টরেটক্কা টরন্টো
সামাজিকতা ও ধর্মপালন -৪
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২০১৫ সালে তরুণ দলনেতা জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠা পেয়ে কানাডার ফেডারেল নির্বাচনে জয়ী হয়। ‘ডার্ক হর্স ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে তাঁর এই বিজয় অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে কিছুটা হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ জাস্টিন ট্রুডো যখন লিবারেলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তখন প্রাক্তন লিবারেল প্রধানমন্ত্রী পিয়ারে ট্রুডোর পুত্রের বাইরে তাঁর তেমন কোন রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা অভিজ্ঞতা ছিল না। বরং তিনি তাঁর লম্বা চুলের স্টাইল কিংবা চ্যারিটি বক্সিং-এর কারণে বেশী পরিচিত ছিলেন। তবে নির্বাচনের ঠিক আগে আগে তিনি চুলের স্টাইল পরিবর্তন করেন। অনেকেই মনে করেন যে কট্টরপন্থী হারপারের কিছু পদক্ষেপ যেমন বিল সি-২৪-এর মাধ্যমে ‘সেকেন্ড ক্লাস’ সিটিজেনদের সিটিজেনশীপ বাতিলের পথ উন্মুক্ত করা, নিকাব ইস্যুকে সামনে এনে ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দেয়া, তথা কথিত ‘বারবারিক কালচারাল’ রোধে হটলাইন চালু করার পরিকল্পনা, এইসব নানাবিধ কারণে জনগণ আর কনজারভেটিভ দলকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছিল না। নির্বাচনী প্রচারণাতে এনডিপি এবং লিবারেল উভয়েই এই সব ইস্যুর বিরুদ্ধে জোর অবস্থান নেয়। সেই সময় টমাস মোলকেয়ারের মতন অভিজ্ঞ দলনেতা থাকা সত্ত্বেও সরকার গঠনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণেই হয়ত এনডিপি জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফেডারেল নির্বাচনে লিবারেলের পক্ষেই জনগণের রায় ঘোষিত হয়। লিবারেলের কিংবা জাস্টিন ট্রুডোর ব্যক্তিগত কোন ক্যারিশমা এই জয়ের পিছনে কাজ করেনি, বরং জনগণের এন্টি-কনজারভেটিভ মনোভাবই লিবারেলের জয়কে নিশ্চিত করেছে। জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য জনগণের এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই তাঁর বিজয় র্যালিতে পলিটিক্যাল ফ্রেজ ‘সানি ওয়েজ’ কথাটা উল্লখ করেন যার অর্থ হচ্ছে তাঁর সরকার জনগণের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপহার দেয়ার অঙ্গীকার করছে। লিবারেলের বিজয়ে সবচেয়ে বেশী আশান্বিত হয়েছিল ফার্স্ট নেশন এবং এক শ্রেণীর মুসলিম ইমিগ্র্যান্ট যারা হারপারের আমলে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।
জেন্ডার ইকোয়ালিটি এবং এম্পাওয়ারিং উইমেন – এই দুইটি নীতিকে সামনে রেখে ট্রুডো বেশ কিছু নারী মন্ত্রীর নিয়োগ দেন তাঁর মন্ত্রীসভায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ফার্স্ট নেশন বংশোদ্ভূত জোডি উইলসন-রেবোল্ড। ট্রুডো তাঁকে একই সাথে আইন মন্ত্রী এবং এটর্নী জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দিলে ফার্স্ট নেশন জনগণ এই ভেবে আশ্বস্ত বোধ করে যে তাদের দীর্ঘদিনের দাবীগুলোর পূরণে এবার হয়ত কানাডার সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে। আফগান বংশোদ্ভূত লিবারেল এমপি মারিয়াম মুন্সেফকে ২০১৭ সালে মিনিস্টার ফর উইমেন এন্ড জেন্ডার ইকোয়ালিটি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ট্রুডো মুসলমানদের ভেতর অনুরূপ আশা জাগাতে সমর্থ হন। উল্লেখ্য যে, মারিয়াম মুন্সেফ হচ্ছে কানাডার সর্বপ্রথম মুসলিম ক্যাবিনেট মিনিস্টার। ক্ষমতায় এসেই তরুণ এবং সুদর্শন ট্রুডো জনগণের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, সেলফি তুলতে চাইলে কাউকেই নিরাশ না করা ইত্যাদি ক্যারিশমা দিয়ে বেশ দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জনে সমর্থ হন। তবে স্বল্পতম সময়ের ভিতর সিরিয়ার শরণার্থীদের কানাডাতে আনার ব্যবস্থা করে সাড়া বিশ্বের মিডিয়াতে তিনি সাড়া ফেলে দেন। বিশেষ করে শরণার্থীদের প্রথম দলটি টরন্টোর পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালে ট্রুডো নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে তাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। সিরিয়ান শরণার্থীরা গরম দেশ থেকে আসছে বিধায় তাদের জন্য উপহার হিসেবে কানাডার জনগণ শীতের কাপড় যোগাড় করে রেখেছিল এবং এয়ারপোর্টে একদল স্বেচ্ছাসেবক তাদের প্রত্যেককে সাইজ অনুযায়ী একটি করে গরম জ্যাকেট দিচ্ছিল। সেই সময় ট্রুডো গরম কাপড়ের স্তূপ থেকে সুন্দর একটি জ্যাকেট বেছে নিয়ে নিজের হাতে সিরিয়ান এক বাচ্চা মেয়েকে পরিয়ে দিয়েছিল। সেই আবেগঘন দৃশ্যটি ভিডিও আকারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিডিয়াতে প্রচারিত হয় এবং সেই সাথে ট্রূডোর জনপ্রিয়তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এক সময় অবশ্য ট্রুডোর হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয় এবং তাঁর সরকারকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়। এই সময় আমেরিকাতে আরেক ‘ডার্ক হর্স ক্যান্ডিডেট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে পুরো পৃথিবীকে চমকে দেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই কানাডার সাথে অসম বানিজ্য চুক্তির দোহাই দিয়ে ট্রুডো সরকারকে বেকায়দায় ফেলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সাথেও বানিজ্য চুক্তি নিয়ে বড় ধরণের কূটনৈতিক যুদ্ধে শুরু করেন। তারপরও তিনি ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বেইজিং সফর করে চীনের সাথে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য চুক্তি করে আসলে ট্রুডো ঠিক পরের মাসেই বেইজিং যান। সেখানে তিনি তাঁর আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ বানিজ্য চুক্তির চাইতে হিউম্যান রাইটস, আইনের শাসন এবং নর্থ কোরিয়া ও বার্মার প্রতি চীনের অনৈতিক সমর্থন নিয়েই বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে উৎসাহী হলেন, যা কিনা ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়ার সামিল। ফলশ্রুতিতে তাঁকে শূন্যহাতে ফেরত আসতে হয় এবং সেই সাথে তাঁর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার গভীরতা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। সেই সমালোচনা আরো তীব্র আকার ধারণ করে যখন তিনি একদল শিখ বংশোদ্ভূত দলীয় কর্মী, এমপি এবং ডিফেন্স মিনিস্টার হারজিৎ সাজ্জানকে নিয়ে কিছু দিন পর ইন্ডিয়া সফরে যান। বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব জাসপাল আতওয়াল কীভাবে তাঁর সফরসঙ্গী হলো সেটা নিয়ে মিডিয়াতে তখন তুমুল হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। ট্রূডো এক পর্যায়ে এই বলে মন্তব্য করেন যে তাঁর দলে শিখ বংশোদ্ভূত এমপির সংখ্যা পুরো ইন্ডিয়ায় শিখ এমপিদের চেয়ে বেশী। ইন্ডিয়া অবশ্যই সেটাকে ভালো চোখে দেখেনি। শিখ মিলিট্যান্টদের স্বপ্নের দেশ ‘খালিস্তান’ নিয়ে কানাডা এবং ইন্ডিয়ার ভেতর কূটনৈতিক টানাপোড়ন যে একটি বাস্তবতা সেটা হয়ত ট্রুডো এবং তাঁর সরকার অনেকটাই আন্ডারমাইন্ড করেছিল। এসব কারণে তাঁর সাথে বৈঠকে বসতে ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে অনীহা দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে তাঁর এই সরকারী সফর অনেকটা ব্যক্তিগত অবকাশ যাপনের আকার ধারণ করে। মিডিয়ার খবরে মনে হয়েছে যে ট্রুডো এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে ইন্ডিয়ান কস্টিউম পরে বলিউড তারকাদের সাথে ছবি তোলাতেই বেশী আগ্রহী। তবে সফরের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে মোদী তাঁকে সাক্ষাৎ দেয়াতে কিছুটা হলেও তাঁর মুখ রক্ষা হয়েছিল। তিনি অবশ্য তাঁর ব্যক্তিগত অবকাশ যাপনের জন্য বাহামা দ্বীপের বেল কে-তে প্রিন্স আগাখানের রিসোর্টে গিয়েও সমালোচনার মুখে পড়েন। কারণ তাঁর সেই ছুটি কাটানোর জন্য কানাডা সরকারকে গুনতে হয়েছিল দুই লাখ পনেরো হাজার ডলার যা কিনা মূলত জনগণের দেয়া ট্যাক্সের টাকা।
চীন এবং ইন্ডিয়া সফরের ভরাডুবির পরপরই লিবারেল সরকার সৌদি আরবের হিউম্যান রাইটস নিয়ে মন্তব্য করে আরেকটি আন্তর্জাতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। সৌদী আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ওরফে এমবিএস যিনি কিনা খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ব্যক্তিগত সখ্যতা বজায় রেখে চলেন, তিনি কানাডার এই মন্তব্যে নাখোশ হন। তাঁর ক্লিন শেভড ফরেন মিনিস্টার আদিল যুবায়ের কানাডাতে ফার্স্ট নেশনদের দূর্দশার কথা উল্লেখ করে চোস্ত আমেরিকান একসেন্টে কানাডাকে হুশিয়ার করে বলেন যে কানাডা যেন তার নিজ দেশের হিউম্যান রাইটস নিয়ে আগে চিন্তা করে। এরপর সৌদী সরকার কানাডা থেকে তার সমস্ত ছাত্রকে প্রত্যাহার করে এবং একই সাথে কানাডামুখী সৌদী এয়ারলাইন্সের সমস্ত ফ্লাইট বাতিল করে। এতে ২০১৮ সালে কানাডা থেকে অনেক মুসলিমদের হজ্জ করার সময় চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে মন্দের ভালো এই যে কানাডিয়ান পাসপোর্টে হজ্জ করার অনুমতি অব্যাহত রেখেছিল সৌদী সরকার যা কিনা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের কপালে জোটেনি। এই সময় কানাডা সোদী আরবের পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের আবদ্ধ পরিবেশ থেকে পালিয়ে আসা আঠারো বছর বয়স্কা ‘রাহাফ মোহাম্মদ আল-কুনুন’-কে রিফিউজি হিসেবে কানাডাতে আসার অনুমতি দেয়। আর এই হাই প্রোফাইল রিফিউজিকে ফরেন অ্যাফেয়ার মিনিস্টার ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড নিজে এয়ারপোর্টে এসে রিসিভ করেন। এ ছাড়াও সৌদী সাংবাদিক জামাল খাশোগজি হত্যাকান্ডের জন্য যখন পুরা বিশ্ব সৌদী ক্রাউন প্রিন্স এমবিএসকে অভিযুক্ত করছিল, কানাডাও সেই সময় সৌদী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় যদিও আমেরিকা সৌদী প্রিন্সকে নির্দোষ বলে দাবী করে। কানাডা এবং সৌদী আরবের সম্পর্কের এই টানাটানিতে কানাডাতে অবস্থিত বিভিন্ন মসজিদ সমূহের জন্য সৌদী ডোনেশন আসা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট মুসলিম কমিউনিটির উপর অর্থনৈতিক সাহায্যের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যাই হোক কানাডা এবং সৌদী সরকারের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরলেও কোন পক্ষই অবশ্য দুই দেশের মধ্যকার অস্ত্র চুক্তি নিয়ে কোন কথা বলেনি, ফলে থলের বিড়াল নিশ্চিন্তে থলের ভেতরই থেকে যায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সব সময়ই কিছু স্পর্শ কাতর বিষয় থাকে যা নিয়ে কেউ সহজে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না।
আমেরিকার অনুরোধে চীনের বিখ্যাত হুয়াওয়েই কোম্পানীর চীফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার মং ওয়েনট্রৌ-কে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভ্যানকুভার এয়ারপোর্টে গ্রেফতার করে কানাডা আরেকটি বড় ধরণের কূটনৈতিক সংকটে পতিত হয়। শুরুতে মনে হয়েছিল মং ওয়েনট্রৌ-কে তাড়াতাড়ি আমেরিকাতে পাঠিয়ে দিয়ে চীন এবং আমেরিকার ব্যাপার থেকে কানাডা তার হাত মুছে ফেলবে। কিন্তু আমেরিকা মং ওয়েনট্রৌ-কে তার দেশে নেয়ার ব্যাপারে গড়িমসি শুরু করে। ইতিমধ্যে প্রতিশোধ স্বরূপ চীন কানাডার দুই নাগরিক ‘মাইকেল কোভরিগ’ এবং ‘মাইকেল স্পাভর’-কে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করে ফেলে। মিডিয়া তাদেরকে একত্রে ‘টু মাইকেলস’ বলে উল্লেখ করা শুরু করে। চীন জোর দাবী জানায় যে তাদের গ্রেফতারের সাথে মং ওয়েনট্রৌ-এর কোন সম্পর্ক নাই। ট্রাম্প নিজ মুখে যখন ইঙ্গিত দেন যে মং ওয়েনট্রৌ-কে চীনের সাথে বানিজ্য চুক্তির দর কষাকষিতে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে তখন চীন কানাডাকে কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার ভেঙে নানা রকম হুমকি দেয়া শুরু করে এবং এক পর্যায়ে কানাডাকে আমেরিকার পা-চাটা কুকুর বলেও অভিহিত করে। অতি সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর সাথে আলোচনা করে মং ওয়েনট্রৌ-কে মুক্তি দিতে সম্মত হন, তবে বিনিময়ে কানাডার দুই মাইকেলের মুক্তিও নিশ্চিত করেন। দুই মাইকেল যখন কানাডার এয়ারফোর্সের পাঠানো বিশেষ বিমানে চীনের সীমা অতিক্রম করে, তখনই কেবল মাত্র মং ওয়েনট্রৌ এয়ার চায়নার প্লেনে করে ভ্যানকুভার এয়ারপোর্ট থেকে চীনের উদ্দেশ্যে দেয়। চীনের শেনট্রেন এয়ারপোর্টে মং ওয়েনট্রৌ যখন এসে পৌঁছায় তখন তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয়। অপরদিকে দুই মাইকেলকে ক্যালগেরির এক এয়ারপোর্টে প্রাইম মিনিস্টার ট্রুডো এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রিসিভ করেন। এই ভাবে প্রায় তিন বছর পর দুই মাইকেল এবং মং ওয়েনট্রৌ-এর কেসের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে চীন এবং কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক কতখানি রিকভার করবে সেটা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারবে।
লিবারেল সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ফার্স্ট নেশন এবং মুসলিম কমিউনিটি যে আশার আলো দেখতে পেয়েছিল তা অচিরেই মিলিয়ে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে এসএনসি লাভালন কেসে জোডি উইলসন-রেবোল্ডকে যেভাবে নাজেহাল করা হয় আর কুইবেক মসজিদের সাজাপ্রাপ্ত সুটার আলেকজান্দ্রে বিসোনেট-এর সাজা চল্লিশ বছর থেকে কমে পঁচিশ বছর হওয়ায় ফার্স্ট নেশন এবং মুসলিম কমিউনিটি তাদের প্রতি লিবারেল সরকারের দায় নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এছাড়াও মারিজুয়ানা বা ক্যানিবাসকে লিগ্যাল করা নিয়ে কিংবা স্কুলের কারিকুলামে সেক্স এডুকেশনের সিলেবাসের কারণে অনেক মুসলিম কানাডিয়ানরা অস্বস্তিতে পড়েন। হিজাব এবং নিকাব নিয়ে তথাকথিত হেইট ক্রাইমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে লিবারেল এমপি ইকরা খালিদ ‘সিস্টেমিক রেসিজম এন্ড রিলিজিয়াস ডিসক্রিমিনেশন’ টাইটেলে পার্লামেন্টে একটি মোশন (এম-১০৩) আনেন যেটাতে কনজারভেটিভ দল ভোট না দিলেও লিবারেল এবং এনডিপি পূর্ণ সমর্থন জানায়। অনেকেই এই মোশনকে ইসলামোফোবিয়া সংক্রান্ত আইন ভেবে তুমুল বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি করে। এই সময় কনজারভেটিভের দাবীর মুখে এমপি ইকরা খালিদ ইসলামোফোবিয়াকে সংজ্ঞায়িত করেন এই ভাবে যে ‘দ্য ইররেশনাল হেইট অব মুসলিম দ্যাট লিডস টু ডিসক্রিমিনেশন’। ইকরা খালিদ পঞ্চাশ হাজারের বেশী ই-মেইল পেয়েছিলেন যেখানে তাকে এই মোশন আনার জন্য প্রাণনাশ সহ বিভিন্ন ধরণের হুমকি দেয়া হয়। এই মোশন নিয়ে উত্তেজনা এক সময় থেমে যায় বটে, তবে মুসলিম কানাডিয়ানদের অনেকেই মনে মনে আশা পোষণ করেন যে একদিন ইসলামোফোবিয়া নিয়ে আইন পাশ হবে। কারণ যখনই কোন মুসলিম হেইট ক্রাইমের শিকার হন, ট্রুডো তখন মিডিয়াতে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘ইসলামোফোবিয়া ইজ রিয়েল’। কিন্তু বাস্তবে যখন ইসলামোফোবিয়া দূরীকরণে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয় না তখন অনেকেই মনে করেন যে ট্রুডোর এই কান্না শুধুই লোক দেখানো। অনেকে আবার এও মনে করিয়ে দেন যে, ট্রুডোর মা মার্গারেট ট্রুডো ছিলেন এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী এবং ট্রুডো নিজেও ছিলেন হাই স্কুলের ড্রামা টিচার।
লিবারেল তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২০১৯ সালের নির্বাচনে এনডিপি-এর সাথে জোট বেঁধে মাইনরিটি সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুতে পুরা বিশ্ব কোভিডের কারণে অচল হয়ে পড়লে ট্রুডো সরকারকেও বেশ বিপাকে পড়তে হয়। প্যান্ডেমিকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সারভাইভ করার জন্য লিবারেল সরকার বিভিন্ন রকম অর্থ সাহায্যের স্কীম চালু করে। এই স্কীমগুলোকে চালু রাখার জন্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমান অর্থের যোগান দেয়া হয়। কিছুদিন পর প্রকাশ পায় যে ‘উই চ্যারিটি’ নামক এক প্রতিষ্ঠানকে অন্যায্যভাবে বেশ বিরাট অংকের অর্থ বন্টনের দায়িত্ব দেয়া হয়। কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতন এই অর্থ কেলেঙ্কারিতে ট্রুডো পরিবারের নাম উঠে আসে। সেই কেলেঙ্কারির রেশ কিছুটা স্তিমিত হতেই ট্রুডো হঠাৎ করেই মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচনের ডাক দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে তার উদ্দেশ্য নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করা। বিভিন্ন কারণে লিবারেলের জনপ্রিয়তা যখন প্রায় তলানিতে সেই সময় নির্বাচনের ডাক দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ সেটা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হল। অনেকেই নির্বাচনে লিবারেল আর উঠে আসতে পারবে না বলে মনে করতে লাগল।
কানাডাতে প্রতিটি নির্বাচনের সময় মুসলিম কমিউনিটিতে ভোট দেয়া নিয়ে নানা ধরণের আলোচনা শুরু হয়। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্র জায়েজ কিনা এবং সেই সাথে ভোট দেয়াটা উচিৎ কিনা সেই প্রসঙ্গে নানা মুফতির নানা মত রয়েছে। তবে ‘দ্য কানাডিয়ান-মুসলিম ভোট’ নামক একটি রেজিস্টার্ড সংস্থা মুসলমানদেরকে ভোট দেয়ার জন্য উৎসাহিত করে যাচ্ছে। তবে কানাডাতে বেশ কিছু মুসলিম বিদ্বেষী ঘটনা ঘটে যাওয়াতে আগে যারা ভোট দিতে অনুৎসাহিত করতেন তারাও এখন ভোট দেয়ার ব্যাপারে মুসলিমদেরকে উৎসাহিত করছেন। টরন্টোস্থ আবু হুরাইরা মসজিদের খুতবাতে বলা হয়েছে যে মুসলমানেরা তখনই নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করতে পারবে যখন তারা তাদের উপর অর্পিত তিনটি দায়িত্ব পালন করতে পারবে। দায়িত্ব তিনটি হচ্ছে, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ (ফরবিডিং দ্য ইভল) এবং আল্লাহ্ এর প্রতি বিশ্বাস। এখানে ‘ফরবিডিং দ্য ইভল’ বলতে বোঝান হচ্ছে যে দল কম ক্ষতিকর সেই দলকে ভোট দেয়াটা হবে মুসলমানদের দায়িত্ব। অনেকেই এই কথার অর্থকে মুসলমানদের জন্য অধিক ক্ষতিকর দল কনজারভেটিভ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেই জন্য ‘স্ট্রাটেজিক ভাবে ভোট দিতে হবে’, অর্থাৎ লিবারেলকে ভোট দিতে হবে, যদিও হয়ত এনডিপি-এর নির্বাচনী ম্যান্ডেট মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বেশী কম ক্ষতিকর। কানাডাতে ভোটের আগে সব দলের নেতাদের মাঝে ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজী এই দুই ভাষায় দুইটি ডিবেট অনুষ্ঠিত হয়। সেই ডিবেটে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে তা পূর্বেই জানিয়ে দেয়া হয়। এবারের নির্বাচনী সেই ডিবেটে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে কোন আলোচনা না হওয়াতে এটাই স্পষ্ট হয় যে এদেশের রাজনীতিতে মুসলমানদের নিয়ে কার্যত কারোই কোন মাথা ব্যথা নেই। মুসলমানদের সমস্যা মুসলমানদেরকেই সমাধান করতে হবে। সেই জন্য এদেশের মূলধারার রাজনীতিতে মুসলমানদের বেশী বেশী করে অংশ গ্রহণ করা উচিৎ। এবারের ফেডারেল নির্বাচনে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে ছয়জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান কন্টেস্ট করেছিলেন। যদিও কেউই নির্বাচিত হতে পারেন নি, তবে তারা অবশ্যই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে রইবেন।
নির্বাচনে অবশেষে লিবারেল জয়ী হয়েছে বটে তবে আবারও তাদেরকে মাইনরিটি সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনের ফলাফল এক কথায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায় – ‘যেই লাউ সেই কদু’। কিন্তু মাঝখান থেকে জনগণের ছয়শত মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেল। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো