প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮৬

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান


(পূর্ব প্রকাশের পর)

বেলজিয়ামে যাবার বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম কারণ ছিল এর একটি বিশেষ শহর দেখা। ব্রুজেস। ফেলন এর মিউজিয়াম দেখে বেশ রাতে ফিরেছি। তারপর ডিনার করেই ঠিক হলো, আলোচনার ভেতরে, যে কাল একটি সকাল সকাল বেরুতে হবে। ব্রাসেলস থেকে দেড়/দুই ঘন্টার পথ ব্রুজেস।
পরদিন বেশ ভোরে নাস্তা রেডী করে সবাইকে ডেকে খাওয়ালাম। নিজেও চট করে খেয়ে নিয়ে, রেডী হয়ে নিলাম। আজ আবার আমাদের সাথে মিঠুর মেয়ে যাবে। জয়া আলম। খুব মিষ্টি মেয়ে। একটিই সমস্যা, ইংরেজী একদমই জানে না। ছেলে স্বাধীন একটু বলতে পারে। অতএব জয়া গেলেও আমি মোটেই উদ্বেলিত নই। কথা বুঝি না। যাইহোক, আমরা রওনা দিলাম নটার মধ্যে। পথে যেতে যেতে মিঠু বললো ‘আজ বেলজিয়ামের একটা বিখ্যাত খাবার খাওয়াবো।’ পথের অনেক কিছু দেখতে দেখতে মিঠু ধারা বর্ণনা করে গেল।
অবশেষে প্রায় দুই ঘন্টা হাইওয়েতে চালিয়ে বেলজিয়ামের উপকণ্ঠে একটি বিখ্যাত শহরে এলো। ব্রুজেজ।
কথিত আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিষ্ঠুর অধিপতি হিটলার দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধেও সময় যখন সারা পৃথিবীতে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছিলেন, এবং চরম নিষ্ঠুর খেলায় মত্ত হয়েছিলেন তখনও তিনি তার সেনাপতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন ব্রুজেস, প্রাগ এইরকম কয়েকটি শহরে যেন বোমা নিক্ষেপ না করা হয়।
পৃথিবীর কয়েকটি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী শহরের মধ্যে ব্রুজেস অন্যতম। West Flanders in the northwest Belgium এর রাজধানী এই Bruges .
আমরা যখন পৌছালাম সূর্যটা বেশ মাথার উপওে উঠে গেছে। খুব বড় শহর নয়। লোক সংখ্যাও খুব বেশী নয়। মাত্র ১১৭,২৬০। তবে টুরিস্টদের দেখবার মত। এখানকার দ্রষ্ট্রব্য সব জায়গা গুলোতেই বিশাল লাইন। শহরটা যে কত পুরাতন তার প্রকৃত হিসাব ঠিক ঠাক কেউ বলতে পারে না।
তবু ১৩/১৪ সেঞ্চুরীর একটি শহরে পা রেখে কেমন অদ্ভূত একটা অনুভূতি কাজ করছিল। সব থেকে মজার ব্যাপার যে, ব্রুজেস গেলে আপনাকে নতুন করে কোন মিউজিয়ামে যেতে হবে না। গোটা শহরটাই মিউজিয়াম। অথবা আপনাকে কারো কাছে জেনে নিতে হবে না যে, এটা কতটা পুরাতন শহর?? এই শহরে পা রেখেইে আপনি নিজেই অনুধাবন করতে পারবেন। চলার পথ আপনাকে প্রথমত বলে দিবে। রস্তার প্রতিটি ইট এর সাক্ষী। ইউরোপের পুরানো শহরের (ইটালীতেও দেখেছি) একটি মজার বৈশিষ্ট্য, এদের রাস্তাগুলো কংক্রিটের নয়। ব্রীকের। সেটাও তথাকথিত আমাদের দেখা সাধারণ ব্রীক (ইট) নয়। এগুলো ৪ ী ৩ ইঞ্চির মত সাইজ। সবগুলো রাস্তাই এই ব্রীক দিয়েই তৈরী। ব্রুজেজ শহরেও তাই। এখানকার রাস্তায় পা রেখেই বুঝে যাবেন যে এটা ১০০০/১৩০০ সেঞ্চুরির রাস্তা। অথবা কারো মতে ৮০০ সেঞ্চুরীর। কারণ চলার পথের এই ব্রীকগুলো কালো হয়ে গিয়েছে। এবং রাস্তাগুলো অসমান। এমনকি কোন কোন ব্রীক বসে গিয়েছে ১ থেকে ২ ইঞ্চির মত। আমাকে রীতিমত নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাটতে হচ্ছিল। এই শহরের মানুষের মূল প্রফেশন হলো, মাছ ধরা। এমনকি কিছু কিছু ট্যুরিস্টও শখের বসে এটি করছে। অর্থাৎ টুরিস্টরাও মাছ ধরছে।

ব্রুজেজ এর লেকের সামনে লেখক


ব্রুজেজ শহরটা আপনাকে দেখতে হলে হেটে হেটে দেখতে হবে। অথবা গোটা শহরেকে ঘিরে আছে পানি (লেক)। আপনি হাটতে না চাইলে নৌকায় করে গোটা ব্রুজেজ শহরকে প্রদক্ষিণ করতে পারেন। নৌকাতে বসেই গোটা শহরকে দেখতে পারবেন এবং জানতেও পারবেন। প্রতিটি বোটের চালকই হলো একজন টুরিস্ট গাইড। তার ধারা বর্ণনায় এই শহরের সমস্ত পুরাতন ইতিহাস আপনার জানা হয়ে যাবে। আমরা এক থেকে দেড় ঘন্টা হাটাহাটি করলাম। অতপর নৌকায় উঠবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথেই মিঠু বললো, আপনারা আসেন। জয়া নিয়ে আসবে আপনাদের। মিঠু আর নাই। একেবারে হাওয়া। আমরা আস্তে আস্তে ঘাটে এলাম। দেখি বিশাল বিশাল দুইটা লাইন। একটি টিকিটের অন্যটি নৌকায় উঠবার। এখানে প্যারিসের মত ক্রুজ নয়। অনেকটা স্পীডবোটের মত। তবে আকাওে বেশ বড় এই বোট গুলো। বেশ বড়। প্রায় ২০ জনের মত মানুষ ধরে যাবে এই বোটে। মিঠু টিকিট সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়েছে।
এখানে আসবার জন্য সব থেকে সুবিধাজনক আবহাওয়া এবং সময় হলো জুন মাস থেকে আগস্ট মাস। মানে সামার। অথচ এখান মিডল ডিসেম্বর, কিন্তু এত ভিড় যে বিশাল বিশাল দুইটা লাইন। একটা লাইনে মানুষ টিকিট কাটছে, অন্য লাইনে সবাই লাইন দিয়ে নৌকায় উঠছে। অতপর আমরাও লাইনে হেটে হেটে বোটে উঠলাম। আমাকে ধরে ধরে উঠালো মিঠু এবং আমার স্বামী। নৌকা ছেড়ে দিল। ছাড়ার আগে বোটম্যান বা গাইড একটা আধা ঘন্টার লেকচার দিল ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ এ। যেতে যেতে সব শুনছিলাম এবং দেখছিলাম। বাড়িগুলো দেখে রীতিমত শরীর ছমছম করছিল। হাজার বছরের পুরানো ঘর বাড়ি। সারা পৃথিবীতে কত জায়গাতে নৌ-বিহার করলাম। কিন্তু এরকম শরীর ছমছম করেনি। আমার বারবার মনে হচ্ছিল, এখুনি পানি ঘেষে উপরে উঠে যাওয়া বাড়ীগুলো হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে। পানির মধ্যে একটুখানি আবার ছোট্ট একটা দ্বীপের মত আছে। ওর মধ্যে বিশাল ঝাকড়ানো কি একটা গাছ নাম না জানা। হাজার বছর আগের। হায় আল্লাহ, দেখেই ভয় ভয় করছিল। তবে একই সাথে দারুন একটা এক্সাইটমেন্টও কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল ঐ হাজার বছর আগে আমি চলে গেছি। আমার আশপাশের সব ঐ সময়কার মানুষ, আমি তাদের মধ্যেই বিচরণ করছি। এরা আনেকটা সময় ঘরলো। অনেক্ষণ পর ঘাটে এলাম। প্রায় সাড়ে তিনটার মত বাজে। ক্ষুধায় অবস্থা খারাপ। এখানকার বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং পিজ্জা। আগেই ঠিক ছিল ঐটাই খাবো। মিঠু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর কথাই বলছিল।
তারপর পিজ্জা হাটে গেলাম। ওহ! আল্লাহ ওখানে দেখি মাইল খানেক লম্বা লাইন। যাই হোক লাইনে তো দাঁড়ালাম। কিন্তু আমিতো খুব বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারি না। যাই হোক জয়া সম্ভবত ওর বাবা কে ফ্রেন্স এ বলেছিল যে, ‘ফুপির কুব কষ্ট হচ্ছে’। ওদের কথা কথোপকথন শুনে সামনের একজন ছেলে হাঁকডাক করে আমাদের একদম ভেতওে ঢুকিয়ে দিল। এখানে ‘ buffet’ সিস্টেম। যতখুশি পিজ্জা, ফ্রেঞ্চফ্রাই এবং গারলিক স্টিক খাও। সেই সাথে ৩/৪ রকমের কোল্ড ড্রিংকস। সব ফ্রি, যত খুশী খাও। সত্যি এখানকার পিজ্জা অসম্ভব সুন্দর। ফ্রেন্স ফ্রাইও সত্যি অসাধারণ ছিল। টেস্টটা একদমই অন্যরকম। এরপর জয়া অনেক শপিং করলো। আমি কিছুই কিনিনি। মিঠু অনেক কিছু কিনতে চাচ্ছিল আমার জন্য। আমি মানা করলাম। বললাম, এখনও অনেকটা পথ আমাকে বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে। অতএব বোঝা বাড়লে অনেক অসুবিধায় পড়বো। আমি নিজেই তো আপাতত একটি বোঝা।
মিঠুর বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি আমি রাঁধতে বসলাম। চিংড়ির মালাইকারি, কেসকি মাছের লাল ঝোল। ল্যাম্বেও রেজালা আর সাদা ভাত। আর ওদিকে আমার স্বামী কাপড় গুছাচ্ছে। আর মিঠু একটু পর পর বাথরুমে যাচ্ছে চোখ মুখ ধুতে। একভাবে কাঁদছে। জয়া আমাকে ভাঙ্গা ইংলিশে বললো, একটি একটি শব্দে, Dad, Sad, Cry কি বলবো? ওতো আমার শুধু কাজিনই নয়। (আমার ছোট খালার ছেলে) আমার বন্ধুও! আমার গোটা ছেলেবেলা, আমার কৈশোর। এবং বড় বেলা। কতশত হাজারো স্মৃতি। কিন্তু ঐ যে আমি কাঁদতে পারি না। একদম। বুকটা ভার হয়ে আসে। গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে বেড়ায়। তবু কান্না আসে না। এ কষ্ট কাওকে বোঝানো যাবে না।
অনেক রান্না করলাম। জয়া-ই ভাল করে খেলো। আমরা সবাই এমন ভাব করলাম, পেট ভারা। অবশ্য প্রায় সারারাত স্মৃতির জাবড় কাটলাম আমরা তিনজন। জয়া নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তিনটার পর এক ঘন্টার জন্য শুতে গেলাম। কারণ সাড়ে সাতটায় আমাদের প্লেন ছাড়বে। বাসা থেকে সাড়ে পাঁচটায় বের হবো। সব গোছানো। চারটায় উঠে নামাজ পড়ে, চা খেলাম ‘নাট কেক’ দিয়ে। তারপর রওনা দিলাম। পথে মিঠু বেশ কিছু টিপস দিচ্ছিলো ইটালীর ব্যাপারে। ইটালী আর স্পেন মিঠুর দ্বিতীয় বাড়ি। আমাদের সাথেও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মাত্র ১৫ দিন আগেই রোম থেকে এসেছে। আমি মানা করেছিলাম।
এয়ারপোর্টে নেমে আমরা বললাম, ‘তুই চলে যা’, শুধু শুধু ২৫ ইউরো দিয়ে গাড়ি কেন পার্ক করবি? মিঠুতো কথা শুনবে না। ঠিকই গাড়ি পার্ক করে আমাদের পিছু পিছু এলো। ওখানে দেড় ঘন্টার মত মিঠু আমাদের পেলো। বেশ কিছু ড্রাই ফুড কিনে
দিল। যখন শেষ বারের মত আমাদের ভেতরে চলে যেতে হবে, আমি মিঠুকে বললাম, ‘মিঠু আসিরে… খুব শিঘ্রি আবার দেখা হবে। বাড়ি যা’। মিঠু অকস্মাৎ আমাদেও কঠিন হতচকিত করে দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আমি জানতাম এমন একটা কিছু ঘটতে চলেছে। আমার হাত ধরে রেখেছে। আমার চোখ দিয়ে আমার অজান্তেই কান্না ঝরছে। সবাই দেখছে। তারপর একজন কোমল হৃদয়ের মহিলা সিকিউরিটি মিঠুকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর জিগজাগ বেল্টের মধ্য দিয়ে যতদূর দেখা গেল, দুচোখ ভরে মিঠুকে দেখে নিলাম।
এবং ৭:৪৫ এর এক মিনিটও লেট হলো না। বেলজিয়ামের মাটি থেকে উড়াল দিল আমাদেরকে নিয়ে প্লেন। আর ঠিক ১১:৩২ এ ইটালীর রোমে অবতরণ করলো প্লেন।
ভেতরটি ‘থম’ মেরে ছিল। কান্না না করার কষ্ট বুকের মধ্যে মুচড়ে মুচড়ে উঠছিল। এত মায়া এই পৃথিবীর পরতে পরতে। কেন কিসের এত মায়া?
কতকাল পওে মিঠুর সাথে দেখা হলো। একটুও মনে হলো না মাঝে ৩০/৩২ বছর চলে গেছে। একেই কি বলে রক্তের বন্ধন?
আবার কি কখনো দেখা হবে? কি জানি? হয়তো হবে… হয়তো হবে না। (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।
gulshanararina@gmail.com