কানাডায় কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ
২০২০ সালে প্রতি চারজনে একজন নারী এবং প্রতি ছয়জনে একজন পুরুষ কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ করেছেন
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ২০২০ সালে বছরজুড়ে প্রতি চারজনে একজন নারী (২৫%) ও প্রতি ছয়জনে একজন পুরুষ (১৭%) কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত বা অশোভন যৌন আচরণ করেছেন। এই ধরণের যৌন আচরণের মধ্যে রয়েছে মৌখিক অথবা লিখিত যোগাযোগ, যৌন উপকরণ ব্যবহার এবং অবাঞ্ছিত শারীরিক স্পর্শ অথবা যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ইত্যাদি।
কানাডার সব কর্মস্থলকেই হয়রানি ও বৈষম্যবিরোধী আইন বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হয় এবং অনেক নিয়োগদাতারই কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের সমস্যা নিরসনের জন্য নিজস্ব নীতি বহাল করেনÑ এর মধ্যে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হলে যথাযথ ব্যক্তির কাছে রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াও রয়েছে।
স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডার প্রতিবেদনে বলা হয়, তা সত্ত্বেও, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩২%) নারী এবং এক-চতুর্থাংশ (২৬%) পুরুষ বলেছেন, যৌন হয়রানি অথবা আক্রমণের শিকার হলে কীভাবে রিপোর্ট করতে হবে সে বিষয়ে তারা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে কোনওরকম নির্দেশনা পাননি।
কর্মস্থলে যৌন অসদাচরণ বিষয়ে ২০২০ সালের এক জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রণীত ‘কানাডার বিভিন্ন প্রদেশে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ, যৌন হামলা ও লৈঙ্গিক বৈষম্য সম্পর্কিত কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা, ২০২০’ শীর্ষক নিবন্ধটি স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডা কর্তৃক গত আগস্ট মাসে প্রকাশ করা হয়।
কর্মস্থলে যৌন অসদাচরণ নিয়ে এই জরিপ চালানো হয় করোনার কারণে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ব্যবস্থা গ্রহণের ঠিক আগে। ওই ব্যবস্থার মধ্যে অনেক কর্মস্থল বন্ধ করে দেয়ার বিষয়টিও রয়েছে। তাই জরিপের ফলাফলে মহামারির আগে যখন সব অফিস আদালত পুরোপুরি খোলা ছিল সেই সময়কার কর্মচারীদের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে।
প্রতি দশজনে একজন নারী কর্মস্থলে লৈঙ্গিক-বৈষম্যের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন
স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডার প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি দশ জনে একজন নারী (১০%) মহামারির আগের বছর লিঙ্গভেদ, লৈঙ্গিক পরিচিতি অথবা লৈঙ্গিক বিচারে ব্যক্তিগতভাবে কর্মস্থলে বৈষম্যের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তুলনায় এ ধরণের বৈষম্যের শিকার হন প্রতি ২০ জনে একজন পুরুষ (৪%)।
অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ কিংবা লিঙ্গভেদ, লৈঙ্গিক পরিচিতি অথবা লৈঙ্গিক বিচারে বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে নারী, তরুণ বয়সের কর্মচারী, প্রতিবন্ধী অথবা যারা যৌন অভ্যাসের দিক থেকে এলজিবিটিকিউ+ {(lesbian, gay, bisexual, transgender, queer (or sometimes questioning), and two-spirited (LGBTQ2+)} সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত তাদের ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ, এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত কর্মচারীদের প্রায় অর্ধেকই (৪৭%) ব্যক্তিগতভাবে এধরণের আচরণ বা বৈষম্যের শিকার হন। সেই তুলনায় যারা এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নন তাদের ক্ষেত্রে এধরণের অভিজ্ঞতা পান এক-পঞ্চমাংশের কিছু বেশি সংখ্যক (২২%) কর্মচারী।
শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কর্মীর চেয়ে অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক কারণে বৈষম্যের বিষয়ে অভিযোগ করার ঘটনা ছিলো অনেক কম। এমনটাই দেখা গেছে শ্বেতাঙ্গ নারীদের ক্ষেত্রে (যাদের আট শতাংশ লৈঙ্গিক কারণে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে অশ্বেতাঙ্গ নারী কর্মীদের ১১ শতাংশ বৈষম্যের শিকার হন)। আর শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ পুরুষেরা এমন বৈষম্যের শিকার হন যথক্রমে ৪% এবং ৫%। কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত বা অশোভন যৌন আচরণের ফলাফলও একই রকম: শ্বেতাঙ্গ নারী-পুরুষ এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছে যথাক্রমে ১৯% এবং ১১%, অন্যদিকে অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা হয় যথাক্রমে ২৭% এবং ১৯%।
কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হওয়ার ঘটনা আদিবাসী এবং যারা আদিবাসী নন তেমন সব নারীকর্মীর ক্ষেত্রেই সমান। উভয় জনগোষ্ঠীর নারীদের ২৫% এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন। আবার পুরুষদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা প্রায় সমান। আদিবাসী পুরুষদের ২০% এবং অন-আদিবাসী পুরুষদের ১৬% কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হন। এসব বিষয়ে আদিবাসী ও অন-আদিবাসী নারীরা অভিযোগও করেন সমান সংখ্যক (যথাক্রমে ১০%)।
ঐতিহাসিকভাবে পুরুষেরা করে এসেছেন এমন পেশায় নিয়োজিত নারীদের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ ঘটে অনেক বেশি। নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হন সেইসব নারী যারা এমন কোনও পেশায় যুক্ত যেখানে ঐতিহাসিকভাবে পুরুষেরই প্রাধান্য ছিলো। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসায়, পরিবহন, যন্ত্রপাতি চালনা ও সংশ্লিষ্ট পেশাগুলোতে নিয়োজিত মহিলাদের প্রায় অর্ধেক (৪৭%) বলেছেন, মহামারির আগের বছর তারা এ ধরনের আচরণের শিকার হয়েছেন, যেখানে তুলনায় ১৯% পুরুষ একই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন।
স্বাস্থ্য, বিপনন ও পরিষেবা খাতের চাকরিতে নিয়োজিত নারী ও পুরুষেরা উচ্চ হারে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হন
ঐতিহাসিকভাবে নারীরাই দখল করে ছিলো এমন কিছু পেশায় নিয়োজিত নারীরাও মহামারির আগের বছর বেশ উচ্চ হারে অবাঞ্ছিত বা অশোভন যৌন আচরণের শিকার হন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিপনন ও পরিষেবা খাতে কর্মরত প্রায় প্রতি তিনজন নারীর একজন (৩২%) এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পেশার (৩০%) নারী বলেন, তারা মহামারির আগের বছরে কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হয়েছেন।
তুলনামূলক বিচারে বিপনন ও পরিষেবা খাতের প্রায় প্রতি পাঁচজনে একজন পুরুষ (২২%) এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতের (১৯%) পুরুষ মহামারির আগের বছরে ব্যক্তিগতভাবে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হন।
বিপনন ও পরিষেবা খাতের পেশায় নিয়োজিত যেসব নারী এধরণের আচরণের শিকার হয়েছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৩%) বলেছেন, একজন গ্রাহক বা খদ্দের অন্তত একবার এ ধরণের আচরণ করার জন্য দায়ী। একই রকম কথা বলেছেন, এই খাতের এক-পঞ্চমাংশ (২১%) পুরুষ। অন্যদিকে যেসব পুরুষ এমন আচরণের মুখোমুখি হন তারা বেশিরভাগ হয়েছেন কোনও সহকর্মীর দ্বারা (৮৩%), যেখানে এই খাতের নারীরা হয়েছেন (৬৪%)।
যৌনতাপূর্ণ টেক্সট ম্যাসেস, ভিডিও বা অডিও ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি হয়েছেন এমন প্রতি তিনজনে একজন এজন্যে কর্তৃপক্ষের কাউকে দায়ী করেছেন
স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষীয় অবস্থানে থাকেন এমন লোকজনÑ যেমন
সুপারভাইজার বা ঊর্ধ্বতন কর্তাÑ উল্লেখিত বছরে প্রায়শ অশোভন যৌন আচরণের পেছনে মূল হোতা। উদাহরণস্বরূপ, কর্মক্ষেত্রে যৌন অবাঞ্ছিত আচরণের শিকার হওয়া নারীদের প্রতি ১০ জনে তিনজন (২৮%) কোনও কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছেন, অন্যদিকে এমন আচরণের মুখোমুখি হওয়া পুরুষদের ৩০% একই কথা বলেছেন।
কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক কারণে বৈষম্যের শিকার হওয়া ৪৪% নারী ও ৩৬% পুরুষ বলেছেন, কর্তৃপক্ষের কেউ এজন্যে দায়ী।
অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের তিন ধরণের অপরাধের সবগুলোর জন্য নারীরা প্রায়শ একজন পুরুষকেই অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করেন। তবে যৌন উপকরণের মাধ্যমে অবাঞ্ছিত আচরণের শিকার পুরুষদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইভাবে সত্য (৬৬%)। অনাকাক্সিক্ষত শারীরিক স্পর্শ বা যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব পাওয়া পুরুষদের প্রায় অর্ধেক (৫১%) এজন্য একজন নারীকে দায়ী করেন।
অনেক নারী পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় তাদের এ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার কথা বলেননি
অন্য কোনও প্রেক্ষাপটে ঘটা অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ এবং যৌন পীড়নের ঘটনার মতই কর্মস্থলে সংঘটিত ঘটনার সবগুলো কর্তৃপক্ষের কারও কাছে রিপোর্ট করা হয়নি। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মহামারি শুরুর আগের বছর কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত যৌন ইঙ্গিত পেয়েছেন এমন নারীদের প্রায় অর্ধেক (৫১%) এ বিষয়ে আলোচনা করেন তার কোনও সহকর্মীর সঙ্গে। সুপারভাইজার বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত আবার ওইসব ঘটনার শিকার নারীদের ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও কম (৪৬%)। পুরুষদের আরও অনেক কম সংখ্যক (২০%) এমন ঘটনা নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করেন। আর যারা আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে মোটামুটি প্রতি ১০ জনে চারজন (৩৯%) বিষয়টি সুপারভাইজার বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।
এ ধরণের অভিজ্ঞতার বিষয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করেননি এমন নারীদের পাঁচজনে একজন (২০%) বলেন, তারা পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় এ কাজে বিরত থেকেছেন। তবে এই সংখ্যাটি পুরুষদের তুলনায় (৮%) বেশ বেশি। এক-চতুর্থাংশের সামান্য কিছু বেশি (২৬%) নারী বলেন, তারা যদি বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করতেন তাহলে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হতো না। ১২% নারী বলেন, তারা এ ধরণের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে খুবই বিব্রত ও লজ্জিত বোধ করেছেন।
পুরুষদের মধ্যে যারা অশোভন বা অবাঞ্ছিত যোগাযোগের বিষয়ে অভিযোগ করেননি তাদের এক-চতুর্থাংশ (২৬%) বলেছেন, তারা বিষয়টিকে অশোভন বলে মনেই করেননি।