বিশ্বের অন্যতম শান্তির দেশ কানাডায় ইসলামোফোবিয়া

খুরশিদ আলম

গত পাঁচ বছরে ইসলামোফোবিয়ার শিকার হয়ে কানাডায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে যা শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ! ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম সম্প্রতি এই তথ্য জানায়। অথচ এই দেশটি বিশে^ প্রথম সারির একটি শান্তির দেশ হিসাবে পরিচিত এবং ইমিগ্রেন্টবান্ধব হিসাবেও এই দেশটির রয়েছে সুখ্যাতি।  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  ‘U.S. News & World Report’ এর এক জরিপেও দেখা গেছে ২০১৮ সালে কানাডা ইমিগ্রেন্টদের জন্য সেরা দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। শুধু ইউএস নিউজ এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট নয়, এরকম তথ্য দেখা যায় ওয়াশিংটন ভিত্তিক পিউ রিসার্স সেন্টারের এক সমীক্ষায়ও। ওতে বলা হয় বিশ্বের প্রথম সারির দশটি দেশের মধ্যে ইমিগ্রেন্টদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে কানাডিয়ানদের। নতুন ইমিগ্রেন্টদেরকে তাঁরা বোঝা মনে না করে একটা শক্তি হিসাবে বিবেচনা করেন।

কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তির দেশ হিসাবেও বিবেচিত হয়ে আসছে। ইতিপূর্বের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রথম দশটি শান্তির দেশের তালিকায় কানাডার অবস্থান অষ্টম। গ্লোবাল পিস ইন্ডেক্স কয়েক বছর আগে এই রিপোর্টটি (২০১৬) প্রকাশ করে। তাদের রিপোর্টে আরো দেখা যায় কানাডা ইউরোপের বাইরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে শান্তি ও নিরাপত্তার বিচারে। আর উত্তর আমেরিকায় কানাডার অবস্থান সর্বোচ্চ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুদূর পিছিয়ে আছে কানাডার তুলনায়।

পিউ রিসার্স সেন্টার এর অনুসন্ধান থেকে আরো জানা যায়, অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি বা সন্ত্রাস বৃদ্ধির জন্য ইমিগ্রেন্টদেরকে দায়ী করার প্রবণতা অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় কানাডিয়ান নাগরিকদের মধ্যে অনেক কম। পিউ রিসার্স সেন্টার এই তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৮ দেশের উপর জরিপ চালায়। আর বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ইমিগ্রেন্ট বাস করেন এই ১৮ দেশে। ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ টরন্টো স্টার পত্রিকায় এই সংবাদটি ছাপা হয়।

আর এই ইমিগ্রেন্টদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আদমশুমারীর রিপোর্ট অনুযায়ী কানাডায় মোট জনসংখ্যার ৩.২% হলো মুসলিম। মুসলিম সম্প্রদায় এ দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠি। সংখ্যায় প্রায় ১,০৫৩,৯৪৫ জন। ২০১১ সালের রিপোর্ট এটি।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে শান্তিপ্রিয় ও ইমিগ্রেন্টবান্ধব এই দেশটিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি কেন এই ঘৃণা বা বিদ্বেষ? কেনই বা টার্গেট করে গত পাঁচ বছরে ১১ জন নিরাপরাধ মুসলিম ব্যক্তিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হলো?

গত ৬ জুন অন্টারিওতে এক মুসলিম বিদ্বেষী ঘাতকের গাড়ির আঘাতে নিহত আফজাল পরিবারের সদস্যদের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্য বিভিন্ন ধর্ম বিশ^াসের লোকজন রাস্তায় নেমে আসেন। ছবি : ট্রাভিস ডলিনি/সিবিসি

আমরা দেখেছি গত পাঁচ বছরে কানাডায় মুসলিম হত্যাকান্ডের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী। ঐ দিন ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিবের নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন। মসজিদে মাগরিব নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের উপর হামলা চালানোর পর গাড়িতে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন আলেকজান্ডার। ঘটনাস্থল থেকে কিছু দূর গিয়ে ২৭ বছর বয়সী ঐ যুবক নিজেই ৯১১ এ কল করে পুলিশ ডাকেন এবং গুলিবর্ষণের ব্যাপারে পুলিশকে সহযোগিতার কথা বলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁর গাড়িতে তল্লাসী চালিয়ে দুটি রাইফেল এবং একটি একে-৪৭ রাইফেল উদ্বার করেন।

সেদিন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কানাডিয়ানদেরকে ভীত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশ্য আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা, তাঁরা চায় অনৈক্য সৃষ্টি করতে এবং বিদ্বেষের বীজ রোপন করতে। আমরা তা হতে দিব না। তিনি কানাডায় বসবাসরত ১০ লাখ মুসলমানকে উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কানাডার ৩৬ মিলিয়ন হৃদয় আপনাদের সঙ্গে সহমর্মী। আপনারা জেনে রাখুন আমরা আপনাদেরকে মূল্যায়ন করি। আপনারা কানাডার সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন অপরিমেয় ভাবে। আপনরা এ দেশেরই অংশ। 

মুসলিম হত্যার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে টরন্টোর নিকটবর্তী ইটোবিকোক এর ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম অর্গানাইজেশন অব টরন্টো’র মসজিদের সামনে। গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর ঘটে এই নৃশংস হত্যার ঘটনা। ঐ মসজিদের স্বেচ্ছাসেবক এক মুসল্লিকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সমর্থক Guilherme William Von Neutegem নামের এক যুবক। নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আসলিম জাফিস। ৫৮ বছর বয়স্ক আসলিম জাফিস ঐ দিন সন্ধ্যায় রেক্সডেল এবং কিপলিং এ্যাভিনিউর (৬৫ রেক্সডেল) নিকটবর্তী ঐ মসজিদের সামনে একটি চেয়ারে বসেছিলেন। ভিডিওতে দেখা গেছে খুনী Von Neutegem চেয়ারে বসে থাকা আসলিম জাফিস এর পিছন দিক থেকে এসে সহসা আক্রমণ করেন। আসলিম জাফিস আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেই অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যু হয়। Von Neutegem-কে পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার এর অভিযোগ আনা হয়। কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, Von Neutegem ব্রিটেনের একটি বিদ্বেষী গ্রুপের অনুসারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একটি শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদী গ্রুপেরও অনুসারী সে।

তৃতীয় হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটে অন্টারিও’র লন্ডনে। ঐ হামলায় প্রাণ হারান একই পরিবারের তিন প্রজন্মের চার সদস্য। আর অল্পের জন্য বেঁচে যায় ৯ বছরের এক শিশু। তবে আহত হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।

নিহতদের মধ্যে আছেন তালাত আফজাল (৭৪), তাঁর ছেলে সালমান আফজাল (৪৬), পুত্রবধু মাদিহা সালমান (৪৪) এবং নাতনী ইউমনা আফজাল (১৫)। আহত শিশুটির নাম ফয়েজ আফজাল। রাস্তা পারাপারের সময় অতর্কিতে তাঁদের উপর একটি পিকআপ ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই হামলা ঘটনো হয়।

অন্টারিও প্রভিন্সের লন্ডন শহরে সন্ত্রাসী এই হামলার ঘটনা ঘটে গত ৬ জুন রবিবার সন্ধ্যায়। হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যান নামের ২০ বছর বয়সী এক শে^তাঙ্গ যুবককে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে ৪ জনকে হত্যা ও আরেকজনে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ঘটনার দিন রাত পৌনে নয়টার দিকে পরিবারটি প্রতিদিনকার মত হাটতে রেরিয়েছিলেন। স্থানীয় হাইড পার্ক রাস্তা ধরে হাটার এক পর্যায়ে তাঁরা যখন রাস্তা পারাপারের জন্য গ্রীন লাইটের অপেক্ষা করছিলেন তখনই ঘটে হামলার ঘটনাটি। পুলিশ জানায় ইসলামবিদ্বেষ থেকেই পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়।

লন্ডনের মেয়র এড হোল্ডার নিহতদের পরিবার ও নগরীর মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, এটি একটি গণহত্যার কাজ যা ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং লন্ডনবাসীর বিরুদ্ধে। অবর্ণনীয় বিদ্বেষ এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে আমাদেরকে অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে মমত্ববোধ, সহানুভূতি, ন্যায়বিচার এবং সর্বোপরি ভালবাসা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

হামলার দুদিন পর কানাডার পার্লামেন্টে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, এটি সন্ত্রাসী হামলা। কোন সড়ক দুর্ঘটনা নয়। ইসলামবিদ্বেষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। কানাডার শে^তাঙ্গ বর্ণবাদী গোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।

কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিতে কি কানাডা প্রবাসী মুসলিমদের মধ্যে কোন স্বস্তি নেমে এসেছে? কিংবা তাঁরা কি প্রধানমন্ত্রীর আশ^াসের উপর কোন ভারসা রাখতে পারছেন? নাকি আশংকা করছেন কানাডায় আবারো ঘটতে পারে হত্যাকান্ডের ঘটনা?

কানাডার পরিবহন মন্ত্রী ওমর আলঘাবরা বহু বছর থেকে বলে আসছেন, ইসলামভীতি পরিমিত থেকে দিনদিন অপরিমিত হয়ে উঠেছে সরকারসমূহ, বিভিন্ন ইন্সটিটিউট ও গণমাধ্যমের হাত ধরেই। মন্ত্রী ওমর নিজেও একজন মুসলিম।

উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে কানাডার এক এমপি ইকরা খালিদকে হত্যার হুমকী দেয়া হয়েছিল। ইকরা লিবারেল পার্টির এমপি। তিনি একজন মুসলিম। সিবিসি নিউজ জানায়, এমপি ইকরা খালিদ কানাডার পার্লামেন্টে এন্টি-ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাব পেশ করার পর বিদ্বেষী মেইলের প্লাবন দেখা দিয়েছে তাঁর ই-মেইলে। এর মধ্যে হত্যার হুমকীও আছে। খালিদ পার্লামেন্টে জানান, পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী ইমেইল পেয়েছেন তিনি। তবে সবই বিদ্বেষী ইমেইল নয়। অধিকাংশ ইমেইলই তাঁর সমর্থনে।

ইকরা খালিদ আরো জানান, ইউটিউবেও তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলা হয়েছে সে একজন জঙ্গী সমর্থক এবং নিদারুণ বিরক্তিকর ব্যক্তি। ঐ ভিডিওতে আরো বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাকে গুলি করার জন্য তাঁদেরকে সহায়তা করবো না। তবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো মাটিতে পড়ে তুমি যখন কান্না করবে তার ভিডিও করার জন্য। হ্যা, আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো আমার স্টোরী লেখার জন্য মুখভরা হাসি নিয়ে। হা হা হা। একজন এমপি গুলি খেয়েছেন কানাডিয়ান একজন দেশপ্রেমীর হাতে।’

এমপি খালিদ আরো কয়েকটি ম্যাসেজ পড়ে শুনান পার্লামেন্টে যেগুলো নিম্মরূপ :

Ñ তাকে হত্যা কর। আমি একমত যে সে এদেশে এসেছে আমাদেরকে হত্যা করার জন্য। সে রোগগ্রস্থ, তাকে এই দেশ থেকে বহিস্কার করা প্রয়োজন।

Ñ আমরা তোমাদের মসজিদগুলো পুড়িয়ে দিব।

Ñ কানাডিয়ানরা কেন তাকে এ দেশে আসতে দিয়েছে? তাকে তার দেশে ফেরত পাঠিয়ে দাও।

Ñ তুমি কেন কানাডা থেকে বিদায় হও না। তুমি একটা জঘণ্য আবর্জনার বস্তু। সিংহভাগ সত্যিকার কানাডিয়ানরা চান না তুমি এ দেশে থাক।

পুলিশ কর্তৃপক্ষ অবশ্য তখন জানিয়েছিল যে তাঁরা এমপির অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মিসিসাগায় তাঁর অফিস ও কন্সটিটিউন্সি এলাকায় টহল বৃদ্ধি করেছেন এবং হুমকীর বিষয়টিও তদন্ত করে দেখছেন।

এমপি খালিদের উত্থাপিত মোশনটি ছিল সবরকমের বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় বৈষম্য দূরীকরণ এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান। পরে এই প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে পাস হয় নন-বাইন্ডিং মোসন হিসাবে। এর পক্ষে ভোট পড়েছিল ২০১টি আর বিপক্ষে ভোট পড়েছিল ৯১টি। সিংহভাগ কনজার্ভেটভ এমপি বিপক্ষে ভোট দেন। তবে এ বিষয়ে কোন আইন তৈরী হয়নি।

পাশাপাশি একই ধরণের একটি প্রস্তাব অন্টারিও পার্লামেন্টেও পাশ হয় সর্বসম্মতিক্রমে। ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী এই প্রস্তাবটি পাশ হয় ৮১-০ ভোটে। অর্থাৎ বিপক্ষে একটিও ভোট পড়েনি।

দি কানাডিয়ান প্রেস জানায়, অন্টারিও লিবারেল পার্টির তৎকালীন ব্যাকবেঞ্চার এমপিপি নেটালী ডেস রোজিয়ার্স এই এন্টি-ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাব উত্থাপিত করেছিলেন ইতিপূর্বে। তিনি পার্লামেন্টের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান সব ধরণের ঘৃণা, শত্রুতা, কুসংস্কার, বর্ণবাদ এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার জন্য। তিনি ক্রমবর্ধমান এন্টি মুসলিম বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি ও মনমানসিকতার বিরুদ্ধেও তীব্র নিন্দা জানানোর আহ্বান জানান এবং ধিক্কার জানানোর আহ্বান জানান সবধরণের ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে।

উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে এমপিপি নেটালী ডেস রোজিয়ার্স এর রাইডিং এলাকায় এন্টি-মুসলিম গ্র্যাফিটি (দেয়াল চিত্র) অংকনের ঘটনা ঘটে এবং জনৈক হিজাবধারী মুসলিম মহিলার মুখের উপর থুথু ফেলার ঘটনাও ঘটে। নিজ এলাকয় ঐ সব ধর্মীয় বিদ্বেষী ঘটনা দেখে রোজিয়ার্স এই এন্টি-ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন।

কানাডায় ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধি পেলেও একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের আগে কোন জাতীয় নেতার মুখে এ বিষয়ে কোন জোরালো বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। লন্ডন অন্টারিওতে এক মুসলিম পরিবারের চার জনকে হত্যার পর কানাডার জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেখানে গিয়েছিলেন সমবেদনা জানাতে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও গিয়েছিলেন সেখানে। সিটিভি নিউজের এক খবরে বলা হয় প্রধানমন্ত্রী সেখানে বক্তব্য দেয়ার সময় বলেন, ‘কানাডায় ইসলামোফোবিয়া বিদ্যমান, বর্ণবাদ বিদ্যমান। কিন্তু এগুলোর শিকার হওয়া উচিত নয় করো। আমাদের সবাইকে একত্র হয়ে দাঁড়াতে হবে। ইসলামোফোবিয়া, বিদ্বেষ, সন্ত্রাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে বলতে হবে না না।’

একই অনুষ্ঠানে কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান এরিন ও’টুল বলেন, ‘কানাডায় ইসলামোফোবিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য দলীয় নেতাদেরকে রাজনীতি একপাশে রেখে এগুতে হবে। বিভিন্ন প্রভিন্সের প্রিমিয়ার, সিটির মেয়র, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে সহিংসতা ও বিদ্বেষকে মোকাবেলা করার জন্য।’

এনডিপি নেতা জাগমিত সিং বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসবাদকে জয়ী হতে দিব না। আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না। লন্ডনের এই হত্যাকান্ডের পর আমাদেরকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিনি প্রশ্ন রাখে বলেন, ‘আর কত লাশ পড়লে আমরা বাস্তব পদক্ষেপ নিব? প্রকৃত পরিবর্তন আনার জন্য আর কতজন মুসলিম ভাই ও বোনকে প্রাণ দিতে হবে? আমাদেরকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’

শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড এই হত্যাকান্ডকে সন্ত্রাসবাদ এবং ঘৃণাজনিত অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এই ভয়াবহ অপরাধ নিখুঁতভাবে ঘৃণা ও বর্ণবাদ দ্বারা প্ররোচিত হয়েছে। এটি একটি অপরাধ। একটি পরিবারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কর্ম এটি।’

অন্টারিও এনডিপি নেতা এন্ড্রিয়া হরওয়থ বলেন, ‘এই ধরণের বিদ্বেষপ্রসুত সন্ত্রাসী কার্যক্রম অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অন্টারিও’র অধিবাসীদেরকে এই সত্যতা স্বীকার করতে হবে যে এখানে বিদ্বেষ বিদ্যমান এবং মুসলিম সম্প্রদায় কানাডায় বিদ্বেষের ভয় মোকাবেলা করে আসছে। আমাদেরকে অবশ্যই এটি স্বীকার করতে হবে এবং এটি হলো প্রথম পদক্ষেপ। ইসলামোফোবিয়া, শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সহিংসতা এবং তাঁদের ঘৃণাজনিত অপরাধ এখানে খুবই বাস্তব, খুবই পরিচিত যা মুসলিম সম্প্রদায় মোকাবিলা করে আসছে।’ 

ব্যাস, ঐ পর্যন্তই! এরপর এ নিয়ে আর কোন উচ্চ-বাচ্য নেই। এবারের জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন জাতীয় দলের ইস্তেহারেও ইসলামোফোবিয়া নিয়ে কোন কথা বলা হয়নি উল্লেখ করার মত। অথচ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল।

তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ইসলামোফোবিয়া গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলেও মূলধারার রাজনীতিবিদ বা নীতিনির্ধারকদের কাছে এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। তাঁরা যদি শুধু ভোটের আশায় মাঝে মধ্যে মায়া কান্না দেখান তবে মুসলিম সম্প্রদায় তাঁদের কাছ থেকে কিছুই আশা করতে পারে না। আবার নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন সেটাও সম্ভব নয় যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতা না থাকে এবং যদি এ বিষয়ে কঠোর কোন আইন না থাকে।

আরেকটি বিষয় লক্ষনীয় যে, গত পাঁচ বছরে কানাডায় যতগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে ইসলামোফোবিয়ার কারণে, তার সবকটিই হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর। তাঁর মুসলিম বিরোধী উস্কানিতেই গোটা কানাডায় ইসলামোফোবিয়া অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেটি প্রতিহত করার জন্য কানাডিয়ান রাজনীতিবিদগণ শুধুমাত্র মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু করেছে এমন নজির পাওয়া ভার।

আসলে কানাডায় ইসলামোফোবিয়া অনেকদিন ধরেই বিদ্যমান রয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে তেমন জোরলো কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সিবিসি নিউজ জানায়, অন্টারিও’র লন্ডনে সংঘঠিত হত্যাকান্ডের পর মুসলিম কমিউনিটিতে জোরালো দাবী উঠেছে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে আরো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য।

মার্কহামে অবস্থিত মানবতা বিষয়ক এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ফাইরাজ আজিজ বলেন, ‘এখন সময় এসেছে কিভাবে আমরা এই বাধা অতিক্রম করবো সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার। শুধু ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে নয়, বিদ্বেষ, বর্ণবাদ, ইহুদী বিদ্বেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধেও।’

অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রধান কমিশনার এনা চাধা বলেন, ‘এ জাতীয় ঘটনাগুলো দুঃখজনক ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যে অন্টারিওতে ইসলামোফোবিয়া আর জেনোফোবিয়া (ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে অহেতুক ভয়) বাস্তব এবং চলমান।

‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস’ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা ফারুক বলেন, ‘লন্ডনের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনা কানাডার মুসলিমদের মধ্যে ভয়, ক্রোধ, হতাশা এবং ক্লান্তির নতুন অনুভূতি তৈরী করেছে। কানাডার মাটিতে এটি একটি সন্ত্রাসী হামলা। ইসলামোফোবিয়া কানাডায় এখনো বড় ধরণের সমস্যা।’

এদিকে গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত এক বিশেষ জরিপে দেখা গেছে, কানাডায় বর্ণবাদ বা জাতিবিদ্বেষকে এখন তেমন একটা বড়ো সমস্যা হিসাবে দেখা হচ্ছে না যদিও কানাডায় ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ বা হেট ক্রাইম বেড়েই চলেছে। গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত ইপসস-এর বিশেষ ঐ জরিপে এই বলা হয়, এক-চতুর্থাংশেরও বেশি কানাডীয় মনে করেন, গত পাঁচ বছরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার বিষয়টি ‘অধিকতর গ্রহণযোগ্য’ হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ২০১৭ সালে কানাডায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইমের সংখ্যা ১৫১ শতাংশ বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি হেট ক্রাইম ঘটেছিলো অন্টারিও ও কুইবেকে। অন্টারিওতে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন হেট ক্রাইমের সংখ্যা বাড়ে ২০৭ শতাংশ আর কুইবেকে ১৮৫ শতাংশ। মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্যের এই বিস্ফোরণের কারণ কী?

অন্টারিও ইউনিভার্সিটির টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের হেট ক্রাইম বিশেষজ্ঞ বারবারা পেরি বলেন, কানাডায় ইসলামভীতি সব সময়ই ছিলো কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, এর পেছনে অনেক উপাদান সক্রিয় তবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ট্রাম্পের প্রভাব।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কানাডায়ও হিংসাশ্রয়ী গ্রুপের ক্রমবিকাশ নিয়ে দেশবাসীর সচেতন হওয়া দরকার। বারবারা পেরির বক্তব্য অনুযায়ী, সারা কানাডায় কমপক্ষে ১৩০টি চরম ডানপন্থী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তিনি বলেন, এই সংখ্যাটি ২০১৫ সালের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্র্যাম্পটন এর মেয়র প্যাট্রিক ব্রাউন ইতিপূর্বে একবার বলেছিলেন, ইসলামোফোবিয়া কোন কাল্পনিক বিষয় নয়। এটি এখানে সত্যি সত্যি ঘটছে। তিনি আরো বলেছিলেন, একজনের গায়ের রং কি, কোন দেশ থেকে তিনি এসেছেন, কোন ভাষায় তিনি কথা বলেন, তিনি শুক্রবারে মসজিদে যান কিনা, তিনি শনিবারে ইহুদীদের ধর্মশালায় যান কিনা, তিনি রবিবারে খ্রীষ্টানদের চার্চে যান কিনা সেটি কখনোই ধর্তব্যের বিষয় হতে পারে না। আমরা সবাই মিলে একত্রিত হয়েছি একটি বৈচিত্রময় সুন্দর দেশ গড়ার এবং এটিই আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়।

প্যাট্রিক ব্রাউনের সঙ্গে আমারাও একমত। বৈচিত্রময় সুন্দর একটি দেশ গড়ার বিষয়টি সকলের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। কোন একটি ধর্ম সম্প্রদায়কে আলাদা রেখে বা তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ বজায় রেখে বৈচিত্রময় সুন্দর দেশ গড়া অলীক কল্পনা মাত্র। তাই কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের জোর দাবী, এ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে অবিলম্বে। এখন আর কথায় বা প্রতিশ্রুতিতে কাজ হবে না। নিতে হবে বাস্তব পদক্ষেপ।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক প্রবাসী কণ্ঠ