতটা সময় পার হয়েছে। রাত প্রায় নয়টা বাজে। আনা-কে নিয়ে আমরা কাছেই একটা খাবারের স্টল থেকে দারুন মজার ডিনার সারলাম। আগামীকালের ট্যুরের ব্যাপারে আগেই আলোচনা হয়েছিল। তারপরও কিঞ্চত আলোচনা করা হলো। আমারা ঠিক কোথায় আনা’র সাথে মিট করবো সেটাও ঠিক করে নিলাম।
অবশেষে আনা শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল। আমরাও আমাদের হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।