মুসলিম নারী ও মেয়েরা কানাডায় ইসলামবিদ্বেষী হামলার অন্তর্জ্বালা বয়ে বেড়ান

“হিজাব পরা কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারীদের ওপর সম্প্রতি ঘৃণা-প্রসূত হামলার যে জোয়ার চলছে তাতে  এই সহিংস বিদ্বেষের চূড়ান্ত পরিণতিতে খুনের ঘটনা অবাক হবার মত কিছু নয়।”

“বড় ধরণের প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংঘাত, যেমন প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ, ৯/১১-এর হামলা অথবা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের মত ঘটনার পর আমরা কানাডায় মুসলমানদের ওপর হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন এবং হামলার ঘটনা বেড়ে যেতে দেখেছি।

অতি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, মুসলমানদের ওপর যত বিদ্বেষ-প্রসূত হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেমন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের ঘটনা, কুইবেকের ইসলামিক সেন্টারে হত্যাকাণ্ড, ইটোবিকোক-এ আইএমও মসজিদের বাইরে হত্যা এবং অন্টারিওর লন্ডনে হত্যাকাণ্ড, তার প্রতিটির পরেই কানাডার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত আক্রমণের জোয়ার বয়ে গেছে, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ এবং/অথবা অন্য অশ্বেতাঙ্গ মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে শারীরিকভাবে আক্রমণ ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, অন্য যে কোনও ধর্মবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের চেয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি কানাডীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি অপেক্ষাকৃত কম অনুকূল।

এঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউটের ২০১৭ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪৬ শতাংশ কানাডীয় ইসলামের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, যা অন্য যে কোনও ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বিরূপতার চেয়ে বেশি। মুসলিম পুরুষ মানেই সহিংস সন্ত্রাসী, মুসলিম নারী বলতেই নিপীড়িত, অসংগঠিত ও নির্বাক এবং খোদ ইসলামই একটি সহিংস ধর্ম, এমন সব বাঁধাধরা দৃষ্টিভঙ্গি কানাডীয়দের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এমনই পরিবেশে ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কানাডায় ১১ জন মুসলিম হত্যার শিকার হয়েছেন।

অন্য যে কোনও ধর্মবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের চেয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি কানাডীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি অপেক্ষাকৃত কম অনুকূল। ফাইল ছবিতে দেখা যাচ্ছে কুইবেকে বিল-২১ এর বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভ করছেন মুসলিম জনতা। ঐ আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কর্মস্থলে ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধ করা হয়। ছবি: লাপ্রেস.সিএ

২০২১ সালের ৬ জুন অন্টারিওর লন্ডনে তালাত আফজাল, তার ছেলে সালমান, ছেলের বউ মাদিহা, তার নাতনি যমুনা ও নাতি ফায়েজ শেষ বসন্তের বিকেলে মহল্লার মধ্যেই হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। তখনই এক বিপর্যয়ে এই সুন্দর পরিবারটির চার সদস্যের জীবন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে যায় নয় বছরের ফায়েজ। সে এখন এতিম। এই গণহত্যা এবং এই জঘন্য হামলা চালিয়েছে একজন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী যার অন্তর ছিলো মুসলিমদের প্রতি ঘৃণায় পরিপূর্ণ।

লন্ডনের ওই ইসলামবিদ্বেষী হামলায় নিহত চার ব্যক্তির মধ্যে তিনজনই ছিলো নারী। ক্যালগেরি ও এডমন্টনে এবং অতি সম্প্রতি হ্যামিল্টনে হিজাব পরা কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারীদের ওপর ঘৃণাপ্রসূত হামলার ব্যাপক জোয়ার,

সেইসঙ্গে দৃশ্যত মুসলিম (মানে হলো, সাংস্কৃতিকভাবে “মুসলিম” বলে চেনা যায় এমন পোশাক, যেমন হিজাব পরা) নারীদের হয়রানি ও গালাগালি করার যে প্রবণতা চলমান রয়েছে তার প্রেক্ষিতে সহিংস ঘৃণার চূড়ান্ত ফল হিসাবে হত্যার ঘটনা কোনও অবাক হবার মত বিষয় নয়। তালাত, মাদিহা ও যমুনা কেমন পোশাক পরা ছিলো আমরা জানি না, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে তারা ওই দুর্বৃত্তের নজরের মধ্যেই ছিলো। আমরা কিছু পরিবার সম্পর্কে জানি যারা ওই ঘটনার অকূস্থল থেকে কয়েক কদম দূরে বসবাস করে। 

আমাদের সদস্যরা জানিয়েছেন যে, ওইসব পরিবারের লোকেরা এখন বাড়ি থেকে বেরুতে ভয় পায়। যখন তারা মুদি দোকানে বা ব্যাংকে যায় তখন বারবার ঘাড়ের পেছনে তাকিয়ে দেখে নেয়, কোনও কালো পিকআপ ট্রাক তাদের অনুসরণ করছে কিনা। কানাডার সব মুসলিম নারী ও মেয়ের মধ্যে বিদ্যমান এই ভীতি অনুভব করা সম্ভব। কারণ পোশাক দেখে তাদেরকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।

কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর মুসলিম উইমেন-এর (CCMW) বর্ণবাদবিরোধী ডিজিটাল শিক্ষা (DARE) প্রকল্পের অংশ হিসাবে সম্প্রতি আমরা কানাডার মুসলিম, ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম যাতে তারা ইসলামবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। তারা আমাদের যেসব বিষয় জানিয়েছেন এখানে তার কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো: ‘বাসে ওঠার সময় আমাকে আঘাত করা হয়, অজ্ঞাত এক ব্যক্তি আমার হিজাব টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করে;’ “ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হবার পরের দিন শ্বেতাঙ্গ মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি একটি নীল রঙের পিকআপ ট্রাক চালিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি নির্ধারিত লেন ছেড়ে আমার গাড়ির পাশে চলে আসেন এবং আমার জানালার কাচ নামানোর ইঙ্গিত করেন। আমি জানালার কাচ নামালে লোকটি চিৎকার করে ওঠেন, ‘নিজের দেশে ফিরে যাও, কুত…!”; ‘ইকুইটি ও ডাইভারসিটি অফিসে (সমতা ও বৈচিত্র বিষয়ক দপ্তর) অভিযোগ করার পর আমার নিজের সহকর্মীদের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক মন্তব্য শুনেছি, আমাকে সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে চাকরিচ্যুত করা হয়;’ ‘হিজাব পরার কারণে আমাকে স্কাই ট্রেনে  যৌন, শারীরিক ও মৌখিকভাবে আঘাত করা হয়।’

আমরা প্রতিবন্ধী, কৃষ্ণাঙ্গ, বিসদৃশ লিঙ্গ (queer), শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ মুসলিম নারীদের নিয়ে ইসলামভীতির ওপর তরুণ প্রজন্মের জন্য গোলটেবিলেরও আয়োজন করি। সরকারের এবং আমাদের প্রতি তাদের বার্তাটি স্পষ্ট; তারা ক্ষমতাসীনদের কাছে সত্য তুলে ধরছে:

‘[যে বিষয়টি] সত্যিই আমাকে বিব্রত করছে, বিশেষ করে ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কিত এসব আলোচনায়, সেটা হলো, এসব ঘটনা যখন ঘটে তখন এর পরিণতি আমার সম্প্রদায়কেই সামলাতে হয়, আর এ বিষয়ে যে কোনও পদক্ষেপও  আমার সম্প্রদায়কেই নিতে হয়। আমি আমার নয় বছর বয়সী বোনকে আমাদের স্থানীয় ইসলামিক সেন্টারের ইসলামোফোবিয়া বিষয়ক কর্মসূচিতে ভর্তি করেছি। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকরা, যাদের হবার কথা আমাদের রক্ষাকারী, তর্ক করছেন এই নিয়ে যে, কোনও বিশেষ প্রতীক বর্ণবাদী কিনা অথবা বিশেষ কোনও গ্রুপের বর্ণবাদী হওয়া উচিৎ কিনা।’ 

সামাজিক পরিচয় সম্পর্কিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ২০১৩ সালের সাধারণ সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের মধ্যে (যে কোনও ধরণের বৈষম্যসহ লিঙ্গ-ভিত্তিক, জাতি বা সংস্কৃতি, বর্ণ বা গায়ের রঙ, শারীরিক গঠন, ধর্ম, ও ভাষাগত বৈষম্য) শতকরা হিসাবে কানাডার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম মহিলারা সর্বোচ্চ বৈষম্যের শিকার হন।

যৌনতা-ভিত্তিক বৈষম্যের শিকার সবচেয়ে বেশি হন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারীরা (৩২ শতাংশ)। সেই তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ অমুসলিম নারীরা এধরনের বৈষম্যের শিকার হন ২৬ শতাংশ, অকৃষ্ণাঙ্গ অমুসলিম নারীরা ১৫ শতাংশ এবং অকৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারীরা ছয় শতাংশ হারে। বিষয়টি আরেকভাবে বুঝে নেয়া যেতে পারে: কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারীদের প্রতি তিনজনে একজন যৌনতা-ভিত্তিক বৈষম্যের শিকার হন। যেখানে অকৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারীরা এধরণের বৈষম্যের শিকার হন প্রতি ১০ জনে এক জনেরও কম।

কানাডার মুসলিম নারীরা যেসব গুরুতর উদ্বেগের বিষয় তুলে ধরেন তার মধ্যে অন্যতম হলো, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং চাকরি পাবার পর ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য। ২০১১ সালে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মুসলিম নারীদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশই ছিলো বেকার, যা সব কানাডীয় নারীর ক্ষেত্রে বিদ্যমান বেকারত্বের হারের জাতীয় গড়ের (৭.৪%) চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারীদের তুলনায় মুসলিম নারীদের চাকরিজীবন চালিয়ে যেতে হয় অনেক দীনহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে। শুধু ঐতিহ্যগত আধ্যাত্মিক রীতি অনুসরণকারী নারীদের (আদিবাসী) মধ্যে বেকারত্বের হার মুসলিম নারী ও মেয়েদের চেয়ে বেশি। কানাডার মোট নারীদের অনুপাতে মুসলিম নারীরা দ্বিগুণ সংখ্যায় STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি,প্রকৌশল ও গণিত) বিষয়ে শিক্ষা অর্জন এবং আনুপাতিক হারে দ্বিগুণ সংখ্যক মুসলিম নারী কর্মক্ষেত্রে দুটি দাপ্তরিক ভাষা ব্যবহার করা সত্ত্বেও তাদের প্রতি এই বৈষম্যই বাস্তব সত্য।

কুইবেক সরকার নির্দিষ্ট কিছু সরকারি খাতের চাকরিতে মুসলিম নারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

কানাডার মুসলিম নারী ও মেয়েরা শিক্ষার ক্ষেত্রে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ইসলামবিদ্বেষী, যৌন বা বর্ণবাদী হামলার ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করা নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলি আমাদের সদস্যরা আমাদেরকে জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, অভিযোগ উপেক্ষা বা নাকচ করে দেয়া হবে এটা জেনেও তারা ঘটনা সম্পর্কে পুলিশে অভিযোগ করেছেন। একটি ঘটনায়, একটি দোকানে হিজাব পরা একজন নারীকে হেনস্থা করা হয়। ওই নারীর ভাষাগত সমস্যা ছিলো, তবু তিনি অভিযোগ করার জন্য স্থানীয় পুলিশের কাছে যান। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বলেন, দওটা কিছু নয়, এ ধরণের ঘটনার ব্যাপারে আপনি তো অভ্যস্ত। আপনাদের পুরুষেরা কি সব সময়ই নারীদের প্রতি এমন আচরণই করে না?’

আমরা জানি, অন্টারিওর লন্ডনে আফজালের পরিবার বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে হামলার শিকার হন। বর্তমানে দৃশ্যত মুসলিম অনেক নারী আমাদের বলেন, তারা সারাক্ষণই ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন যে, তারাই হতে পারেন পরবর্তী হামলার শিকার। – সূত্র : নাউনিউজ.কম