বর্ণবাদীদের মূর্তি অপসারণ
আদিবাসীরাকানাডায় ‘ন্যায়বিচার’ চায়
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সম্প্রতি কানাডা সরকারের কর্মকর্তারা যখন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একটি প্রাক্তন রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের জায়গায় অবস্থিত অচিহ্নিত কবরস্থানে ২১৫টি শিশুর মরদেহ পাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছিলেন, সে সময় তারা যে ভবনে বসেছিলেন সেটি আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল ব্যবস্থা চালুর জন্য দায়ী অন্যতম ব্যক্তির নামে নামাঙ্কিত। সেই ব্যক্তিটির নাম হলো, স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড – তিনি কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
সম্প্রতি শিশুদের গণকবর আবিষ্কারের ঘটনায় বেদনা ও আতঙ্ক দাবানলের মত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি এক পুরনো বিতর্কও নতুন করে সূচনা করে: সেটি হলো, যেখানে এই শিশুগুলি মারা গেছে সেই স্কুল ব্যবস্থার প্রবর্তক বিশেষ ব্যক্তিটির স্মারক মূর্তিগুলো নিয়ে কানাডা কী করবে?
ম্যানিটোবা কিওয়াটিনোবি ওকিমাকানাক (Manitoba Keewatinowi Okimakanak) এর সাবেক গ্রান্ড চিফ শেইলা নর্থ বলেন, ‘ওই ঘোষণা ও এতে যে বার্তার ধরণ আর সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভবনের নাম এই সবকিছুর মধ্যে যে পরিহাস লুকিয়ে আছে তা বিপুল সংখ্যক মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। এসব বিষয় বর্ণবাদ এবং আদিবাসী মানুষের প্রতি ঘৃণার মনোভাবকে চিরস্থায়ী করে তুলছে যা আমরা বুঝতেই পারছি না।’
এধরণের হৈ চৈ এবং হিসাব চুকিয়ে দেয়ার ঘটনা কানাডায় এটাই প্রথম নয়।
গত গ্রীষ্মকালে মন্ট্রিলে বিক্ষোভকারীরা গায়ের জোরে ম্যাকডোনাল্ডের একটি মূর্তি উপড়ে ফেলে এবং মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড প্রদেশের শার্লটিটাউনে ম্যাকডোনাল্ডের একটি মূর্তি শেষ পর্যন্ত সরিয়ে নেয়ার আগে সেটির গায়ে গত সারা বছরজুড়ে নিয়মিতভাবে লাল রঙ দিয়ে রাঙানো হয়েছে।
অথচ, কালো অতীতের ধারাবাহিকতা আছে এমন অন্যান্য অঞ্চল যেমন, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কনফেডারেট দক্ষিণাঞ্চলে এ ধরণের প্রতীকগুলো প্রতিদিনই বহাল রয়েছে এবং এগুলো নিয়ে কী করা হবে সেই সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নিগান সিনক্লেয়ার বলেন, ‘আমরা তরুণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিচ্ছি কাদেরকে আমরা ধরে রাখবো।’ নিগান সিনক্লেয়ারের বাবা মারে সিনক্লেয়ার হলেন ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের চেয়ারম্যান।
নিগান সিনক্লেয়ার বলেন, ‘আপনি কখনই একবারের জন্যও কোনওদিন আশা করতে পারেন না যে, যে লোকটি নিগৃহীত হয়েছে সে কখনও তার ওপর নিপীড়নকারীর নামে নামকরণ করা কোনও ভবনে, যেখানে ওই ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে তার মূর্তি বা অন্য কোনও প্রতীক রাখা আছে সেখানে যেতে পারে। এটা রীতিমত অপমানকর এবং মানসিক আঘাতস্বরূপ।’
জার্মানিতে হলোকাস্টের পর নাৎসি বাহিনীর স্মরণে কোনও মূর্তি স্থাপন করা হয়নি। তার পরিবর্তে জার্মানি ওই বাহিনীর সমস্ত অপরাধ স্মরণ করিয়ে দেয় এমন সব জিনিসে পূর্ণ। এমনকি যে মাঠে হিটলার তার সমর্থকদের নিয়ে ইহুদিবিরোধী উন্মত্ততা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই মাঠটিও পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে। তাতে বলা হয়েছে, ‘এখানে ঢুকলে ঝুঁকি আপনার নিজের।’ একটি নিবন্ধে এই তথ্য পাওয়া যায়।
সিনক্লেয়ার বলেন, ‘সেখানে নাৎসি জার্মানির নীতি উদযাপনের মত কোনও মূর্তি বা ভবন নেই। কিন্তু তার পরও অনেকটা বিসদৃশভাবে নাৎসি জার্মানির কথা এখনও তারা ভাবে এবং এখনও তা স্মরণ করা হয়। এ নিয়ে এখনও আলোচনা হয়।’
“কানাডার নেতারা যখন বলেন, ‘আচ্ছা, ‘আমরা’ ইতিহাস নাকচ করে দিচ্ছি বা ‘আমরা’ ইতিহাস মুছে ফেলছি, তখন সেটা খুবই হাস্যকর এবং পুরোপুরিই ফাঁকা বুলিমাত্র। ইতিহাস এভাবে কাজ করে না।”
বরং এসব মূর্তি নিপীড়িত আদিবাসী পরিবারগুলোর জন্য এক বেদনাময় স্মারক হয়ে আছে।
ম্যানিটোবা কিওয়াটিনোবি ওকিমাকানাক (Manitoba Keewatinowi Okimakanak) এর সাবেক গ্রান্ড চিফ শেইলা নর্থের মতে, গণহত্যার জন্য দায়ী কাউকে মহিমান্বিত করার লক্ষ্যে স্থাপিত মূর্তির পাশ দিয়ে যাবার সময় অথবা বিপুল সংখ্যক আদিবাসীর মৃত্যুর জন্য দায়ী কোনও ব্যক্তির নামে নামকরণ করা সড়কে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় অনেকেরই মনে এমনই অনুভূতি জেগে ওঠে যেমনটা ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সিনক্লেয়ার বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘মানুষ কেন এত ক্রুদ্ধ তা বোধের অগম্য নয়, মানুষকে আঘাত করা হয়েছে, তারা হতাশ।’
অন্যদিকে মূর্তিগুলো বহাল রাখা এবং স্কুলগুলোর নাম ধরে রাখার প্রবক্তারা বলেন, এটা হলো ইতিহাসের সংরক্ষণ আর সেগুলো সরিয়ে ফেলা হবে ইতিহাস মুছে ফেলার শামিল।
আলবার্টার মুখ্যমন্ত্রী জনসন কেনি হলেন এমনই একজন।
তিনি বলেন, ‘রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ব্যবস্থার মাধ্যমে ইন্ডিয়ানদের প্রতি যে বিরাট নৈতিক পাপ করা হয়েছে আমরা সবাই এক হয়ে তার নিন্দা জানাতে পারি।’ সম্প্রতি এক প্রশ্নোত্তর পর্বে কেনি এই মন্তব্য করেন।
কেনি আরও বলেন, ‘একই সঙ্গে আমি মনে করি না যে, ওই পাপের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কানাডীয় ইতিহাসের অনেক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বকে বাদ দেয়ার
কোনও প্রয়োজন আছে।’
কিন্তু সিনক্লেয়ারের মতে, কেনির এই অবস্থানের মধ্যে ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে কীভাবে কাজ করে তার কোনও প্রতিফলন নেই।
তিনি বলেন, ‘ইতিহাস শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে মূর্তির কোনও ভূমিকা নেই। ইতিহাস এভাবে কাজ করে না।’
ম্যাকডোনাল্ড প্যাসিফিক রেলপথ নির্মাণ সম্পন্ন করার কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন যেটি দেশকে এক উপকূলের সঙ্গে অন্য উপকূলকে যুক্ত করেছে। তিনি ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এবং ম্যানিটোবাসহ কয়েকটি প্রদেশকে কানাডার সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ব্যাপকভাবে তাকে স্মরণ করা হয়।
আদিবাসীদের উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তার কিছু বর্ণবাদী অশালীন শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা ছিলো, আর তিনিই ছিলেন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ব্যবস্থার অন্যতম স্থপতিÑ এই স্কুল ব্যবস্থাকে অনেক বিশেষজ্ঞ একটি সাংস্কৃতিক গণহত্যার সূচনাকারী কর্মসূচি হিসাবে উল্লেখ করেন।
মূর্তি অপসারণের দাবি জোরালো হচ্ছে
এই পরিবর্তনের দাবি যতই ভিত্তি পাচ্ছে ততই এসব মূর্তি এবং সড়ক ও ভবনের নাম নিয়ে তারা কী পরিকল্পনা করছে সে বিষয়ে সরকারের ওপর চাপও বাড়ছে।
আদিবাসী পরিষেবা বিষয়ক মন্ত্রী মার্ক মিলার সম্প্রতি বলেন, ‘কোনও কিছু গুড়িয়ে দেয়া, ভেঙ্গে ফেলা আমার কাছে অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। কোনও বিষয় থেকে নজর ফিরিয়ে নেয়াও আমার পছন্দসই বিকল্প নয়। বিষয়টি যতই বেদনাদায়ক হোক, সেটি কেন হচ্ছে তার ব্যাখ্যা করাই আমার পছন্দের বিকল্প।’
তবে, মিলার বলেন, ‘আদিবাসীদের বক্তব্য শোনা হচ্ছে এবং তাদের প্রসঙ্গ বিতর্কের আলোচ্যসূচিতে প্রাধান্য পাচ্ছে’, এটি গুরুত্বপূর্ণ। আর সরকার ওইসব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
অনেকে বলছেন, মূর্তিগুলো কোনও জাদুঘরে রাখা হোক। অন্যরা বলছেন, সেগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকুক, তবে সেখানে একটি ফলকে ওই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের বিবরণ যুক্ত করা হোক। কেউ কেউ চান মূর্তিগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হোক- আবার কারো দাবি, সেগুলোতে কেউ যেন হাত না লাগায়।
সিনক্লেয়ারের কাছে এই বিকল্পগুলো যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, “যে লোকটি অনিষ্টকর অপরাধ করেছে তার ছবির পাশে একটি ফলকে ‘এই লোকটি ক্ষতি করেছিলো’ লিখে দেয়া যথেষ্ট নয়। এতেও মূর্তি সংরক্ষণের মাধ্যমে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে।”
শেইলা নর্থের পরামর্শ হলো, মূর্তিগুলো কোনও গুরুত্বপূর্ণ জায়গার পরিবর্তে এমন কোনও জায়গায় রাখা হোক যেখানে এর থেকে মানুষ কিছু শিখতে পারবে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এগুলো কোনও জায়গার সংরক্ষণ করা দরকার, এমন কোথাও রাখা দরকার যেখানে আমরা সবাই তাদের কর্মকাণ্ড স্মরণ করতে এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। কারণ শেষ যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তা ছিলো (একটি জাতিকে) পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা।’
‘আর আমরা যদি এই লোকগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করি, এবং তারা যেসব অপকর্ম করেছে সেগুলি এবং তারা যেধরণের চিন্তাভাবনা পোষণ করতো সেগুলি যদি আমরা অস্বীকার করি, তাহলে আমাদের জন্য তার অর্থ হবে তাদের নৃশংস কর্মকাণ্ডগুলো ভুলে যাওয়া।’
নর্থ আরও বলেন, তবে সড়ক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের মত জিনিসগুলো পাল্টে ফেলা উচিৎ।
তিনি বলেন, ‘ক্রীড়া সংগঠনগুলি যদি এটা করে থাকতে পারে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরগুলোও সেটা অবশ্যই করতে পারবে।’
বর্ণবাদী স্মৃতিসৌধগুলির বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে বিভিন্ন কমিউনিটি
কী করা হবে সেই প্রশ্নে সব পর্যায়ের সরকারই যখন দোলাচলে তখন কিছু নাগরিক এই আহবানকে নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছেন।
রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক নাম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটিও রেসিডেন্সিয়ার স্কুল ব্যবস্থার প্রবর্তকদের একজনের নামে। ব্যক্তিগতভাবে এবং অনলাইনে অনেক শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এক্স-ইউনিভার্সিটি নামে উল্লেখ করতে শুরু করছে।
এমন উদাহরণ রয়েছে যে, কমিউনিটির পক্ষ থেকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারগুলো ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিস্টলে গত বছর এক দাস ব্যবসায়ীর স্মারক মূর্তি বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভকারীরা উপড়ে ফেলে। মূর্তিটি তারা একটি পোতাশ্রয়ের পাশে পানিতে ফেলে দেয়। পরে কর্তৃপক্ষের লোকজন সেটি খুঁজে তুলে এনে প্রকাশ্য স্থানে স্থাপনের পরিবর্তে একটি জাদুঘরে রেখে দেয়।
সিনক্লেয়ারের মতে, কানাডায় মূর্তি নিয়ে বিতর্কের দিন ফুরিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘এটি কোনও যদির প্রশ্ন নয়, বরং এটি হলো কখন ন্যায়বিচার আসবে সেই প্রশ্ন। তবে যখন ন্যায়বিচার আসন্ন বলে অনুভব করবেন তখন অন্যায়ের মাধ্যমে যারা লাভবান হয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে উঠবে, তারা বেহুদা চিৎকার চেঁচামেচি করবে, কখনই হাল না ছাড়ার অঙ্গীকার করবে।’
‘তবে এটি হলো, পরিবর্তনের একটি লক্ষণ।’
সূত্র : র্যাচেল গিলমোর/ গ্লোবাল নিউজ