কানাডায় আসতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি ছেলে মেয়েদের জন্য টুকিটাকি তথ্য

নজরুল ইসলাম

এই লেখায় আমি খানিকটা নিজের সম্পর্কে বলবো এই জন্য যে যদি বাংলাদেশী ছেলে মেয়েদের সামান্যতম উপকারে আসে। উপকারে আসলে আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে।

১৯৭৪-১৯৭৮ এর দিকে আমি বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রৌকশল সংস্থার কোনো একটা প্রজেক্টে কাজ করি। সে সময় আমার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। তখন আমি যে বেতন পেতাম তা দিয়ে দুইবেলা রুটির ব্যবস্থা করা কঠিন ছিল। বাজারের সঙ্গে বেতনের কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। আমি সর্বদাই ভাবতাম কি ভাবে বাইরের দেশ গুলিতে চাকুরী নিয়ে যাওয়া যায়। এ নিয়ে আমরা বন্ধুদের কয়েক জনে মাঝে মধ্যে আলাপ আলোচনা ও করতাম। একদিন এ ধরণের আলাপ আলোচনা চলছিল, একজন আমাকে বললেন, ‘আপনি ইচ্ছা করলে বিদেশে চলে যেতে পারেন।’ আমি ওনাকে লক্ষ্য করে বললাম,‘এজেন্টকে টাকা দেয়ার মতো অবস্থা আমার বা আমার বাবার নাই।’ উনি আমাকে বললেন, ‘সবার ক্ষেত্রে এজেন্ট (দালাল) কে টাকা দিতে হয় না। আপনার যে টুকু  পড়াশুনা আছে তা দেখিয়ে ইচ্ছা করলে চেষ্টা করতে পারেন।’ আমি উৎসাহ বোধ করলাম এবং আসতে আসতে লাইব্রেরি ও বিভিন্ন সোর্স থেকে এমপ্লয়ারদের একটা লিস্ট তৈরী করে কয়েকটি দেশে সরাসরি চিঠি লিখা শুরু করি।

সেই যুগে একমাত্র টাইপিস্টরা বা স্টেনোরা টাইপ জানতো। অন্যদেরকে ওদের উপর নির্ভর করতে হতো। কোনো অফিসিয়াল বা পার্সোনাল বিষয় টাইপিস্টকে দিয়ে, না হয় হাতে লিখে পাঠাতে হতো। কোনো একজন টাইপিস্টের  স্বরণাপন্ন হতাম নিজের বায়ো-ডাটা, ও সার্টিফিকেট টাইপ করানোর জন্য। এ  ছাড়া সার্টিফিকেট ও  নিজের পাসপোর্ট ফটো নিয়ে একজন গেজেটেড অফিসারের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে এটাস্টেড করাতাম। অফিসার খুটে খুটে সার্টিফিকেট প্রতিটি লাইন পড়তো এবং সই করে এটাস্টেড সীল লাগিয়ে দিত। তা ছাড়া ফটো স্বাক্ষর করার পূর্বে একবার ভালো করে দেখে নিতেন, ছবি এবং আমি একই ব্যাক্তি কিনা।

কাভারিং লেটার তৈরী করে পুনরায় টাইপিস্টের স্বরণাপন্ন হতাম। তার পরে পোস্ট অফিসে গিয়ে এমপ্লয়ারের ঠিকানায় কাগজ পাঠাতাম। তার প্রাপ্তি স্বীকার পেতে অনেক সময় দুই থেকে তিন মাস ও লাগতো। আবার অনেক সময় রেসপন্স না পেলে পুনরায় কাগজ পত্র পাঠাতাম। এই করে মাসিক বেতনের এক তৃতীয়াংশ খরচ হয়ে যেত চিঠিপত্র লেখা লেখির পিছনে। আজকাল সব কিছু কত সহজ হয়েছে,  স্ক্যাননিং করে ইন্টারনেটে কাগজ পত্র পাঠান কয়েক মিনিটের ব্যাপার। তা ছাড়া খরচ অতি সামান্য বা নাই।

প্রতি মাসে চিঠিপত্র পাঠাতে গিয়ে আমি বাড়তি খরচে পড়তাম এবং এই করে সংসার চালাতে অনেক অসুবিধা  হতো। একদিকে বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাতাম, আর অপর দিকে একটার পর একটা চাকুরী পাল্টাতাম ইনকাম বাড়ানোর জন্য। এভাবে একটার পর একটা চাকুরী পরিবর্তন করেই যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই সংসারের খরচ বহন করতে পারছি না। আমার ওয়াইফ একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কাজ করে ও কিছুটা সাহায্যের হাত বাড়াতো। প্রতি মাসে ধার করে সংসার চালানো হতো। দোকান বাকি, প্রতি মাসেই অফিস থেকে অ্যাডভান্স বেতনের স্বাপেক্ষে টাকা উঠিয়ে নিয়ে নিতাম। অনেক সময় অফিস অ্যাডভান্স টাকা দিত না, সে ক্ষেত্রে আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে কোনো রকমে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ অবস্থা কতদিন চলবে? চারিদিকে শুধু অভাব আর অভাব। মা-বাবার বড় ছেলে আমি, বাড়িতে মা বাবা আর  ছোট ভাই, কিছু না কিছু টাকা প্রতিমাসে দিতে হতো। যা দিতাম,তা দিয়ে  তাদের ও কিছুই হতো না।

কয়েক মাস পরে পরে বিদেশ থেকে আসা একটা চিঠির এনভেলপ দেখলে মনে করতাম এই বুঝি একটা ভালো খবর এসেছে । একটা চিঠির এনভেলপ দেখলে কয়েকবার বিভিন্ন সূরা আর দোআ আগে পড়ে নিতাম, মনে মনে আশার আলো দেখতাম, যেন একটা ভালো খবর আসে।  কিন্তু আমিতো মরীচিকার পিছনে ধাওয়া করছি,  আমি জেনে নিয়েছি, ৯৯% ব্যর্থ প্রচেষ্টার পিছনে আমি দৌড়াচ্ছি। জেনে শুনেও আমি আসায় বুক বেঁধে তিনটি বৎসর একাধারে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। আমি এ ভাবে সান্তনা নিতাম যে আমি স্মোক করি না, বাইরে এক কাপ চা-ও পান করি না, তার পরিবর্তে সে পয়সা একটা কাজে ব্যয় করছি।

অফিসের কাজ শেষ করে,  ইভেনিং কোর্সে,  স্কিল ডেভেলপ করার জন্য একটার পর একটা শর্ট কোর্স, ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে বা ওঈগঅ তে করে যাচ্ছি।  মাঝে  মধ্যে দু একটা চিঠিতে একটু আসার আলো পেতাম এবং পুনরায় রিমাইন্ডার দিতাম।

জাম্বিয়া থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম, ওরা জানিয়েছিল সময়মতো কাগজ প্রসেস করবে। কিন্তু একটার পর একটা রিমাইন্ডার দিয়ে যাচ্ছি, ‘নো রেসপন্স।’ এই ভাবে একবার নাইজেরিয়ার একটা সিভিল সার্ভিস কমিশন থেকেও পজিটিভ রেসপন্স পেয়েছিলাম। সিভিল সার্ভিস কমিশন আমার কাগজ মিনিস্ট্রি অফ এডুকেশনে ইকোনমিকসের (Economics) টিচার হিসাবে নিয়োগ দিয়ে টিকেট পাঠানোর জন্য লিখেছিলো। তিন বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে আমি এই একটি মাত্র আশার আলো দেখতে পেলাম। তার পরে আরও একটি বৎসর অক্লান্ত প্রচেষ্টা , অনেক কথা, অনেক চেষ্টা, সে দিকে আর যাচ্ছি না।

আমি ১৯৮২ সনে মিনিস্ট্রি অফ ফিনান্স, ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে, বাউচি স্টেট, নাইজেরিয়ায় চাকুরী নিয়ে পরিবার সহ চলে গেলাম। আমাকে আর পিছু তাকাতে হলো না। আমি স্বস্তির নিঃশ^াস নিলাম, এই ভেবে যে একটা বিরাট স্টেপ আমি নিয়েছি। সে অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে, ধাপে ধাপে চেষ্টা করে, আজ কানাডার মতো একটা সুন্দর দেশে আছি। আমি তার চেয়ে আর বেশি কি আশা করতে  পারি? আমার এই লেখা পড়ে কেউ যদি একটু  আশার আলো দেখে, এতেই আমার সার্থকতা। আমার বন্ধুরা অনেকে বাংলাদেশে থেকেও অনেক কিছু করেছে। কিন্তু আমি ও সব নিয়ে আর চিন্তা করছি না।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। কানাডাতে প্রতি বৎসর ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও বিসনেস ক্যাটেগরিতে বহু ইমিগ্র্যান্ট আসে। যারা বিসনেস ক্যাটেগরিতে আসে, এখানে এসে  ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলে, অনেকে কৃতকার্য হয় এবং অনেকে একটার পর একটা পরিবর্তন করে অন্য ব্যবসা দিয়ে বহু চড়াই উৎরাই পার হয়ে এক সময় দাঁড়িয়ে যায়। বাংলাদেশেও কঠোর পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, ইমিগ্রেশন কানাডার ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে দরখাস্ত করতে পারেন। যে ট্রেডে ব্যবসা করতে চান, সে ট্রেডের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের লোকজন অনেকদিন থেকে  কাজ করে আসছে, তারা ইচ্ছা করলে এ সব সুযোগ নিতে পারে। যাদের আর্থিক সচ্ছলতা আছে এবং ব্যবসা শুরু করার মানসিকতা আছে ,তারা নিজস্ব অভিজ্ঞতা দেখিয়ে,বিসনেস প্ল্যান (কি ধরণের ব্যবসা করতে চান) দরখাস্ত করতে পারেন। কানাডাতে ব্যবসা শুরু করার একটা শর্ত, এ দেশে এসে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একজন অথবা অবস্থা বুঝে বেশি কানাডিয়ান নাগরিককে নিজের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ দিতে হবে। ইচ্ছা করলে আপনারা, ও সব দেশে কানাডিয়ান হাই কমিশনে খোঁজ খবর নিয়ে কাগজ প্রসেস করতে পারেন। অনেক দিন পূর্বে আমার এক পরিচিত জন সৌদি আরবে বহু বৎসর কাজ করার পর টাকা পয়সা জমিয়ে এখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খোলার অনুমতি নিয়ে এসে ব্যবসা খুলে ছিলেন। কয়েক বৎসর পরিশ্রম  করে উনি ভালোই করেছেন। টরন্টো এবং তার আসে পাশের শহর গুলিতে আজকাল বহু দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নজরে পড়ে এবং অনেকে ভালো করছে। কেউ কেউ ফার্ম খুলে গরু/ছাগল পুষে বেশ সুবিধা করছেন। আবার কেউ বা কৃষি ফার্ম নিয়ে ভালো অবস্থায় আছেন।

তা ছাড়া এ দেশে দক্ষ শ্রমিক হিসাবেও আসতে পারেন। ফেডারেল বা প্রতিটি প্রভিন্স ও টেরিটোরির নিজস্ব প্রয়োজনীয় ফিল্ডে বিভিন্ন ক্যাটাগরির লোক সারা বৎসর নেয়া হয়ে থাকে। তবে একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে প্রতি দরখাস্ত কারীকে ইংলিশ IELTS টেস্ট দিয়ে মিনিমাম স্কোর পেতে হবে। কানাডার দ্বিতীয় ভাষা ফ্রেঞ্চ, যদি কেউ জানে,তাহলে তার জন্য একটা এক্সট্রা সুবিধা রয়েছে।

কানাডার জব লেটার প্রসঙ্গ:

বাংলাদেশে ছুটিতে গেলে অনেকে প্রশ্ন তুলে যে এ দেশে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে জব লেটার দেয়া হয়। এটা মূলত সঠিক কিনা জানিনা। তার কারণ আমাদের ছাত্র ছাত্রীরা যে ধরণের স্কিল ডেভেলপ করে তা দিয়ে ১% লোকও এ ধরণের জব লেটার পেতে পারে না। আমাদের ছেলে মেয়েদের ইংলিশ টেস্টের (IELTS) কথা বললে ভয়ে দৌড়ে পালায় । আমি দুই একজন কে টেস্ট দেয়ার জন্য এ দেশ থেকে বই পাঠিয়েছি। ওরা টেস্ট দেয়া থাক দূরের কথা, বই খুলেও দেখে নি।

আজকাল কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের যুগ, আপনারা যে যেখানে আছেন ,ঘরে বসে যে কোনো লোক তার নিজস্ব ফিলডে সুযোগ আছে কিনা জানতে পারেন। অন্যের (এজেন্ট) পরামর্শ নিতে হয় না। আমি বার বার এজেন্ট বলছি, তবে এ জাতীয় কাজ করে এমন অনেক ভালো লোকও আছে যারা নির্ভর যোগ্য এবং সঠিক তথ্য দিয়ে থাকে। তবে কে সঠিক, কে বেঠিক তা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। আর কথার ফুলঝুরিতে কারো কাছে বিক্রি হবেন না। আমারই  পরিচিত ছেলে, সে তার বিভিন্ন সোর্স থেকে কিছু টাকা সংগ্রহ করে কোনো এক এজেন্টকে দিয়েছিলো। দুই থেকে তিন বৎসর সে এজেন্ট এই মাসে, পরের মাসে বলে বলে ঘুরিয়ে তাকে বিদেশ পাঠাতে পারে নাই। শেষে অনেক আর্তনাদ করে টাকাটা ফেরত পেয়েছিলো। আমি বললাম,‘ তুমি অনেক ভাগ্যবান।’ এখানে অনেক এজেন্ট আছে যাদের অফিস আমাদের দেশে রয়েছে, তবে ভালো ভাবে যাচাই করে নেবেন। সব চেয়ে ভালো পথ হলো নিজের চেষ্টা নিজে করবেন, এতে ‘হারি জিতি নাহি লাজ’, অন্ততঃ আপনার পয়সা নষ্ট হলো না।

ওয়ার্কার্স ভিসা:

এ দেশে প্রচুর বেকার সমস্যা, ইমিগ্রেশন নিয়ে এসে স্কিল আপগ্রেড করতে হয়। তিন থেকে চার বৎসর ভাষার স্কিলও ডেভেলপ করতে লাগে।  দেশে গেলে অনেকেই এই প্রশ্নটা করে থাকে, কানাডাতে সামার/ওয়ার্কার্স ভিসার সুযোগ আছে কি না। হাঁ,আছে তবে আপনাদের জন্য না। এখানে যত সামার শ্রমিক (seasonal) নিয়োগ দেয়া হয়, ফসলাদির মৌসুম শেষে তাদের চলে যেতে হয়। এরা এ সব লোকদের মেক্সিকো বা দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন নিকটতম দেশ থেকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এ সব কাজের লোকদের দূর দূরান্তের দেশ থেকে নেয়া হয় না। মেক্সিকো থেকে একজন লোক আনতে খরচ অনেক কম লাগে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একজন লেবার আনতে তার কয়েক গুন্ বেশি খরচ পড়ে। এ সব বিবেচনা করে স্বল্পকালীন সময়ের লোক ওরা নিকটতম দেশ থেকে নিয়ে কাজ করায়। তা ছাড়া ট্র্যাক্টর ও অন্যান্য মেশিনারিজ এ সব শ্রমিকরা চালাতে জানে। সব চেয়ে বড়ো সমস্যা হলো, আমাদের দেশের লোক অদক্ষ, হাতে কাজ করে। সে সবও ওরা বিবেচনা করে লোক আনার পূর্বে।

কেউ যদি বলে এতো এতো টাকা দিলে ওয়ার্কার্স ভিসা পাওয়া যায়, খুব ভালো কথা। কিন্তু কি ভাবে? ওয়ার্কার্স ভিসার নিয়ম হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ দেশের পত্রিকায় লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেবে। যদি লোক না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে প্রমাণাদি দিয়ে কানাডিয়ান হাই কমিশনে এমপ্লয়ার এপ্ললাই করবে ‘আমি এই এই কাজের জন্য এই যোগ্যতার লোক পাচ্ছি না, ওমুক দেশের এই লোকের এই যোগ্যতা আছে,তাকে অনুমোধন দেয়া হোক’। এটা প্রমাণ করা অনেক কঠিন। কারণ যে লোক আসবে তাকে IELTS টেস্ট দিতে হবে। ভুল তথ্য দিয়ে টাকা খরচ করবেন,‘আম আর ছালা’ দু’টাই খোয়াবেন। তাছাড়া তাকে ওই কাজের এক্সপার্ট হতে হবে। সব চেয়ে ভালো নিয়ম হলো, দেশে অন্তত চার বৎসর কাজের অভিজ্ঞতা/ স্কিল ডেভেলপ করা এবং তার সঙ্গে ইংলিশ টেস্ট দিয়ে নিজেকে তৈরী করে নেয়া। কানাডাতে সব সময় দক্ষ/শিক্ষিত লোক আসার সুযোগ আছে। আস্তে আস্তে চেষ্টা করুন, এখনই সমুদ্রে ঝঁপিয়ে পড়তে হবে কেন?

কানাডা সরকার সুক্ষ ভাবে বিচার বিশ্লেষন করে এ দেশের আইন কানুন বানিয়েছে এবং তার প্রয়োগের উপর জোর দিয়েছে। কানাডা একটা ওয়েলফেয়ার স্টেট। পৃথিবীতে যুক্ত রাজ্য এবং আরো কয়েকটি দেশে এ প্রথা রয়েছে যেখানে জনগণের সুযোগ সুবিধাকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

এ দেশে যে সব লোক ব্যবসা সংক্রান্ত ভিসা নিয়ে আসতে চান, তাদের জন্য আরও কিছু কিছু তথ্য দেয়া দরকার মনে করছি। এখানে কাজের কোনো শ্রেণী বিন্যাস নাই, যেমন একজন ছোট কাজ করেন , একজন বড় কাজ করেন। এখানে কাজ কাজই, সে দৈনিক মজুর আর অফিসিয়াল কাজ, যাই হোক না কেন? অনেক সময় দেখা যায় একজন দৈনিক মজুর অত্যন্ত নামি দামি গাড়ি ব্যবহার করে এবং তার বিশাল বড়ো বাড়ি আর যে ব্যাক্তি অফিসিয়াল কাজ করে তার গাড়ি নাই, বাড়ি নাই। অথবা পুরানো গাড়ি ব্যবহার করে। যারা কৃষক তাদের অনেক সুন্দর বাড়ি/গাড়ি, তাদের নিজেদের silo (গুদাম ) আছে এবং আমাদের শ্রমিকদের দু’বেলা পেটের ভাত জুটে না। এদের সঙ্গে আমাদের কোনো তুলো না হয় না।

আপনারা ব্যবসায়ী হিসাবে ইমিগ্রেশন নিয়ে আসবেন? এ দেশে  প্রতিটি ছোটোখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে  সরকারের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। সরকারের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ব্যাতিত কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা যায় না।  সে হেয়ার সেলুন ,কাপড় সেলাই মেশিনের দোকান অথবা মুচির দোকান বা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি যাই হোক তাকে সরকারি অফিসে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গুলি প্রতি মাসে কর্মচারী নাম, SIN বা আইডেন্টিটি কার্ড নম্বর সহ, (ক) এমপ্লয়মেন্ট ইন্সুরেন্স বেনিফিট ডেডাক্শন ও (খ) কানাডা পেনশন প্ল্যান  ডেডাক্শন কেটে নিয়ে সমপরিমাণ এমাউন্ট (প্রতিষ্ঠানের মালিককে/employer) যোগ করে সরকারের একাউন্টে জমা দিতে হয়। যেহেতু আপনি বা আপনারা ব্যবসায়ী হয়ে আসবেন তাই আপনাকে এ সম্পর্কে পূর্বে জানতে পারলে ভালো হবে ।

এমপ্লয়মেন্ট  বেনিফিট : মনে করেন আপনি কোনো কারণে কর্মচারীকে আর রাখতে পারছেন না, যদি কোনো কারণে কর্মচারী কাজ হারায়, সে কর্মকর্তার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এমপ্লয়মেন্ট অফিস এ কাগজ জমা দিলে, অফিস কেস ভেরিফিকেশন করে, একটা সার্টেন পার্সেন্টেজে কোনো একটা নির্দিষ্ট সময় পয্যন্ত মাসিক ভাতা দেবে।  এ সময় সীমার মধ্যে সে অন্যত্র কাজ জোগাড় করে নেবে।

কানাডাতে লক্ষ লক্ষ টিচার,সরকারি কর্মচারী/প্রাইভেট চাকুরিজীবীদের সমস্ত চাকুরী জীবনে অনেকের একবার  ও সরকারের কাছ থেকে  এমপ্লয়মেন্ট বা সোশ্যাল বেনিফিট নিতে হয়না। কিন্তু লাইফ লং তাদের বেতন থেকে contribute করতে হয় এবং এর বেনিফিট নিউলী ইমিগ্র্যান্ট বা ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের ক্ষেত্রে কাজে লাগে। সে জন্য অনেকে কটাক্ষ করে বলে যে, ‘আমরা contribute করি আর নিউলী ইমিগ্র্যান্টরা এর সুবিধা পায়।’ কারণ বেনিফিট নিয়ে (Most of the employee)  জব ট্রেনিং বা ইউনিভার্সিটি /কলেজ বফঁপধঃরড়হ আপগ্রেড করার সুযোগ পায়। যারা আমাদের দেশগুলি থেকে ইমিগ্রেশন নিয়ে আসে, তারা সাধারণত: এসব সুবিধা নিয়ে এডুকেশন আপগ্রেড করে এবং নিজের ফিল্ডে চাকুরী ম্যানেজ করে ।

পেনশন প্ল্যান: এখানে অবসরের বয়স : ৬০-৬৫ বৎসর। কর্মচারী সরকারি অথবা বেসরকারি যাই হোক না কেন, সমান ভাবে তার অর্জিত পেনশন অনুযায়ী বাকি জীবনে সুবিধা পেয়ে থাকে, যদি সে ট্যাক্সি ড্রাইভারও হয়, একই হারে সুবিধা পাবে।

এখানে সরকার প্রতিটি মানুষের ইনকামের সোর্স জানতে পারে এবং গোপন করার কিছুই নাই, প্রতিটি লোকের জীবন বৃত্তান্ত সরকারের নখদর্পনে। সিস্টেমকে এমন ভাবে ডেভেলপ করা হয়েছে যে সরকার যে কোনো সময় একটা লোকের আর্থিক, মানসিক ও অন্যান্য বিবরণ বা অবস্থা  জানতে পারে এবং সে ভাবে সাহায্য করতে পারে। এরা এতটা সুন্দর করে সিস্টেম ডেভেলপ করেছে যা প্রশংসার যোগ্য ।

যে জাতি যত বেশি সৎ ও পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি  উন্নত। এখানে-২৫ সেলসিয়াস থেকে -৩০ সেলসিয়াস  ঠান্ডায় মানুষ বরফের মধ্যে রাস্তা পরিষ্কার করে ও কনস্ট্রাকশন এ কাজ করে। এখানে রাস্তার  বরফ পরিষ্কার না হলে গাড়ি চলা চল বন্ধ থাকবে। প্রচন্ড শীতে কেউ ঘরে বসে থাকে না, যার  যেই কাজে চলে যায়। এ দেশে অনেক কল কারখানা ২৪ঘন্টা চলে। যত বরফ হোক না কেন,রাস্তা পরিষ্কার হতে থাকে এবং মানুষের কাজ বন্ধ থাকে না । Good luck.

নজরুল ইসলাম

টরন্টো