‘অন্টারিওতে শ্রমজীবী মানুষের জন্য ১০ সেন্ট মজুরি বৃদ্ধি অপমানজনক’
খুরশিদ আলম
করোনা মহামারীকালে কানাডিয়ানদের মর্মপীড়ার মূল কারণ যখন অর্থসংকট তখন অন্টারিওতে কর্মজীবী মানুষের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা হলো মাত্র ১০ সেন্ট! অক্টোবর মাসের ১ তারিখ থেকে নতুন এই আইন কার্যকর করা হয়। এর ফলে ন্যূনতম মজুরি এখন ঘন্টায় ১৪.২৫ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.৩৫ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
অন্টারিওর প্রধান বিরোধী দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র নেতা এন্ড্রিয়া হোরওয়াথ ১০ সেন্টের এই মজুরি বৃদ্ধির আইনকে শ্রমজীবী মানুষের জন্য অপমানজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। সিবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই মজুরি বৃদ্ধি অন্টারিওর শ্রমজীবী মানুষের জন্য কোন ভিন্নতা বয়ে আনবে না।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিও’র বিগত লিবারেল সরকারের করা fair workplaces better jobs act অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা ড্যাগ ফোর্ড গত নির্বাচনে জয়ী হয়ে শুরুতেই এই আইনটি বাতিল করে দেন।
তারও আগে ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে লিবারেল সরকার যখন ন্যূনতম মজুরি ১৪ ডলার করেছিল তখন অনেক অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৪ ডলার করার ফলে এখানকার চাকরীর বাজারে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। চাকরী হারাবেন অনেকে এবং নতুন কোন চাকরী সৃষ্টি হবে না।
টিডি ব্যাংক এর ভবিষ্যতবাণী ছিল ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির ফলে এই প্রভিন্সে প্রায় ৯০ হজার লোক চাকরী হারাবেন। ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ ‘রেস্টুরেন্ট কানাডা’র সতর্কবাণী ছিল, ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি এবং অন্যান্য নতুন শ্রম আইনের কারণে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার চাকরী হুমকীর মুখে পড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর কোনটাই হয়নি।
অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির পর কিছু কিছু চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠান আত্মরক্ষার নামে কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা কর্তন করে। কিন্তু দেখা গেল সেই সময় অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরী ১৪ ডলারে উন্নীত করার পর ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও নতুন চাকরী সৃষ্টিতে তা নেতিবাচক কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং দেখা গেছে ২০১৮ সালের জুলাই মাসেই অন্টারিওতে ষাট হাজার নতুন চাকরী যোগ হয়েছে (যদিও এর একটা উল্ল্লেখযোগ্য অংশ সরকারী প্রতিষ্ঠানে)। অন্যদিকে বেকারত্বের হার কমে এসে ৫.৪ এ ঠেকেছিল। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব এটি। এবং গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ম বেকারত্বের হার ছিল এটি। সেই সময়কার হাফিংটন পোস্ট এই তথ্য জানায়।
এদিকে মহামারী শুরু হওয়ার পর আজকের বাস্তবতা হলো, কানাডায় অর্থনৈতিক অসাম্য বেড়েছে। কানাডিয়ান ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব কমার্স (সিআইবিসি) এর সাম্প্রতিক এক নতুন বিশ্লেষণে এই তথ্য উঠে এসেছে।
গত বছর ৫ অক্টোবর কানাডিয়ান ব্যাংক সিআইবিসি’র অর্থনীতিবিদ বেঞ্জামিন তাল ও ক্যাথারিন জাজ-এর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, মহামারীর সময় যত লোক চাকরি হারিয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কানাডার ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
তবে উচ্চ আয়ের মানুষেরা মহামারী শুরুর পরও বেশ ভালো করছেন। আসলে তারা এত ভালো করছেন যে, অনেক চাকরিতে সঙ্কট শুরুর আগের চেয়ে প্রতি ঘণ্টায় ৪০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিঘণ্টায় ১৬ ডলার বা তার চেয়ে কম অর্থ দেয়া হতো এমন চাকরির প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটি বন্ধ হয়ে গেছে।
গতবছর মে মাসে সম্পাদিত এফপি কানাডার এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, অর্থনৈতিক সঙ্কটের চাপে ৪৯ শতাংশ কানাডীয় রাতে ঘুমাতে পারছেন না। অপেক্ষাকৃত তরুণ কানাডীয় এবং নারীদের মধ্যে এরকম উদ্বেগের হার আরও খানিকটা বেশি। তবে এই পরিসংখ্যান এর আগে ২০১৮ সালের সমীক্ষা (৩৮ শতাংশ) এবং ২০১৪ সালের একই ধরণের সমীক্ষায় পাওয়া পরিসংখ্যানের (৫৩ শতাংশ) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই সংবাদ প্রকাশ করে নাউটরন্টো.কম ।
কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব ছাড়াও কমবেশি প্রায় সম সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন ধরণের বিল পরিশোধ ও চাকরির অনিশ্চয়তাজনিত দুশ্চিন্তার কারণে ঘুমাতে পারছেন না। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে গত বছর মে মাসে কানাডায় বেকারত্বের হার সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে।
আর এমনি এক পরিস্থিতিতে অন্টরিওতে স্বল্প আয়ের কর্মজীবী মানুষের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে ঘন্টায় মাত্র ১০ সেন্ট। অর্থাৎ সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজ করলে ৪ ডলার বেশী বেতন পাবেন একজন শ্রমজীবী ব্যক্তি। আর মাসে পাবেন ১৬ ডলার।
আর আগামী বছর কানাডার পরিবারগুলোকে খাবারের পেছনে গড়ে ৬৯৫ ডলার পর্যন্ত বাড়তি ব্যয় করতে হবে। মহামারী, দাবানল এবং ভোক্তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে গ্রোসারী পণ্যের দাম এযাবৎকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে খাদ্যমূল্য বিষয়ক এক রিপোর্টে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। দি কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবরে এ কথা বলা হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২১ সালের কানাডার ফুড প্রাইস রিপোর্ট অনুযায়ী, খাবারের দাম সার্বিকভাবে তিন থেকে পাঁচ শতাংশ বাড়তে পারে এবং এক্ষেত্রে রুটি, মাংস ও সব্জির দাম শীর্ষে থাকতে পারে। ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির খাদ্য বিতরণ ও নীতি বিষয়ের প্রফেসর এবং রিপোর্টের প্রধান লেখক সিলভেন শার্লিবোয়া বলেন, ‘আমরা গ্রোসারীগুলোতে খুব শিগগিরই কোনওরকম পরিবর্তন আশা করছি না। এটি হলো আমাদের এযাবৎকালে ধারণা করা সর্বোচ্চ দরবৃদ্ধি।’
সমীক্ষায় গবেষকরা বলেন, আগামী বছরেও খাদ্যমূল্যের ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে মাংস শিল্পে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে সম্ভাব্য শ্রমিকের অভাব, সরঞ্জাম সরবরাহে বিঘ্ন, খাদ্য উৎপাদন প্লান্ট ও খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে মন্থর গতি এবং ভোক্তাদের চাহিদা পাল্টে যাবার কারণে। মাংসের দাম সার্বিকভাবে সাড়ে ছয় শতাংশ বেড়ে যাবার আশঙ্কা থাকলেও সর্বোচ্চ মূল্য বৃদ্ধি ঘটতে পারে পোল্ট্রি খাতে। কারণ এটি কানাডায় সরবরাহভিত্তিক শিল্প।
শার্লেবোয়া বলেন, গত জুলাই থেকে পোল্ট্রিপণ্যের দাম সাত শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। উৎপাদন খরচ যেহেতু বাড়ছে সেহেতু খুচরা বাজারেও দাম বাড়বে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা পোল্ট্রিপণ্যের দাম একটি মুখ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে। যদি চাষীদেরকে সরঞ্জাম এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কিত পরিচ্ছন্নতার পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় তাহলে তার পরিণামে ভোক্তাদেরকেও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।’
কিন্তু এই বেশী অর্থ ব্যয় কি স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা করতে পারবেন মাসে ১৬ ডলার বেশী বেতন পেয়ে? প্রশ্নই উঠেনা। গ্রোসারীর পেছনে ব্যয় ছাড়াও অন্টারিওতে একটি শ্রমজীবী পরিবারের আয়ের বেশীর ভাগই চলে যায় বাসা ভাড়ার পেছনে। টরন্টো আঞ্চলিক রিয়েল এস্টেট বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, মহামারীর আগে এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের গড় ভাড়া ছিল ২,১৮৭ ডলার। দুই বেড়রুমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া ছিল ২,৮১২ ডলার।
টরন্টো ভিত্তিক লেবার এডভোকেসী সংস্থা ‘ওয়ার্কার্স এ্যাকশন সেন্টার’ এর নির্বাহী পরিচালক ডিনা লেড সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘১০ সেন্ট মজুরি বৃদ্ধি প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি নয়। এটি মূলত মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলার জন্য একটি চেষ্টা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের একটি ন্যূনতম মজুরি রয়েছে যা মূলত মানুষকে দারিদ্রের পর্যায়ে রাখে। অন্যদিকে আবাসনের উচ্চ ব্যয় এবং মহামারীর প্রভাবের অর্থ হলো স্বল্প আয়ের মানুষদেরকে জীবন ধারণের জন্য একাধিক চাকরী করতে হচ্ছে। আর ঐ চাকরীগুলোও ন্যূনতম বেতনের। তাছাড়া আবাসনের পিছনেই যখন আয়ের সিংহভাগ চলে যায় তখন জীবনযাপনের অন্যান্য ব্যয় মিটাতে হিমশিম খেতে হয় প্রতিটি স্বল্প আয়ের মানুষকে।’
এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে টরন্টোতে একজন নিন্ম আয়ের শ্রমজীবী মানুষকে এক রুমের বাড়ির জন্য সপ্তাহে ৭৯ ঘণ্টা এবং দুই রুমের বাড়ির জন্য ৯৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়। কানাডার প্রায় সব শহরেই ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তির পক্ষে এক বা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দিতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। অন্টারিও-ভিত্তিক এক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস’ এর নতুন এক রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে। খবর সিবিসি নিউজের।
সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস এর কর্মকর্তা ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘কানাডার মতো একটি ধনী দেশে একা উপার্জন করেন এমন ব্যক্তি সপ্তাহের পুরো সময় কাজ করলেই কেবল পরিবারের জন্য দুই রুমের একটি মোটামুটি ভদ্রোচিত অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিন্তু টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভারের মতো বৃহত্তম মেট্রোপলিটন শহরসহ কানাডার বেশিরভাগ শহরে এমন কোনও এলাকা নেই যেখানে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তির একক উপার্জনে এক বা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা সম্ভব।’
২০১৮ সালের এক হিসাবে দেখা যায় কানাডায় দারিদ্রতার হার ১১%। আর টরন্টোতে চার সদস্যের একটি পরিবারের বাৎসরিক আয় যদি ৪৮ হাজার ডলারের কম হয় তবে ধরে নেয়া হয় সেই পরিবারটি দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা যায়, কানাডায় প্রতিদিন প্রায় এক মিলিয়ন লোককে ফুড ব্যাংকের স্মরনাপন্ন হতে হয় অভাবের তারনায়। ইউনিভারসিটি অব টরন্টোর সোস্যাল ওয়ার্ক ফেকাল্টির অধ্যাপক লিওনার্ড এডওয়ার্ডের মতে কানাডায় প্রতি তিনজন দরিদ্র লোকের মধ্যে একজন হলেন ইমিগ্রেন্ট যারা এখানে মাইনরিটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে বিবেচিতে হয়। অথচ কানাডা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী দেশগুলোর একটি। বহু সংখ্যক সেরা ধনীরও বসবাস রয়েছে এই কানাডায়। প্রথম সারির ১০০ জন ধনী কানাডিয়ানের মোট সম্পত্তির পরিমান ২০০ বিলিয়ন ডলার।
কারো কারো মতে কানাডায় দারিদ্রতাটি একটি বিশেষ গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা টরন্টো, ভ্যাংকুভার ও মন্ট্রিয়লের মতো বড় বড় শহরগুলোত থাকেন তারাই এর শিকার হচ্ছেন বেশী। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এই বড় বড় শহরগুলোতে ইমিগ্রেন্টদের বসবাসই বেশী এবং তারাই দারিদ্রতার শিকার হচ্ছেন সবচেয়ে বেশী।
অন্য আরেক হিসেবে আমরা দেখতে পাই কানাডায় বসবাসরত শতকরা প্রায় ২০ ভাগ বাংলাদেশীর আয় দারিদ্রসীমার নিচে। এদের আয়ের সবটুকুই ব্যয় হয়ে যায় থাকা ও খাওয়ার পিছনে। সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না। সম্প্রতি কানাডা সরকারের এক অভ্যন্তরীন জরীপে এই তথ্য উঠে এসেছে। জরীপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় নতুন ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছেন যারা চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে এসেছেন। স্বল্প আয়ের এই ইমিগ্রেন্টদের কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন সরকারী ভাতা গ্রহণ করতে।
গত এক দশকে টরন্টোতে বাড়ি ভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বেতন বৃদ্ধির হার তার ধারেকাছেও যায়নি। নামকাওয়াস্তে যেটুকু বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে তা নিছকই তামাশা বলে মনে করেন অনেকে।
তাহলে একজন শ্রমজীবী মানুষের বেতন কত হওয়া উচিৎ বর্তমান বাজারে? শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেন, এই বেতন হওয়া উচিৎ অন্তত ১৫ ডলার প্রতি ঘন্টায়। অন্টারিওর প্রায় ৭.৪ মিলিয়ন শ্রমজীবী মানুষ বর্তমানে কাজ করছেন স্বল্প বেতনে। এই স্বল্প বেতনের চাকরীরও আবার কোন নিশ্চয়তা নেই, সকালে আছে তো বিকেলের ভরসা নেই। সকলের আবার ফুলটাইম কাজও নেই। অনেকেই পার্টটাইম কাজ করেন। অন্টারিওতে নূন্যতম মজুুরীতে শ্রম বিক্রি করেন এমন লোকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গত কয়েক দশকে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ১৯৯৭ সালে অন্টারিওতে প্রতি ৪০ জনের মধ্যে একজন ন্যূনতম মজুরীতে কাজ করতেন। এখন প্রতি ৮ জনের মধ্যে একজন ন্যূনতম মজুরীতে কাজ করেন। এই পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপের দিকেই যাচ্ছে। আর এই ন্যূনতম মজুরীতে ফুলটাইম কাজ পাওয়াও দিনে দিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্রতাও কমছে না এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেরও কোন উন্নতী ঘটছে না। এতে করে সরকারের চিকিৎসা ব্যয়ভার যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যান্য সামাজিক ব্যয়ভারও। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে শ্রম ঘন্টা। কারণ অভাবজনিত অসুস্থতার জন্য অনেকেই ঠিকমত কাজে যেতে পারেন না। এতে করে মোট জাতীয় উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সমাজেরও অগ্রগতি।
আসলে স্বল্প আয়ের মানুষের বিপদ সব দেশেই। এমনকি কানাডার মত একটি ধনী দেশেও। অথচ এই দেশটি জনগণের ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসাবে পরিচিত। তারপরও সরকারী হিসাবেই দেখা যায় কানাডায় প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন দারিদ্র সীমার নীচে বাস করেন। অর্থাৎ প্রায় ১১% কানাডিয়ান গরীব। সংখ্যার হিসাবে প্রায় চার লক্ষ কানাডিয়ান গরীব যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আর এরাই চাকরী করেন ন্যূনতম বেতনে। ড্যাগ ফোর্ডের সরকার অন্টারিওতে এদের জন্য বেতন বাড়িয়েছেন ঘন্টায় ১০ সেন্ট। এরা ফুল টাইম কাজ করার পর মাস শেষে হাতে পাবেন অতিরিক্ত ১৬ ডলার যা দিয়ে প্রতিদিন এক কাপ স্মল সাইজ কফিও ক্রয় করা যাবে না। এই বৃদ্ধি তামাশা ছাড়া আর কি হতে পারে?
শুরুতেই উল্লেখ করেছি, অন্টারিওর প্রধান বিরোধী দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান এন্ড্রিয়া হোরওয়াথ- ১০ সেন্টের এই মজুরি বৃদ্ধির ঘটনাকে শ্রমজীবী মানুষের জন্য অপমানজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এই অপমান নিয়েই অন্টারিওর স্বল্প আয়ের কর্মজীবী মানুষদেরকে বেঁচে থাকার তীব্র সংগ্রাম করে যেতে হবে।
এই পরিস্থিতি যে কেবল অন্টারিওতেই বিদ্যমান তা নয়। অন্যান্য প্রভিন্সেও কম-বেশী একই অবস্থা বিরাজমান। অথচ আমরা জানি কানাডায় সবচেয়ে ধনীব্যক্তিদের হাতেই ক্রমবর্ধমানহারে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এখানকার ‘সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভ’ নামের বাম ঘরানার একটি সংগঠনের রিপোর্টে দেখা যায়, সবচেয়ে ধনী ৮৬জন ব্যক্তি বা পরিবার অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ০.০০২ শতাংশ লোক ক্রমশ আরও ধনী হয়ে উঠছে এবং এই মুহূর্তে তাঁদের হাতে দেশের দরিদ্রতম এক কোটি ১৪ লাখ লোকের সমপরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে। রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এই পরিসংখ্যান ১৯৯৯ সালের চেয়ে বেশি। ওই বছর সবচেয়ে ধনী ৮৬ ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ছিলো সবচেয়ে গরীব এক কোটি ১ লাখ মানুষের সম্পদের সমান। তাঁদের ওই সম্পদ দিয়ে কানাডার ‘নিউ বার্নসউইক’ প্রভিন্সের সবকিছু কিনে ফেলার পরও অরো ৪ হাজার কোটি ডলার হাতে থেকে যাবে!
এই হলো কানাডা। ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হওয়ার পরও দেশটিতে বহু লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছেন এবং অন্যদিকে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন মুষ্ঠিমেয় লোক। সম্পদের এই অসম বন্টন দেশটিতে এক অসম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
অক্টোবর ২৫, ২০২১
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ