টরেটক্কা টরন্টো

সামাজিকতা ও ধর্মপালন -৫

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো ভিত্তিক গ্লে­াবাল নিউজের ২০১৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর অনলাইন সংখ্যার একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট ব্যাপক সাড়া জাগায় বাংলাদেশী কমিউনিটির মাঝে। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট স্টুয়ার্ড বেল এবং এন্ড্রু রাসেলের করা সেই রিপোর্টে বলা হয় যে বৃহত্তর টরন্টোর এজ্যাক্স শহরের ভারতীয় বিজনেসম্যান তারেক রানা নাকি আসলে বাংলাদেশের পলাতক সন্ত্রাসী খন্দকার তানভীর ইসলাম ওরফে জয়। এক সময়ের ঢাকার সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্য জয় নাকি তারেক রানা নাম নিয়ে ইন্ডিয়া থেকে ২০১৩ সালে অভিবাসী ভিসা নিয়ে কানাডাতে আসে। তারপর এজ্যাক্সে ‘এসজে-সেভেনটি ওয়ান’ নামের একটি কোম্পানী খুলে সে নিজেকে একজন বিল্ডার্স বলে প্রচার করা শুরু করে। লোকাল এমপি এবং মেয়রের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে বিভিন্ন সিভিক অ্যাওয়ার্ড সহ ২০১৮ সালে সে ‘এন্টারপ্রেনার অব দ্য ইয়ার ইন এজ্যাক্স’ উপাধীও বগলদাবা করে ফেলে। সেই রিপোর্টে সাংবাদিকদ্বয় দৃঢ় সংশয় প্রকাশ করে বলেন যে, আদতে তারেক রানাই হচ্ছে জয়। কারণ চেহারা ছাড়াও তাদের জন্ম তারিখও নাকি মিলে যায়। এই রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে তারেক রানার আর খোঁজ মেলেনি, তবে টনক নড়ে উঠে বাংলাদেশী কমিউনিটির। তারা নিজদের বাড়ীর আশে পাশে বাংলাদেশের কুখ্যাত পলাতক আসামীর অস্তিত্ব টের পেয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেন। ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পেতে থাকে আরও সব পলাতক আসামীদের অস্তিত্ব যাদের বেশীর ভাগই হচ্ছে ঋণ খেলাপী কিংবা প্রতারক। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কিংবা নানা ধরনের পঞ্জি-স্কিমের ব্যবসার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নিয়ে টরন্টোতে এসে স্থায়ী হয়েছে। গড়ে তুলেছে ‘বেগম পাড়া’ যা নিয়ে বাংলাদেশের সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয় আজকাল।

পাকিস্তান আমলে বলা হত যে বাইশটি পরিবারের হাতে দেশের সব সম্পদ পুঞ্জীভূত। তারাই সব শিল্প কারখানা কিংবা ব্যাংক-বীমার মালিক। আরো লক্ষণীয় বিষয় ছিল যে এসব পরিবারের একটিও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের ছিল না। পঞ্চাশের দশকে ঢাকার রাস্তায় হাতেগোনা কিছু প্রাইভেট কার চলত। এরপর ১৯৭১-এ আমরা স্বাধীন হলাম। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে একটা কথা প্রায়ই শোনা যেত, ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। বিশেষ এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে এই বিশেষণে ভূষিত করা হত তখন। মূলত তারা দূর্নীতির মাধ্যমে ‘সরকারী পারমিট’ জোগাড় করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র গুদামজাত করে বাজারে তৈরি করত কৃত্তিম সংকট। আর সেই কৃত্তিম সংকটের সুযোগ নিয়েই তারা রাতারাতি হাতিয়ে নিত প্রচুর মুনাফা। অবশ্য এক সময় তাদের অর্থাৎ এই কালোবাজারীদের দৌরাত্ম্য শেষ হয়। দেশে এক উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশ ঘটে যারা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করে তুলেন বিভিন্ন কলকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে, দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করেন। তাঁরা দেশীয় পণ্যকে বিদেশে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেন এবং বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ তৈরি করেন। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রির অবদান সবচেয়ে বেশী। শুধু বৈদেশিক মুদ্রা আয় নয়, এই গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রিই বিশ্ব বাজারে পরিচিত করে তুলে বাংলাদেশের নাম। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই ভীষণ রকমের এক ‘ইমেজ’ ক্রাইসিসে ভুগছে। শুরুটা হয়েছিল তদানীন্তন মার্কিন সেক্রেটারী অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার যখন বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে অভিহিত করেছিল। তখন থেকেই আমাদের কপালে জুটে যায় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’-এর তকমা। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে আমাদের গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রি। বিদেশী নামীদামী ব্রান্ডের পোশাকে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লিখা ট্যাগ অনেকটাই দূর করে দিতে পেরেছে বাংলাদেশের এই ইমেজ প্রবলেমকে। দেশের অর্থনীতিতে এবং ইমেজ বৃদ্ধিতে সক্রিয় অবদান রাখার জন্য এই উদ্যোক্তা শ্রেণী সব সময়ই প্রশংসার দাবীদার। দেশের সরকারের উচিৎ এই শ্রেণীকে উৎসাহ এবং সহযোগিতা প্রদান করা। যারা এই শ্রেণীকে বিনা কারণে হেনস্থা করবে তাদেরকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনা। যাতে তারা তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাকে দেশের ভিতরেই পুনর্বিনিয়োগ করে দেশকে আরো সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে উৎসাহিত হন।

এনআরবি গ্লে­াবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি এই পিকে হালদার তার দূর্নীতির ক্যারিয়ার শুরু করে আর্থিক খাতের বড় বড় কোম্পানী দখল ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে। ছবি: মানবজমিন

কিন্তু এই উদ্যোক্তা শ্রেণীর পাশাপাশি গজিয়ে উঠেছে এক তেলবাজ প্রতারক ও বাটপার শ্রেণী। তারা ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা লোন নিয়ে কিংবা দেশের সাধারণ জনগণের টাকা বিভিন্ন কায়দায় আত্মসাৎ করে কালো টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। এই কালো টাকার পাহাড়কে তারা সঙ্গত কারণেই দেশে রাখতে নিরাপদ মনে করেনি। তাই সেই টাকা নিয়ে তারা পাড়ি দিয়েছে মালেয়শিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’-এ কিংবা টরন্টোর ‘বেগম পাড়া’তে কিংবা অন্য কোথাও। ফলে দেশ থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে লক্ষ কোটি টাকা। ‘যুগান্তর’ পত্রিকার এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা। যে গতিতে আমাদের দেশ থেকে টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে সেটা যদি অব্যাহত থাকে তবে যে খুব শ্রীঘ্রই আমাদের দেশের অর্থনীতির বারোটা বেজে যাবে সেটা বোঝার জন্য আপনাকে বড় কোন অর্থনীতিবিদ হতে হবে না। অথচ পরিস্থিতি হতে পারত অন্যরকম। সম্প্রতি দেশের বিশিষ্ট নাট্যজন মামুনুর রশীদ সমকাল পত্রিকাতে (১২ই জানুয়ারী, ২০২০) তাঁর এক লেখায় (“অসম্ভবের পথে মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব”) লিখেছেন -“দেশে এখন যে পরিমান উন্নয়ন কার্যক্রম হচ্ছে এবং নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কাজের পরিধি বাড়ছে, তাতে সত্যি সোনার বাংলা গড়া সম্ভব, যদি চাটার দল সবকিছু চেটেপুটে না খেয়ে ফেলে। এই চাটার দলকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে চিহ্নিত করেছিলেন। চাটার দলকে যদি নিশ্চিহ্ন করা যেত, তাহলে দেশের চেহারাটাই অন্যরকম হয়ে যেত”। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশটা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা হয়ে উঠেনি বরং সেই চোর বাটপারের দলই দেশটাকে চেটেপুটে খেয়ে ছোবড়া বানিয়ে দিচ্ছে।

একটা সময় ছিল যখন লাখ টাকা ছিল অনেক টাকা, কারো লাখ টাকা হলে সে তখন ‘লাখের বাতি’ জ্বালাত। পরবর্তীতে অর্থনীতির সুত্র ধরে সময়ের সাথে সাথে মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে কোটি টাকাকেও অনেক টাকা মনে না হওয়ার যুগ শুরু হলো। আর সেই সাথে আম জনতা পরিচিত হতে শুরু করল ‘কোটি টাকা’র দূর্নীতির সাথে। অর্থ কেলেঙ্কারির আকার যে কত বড় হতে পারে সে ব্যাপারে প্রথম ধাক্কা আসে যখন ‘হলমার্ক’-এর চার হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণের কথা পত্রিকাতে আসা শুরু হয়। প্রশ্ন দেখা দেয় একজন অখ্যাত লোক তানভীর কিভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে এই অতি বিরাট অংকের টাকা ঋণ পেল। কারা ছিলেন এই ঋণ দেয়ার পিছনের কুশীলব? তখনকার অর্থমন্ত্রী অবশ্য সেই সব প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়ে বরং চার হাজার কোটি টাকাকে ‘সামান্য টাকা’ বলে উল্লেখ করে সমালোচিত হয়েছিলেন (“মাত্র চার হাজার কোটি টাকার দূর্নীতি!”, প্রথম আলো, ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২)। এরপর পুরো জাতিকে স্তভিত করে দিয়ে খবরে আসে প্রশান্ত কুমার হালদার যে কিনা পিকে হালদার নামেই অধিক পরিচিত। ‘প্রথম আলো’ সহ বিভিন্ন পত্রিকাতে পিকে হালদারের পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ খবর ছাপা হয় সে নাকি বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানীর নামে ব্যাংক ঋণ এবং পুঁজি বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডাতে পালিয়ে গেছে। সেই টাকার সঠিক পরিমান অবশ্য কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন নি, তবে ধারণা করা হয় সেই টাকার পরিমান দশ হাজার কোটির কম নয়। পত্রিকার খবরে কানাডাতে বসবাসরত ছোট ভাই প্রিতিশ ও প্রিতিশের স্ত্রী সুস্মিতা সহ পরিবারের আরও ঘনিষ্ঠ স্বজনদের নামও চলে আসে তার ‘পার্টনারস ইন ক্রাইম’ হিসেবে। সেই সাথে তার ব্যবহৃত টরন্টো শহরের ঠিকানাও। গুগল ম্যাপ থেকে পাওয়া তার বাড়ীর ছবিও চলে এসেছে ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে। এনআরবি গ্লে­াবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি এই পিকে হালদার তার এই দূর্নীতির ক্যারিয়ার শুরু করে আর্থিক খাতের বড় বড় কোম্পানী দখল ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে। সে নানা কৌশলে বড় বড় যে চারটি কোম্পানী দখলে নিয়েছিল সেগুলো হলো, ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’, ‘পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’ ‘এফ এ এস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেষ্টমেন্ট লিমিটেড’ এবং ‘বাংলাদেশ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানী (বি আই এফ সি)। আমার এক বন্ধুর পরিবার ‘পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’-এ বিশ লক্ষ টাকা লগ্নি করে আজ দিশেহারা। পিকে হালদার বর্তমানে পলাতক। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে বিগত পনেরো বছর ধরে সে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে, নামে বেনামে নাম সর্বস্ব কোম্পানী খুলে শেয়ার বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা পকেটস্থ করেছে, ঐ সময় দুদকের ভূমিকা কি ছিল? তারপর বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় কিভাবে? যে শর্সে দিয়ে ভূত তাড়ানো হবে সেই শর্সের ভিতরেই নাকি ভূত রয়েছে। দুদকের পরিচালক এনামুল বাছির এবং ডিআইজি মিজানুর রহমানের মধ্যে চল্লিশ লাখ টাকার ঘুষ বিনিময়ের মামলাই তা প্রমাণ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দুদকের পক্ষ থেকে সাফাই গাওয়া হয় যে তারা নাকি নয় মিনিটের জন্য পিকে হালদারকে ধরতে পারেন নি। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদ অধিবেশনে দুদকের উদ্দেশ্য বলেন, আপনারা কেন তাকে নয় ঘণ্টা আগে আটক করলেন না। তিনি আরো বলেন যে বাংলাদেশে আর কোন কালো টাকা নেই। সবই পাচার হয়ে গেছে বিদেশে। তাই তিনি প্রস্তাব করেন যে, দূর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের হেড অফিস আপাতত বাংলাদেশে রাখার দরকার নেই, বরং সেটাকে কানাডাতে স্থানান্তরিত করা দরকার (‘প্রথম আলো’, জুন ০৭, ২০২১)। স্যাটেয়ার ধর্মী তাঁর এই বক্তব্যে সহজেই বোঝা যায় যে দূর্নীতির টাকার একটা মোটা অংশ বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে পাচার হয়ে এসেছে।

বাংলাদেশের মেইনস্ট্রীম পত্রপত্রিকার প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সেই পাচারকৃত টাকার পরিমান অবিশ্বাস্য রকমের বিশাল। মুদ্রা-রাক্ষস পিকে হালদার একাই নাকি দশ হাজার কোটি টাকার উপর লোপাট করে নিয়ে এসেছে কানাডাতে। আরো অনেক প্রতারক, বাটপার কিংবা দূর্নীতি পরায়ণ সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারাও রয়েছে এই তালিকায়। অধুনাকালে এক শ্রেণীর মানুষ প্রতারণাকে শিল্পোত্তীর্ণ পর্যায়ে নিয়ে গেছে বাংলাদেশে। করোনোর টেস্ট নিয়ে জালিয়াতিতে ধরা পড়া এমনই কয়েকজনের ভিতর একজন হচ্ছে সাহেদ যে কিনা টিভির প্রথম সারির টক-শোগুলিতে নিয়মিত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অংশ গ্রহণ করত। অথচ আওয়ামী লীগে তার কোন পজিশনই ছিল না। সম্প্রতি অতিরিক্ত সচিবের ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে নন-মেট্রিক আব্দুল কাদের সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাজ পাইয়ে দেয়ার নাম করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। সেই আব্দুল কাদেরের সাথে যখন স্বঘোষিত প্রিন্স এবং ‘রহস্য মানব’ মুসা বিন শমসেরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেল তখন প্রিন্স মুসাকে ডিবিতে তলব করে পাঠানো হয়। খবরে প্রকাশ প্রিন্স মুসার নাকি বিরাশি মিলিয়ন ডলার আটকে আছে সুইস ব্যাংকে। সেই টাকা ছাড়াতে পারলে তিনি নাকি বাংলাদেশে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করে দিবেন। কিন্তু তিন ঘণ্টা জেরা করার পর সাংবাদিক সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন যে, মুসা বিন শমসের আসলে একজন ভন্ড, তার কোন অর্থ সম্পদ নেই (‘প্রথম আলো’, অক্টোবর ১৮, ২০২১)। এই হচ্ছে বাংলাদেশে প্রতারণার হাল হকিকত।

বাংলাদেশের এক শীর্ষ দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘ব্যাংক ডুবিয়ে জাহাজ ভাসালেন তিনি’ (প্রথম আলো, ০২ মার্চ, ২০১৮)। সেখানে শুধু বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর ব্যক্তিগত দূর্নীতির কথা উঠে এসেছিল, কিন্তু তিনি যাদেরকে নিয়ম বহির্ভূত ঋণ দিয়েছিলেন তাদের পরিচয় প্রকাশ পায়নি। সেই সব ঋণ খেলাপীদের কেউ কেউ যে কানাডার বেগম পাড়া-তে লুকিয়ে নেই তাই বা কে হলফ করে বলতে পারবে? সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত ‘প্রথম আলো’ (“ব্যাংক খাত ঝামেলায়ঃ মুহিত”, ১৯ জানুয়ারী, ২০২০) পত্রিকাকে দেয়া এক ইন্টারভিঊতে স্বীকার করেছেন যে বাচ্চুর হাই-লেভেলের কানেকশনের কারণেই নাকি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে সেই সব ঋণ খেলাপিদেরও কানেকশন বেশ শক্ত। আর আমরা দেখছি যে টাকা একবার বিদেশে পাচার হয়ে গেলে সেই টাকা কিন্তু সহজে ফেরৎ পাওয়া যায় না। হ্যাকার কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের পাচারকৃত টাকা কিন্তু ফিলিপাইন থেকে এখনও ফেরৎ আসেনি, কবে আসবে সেটাও এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। তাই দুদকের কর্তাব্যক্তিরা যতই আস্ফালন করুক না কেন পিকে হালদারদের পাচারকৃত টাকা যে খুব সহজেই বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে নিতে পারবে না সেটা কিন্তু সবাই বোঝে। এমন কি চীনের কম্যুনিস্ট সরকারকে আদাজল খেয়ে লাগতে হয়েছিল লাই চ্যাংসিং নামক এক কুখ্যাত স্মাগলারকে ভ্যাঙ্কুভার থেকে চীনে ফেরত নিতে। বাংলাদেশ সরকার কি সেভাবে লেগে থাকতে পারবে? তাছাড়া পিকে হালদারের আগে বাংলাদেশ সরকারের প্রায়োরিটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে নেয়া।

প্রশ্ন উঠছে কানাডা কি তার নমনীয় নীতির কারণে দুষ্কৃতিকারীদের জন্য অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে? যেমন ‘ফরেন বায়ার’ ক্যাটাগরিতে বাড়ী কেনার ক্ষেত্রে কানাডার নমনীয় নীতির কারণে বিগত বছরগুলোতে ভ্যাঙ্কুভার, টরন্টো, অটোয়া শহরে দেখা গিয়েছে বিদেশী ক্রেতাদের নজীরবিহীন ভীড়। ফলে এই শহরগুলোর প্রপার্টি মার্কেট হয়েছে হট কেকের চাইতেও বেশী হট। তবে লোকাল কানাডিয়ানদের মাঝে অসন্তোষের মেঘ দানা বেঁধে উঠায় কানাডিয়ান সরকার কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করে বল্গাহীন এই মার্কেটের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন অনুসন্ধানে জানা যায় যে এই বিদেশী ক্রেতাদের একটা বড় অংশ হচ্ছে মেইনল্যান্ড চীনের ব্যবসায়ীরা। তবে এই ধরাছোঁয়ার বাইরের রিয়েল এস্টেট বাজারে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশী মুদ্রা-রাক্ষসেরাও। তবে আশার কথা এই যে, একটা তীব্র জনমত গড়ে উঠছে এইসব লুটেরাদের বিরুদ্ধে। “লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও” স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে ড্যানফোর্থস্থ বাংলাদেশী চত্বর। আমরা যদি আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই সব ব্যাংক লুটেরাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করি, তাদেরকে এখানে বাড়ী কিংবা ব্যবসা করতে সহযোগিতা না করি, এখানকার মেইনষ্ট্রীম মিডিয়াতে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিই, তবে তারা হয়ত এদেশটাকে আর তাদের অভয়ারণ্য বলে ভাবতে পারবে না। পাড়ি জমাবে নতুন কোন গন্তব্যে। আর রক্ষা পাবে টরন্টো শহর তাদের রাহুপাশ থেকে।

(চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো

One thought on “টরেটক্কা টরন্টো

  • Toronto, Sunday, November 28, 2021 at 9:17 pm
    Permalink

    Great article.

Comments are closed.