টরেটক্কা টরন্টো

সামাজিকতা ও ধর্মপালন -৩


কাজী সাব্বির আহমেদ

ইমিগ্রেশন নিয়ে টরন্টোতে আসবার আগেই আমার এবং আমার স্ত্রীর, দুজনেরই এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য আমরা দুজনেই চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে বেইজিং-এ যাই। সেখানে আমরা ভাষা শিক্ষার জন্য প্রথম বছরটি কাটিয়েছিলাম বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে। এই ইনস্টিটিউটে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই নানা বয়সের ছাত্রছাত্রীরা আসে চীনা ভাষা শিখার জন্য। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলিতে মুখরিত ক্যাম্পাসটিকে মনে হত যেন একটি ক্ষুদে পৃথিবী। এই ক্যাম্পাসের বাসিন্দা হিসেবে আমরাও সেই সব নানা দেশের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মিশে যেতে পেরেছিলাম, জানতে পেরেছিলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কালচার সম্পর্কে। আফ্রিকানদের কালচারকে খুব কাছ থেকে যেমন জানতে পেরেছিলাম, তেমনি ইস্ট ইউরোপীয়ানদের সাথে অন্যান্য ইউরোপীয়ানদের আর্থ-সামাজিক ও মন-মানসিকতাগত পার্থক্যটাও ধরতে পেরেছিলাম। জাপানী কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার ছাত্রছাত্রীদের যেমন বিলাসবহুল জীবন কাটাতে দেখেছিলাম তেমনি দেখেছিলাম সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খলার ঘেরাটোপে আবদ্ধ উত্তর কোরিয়ার ছাত্রছাত্রীদের মানবেতর জীবনযাপন। বিভিন্ন আরবদেশ থেকে আসা মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের সাথে যেমন মিশেছিলাম, তেমনি তাদের চিরশত্রু লেবানন কিংবা সিরিয়া থেকে আসা খ্রীস্টান ছাত্রছাত্রীদের সাথেও ছিল সখ্যতা। আর চাইনিজ ছাত্রছাত্রী কিংবা শিক্ষকদের সাথে মিশে তখনকার চাইনিজ সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ভূপেন হাজারিকার ‘আমি এক যাযাবর’ গানটির মতন আমরা যেন সেই ক্যাম্পাসের মধ্যেই পুরো পৃথিবীকে ঘুরে দেখার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। ফলে এরপর আমরা যে দেশেই গিয়েছি সেখানে আর নিজেদেরকে কখনই ‘টোটাল স্ট্রেঞ্জার’ বলে মনে হয়নি। বেইজিং-এ প্রায় দীর্ঘ সাত বছর থাকার পর আমি একসময় সিঙ্গাপুরে এসে থিতু হলাম, সেখানেই আমাদের দাম্পত্য জীবনের শুরু। সিঙ্গাপুরে প্রায় দশ বছর কাটানোর পর আমরা কানাডার ইমিগ্রেশন ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করি। বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে দীর্ঘকাল কাটানোর সুবাদে কানাডা কিংবা টরন্টোতে যখন আমরা প্রথম আসি তখন আমরা প্রথম বিদেশ আসার শক থেকে মুক্ত ছিলাম। কিন্তু আমাদের জন্য যে জিনিষটা সম্পূর্ণ নতুন ছিল সেটা হলো এখানকার বাংলাদেশী-কানাডিয়ান কমিউনিটির কেমেস্ট্রি। কারণ এর আগে আমরা যেসব দেশে থেকে এসেছি সেখানে বাংলাদেশী কমিউনিটি ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট। তার উপর সামাজিক মেলামেশার গণ্ডিটা ছিল অনেকটাই পেশাবৃত্তিক। যেমন সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন পেশার বাংলাদেশীরা বাস করতেন, ক্লিনার থেকে শুরু করে সেদেশের সেরা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর কিংবা শিপিং লাইনের বড় হর্তাকর্তা। আমরা দুজনেই যেহেতু সেখানকার ইউনিভার্সিটির সাথে যুক্ত ছিলাম, তাই আমাদের সামাজিক দেখা সাক্ষাৎ মূলত ইউনিভার্সিটির সাথে যুক্ত অন্যান্য বাংলাদেশীদের সাথেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য সিঙ্গাপুর সরকার অনুমোদিত একটি মাত্র কমিউনিটির সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। সেই সুবাদে অন্যান্য পেশার সাথে যুক্ত বাংলাদেশী এবং কলকাতার বাঙালীদের সাথে পরিচয় হয়েছে বটে কিন্তু মেলামেশাটা সেই কমিউনিটির কার্যক্রমের ভিতরই সীমাবদ্ধ ছিল। তাছাড়া খুব কম বাংলাদেশী সিঙ্গাপুরের নাগরিত্ব নিয়ে বাস করত, কারণ সিঙ্গাপুরের নাগরিত্ব নিলে বাংলাদেশের নাগরিত্ব ত্যাগ করতে হয়। ফলে বাংলাদেশীদের জীবনধারায় সেদেশের সমাজ কিংবা রাজনীতির প্রভাব ছিল খুবই সামান্য। যেহেতু একদিন বাংলাদেশে ফেরত যেতে হবে, তাই সবাই বাংলাদেশকেই কেন্দ্র করে তাদের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলে। কিন্তু কানাডার বাংলাদেশী কমিউনিটির ভাইভ সম্পূর্ণ ভিন্ন, কারণ সবাই এখানে একই সাথে কানাডার এবং বাংলাদেশের নাগরিক। নিজ থেকে না চাইলে বাংলাদেশে আর কখনই ফিরে যেতে হবে না যদিও বাংলাদেশের দুয়ার সব সময়ই খোলা থাকবে। তাই সবারই ভবিষ্যত পরিকল্পনা কানাডা কেন্দ্রিক। অনেকে অবশ্য বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে কিছু একটা করার স্বপ্ন নিয়ে একবারে চলে গিয়েও বছর না ঘুরতেই আবার কানাডাতে ফেরত এসেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পর্যাপ্ত মেডিক্যাল কেয়ারের অভাব এবং সেই সাথে কিছু কানাডিয়ান বাংলাদেশীর দেশ থেকে ফেরত আসার ঘটনার কারণে শেষ বয়সে একবারে দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে এখানকার অধিকাংশ বাংলাদেশীই উৎসাহী না। কয়েক বছর পর পর মাস খানেকের জন্য বাবা-মা-ভাইবোন অথবা নিকট আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে যাওয়া কিংবা দেশের জমিজমা বাড়িঘর বিক্রী করে কীভাবে সেই টাকাটা ডলারে কনভার্ট করে এদেশে নিয়ে আসা যায় সেটাই হচ্ছে এখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটির স্বাভাবিক চিন্তাধারা। এই চিন্তাধারার সাথে আগে পরিচিত ছিলাম না। ধীরে ধীরে নিজেদেরকে এই প্র্যাগমেটিক চিন্তাধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে এখানকার কমিউনিটির একজন সদস্য হয়ে উঠাটাই ছিল আমাদের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ।
এদেশে এসে প্রথম যে জিনিষটা অনুভব করলাম সেটা হলো কানাডা হচ্ছে আমার জন্য নতুন একটা দেশ। আমি এদেশের একজন ভবিষ্যৎ নাগরিক। ফলে দেশটা আমার। এই অনুভূতি কখনই অনুভব করিনি যখন আমরা সিঙ্গাপুরে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসেবে সেখানে দীর্ঘ দশ বছর বাস করেছি। তাই এক সময় কানাডার সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ধারাকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা শুরু করলাম এবং একই সাথে এই দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান কোথায় সেটাও নির্ণয় করার চেষ্টা করলাম। আমরা যখন ২০০৬ সালে টরন্টোতে আসি তখন হারপারের কনজারভেটিভ দল ছিল ক্ষমতায়। ফলে তাদের দলীয় নীতিই প্রতিফলিত হত সরকারি কার্যক্রমে আর সেটাই অনুরণিত হত মিডিয়ার সংবাদে। তাছাড়া সেই সময়টা ছিল মর্মন্তুদ নাইন-ইলেভেনের পাঁচ বছর পূর্তির বছর। ফলে মুসলমানদের নিয়ে নানা ধরনের নেগেটিভ খবর কিংবা প্রচারণার জোয়ার ছিল চারিদিকে। ক্লাস নাইনের কেমেস্ট্রি বইয়ে পড়া ‘সকল ক্ষারকই ক্ষার নয়, কিন্তু সকল ক্ষারই ক্ষারক’-এর আদলে ‘সব মুসলমানই টেরোরিস্ট নয় কিন্তু সব টেরোরিস্টই মুসলমান’-এর প্রচারণা ছিল সবচেয়ে বিষাক্ত। অনেক মুসলমানকে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য বিব্রত বোধ করতে দেখেছি। আমার পরিচিত এক ছোট ভাইকে দেখেছি ইসলাম ত্যাগ করে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে। শুধু তাই নয় আমেরিকার নাগরিক হওয়ার সুবাদে তাকে দেখেছি গান-রাইট নিয়ে রাইট উইং-এর পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে। নিজেকে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট সাদাদের একজন হিসেবে পরিচয় দিতেই তাকে বেশী আগ্রহী দেখেছি। আমার সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে আমাকে সে ‘ইসলামিস্ট’ বলে গালি দিয়ে আমার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে কোন কসুর করেনি। তার মতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক বাংলাদেশীই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এই দক্ষিণ আমেরিকাতে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কারও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করি না, কিন্তু কেউ যখন সাধারণ যুক্তিতর্কের বাইরে গিয়ে অনেকটা গায়ের জোরে অন্যকে নিজের মতার্দশের দিকে টানতে চায় তখন তাদের জন্য দুঃখ বোধ করি। আমি একবার জুম্মার খুতবাতে খতীবকে বলতে শুনেছি, ‘কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ আমাদের ধর্ম নয়, আমাদের ধর্ম হচ্ছে ইসলাম’। কথাটাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে একটি অর্থহীন বক্তব্য কিন্তু যারা কানাডা কিংবা আমেরিকার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রেসার নিয়ে একটু চিন্তা করেন তারা এই কথাটার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে ঠিকই অনুধাবন করতে পারবেন। কারণ অনেকেই এখানকার অর্থনৈতিক এবং সমাজ ব্যবস্থাকে পারফেক্ট বলে মনে করে থাকেন। অনেক বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্টকে আবার সেই সময়ে ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টির মতাদর্শ কিংবা ম্যান্ডেটকেই ‘কানাডিয়ান লাইফস্টাইল’ বলে ধরে নিয়ে নিজেদেরকে সেইভাবে মোল্ড করতে দেখেছি। মানুষ যেমন তার নিজ ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা পছন্দ করেন না, তারাও তেমনি এখানকার অর্থনৈতিক কিংবা সমাজ ব্যবস্থার কোন সমালোচনা সহজভাবে নিতে পারেন না। তারা কোন ধরনের যুক্তিকে না মেনে প্রথমেই সমালোচনাকারীকে আঘাত করে থাকেন এই বলে যে, আপনি যদি এদের মতন করে চলতে না পারেন তবে এদেশে এসেছেন কেন। তারা ভুলে যান যে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে এদেশে আসার কারণে এদেশের নিয়মনীতির কোন সমালোচনা করা যাবে না এই মর্মে এদেশে কোন আইন নেই। বরং অনেক বিজ্ঞজনেরা সরকারের নানা সমালোচনা করে এদেশের নামকরা সব খবরের কাগজগুলিতে উপসম্পাদকীয় গোছের রচনা লিখে যাচ্ছেন।
কানাডাতে বাংলাদেশী কমিউনিটির ভিতরও বৈচিত্রতা কিন্তু কম নয়। ‘বার্ডস অব এ ফেদার ফ্লক টুগেদার’, ইংরেজী এই প্রবাদ অনুসারে এখানেও একই রকম মন-মানসিকতার লোকজন তাদের নিজস্ব কমিউনিটি গড়ে তুলেছেন। একদল যেমন মসজিদ ভিত্তিক একটা সমাজ গড়ে তুলেছেন, আবার অন্যদিকে আরেক দলকে দেখেছি বাসায় প্রকাশ্যে পানাহারের ব্যবস্থা রেখেছেন। আবার আরেক দল রয়েছেন মাঝামাঝিতে। তবে সবচেয়ে ভালো দিকটি হচ্ছে যে কেউ কিন্তু কারো ধার ধারছেন না, কিংবা কেউ কারো পা মাড়িয়ে দিচ্ছেন না। আবার কমিউনিটির সব মানসিকতার লোকদের একই ছাতার নীচে আনার জন্যও রয়েছে বেশ কিছু কার্যক্রম। বিশেষ করে সামারে এই সমস্ত অ্যাক্টিভিটিসের আধিক্য দেখা যায়, যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক পিকনিক কিংবা নৌভ্রমণ। আমরা যদিও কখনও সেই সব পিকনিকে যাইনি, তবে আমরা দুজনেই ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হওয়াতে এক্স-ক্যাডেটদের সংগঠন এক্স ক্যাডেটস ইন কানাডা কিংবা সংক্ষেপে ইসিসি-এর প্রায় সকল অনুষ্ঠানে সানন্দে যোগ দিয়ে থাকি। ইদানীং আবার স্যোসাল মিডিয়া ভিত্তিক অনেকগুলো সংগঠন বেশ সক্রিয়। এই সব স্যোসাল মিডিয়া ভিত্তিক সংগঠনগুলির কার্যক্রম মূলত বাংলাদেশী কমিউনিটির লোকজনকে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করা। কিছু কিছু সংগঠন আবার স্যোসাল মিডিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে নানা ধরনের ফিজিক্যাল ইভেন্ট যেমন টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট কিংবা চ্যারিটি শো ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে।

টরন্টোতে বাংলাদেশী কমিউনিটির বাংলা নববর্ষ উৎযাপন। ছবি : মনির বাবু


আমাদের কমিউনিটির অনেকেই এদেশে এসে নিজের মূল পেশার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে ব্যর্থ হন, বিশেষ করে যারা দেশে ডাক্তার কিংবা আর্কিটেক্ট ছিলেন। কারণ অনেকেই এই সব পেশার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স নেয়ার পরীক্ষার ঝামেলায় যেতে পারেন না, আবার অনেকেই সেই সব লাইসেন্স পরীক্ষার জটিল এবং দীর্ঘসূত্রিতার বৈতরণী পার হতে পারেন না। জীবনের প্রয়োজনে তাদেরকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে কোন একটি জবে ঢুকে যেতে হয় যেখানে তারা কখনই কাজ করে তৃপ্তি পান না। ফলে অনেকেই বিষণ্ণতার শিকার হন এবং দেশের কথা মনে করে নস্টালজিয়ায় ভুগেন। কানাডার এই জীবনটা তাদের কাছে অর্থহীন লাগে এবং দেশে ফিরে যাওয়ার এক অলীক স্বপ্নে বিভোর থাকেন। আবার অনেকে এদেশে এসে জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর সুযোগ পেয়ে সেটাকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগান। এদেশের সবকিছুর সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করে জীবনটাকে উপভোগ্য করে তুলেন। অনেকে এখানে এসে এমন সব পেশার সাথে জড়িয়ে যান যা তারা হয়ত দেশে থাকলে করতেন না। এর মধ্যে ট্যাক্সি চালানো, ড্রাইভিং শেখানো কিংবা দেশে টাকা পাঠানোর সার্ভিস হচ্ছে অন্যতম। তবে অনেকে আবার বাড়ী বেচাকেনার লাইসেন্স নিয়ে রিয়েলেটরের ব্যবসায় নাম লিখান। কেউ কেউ গ্রোসারী কিংবা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা খুলে বসেন। বাংলাদেশী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থ এবং ভিক্টোরিয়া পার্ক সংলগ্ন এলাকায় এই সব গ্রোসারী কিংবা রেস্টুরেন্ট বেশী চোখে পড়ে। বাংলাদেশীরা এদেশে এসে বিচিত্র সব পেশায় জড়িয়ে গেছেন এবং অনেকে আবার সেই সব পেশায় বেশ সুনামও কুড়িয়েছেন। বাংলাদেশী মিষ্টান্ন দিয়ে মিসিসাগা এবং ব্র্যামটনের ভারতীয় কমিউনিটির বাজার দখল করে নেয়া ব্যবসায়ী যেমন রয়েছেন তেমনি আবার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও-এর প্রেসিডেন্টের পদও অলংকৃত করা একাডেমিশিয়ানও রয়েছেন আমাদের কমিউনিটিতে। তবে আমার দৃষ্টিতে এদেশের মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণের হার অন্যান্য ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটির চেয়ে একবারে অপ্রতুল। অন্টারিও-এর এমপিপি ডলি বেগম ছাড়া আর কোন বাংলাদেশী কানাডিয়ান এদেশের রাজনীতির বড় কোন পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি এখনও। একজন আবার কোন রকম হোম ওয়ার্ক না করেই সরাসরি টরন্টোর মেয়র পদে দাঁড়িয়ে আমাদের কমিউনিটিকে কী বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তা এখনও আমার কাছে বোধগম্য হয়নি। অনেকে হয়ত এদেশের মূলধারার রাজনীতির হালচাল না বুঝেই শুধুমাত্র বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের ভোট ব্যাংককে পুঁজি করে যে কোন দলের কাছ থেকে নমিনেশন পেতে আগ্রহী। এদেশের রাজনীতির মারপ্যাঁচ কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। ইসলামোফোবিয়াকে স্ট্রাটেজিক্যালি প্রমোট করে হারপারের কনজারভেটিভ দল ২০১৫ সালের ফেডারেল ইলেকশনে জেতার পরিকল্পনা করেছিল। সেটাই হয়তবা বুমের‍্যাং হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। নাইন-ইলেভেনের পর পশ্চিমা থিংক ট্যাঙ্কদের সাথে সুর মিলিয়ে কনজারভেটিভ দল যে জিনিষটা সবচেয়ে বেশী রাজনৈতিক আলোচনায় নিয়ে এসেছিলো সেটা ছিল উগ্রবাদী ইসলাম। তাদের সংজ্ঞামতে মুসলমান মহিলারা যে মাথা ঢেকে হিজাব পরেন সেটাও নাকি ইসলামের উগ্রবাদকে উস্কিয়ে দেয়, আর মুখ ঢাকা নিকাব তো ‘নৈব নৈব চ’।
২০১৫ সালের ফেডারেল ইলেকশনের ঠিক আগে আগে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দল উঠে পড়ে লাগল সিটিজেনশীপ সেরেমনিতে নিকাব পরার ব্যাপারে একটি কোর্ট রুলিং নিয়ে। সিটিজেনশীপ বিষয়ক কেবিনেট মিনিস্টার জেইসন কেনি ২০১১ সালে কোন প্রকার আইনি ভিত্তি ছাড়াই সিটিজেনশীপ সেরেমনিতে নিকাব পরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। পাকিস্থান থেকে আগত হাই-স্কুল শিক্ষিকা জুনেরা ইসহাক এই নিষেধাজ্ঞাকে ফেডারেল কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি চেহারা সনাক্তকরণের জন্য নিকাব উন্মুক্ত করতে রাজী কিন্তু পাবলিক সেরেমনিতে নিকাব পরিধানের ব্যাপারে ছিলেন আপোষহীন। স্টিফেন হারপারের নিয়োগকৃত তিনজন বিজ্ঞ বিচারকই জুনেরা ইসহাকের দাবীর পক্ষে রায় দেন। হারপারের দল এই রুলিং-এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। একই সাথে ঘোষণা দেয় যে, তারা নির্বাচনে জয়ী হলে সরকারী কর্মচারীদের নিকাব পরা নিষিদ্ধ করবে। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রবলভাবে সমালোচিত হয় বিভিন্ন মহলে। টরেন্টো স্টার-এর প্রসিদ্ধ কলাম লেখক হারুন সিদ্দিকি সরকারের এই পদক্ষেপকে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় আকারের ‘ংঃধঃব ংঢ়ড়হংড়ৎবফ নরমড়ঃৎু’ বলে উল্লেখ করেন। সিবিসি-এর ‘দি ন্যাশনাল’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যালগেরীর মেয়র নাহিদ নেনশী বলেন – ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে নিকাবকে পছন্দ করিনা এবং মনে মনে চাই মানুষ নিকাব পরিধান না করুক। কিন্তু আরও কম পছন্দ করি যখন সরকার বলে দেয় কি পরতে হবে।’ তিনি এক্ষেত্রে নিকাবকে কোনভাবেই ‘দমন নীতি’-র প্রতীক হিসেবে মানতে রাজী নন। কারণ কারও মতের বিরুদ্ধে নিকাব পরতে বাধ্য করা যদি ‘দমন নীতি’-র প্রতিফলন হয়ে থাকে, তবে কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিকাব অবমুক্ত করাটাও হবে একই নীতির প্রতিফলন। মেয়র নাহিদ হারপার সরকারের এই নিকাব ইস্যু নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপীল করাকে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ এবং ‘জনগণের করের টাকার শ্রাদ্ধ’ বলে মন্তব্য করেন। এই নিয়ে তিনি জেইসন কেনির সাথে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে লিবারেল দলের দলীয় নেতা জাস্টিন ট্রুডো ‘টুইট’ করে মেয়র নাহিদকে সমর্থন জানান এবং হারপারকে ‘বিছিন্নতার রাজনীতি’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। অপর দিকে জনগণকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে নির্বাচনের জেতার জন্য এই নিকাব ইস্যুকে হারপারের এক ধরণের অস্ত্র (বিধঢ়ড়হ ড়ভ সধংং ফরংঃৎধপঃরড়হ) বলে অভিহিত করেন সেই সময়কার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা টমাস মোলকেয়ার। পরে অবশ্য নির্বাচনে হারপারের দল হেরে যায় এবং হারপারকে কনজারভেটিভ দলের দলীয় নেতার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। আরও পরে (২০১৭-তে) যখন ক্যুইবেক সরকার বিল-৬২-এর মাধ্যমে ঘোষণা করে যে নিকাব পরিহিত অবস্থায় কেউ সরকারী কোন সেবা পাওয়ার যোগ্য হবে না, তখন অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো সেটাকে মৌনভাবে সমর্থন দিয়ে যান। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে যে কিছু নেই, সেটাই তিনি আসলে প্রকারান্তে বুঝিয়ে দেন। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো