প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮৭
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
‘কোনদিন ভালবাসা পেলে ফেরাবো না আর
ফেরাবো না আর
চাঁদের আলোয় আবছা অন্ধকার মাখামাখি করে
জোনাক জলা রাতে মেঠো পথে
হাত ধরা ধরি করে বাড়ি ফিরে যাবো
বাড়ি ফিরে যাবো
ভালবাসা বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো
ভালবাসা পেলে ফেরাবো না আর!!!
একদম সঠিক সময়েই ইটালী’র ‘রোম’ এ অবতরণ করেছি। আমাদের হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে আস্তে আস্তে, লোকদের মুখে শুনে শুনেই ট্রেন স্টেশনে চলে গেলাম। খুব বেশী দূর না। তবে আামার জন্য কিছুটা দূর। এখান থেকে আমাদেরকে মূল শহরের দিকে যেতে হবে। এয়ারপোর্ট সাধারণত মূল শহর থেকে কিঞ্চিত দূরে থাকে। এই ট্রেন স্টেশনের নাম, ‘লিওনার্দো’ (এটা আমাদের টরন্টোর ইউনিয়ন স্টেশনের মত)। টিকিটের দাম যথেষ্ট বেশী-৬০ ইউরো। তবে এটা আগইে বলেছি আমাদের ‘গো’ ট্রেনের মত। এবং এই ট্রেন টা এক্সপ্রেস। আমাদের টরন্টোর ‘গো’ ট্রেন যেমন সকাল এবং বিকালে (অফিস টাইমে) এক্সপ্রেস থাকে। অতপর আমরা ‘রোমা টেরমিনি’ স্টেশনের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠে বসলাম। ট্রেন বেশ ছিমছাম এবং পরিষ্কার।
ইটালীতে নামার পর থেকে বিস্ময়ের অবধি নাই। কোথাও ইংলিশ লেখা নাই। কি যন্ত্রণা! তার মানে আমরাই কেবল জানি ইংলিশ, ইন্টারন্যাশনাল ভাষা, এরা জানলেও মানে না। অথচ গোটা ইটালীর বেশীর ভাগ সিটিতেই টুরিস্ট গিজ গিজ করছে।
ট্রেন চলতে শুরু করতেই মনটা ভীষণ আনন্দে ভরে গেল। যেন হঠাৎ-ই মনে পড়ে গেল, ‘রোমা টেরমিনি’-তে আমার নয়নের মনি দাঁড়িয়ে থাকবে। হ্যাঁ, আমাদের বড় ছেলে রায়হান আমাদের রিসিভ করবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। অবশেষে, রায়হান ‘স্পেন’ এ তার অফিসিয়াল ট্যুর শেষ করে আমাদের সাথে ইটালীতে জয়েন করতে যাচ্ছে। লন্ডনে যখন এসেছিলাম একসাথে, তখনই এসব পরিকল্পনা ঠিক হয়েছিল। ছেলে দূরে চলে যাবার পর থেকে এমনই হয়। যতই দেখি যেন আস মেটে না। আমার মনে হয় একমাত্র মা/বাবাই এটা বুঝবে। যাইহোক প্রায় ১ ঘন্টা পর ‘রোমা টেরমিনি’ স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। বিশাল স্টেশন। এত মানুষ, গিজ গিজ করছে। তবুও দূর থেকেই আমার ছেলেকে চিনে নিলাম। কাছে যেতেই ব্যাগ নিয়ে বাপীকে আর আমাকে ‘হাগ’ দিল। তারপর দুই ‘ক্যারি অন’ নিয়ে রায়হান হাটা শুরু করলো। আমাদের হোটেলটি একটা বিখ্যাত জায়গাতে। যেখানে টুরিস্টরা একবার হলেও যাবেই। বিশাল হোটেল। এটার নামটি মজার। ‘Town House Fontana Di Trevi’ – যদিও এটি কোন টাউন হাউজ নয়। আমাদের জন্য সব জায়গাতে আমার ছেলে একটি ‘স্যুইট’ ভাড়া করেছে। আর নিজের জন্য সিঙ্গেল রূম। কতবার বলেছি জাস্ট ডাবল রূম নিলেই হতো। কিন্তু এই ভাবেই ছেলে বউ ক্যাথেরীন সর্বত্র ঠিক করেছে। হোটেলে ঢুকতেই একটু পর যখন তিনতলার লবিতে হাটছি, দেখি লাইট বন্ধ হয়ে গেল। আমি চিল চিৎকার। ম্যানেজার ছুটে এলা। তারপর সরি বলে বললো, এখানে এরকম, প্রতি এক ঘন্টা পর এক মিনিটের জন্য কারেন্ট অফ হয়ে যায়। এ আবার কি? একটু পর পর নিয়ন বাতি আছে। ওটা টিম টিম করছে। এত বড় হোটেল ঐটুকু নিয়ন বাতি যথেষ্ট নয়।
যাইহোক, আমরা যার যার রূমে যেয়ে পরিষ্কার হয়ে কাপড় চেঞ্জ করে আবারো বের হলাম। হোটেলের শেষ সীমানাতেই পৃথিবী বিখ্যাত ‘ফন্টানা দি ট্রেভি’। আমাদের হোটেলটি এর গা ঘেষে। নীতে নেমেই দেখি ডান হাতেই ফন্টানা দি ট্রেভি। টুরিস্ট গিজ গিজ করছে। আমরা এসেছিলাম পিছন দিক দিয়ে। তাই তখন চোখে পড়েনি। আমাদের নায়েগ্রা’র মত এখানেও লোহার প্রাচীর দিয়ে রেখেছে। বিশাল একটা রাজপ্রাসাদ-হালকা হলুদ (বেজ কালার) রঙের যার সামনেই এই ফাউন্টেন। প্রাসাদটি তিনতলা বিশিষ্ট। সামনের প্রতিটি খিলানে অসাধারণ সব স্ট্যাচু। সব বীর প্রতিক। এবং মাঝখানের যে বীর দান্ডায়মান তার পাদুকার নীচ দিয়ে এই গাঢ় নীলাভ পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানির রঙটি অসাধারণ। ফিরোজা রঙের। বেশ জোরে জোরে শব্দ হচেছ। এত মানুষ যে ফাঁক গলিয়ে প্রাচীরের কাছে যাওয়াই সমস্যা হচ্ছিল। যাইহোক আমার লম্বু পুত্র একটু জায়গা করে দিল। বিশাল একটা নামফলকের পাশেই। এটি ১৭৬২ সালে নির্মিত হয়েছিল (দেখে বোঝার উপায় নাই, এতটা চাকচিক্য প্রাসাদটির)।
এটির ডিজাইন করেছিল স্থপতি নিকোলা সালভি। এবং পরবর্তীতে জুসেপ পান্নিনি এবং তার বেশ কয়েকজন সহযোগী দ্বারা সুসম্পন্ন হয়েছে। এই ‘ফন্টনা দি ট্রেভি’ ৮৬ ফুট (২৬.৩ মিটার) উঁচু এবং ৪৯.১৫ মিটার (১৬১.৩ ফুট) চওড়া। এটি রোমের বৃহত্তম ফোয়ারা এবং বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ফোয়ারা।
এটি দেখতে দেখতে যথেষ্ট পরিমানেই আমরা ক্ষুধার্ত হয়েছিলাম। আমরা আমাদের হোটেলের পাশেই বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট আছে, তার মধ্যে ভাল দেখে একটিতে ঢুকে পড়লাম। এটি যেহেতু কোন মুসলিম হোটেল নয়, অতএব আমরা তিনজনই প্লেন ভেজি পাস্তা অর্ডার করলাম। ওরা আবার স্টাটার হিসাবে তিন জনকে পটেটো ফ্রাইস দিয়ে গেল। এবং এই ফ্রাইসটাও বেলজিয়ামের মতই মনে হলো। এদের ফ্রাইস এত সুন্দর যে শুধু একটা খেলেই আমার লাঞ্চ বা ডিনার হয়ে যায়। পরিবেশটাও খুব সুন্দর। এবং এদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। যাইহোক আজ আমাদের টার্গেট ছিল মোটামুটি কাছে পিঠে যা কিছু তার কিছু দেখবো। আগামীকাল সকাল ৯/১০টার মধ্যেই আমাদের টুরিস্ট গাইড ‘এ্যানা’ চলে আসবে। আমরা মুটামুটি যেখানে যেখানে গিয়েছি, সেখানেই একজন টুরিস্ট গাইড ছিল। টুরিস্ট গাইড ছাড়া নিজে নিজে যত কিছু দেখবেন, আপনি মজা পাবেন না। কারণ যা কিছু দেখবেন না কেন গাইডরা তার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ জানাবে। লন্ডনে ছিল বাবু, প্যারিসে নিকোল, বেলজিয়ামে মিঠু এবং ইটালীতে এ্যানা। এই মেয়েটি বছর পাঁচেক আগে কানাডায় ছিল। ওখান থেকে এমএস করে আবার নিজের দেশে চলে এসেছে। এখানেও আবার এমএস করছে। পার্টটাইম জব হিসাবে বেছে নিয়েছে টুরিস্ট গাইড এর চাকরীটা। যাইহোক আমরা আশপাশে বেশ কিছু আউটলেট মলে ঘুরলাম। ছবির কালেকশন দেখলাম এরপর রাত সাড়ে আটটার মধ্যে আউটলেট মলের মধ্যে পিজ্জার দোকানে দাঁড়িয়ে পিজ্জা খেলাম। রাত সাড়ে ৯টা মধ্যে হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিনের অপেক্ষায় রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল ৭টার মধ্যেই রেডি হয়ে বের হলাম। নীচে নেমে আগের দিনের ঐ রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে নিলাম। তারপর আমরা হন্টন শুরু করলাম। আমাদের টুরিস্ট গাইড আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, কোন একটি জায়গায় যেটা রায়হান জানে। ৯টার আগেই পৌঁছে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখি একটি দীর্ঘাঙ্গিনী তনুলতা, নীল জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে আছে। হাই, হ্যালোর পরই কথা বলা শুরু করলাম। এ্যানা একদম ঝরঝরে ইংরেজী বলে, যদিও তার উচ্চারনে এখনো ‘ত’ এর ভাব রয়ে গেছে। ভীষণ মিষ্টি মেয়ে। মূহূর্তের মধ্যেই মনে হলো, হাজার বছরের সখ্যতা। মূলত ওকে আমাকে ধরে নিয়ে হাটার জন্যই হায়ার করা হয়েছে। আমার ওয়াকার নিয়ে হাটার কথা। কিন্তু আমি সেটা অগ্রহ্য করে একাই হাটবার মনস্থ করেছি। আমার সার্জন বলেছে মনোবলটাই আসল। আমি নিজেও সেটা প্রবল ভাবে বিশ^াস করি। তাই এই পদক্ষেপ নিয়েছি। যদিও এ্যামা সত্যিই আমাকে চলার পথে একটি মুহুর্তের জন্যও বাহু বা হাতটি ছাড়লো না। এখন আমাদের গন্তব্য Pantheon’.
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে গেলাম। প্রচুর মানুষ ভিতরে এবং বাইরে। বাইরে সাবাই ছবি তুলছে। বাপরে, এর উচ্চতা দেখতে দেখতে আমার ঘারে ব্যাথা। একদম বাইরে থেকে মনে হবে ৭/৮ খিলান বিশিষ্ট একটি গীর্জা বা মন্দির। কিন্তু ভিতরে গেলে ভুল ভাঙ্গবে। ‘প্যানথিয়ন’ দুই হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে রোমের গৌরবের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্যানথিয়নের গল্প জনমনে অবিচ্ছেদ্যভাবে রয়েছে যুগ যুগ ধরে। আগ্রিপ্পার দ্বারা নির্মিত প্যানথিয়ন ২৫ থেকে ২৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে যা কিনা বারো দেবতা এবং জীবিত সোভরালকে উৎসর্গ করা একটি মন্দির।
ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, এই ভবনটি ১১৮ থেকে ১২৫ খ্রিষ্টব্দের মধ্যে হ্যাড্রিয়ানের আমূল পুনর্গঠনের ফল। এটি একটি অসাধারণ ভবন যা কিনা শতাব্দি ধরে অক্ষত আছে।
এখান থেকে বের হয়েই খুব বেশী দূরে নয়, আমরা PIAZZA DI SPAGNA : THE SPANISH STEPS’ রোমের একটি বিখ্যাত স্পটে গেলাম। এটি ১৭২৩ থেকে ১৭২৫ এর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে এটা স্থপতি ‘ফ্রান্সেসকো ডি’ সানকটিসের মূল প্রকল্প অনুসারে স্প্যানিস দূতাবাসের সাথে সংযুক্ত করার পাশাপাশি একটি মিলনস্থান করেছিল। বৃহৎ ভবনে নানারকম প্রতিকী স্থাপন রয়েছে। আসলে এটি ১৫৯৮ সালে টাইবার নদী যখন উপচে পড়েছিল বন্যার কারণে, প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল, চলমান নৌকা উল্টে মানুষ হত হয়েছি। এটি
সেই সময়কে স্মরণ করে, সহজভাবে ডিজাইন করেছে এমন ভাবে যেন এটি রাস্তার স্তরের নীচে অবস্থিত। এবং এটি অর্ধেক ডুবে গেছে। আমি নীচে দাঁড়িয়ে এবং একটু চারপাশ ঘুরে এর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রোমের প্রায় সব দ্রষ্টব্য স্থান গুলো অতিকায়। বিশালতায় এবং উচ্চতায়। আমার জন্য খুবই টাফ ছিল।
যদিও রাস্তায় যখন হাটছিলাম, আমার হাসি পাচ্ছিল। রাস্তাগুলো বেশ ছোট ছোট। গাড়িগুলো রীতিমত মিউজিয়ামে রাখার মত ছোট। নর্থ আমেরিকানদের কাছে সত্যি মজার, এত ছোট ছোট গাড়ি। কারণ যেন, তেল কম লাগে। বিদ্যুতের কথা আগেই বলেছি। প্রতি ঘন্টা পর ১ মিনিটের জন্য কারেন্ট অফ হয়ে যাবে। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোতে এই নিয়মটি মানলে ভাল হতো।
আমি সুদূর ইটালীর রোমে বসে বাংলাদেশের কথা ভাবছিলাম। একেই বোধ হয় বলা হয় দেশ মাতৃকার টান। (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।
gulshanararina@gmail.com