আন্তঃবর্ণ বিয়ের মাধ্যমে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ সম্ভব, দম্পতিদের বক্তব্য

বৃহত্তর টরন্টোর দম্পতিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি কীভাবে উত্তরসূরীদের মধ্যে সঞ্চার করবেন সে বিষয়ে সচেতন

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : মিশ্রবর্ণের মধ্যে বিয়েশাদী সফল করতে অনেক প্রয়াসের দরকার হয়, তবে বৃহত্তর টরন্টো অঞ্চলের অনেক মিশ্র বর্ণের দম্পতি বলেন, এটা সব সময়ই সুফলদায়ক।

মাইকেল জোবিন এবং তবিয়াস ওয়াংকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।

ওয়াং তাইওয়ানী-কানাডীয় আর জোবিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কানাডাতেই। জোবিন বলেন, তার কাছে তাদের উভয়ের মিলিত হওয়া এবং তাদের সন্তানের জীবনে ওয়াং-এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্বয় ঘটানো সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে ওয়াং তার নিজের সংস্কৃতির ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতি নন।   

ওয়াং বলেন, ‘আমি যখন এখানে আসি তখন নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে বিদ্রোহ করেই এখানে এসেছি। এটা এমন ছিল যে, আমি চীনা সংস্কৃতি নিয়ে কিছুই করতে চাইনি, কারণ আমার জন্য সেটা কঠিন ছিল। সুতরাং আমি যত দ্রুত সম্ভব উত্তর-আমেরিকার সংস্কৃতি গ্রহণ করে নিয়েছি।’

বাঁ থেকে ডানে: মাইকেল জোবিন, আর্চার, এবং তবিয়াস ওয়াং। এই দম্পতি বলেন, আর্চারের জীবনে তার বাবার তাইওয়ানি ঐতিহ্য সঞ্চারিত করাই তাদের অগ্রাধিকার। (ভানেসা হেইনস)

তাদের ছেলে আর্চারের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তার ওই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়নি।

ওয়াং বলেন, ‘আপনার বয়স যতই বাড়বে, ততই বুঝতে পারবেন আপনার আত্মপরিচয় এবং আবেগের রূপায়নে নিজের শেকড় এবং পরিবার কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’

এখন ওয়াং ও জোবিন তাদের ছেলের জীবনে ওয়াংয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটানোকে নিজেদের লক্ষ্য হিসাবে নিয়েছেন এবং ছেলের বেড়ে ওঠার সময় তাকে বাবার মাতৃভাষা শেখাচ্ছেন আর বিশেষ সাংস্কৃতিক দিবসগুলো পালন করছেন।

এমনকি তারা আর্চারকে একটি চীনা ভাষার ডেকেয়ার বিদ্যালয়েও ভর্তি করে দিয়েছেন। 

জোবিন বলেন, ‘আমাদের ছেলে এখন নিজের জীবনে এবং শিক্ষায় সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রতিদিনই অনেক বেশি সমৃদ্ধ হচ্ছে।’

‘বাচ্চারা তাদের ঐতিহ্যগত পোশাক পরছে এবং গান গাইছে। আর তাদের সংস্কৃতির এই বিষয়গুলি শিখছে এটা দেখতে পারা সত্যিই চমৎকার।’

জোবিন বলেন, ওয়াংয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জোরদার করার সুফল তিনি দেখতে পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানো সব সময় খুব সহজ কাজ নয়, কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ভাষা শেখা আমাদের ছেলের জন্য নিশ্চিতভাবেই একটি বাড়তি কাজ।’

‘আমরা তাকে প্রতিদিনই অব্যাহতভাবে সমৃদ্ধ করার বিষয়টি বেছে নিয়েছি, কারণ, আমরা মনে করি, এটি তার জন্য অসম্ভব রকমের গুরুত্ববহ।’

‘আমার মনে হয়, আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, ওয়াংয়ের ঐতিহ্যের উভয় দিক যতটা সম্ভব গ্রহণযোগ্য করে তোলাই আমার দায়িত্ব। আর এটি অব্যাহত রাখাও আমার দায়িত্ব বলে মনে করি, কারণ, আরেকটি ভাষা জানা ও নিজের ঐতিহ্যের সবকিছু জানা হলো একটি ঐশী দান। আর এজন্যে আর্চারের জীবন আরও বেশি বর্ণাঢ্য হবে।’

এদেশে মিশ্রবর্ণের বিয়ের যে সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা ২০১১ সালের। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সংজ্ঞা অনুযায়ী, মিশ্রবর্ণের মিলন হলো, ‘এমন এক জুটি যেখানে স্বামী-স্ত্রী বা জীবনসঙ্গী দুজনের মধ্যে একজন অশ্বেতাঙ্গ এবং অন্যজন তা নয়। আবার এমন জুটিও হতে পারে যেখানে স্বামী-স্ত্রী বা জীবনসঙ্গীরা দুটি ভিন্ন অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সদস্য।’

তথ্যে দেখা যায়, যেসময় ওই তথ্য সংগ্রহ করা হয় তখন মিশ্রবর্ণের সম্পর্কে জড়ানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিলো জাপানিদের মধ্যে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয় ও চীনারা নিজেদের জনগোষ্ঠীর বাইরে থেকে স্বামী-স্ত্রী বা জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছে সবচেয়ে কম।

মিশ্র বিয়ে নিয়ে পডকাস্ট তৈরি করেছে দম্পতি

কুলবিন্দর শরণ কল্পওয়েল ও তার স্বামী স্কট কল্ডওয়েলের মিলিত জীবনে স্ত্রীর শিখ ঐতিহ্য খাপ খাইয়ে নেয়ার বিষয়টি কখনওই বাঁধা হয়ে ওঠেনি। তবে স্ত্রী বলেন, তারা এটা করেছেন তাদের নিজেদের মত করে।

শরণ কল্ডওয়েল বলেন, ‘সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজটি এক নতুন কায়দায় সম্পন্ন করা ছিলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

‘এটি হলো মূল্যবোধ বাছাই করা ও তা গ্রহণ করা। আর আপনি পরের প্রজন্মের মধ্যে যা প্রতিষ্ঠা করতে চান সেটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।’

শরণ কল্ডওয়েরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়।

তিনি এবং স্কট কল্ডওয়েল বলেন, মিশ্র বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যই নিজেদের পরিবারকে পরস্পরের সংস্কৃতি শেখানোর ব্যাপারে অংশ নেয়া জরুরী। কল্ডওয়েল এমনকি কিছু পাঞ্জাবি শব্দও শিখে নিয়েছেন যাতে তিনি শরণের বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে পারেন এবং তাদের দুটি সন্তানকে ওই ভাষার কিছুটা শিক্ষা দিতে পারেন।

তিনি বলেন, ‘এটি হলো সন্তানের মধ্যে নিজের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদেরকে এটা জানানো যে, এর মধ্যে অহংকার ও আত্মপরিচয়ের বিষয়টি জড়িত।’

সঙ্গীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি খুঁজে বের করুন, বিশেষজ্ঞের বক্তব্য

ইয়াসমিন রফিক একজন সাইকোথেরাপিস্ট এবং বৃহত্তর টরন্টো এলাকার একটি সংস্থা ‘কাপল্স ইন স্টেপ’ এর নিবন্ধিত সমাজ সেবক। তার সংস্থাটি ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় বিশ্বাসের যেসব মানুষ সম্পর্কে জড়িয়েছেন তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। যাদের অনেকেই দক্ষিণ এশীয় পটভূমি থেকে আসা।

তিনি বলেন, যে কোনও দম্পতির ক্ষেত্রেই আশা-আকাক্সক্ষার বিষয়টি সামলে নেয়া জরুরী, কিন্তু ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দম্পতির ক্ষেত্রে জটিলতার আরেকটি স্তর যোগ হয়।

‘আপনার সঙ্গী কীভাবে বেড়ে উঠেছেন এবং তার কাছে কোন জরুরী বিষয় কোনগুলি তা খুঁজে বের করা সত্যি গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, এশীয় পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে, পরিবারের গতিশীলতা ধরে রাখা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়গুলি অত্যধিক জরুরী হতে পারে।

ইয়াসমিন রফিক ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বহু এশীয় পরিবার… আমরা সত্যিই গর্ববোধ করি নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি নিয়ে। আর পরিবারের এই উপাদানটি আমাদের কাছে খুব, খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

‘আমরা আমাদের বাবা-মাকে নিয়ে যথেষ্ট ভাবি; তারা এটা ধরে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেন এবং তা অব্যাহত রাখেন। আর আমাদের সংস্কৃতি বা ধর্মের বাইরে বিয়ে করার বিষয়টি হলো এমন যে, আপনি হয়তো সেই পরিবার হারাবেন যে পরিবারে সামাজিকতার বোধও অত্যন্ত বলিষ্ঠ।’

ইয়াসমিন বলেন, আন্তঃবর্ণ ও আন্তঃধর্মের দম্পতিদেরকে পরস্পরের সম্পর্কে জানা এবং তাদের কাছে গুরুত্ববহ বিষয়গুলি সম্পর্কে জানার জন্য বাড়তি প্রয়াস চালানো জরুরী। এটা তাদেরকে তাদের বাবা-মার কাছে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলি বুঝতে পারা এবং তারা কীভাবে বাচ্চাদের মানুষ করতে চান সেটা বুঝতে সহায়ক হবে।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আন্তঃবর্ণ ও আন্তঃধর্মের দম্পতিদের ক্ষেত্রে অধিকতর প্রয়াসী হওয়াই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।’

সূত্র : কীর্তন শশীশরণ, মঞ্জুলা সেলভারাজা – সিবিসি নিউজ