৯/১১ এর পর থেকে কানাডায় ইসলামভীতি এক ধ্রুব সত্যে পরিণত হয়েছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ : মিজ. সুনেরা থোবানি বলেন, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা ঘটার পর পরই তিনি হত্যার হুমকি পেতে থাকেন।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজের প্রফেসর থোবানি মুসলমান। তিনি ওইসময় আফগানিস্তানে আসন্ন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, যেটি ছিলো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কয়েক দশকব্যাপী যুদ্ধের সূচনা। আফগানিস্তানে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে তিনি ইসলামভীতির মূল নিশানায় পরিণত হন। ৯/১১-এর হামলার পর কানাডাসহ পশ্চিমা জগতের বিরাট অংশে ইসলামভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

মিজ. থোবানি বলেন,  ‘লোকেরা আমার কর্মস্থলে এসে সমবেত হয়, আর আমাকে যাতে বরখাস্ত করা হয় সেই দাবি জানিয়ে লেখা দরখাস্তে স্বাক্ষর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের দপ্তরে পাঠায়।’

‘কিন্তু আমি কখনই পিছু হঠিনি। এইসব আক্রমণ, মুসলমানদের প্রতি এই ঘৃণা ৯/১১-এর পর থেকে কানাডার রাজনৈতিক জীবনে এক ধ্রুব সত্যে পরিণত হয়েছে।’

পরিসংখ্যান ও সমীক্ষার তথ্যে দেখা যায়, ২০০১ সালের পর থেকে কানাডায় ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধও বিপুলভাবে বেড়েছে। আর ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের অভিযোগের সংখ্যায় কমবেশি হতে দেখা গেলেও গত ২০ বছরে তা কখনই ৯/১১-এর আগের পর্যায়ে নামেনি।

‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ বছরগুলো

গবেষকরা উদ্ধৃত করেন কানাডার ইসলামিক কংগ্রেসের ২০০৩ সালে প্রকাশিত এমন একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ৯/১১-এর পরের মাত্র এক বছরের মধ্যে কানাডায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত হামলা কত দ্রুত বেড়ে যায়।

রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০২ সালে ওই গ্রুপের কাছে ১৭০টিরও বেশি হেট ক্রাইমের ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ আসে। ২০০০ সালে এধরণের অপরাধের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১টি। তার মানে হলো, মাত্র দুই বছরের মধ্যে হেট ক্রাইমের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার শতাংশ বেড়ে যায়।

থোবানি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সতিকারের অনুভূতি এমন ছিলো যে, সন্ত্রাসীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।’ ‘কানাডাসহ গোটা পাশ্চাত্যেই এই অবস্থা বিদ্যমান ছিলো।’

ওই হামলা কানাডাকে জোরালো নিরাপত্তা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। কানাডার আকাশসীমা পরবর্তী বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাস করে।

পরের বছর কানাডা একটি আন্তর্জাতিক জোটে যোগদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ওই জোট আফগানিস্তানের আল-কায়েদা সন্ত্রাসবাদী গ্রুপকে ধ্বংস করা এবং ক্ষমতাসীন তালেবান শাসকদের উৎখাতের জন্য সেদেশে সৈন্য পাঠায়। সে সেময় সংখ্যাগরিষ্ঠ কানাডীয় নিজ দেশের সামরিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সমর্থন জানায়, যদিও তা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মত ব্যাপকভিত্তিক ছিলো না।

থোবানি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সরকার আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশের পক্ষে যে যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে অর্থাৎ তারা তালেবানী শাসকদের নিবর্তনমূলক শাসন থেকে আফগান নারী ও মেয়েদের মুক্ত করার জন্য সেদেশে যাচ্ছে: অংশত সেই যুক্তির কারণেও মুসলিমবিরোধী মনোভাব তীব্র হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, ‘সে সময় আমরা যা দেখেছি সেটা হলো, ইসলামভীতি একটি লৈঙ্গিক পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য হয়ে উঠেছে। এটি মুসলিমদের (পুরুষ) সম্পর্কে বিরূপ ধারণা উস্কে দিয়েছে এবং একইসঙ্গে মুসলিম নারী ও মেয়েদের সম্পর্কেও আচরণকেও। সেই বিরূপ আচরণ আর কখনও বন্ধ হয়নি। ৯/১১-এর পর থেকে এই ব্যবধান আরও বেশি বড় হয়ে উঠেছে।’

কানাডিয়ান কাউন্সিল অন ইসলামিক রিলেশন্স যা এখন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস (NCCM) নামে পরিচিত – ২০০২ সালে এক সমীক্ষায় দেখতে পেয়েছে যে, কানাডার মুসলমানদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ৯/১১-এর হামলার পর ‘পক্ষপাত অথবা বৈষম্যের’ শিকার হয়েছেন। এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান সংস্থাকে জানিয়েছেন, ওই দিনের পর তাদের জীবনযাপন কঠিনতর হয়ে পড়েছে, তারা অনুভব করছেন যে, কানাডীয়রা তাদের অপছন্দ করছে।

NCCM-এর যোগাযোগ সমন্বয়কারী ফাতেমা আবদাল্লা বলেন, ‘ওই সময় থেকে বিষয়টি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। আর এই সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ব্যাপারটা কেবল যে বাড়ছে তা-ই নয় এটি বহুগুনে বিবর্ধিত হচ্ছে।’

২০১০ এর দশকে বৃদ্ধি

পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হেট ক্রাইম সম্পর্কে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়কালের তথ্য-উপাত্ত হলো সবচেয়ে পরিপূর্ণ। এতে দেখা যায়, ২০১০-এর দশকের প্রথমার্ধে কানাডায় মুসলিমবিরোধী হামলার ঘটনা ধীরে হলেও নিরবচ্ছিন্নভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে হামলার ঘটনা ছিলো ৩৬টি, সেখানে ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯টিতে।

২০১৫ সালে হঠাৎ করেই মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ১৫৯টি হেট ক্রাইমের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে এটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং আগের বছরের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেড়ে হেট ক্রাইমের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪৯টিতে। এর আগের বছর ২০১৬ সালে এ ধরণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয় ১৩৯টি।  

কানাডার হেট ক্রাইমবিরোধী নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক ইভান বলগর্ড বলেন, ওই সময়ের মধ্যে আধুনিক ইসলামবিদ্বেষী আন্দোলনের (modern Islamophobic movement) বীজ দৃশ্যমান হতে শুরু করে।

তিনি বলেন, ‘এর প্রথম বাস্তব প্রতিফলন ঘটে ১০৩ নং প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অনুষ্ঠিত জমায়েতের মধ্য দিয়ে।’ ১০৩ নং প্রস্তাব ছিল পার্লামেন্টে ২০১৬ সালে উত্থাপিত এবং পরের বছর পাস হওয়া একটি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব যাতে ইসলামোফোবিয়ার নিন্দা করা হয়।

বলগর্ড বলেন, ‘তখন থেকে আমরা যা কিছু দেখতে পাচ্ছি সেগুলো বিকশিত হয়েছে ওই ঘটনা থেকেই: সরকারবিরোধী, বামপন্থাবিরোধী অভিজাত বিরোধী দল যা বিবর্তিত হয়েছে ইয়েলো ভেস্টে এবং এই সবগুলো অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপেরই … ভিত্তি হলো মুসলিমবিরোধী ঘৃণা, যখন জাতিগত অধিকারের প্রশ্ন সামনে আসে।’

বলগর্ড অন্যান্য উস্কানীমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়েও উল্লেখ করেন যার মধ্যে রয়েছে, ২০১৫ সালের নির্বাচনের সময় স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ সরকারের পক্ষ থেকে ‘বর্বর সাংস্কৃতিক অনুশীলনের হটলাইন’ প্রতিষ্ঠার শপথ ঘোষণার বিষয়টি। এই ঘোষণা মুসলিমবিরোধী মনোভাবকে পরিপুষ্ট করেছে বলে অনেকে সমালোচনা করেছেন। ওই পদক্ষেপই ২০১৩ সালে কুইবেকে মূল্যবোধের সনদ গ্রহণের পথ করে দেয় যাতে সরকারি কর্মচারীদের ধর্মীয় প্রতীক যেমন হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়।

বলগর্ড বলেন, ‘এই সমস্ত অনুভূতির পক্ষে যেসব বয়ান দেয়া হচ্ছে তার পেছনে রয়েছে একটি বিশাল ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, আর সেটি হলো, মুসলমানরা পাশ্চাত্যে অনুপ্রবেশ ঘটানো এবং শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর চেষ্টা করছে, কিংবা তারা অন্তত পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছু রাজনীতিক আবার এতে ইন্ধন যোগাচ্ছেন।’

২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কানাডার ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক কিছু হামলার ঘটনা ঘটে মুসলমান ও তাদের উপাসনালয়ের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ছিলো, ২০১৪ সালে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং ২০১৫ সালে অন্টারিওর পিটারবরোতে মসজিদে অগ্নিসংযোগ।

এসব হামলার সবগুলোকেই চূড়ান্তভাবে ছাড়িয়ে যায় ২০১৭ সালে কুইবেক সিটিতে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার ও মসজিদে গুলি চালিয়ে ছয়জন মুসলমানকে হত্যা এবং ১৯ জনের বেশি মুসলমানকে জখম করার ঘটনা। 

এই পুরো সময় ধরে, মুসলিম নারীরা Ñ যারা হিজাব বা নেকাব পরার কারণে সহজেই দৃশ্যমান টার্গেটে পরিণত হনÑ সারা দেশেই শহরগুলোতে আক্রান্ত হন। হামলাকারীদের অনেকে মুসলিম নারীদের হিজাব টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করে অথবা ছিঁড়ে ফেলে।

ঘঈঈগ-র আবদাল্লা বলেন, সামাজিক গণমাধ্যমের উত্থানের ফলে হেট গ্রুপের গঠন, বিকাশ ও হামলার পরিকল্পনা করার বিষয়গুলি সহজতর হয়েছে এবং তারা নতুন নতুন লোকদের কট্টরবাদী করে তুলছে। এ থেকেই হেট ক্রাইমের সাম্প্রতিক উত্থানের বিষয়টির ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব।

মিজ. আবদাল্লা বলেন, ‘এ কারণেই আমরা অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানাই, নির্দিষ্ট করে যখন আমরা দেখেছি যে, কুইবেক সিটির মসজিদে গুলি চালনায় উদ্বুদ্ধকরণে মূলত জড়িত ছিলো সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইন ফোরামগুলো। এক্ষেত্রে আমরা কিছু অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল।’

ইসলামভীতি জোরালোভাবেই বিদ্যমান

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার অতি সাম্প্রতিক উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট হওয়া অপরাধের সংখ্যা গত তিন বছরে সামান্য কমেছে। এটি ঘটেছে ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝিতে যেসব হামলা হয়েছে তার পরবর্তী প্রচারণা ও সচেতনতার জোয়ারের পাশাপাশি। কিন্তু তার পরও এই সংখ্যা এখনও ৯/১১-এর পরের বছরগুলির শুরুর দিকের চেয়ে অনেক বেশি।

২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১৪০টির বেশি হামলার ঘটনার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারিকালে হেট ক্রাইমের পরিমাণ সার্বিকভাবে বাড়ার পরও গত বছর মুসলিমদের বিরুদ্ধে হামলার সংখ্যা ২০১৩ সালের পর সর্বনিম্নে নেমেছে। গত বছর মোট ৮২টি হামলার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়।

মুসলিম নারীদের ওপর একর পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে এডমন্টন শহরে। সেখানে মসজিদগুলি এখনও হুমকির মুখে রয়েছে। গত সপ্তাহে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ল্যাঙলিতে একটি মসজিদে হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিটিতে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চের মসজিদে ২০১৯ সালে যেভাবে গুলি চালিয়ে ৫১জন নামাজরত মুসলিমকে হত্যা করা হয়, ঠিক সেইভাবে গুলি করা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি মুসলিম কমিউনিটির নেতাদের সঙ্গে এক শীর্ষ বৈঠকে কানাডার সরকার অনলাইনে ঘৃণা প্রচারের বিষয়সহ এর বিরুদ্ধে অধিকতর প্রচারণা ও সচেতনতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে আরও অনেক কিছু করার দরকার আছে।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর থোবানি বলেন, ‘এসব হলো সাময়িক সমাধান। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী তুলে আনা ও কানাডায় উদ্বাস্তুদের পাঠানোর পর, এখনই সক্রিয় হয়ে ওঠার এবং পরিবর্তন আনার সময়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কেন আফগানিস্তান যুদ্ধে জড়িয়েছি সে বিষয়ে সততার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে না পারা পর্যন্ত আমাদের সম্প্রসারিত সীমান্ত নীতি অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের সঙ্গেই সাজুয্যপুর্ণ। আমরা এখনও ওই ধরণের হামলা ও হুমকি দেখতে থাকবো।’

সূত্র : সিন বয়নটন / গ্লোবাল নিউজ