করোনার দিনগুলো

কোভিড যেতে যেতেও আবার জাঁকিয়ে বসেছে!

জসিম মল্লিক


কানাডার কোভিড যেতে যেতেও যাচ্ছে না। আবার তুন করে জাঁকিয়ে বসেছে। এ লেখা যখন লিখছি তখন অন্টারিওতে প্রতিদিন পাঁচশর উপরে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই যারা ভ্যাকসিন নেননি তারা। তবে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদিকে কানাডার সাথে আমেরিকার সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছে। জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। তার মধ্যে হঠাৎ করেই কানাডায় ফেডারেল ইলেকশন ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার কোথাও কোথাও ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করছে এবং ভ্যাকসিন পাসপোর্ট দেওয়ার পক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এদিকে মার্কিন কংগ্রেসের তিনজন সিনেটর করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এ খবর পাওয়ার পরে তাঁদের সঙ্গে একই সভায় অংশগ্রহণকারী অন্য সিনেটররা সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। ১৯ আগষ্ট মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর রোজার উইকার, কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট সিনেটর জন হিকেনলুপার এবং মেইন অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেটর আনগুস কিং সংক্রমিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ১১ আগস্ট অবকাঠামো আইন প্রস্তাব পাস করা নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সিনেটররা প্রায় ২০ ঘণ্টা একসঙ্গে সভায় ছিলেন। ওয়াশিংটন থেকে নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় ফিরে যাওয়ার পরই তাঁদের মধ্যে তিনজন সিনেটরের সংক্রমিত হওয়ার খবর জানা গেল।
এ মাসের শুরুর দিকে সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম সংক্রমিত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এক মাসের মধ্যে মার্কিন সিনেটের চারজন সিনেটর করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেন। নতুন যে তিনজন সিনেটর সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই টিকা নিয়েছিলেন। সিনেটর আঙ্গুস কিং জানিয়েছেন, তিনি শারীরিকভাবে ভালোবোধ করছেন না। তবে টিকা গ্রহণ না করলে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতো বলে তিনি মনে করেন। সিনেটর কিং এক বিবৃতিতে টিকা গ্রহণ এবং সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলেছে, টিকা গ্রহণ করা লোকজনের মধ্যে সংক্রমণ, হাসপাতালে ভর্তি এবং কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা এক শতাংশের কম। গত বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আবার নতুন করে লোকজন সংক্রমিত হচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের গড় হিসেবে প্রতিদিন ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৫১ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। ৬০ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ এক ডোজের টিকা নিয়েছেন।

আমার অনেক বাড়ি যেতে মন চায়। এ রকম মনে হওয়ার কারন আমি চাইলেও যেতে পারছিনা তাই বেশি করে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোভিড আমার পায়ে শেকল পড়িয়ে রেখেছে। আমার প্রিয় কিছু জায়গা আছে, সেসব জায়গায় আমি যেতে চাই। আমি এক জায়গায় বেশিদিন স্থির থাকতে পারি না, আমি অনেক অস্থির প্রকৃতির মানুষ। আমাকে আপাত শান্ত প্রকৃতির মনে হলেও আমি মোটেও তা না, ভিতরে ভিতরে আমি প্রচন্ড অস্থির, একরোখা, জেদি মানুষ। যারা আমার খুব ঘনিষ্ট তারাই শুধু জানে সেটা। আমি যখন যেটা করতে চাই, যখন যেখানে যেতে চাই, যখন যেটা বলতে চাই তা না পারলে আমি প্রচন্ড যন্ত্রণায় ভুগি। আমার ঘুম নষ্ট হয়ে যায়, খেতে পারি না, কাজ করতে পারি না, লিখতে পারি না। আমার প্রিয় জায়গাগুলোতে আমি বারবার যেতে চাই। আমার কোনো খারাপ লাগে না তাতে। ক্লান্তি আসে না। প্রিয় জায়গার প্রিয় মানুষদের সাথে মিশতে চাই। আমার প্রিয় মানুষের সংখ্যা বেশি না। পরিচিত অনেক কিন্তু প্রিয় অল্প ক’জন।
সবাই আমাকে বোঝে না। আমিও সবাইকে বুঝি না। সমস্যা আমারই বেশি। আমি প্রায়ই আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। প্রবল উৎসাহ আর আকংখা নিয়ে কারো সাথে মিশি, নিজেকে উজার করে দেই। তারপর কোনো এক সময় আবিষ্কার করি আরে তার প্রতি তো আমার আগ্রহ নষ্ট গেছে! এর কারণ সামান্য। যখনই আমি দেখি সে আমার টাইপ না, সে স্বার্থপর তখনই আগ্রহটা হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি তাকে বুঝতে দেই না। আমার ত্রুটির কারণেও অনেকে আমাকে খারিজ করে দেয়। তাই আমার আপনজনের সংখ্যা বেশি বাড়ে না। তাই যে ক’জন প্রিয় মানুষ আছে বারবার তাদের সান্নিধ্য পেতে চাই। এক বছরের বেশি বাংলাদেশে যাই না। বরিশালের রাস্তা, অলি গলি দিয়ে হাঁটি না। ঢাকার ধুলো বালি গায়ে মাখি না, ট্রাফিক জ্যাম, ভীড়ভাট্টা দেখি না। আজকাল কেবলই মনে হয় আমি কতদিন নিউইয়র্ক যাই না, লসএঞ্জেলেস যাই না, কোলকাতা যাই না, লন্ডন যাই না, প্যারিস যাইনা, ব্যাংকক যাই না, কুয়ালামপুর যাই না। কতবার হংকং যাওয়ার কথা ভাবি, ভিয়েতনাম যেতে চাই, সিডনি, টোকিও, বার্লিন যেতে চাই। এসব জায়গায় আমার যাওয়া ডিউ হয়ে আছে। কিন্তু যাওয়া কি হবে! আবার কি সেসব জায়গার বন্ধুদের সাথে মেশা হবে! সবকিছু অনিশ্চিত। জীবন অনিশ্চিত। শুধু আশা বেঁচে থাকে।
আমার অনেক বাড়ি যেতে মন চায়। সেই আশায় বসে আছি। কিন্তু আমারতো আসলে কোথাও কোনো বাড়ি ঘর নাই। মা সবসময় বরিশালে জলপাই তলায় একটা বাড়ির কথা বলতেন। এটা মায়ের একটা অবসেশন ছিল। বলতেন একটা বাড়ি করবি জলপাই তলায়, পুরো তেরো কাঠা জমির ঘেরওয়ালা, ছ’টা আম, চারটে কাঠাল, দশটা সুপুরি আর দশটা নারকেল গাছ লাগাবি, পিছনে থাকবে কলার ঝাড়। কুঞ্জলতা আমার বড় পছন্দ, বুঝলি! বেড়ার গায়ে গায়ে লতিয়ে দেবো। তুইতো শিম খেতে ভালোবাসিস-একটু শিমের মাচান করবি, গোয়ালঘরের চালের উপর লকলকিয়ে উঠবে লাউডগা.। আরো কতকি বলতেন যার কেনো অর্থ নেই। পারষ্পর্যহীন কিন্তু তাই আমি কান পেতে শুনতাম..। কিন্তু সেই বাড়িও করা হয়নি আজও।
সেজন্য আমার একটু মনোকষ্ট আছে বটে আবার এটাও ঠিক যেভাবে আছি ভালোইতো আছি। ঘরহীন ঘরে। ঠিক করেছি আমার যা কিছু আছে তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেবো আর পৃথিবীটাকে ঘুরে ঘুরে দেখব। শৈশব থেকেই আমার মধ্যে একটা উড়ানচন্ডি ভাব ছিল। আমি যখন তখন ঘর থেকে বের হয়ে পড়তাম। দু’চারটাকা জমলেই চলে যেতাম দূরে কোথাও। চেনা নাই জানা নাই বেড়িয়ে পরতাম ঘর থেকে। কখনো খুলনা, কখনো যশোর, কখনো পটুয়াখালি, কখনও ফরিদপুর, কখনো বগুড়া, কখনো রাজশাহি চলে যেতাম। ট্রেনের থার্ডক্লাসে চড়ে চলে যেতাম বগুড়া বা লঞ্চের ডেকে শুয়ে চলে যেতাম ঢাকা। পকেটে পয়সা থাকত না বলে না খেয়ে রাত পার করতাম। মা অনেক টেনশন করতেন আমাকে নিয়ে। কখনোই আমাকে ঘরমুখো করতে পারেন নি। একদিন মা বলেছিলেন, তুমি একটা পাখি। কানাডা আসার পর মৃত্যুর আগেও একবার এই কথা বলেছেন। বলেছিলেন, তুমি আমার ছোট সন্তান হয়েও তোমাকে আমি কাছে পেলাম না। পাখির মতো এই দেখি, আবার দেখি নাই। তারপর মা কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, তোমার মাথায় কেবল ঘুঘু ডাকে।
আমি আসলে আকস্মিক সংসারি। আমার চমৎকার দুটি সন্তান আছে। তারা আমাকে দারুণ বোঝে। এটাই আমার শক্তির জায়গা। তাই আমি যে কেনো সময় ঘর হতে বেড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করব না। আমার অনেক একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় যেনো একটা মায়ার বন্ধন রয়ে গেছে। মায়া জিনিসটা খুব খারাপ! খুব পোড়ায়! আমাকে সামনে এগুতে দেয় না, কেবল পিছু টানে। কিন্তু আমিতো একলা মানুষ বস্তুত। প্রবাস জীবনের একাকীত্বকে কিছুটা হলেও দূর করে আমার লেখালেখি। আমি লিখি আমার আনন্দের জন্য। আমার আনন্দানুভূতিগুলো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি। বন্ধুরাই আমার বেঁচে থাকার প্রেরনা হিসাবে কাজ করে। আমি যাদের জন্য অনেক করেছি তারা প্রায় সবাই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এর কারন আমার জানা নাই। এই রহস্য কিছুতেই উদঘাটিত করতে পারি না। কিন্তু তা সত্বেও আমার কোনো রাগ ক্ষোভ হয় না। এমনটাই হওয়ার কথা। তা সত্বেও আমি আমার হাতকে সংকুচিত করব না। এটা আমার মায়ের নির্দেশ। সেই নির্দেশ মেনে চলি সবসময়।
লেখালেখির ক্ষেত্রে আমার কোনো গুরু নাই। বই পড়ে পড়ে আর শৈশবের একাকীত্ব আর নির্জনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই আমি কাগজ কলম হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের মতো পরিবারে সেসব ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের রয়েছে এক বিশাল পরিবার কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে আমাদের অবস্থা ছিল অনেক খারাপ। দুই বছর বয়সে পিতৃহীন হওয়ার কারনে অন্যান্যদের তুলনায় আমরা একটু পিছিয়ে ছিলাম। আমার নিরক্ষর মা এক অনন্ত লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন সারা জীবন। আমাদের জন্য পাতের খাবার তুলে রেখেছেন। আমাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা ছিল বেশি। আমি ছিলাম প্রথাবিরোধী এক কিশোর। দুরন্ত, চঞ্চল।
সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেও বাধতে পারেননি। এর কারণ হচ্ছে আমার মধ্যে যে আলাদা এক আমি আছে মা তা বুঝতেন না। এক-একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মাধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ‘আমি’ আছে। সেই সব বিষন্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত। প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না। সংসার নিয়ে মা ব্যস্ত। সেই থেকে আমি একলা হয়ে গেছি।
টরন্টো ৫ মে ২০২১

মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। স্কেচ : হুতুম স্কুল

মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত


আমি যখন আমার মাকে নিয়ে লিখি তখন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই। নিজের অজান্তেই একটার পর একটা শব্দ বসতে থাকে। একধরণের আবেগ আর ভাললাগায় ভিতরটা বিবশ হয়ে যায়। একটা চাঞ্চল্য তৈরী হয় ধমনীতে। পারিপার্শ্বিক সবকিছু বিস্মৃত হয়ে যাই। অন্য এক জগতে চলে যাই যেনো। গল্প, উপন্যাস বা অন্য কোনো কিছু লেখার সময় আমার এমন হয় না। শুধু মা কে নিয়ে লেখার সময় হয়। মা এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। আমি স্পষ্ট মাকে দেখতে পাই। কথা বলি। মনে হয় আমি লিখছি না, অন্য কেউ লিখছে। আমি নিজেও জানিনা কি লিখছি।
লেখার পর কেউ যখন বলে আপনার লেখা পড়ে চোখে পানি এসে গেছে তখন আমি খুব অবাক হই। মাঝে মাঝে আমিও আমার লেখা পড়ে কাঁদি। এসব আমি লিখেছি! বিশ্বাস হয় না। মনে হয় কেউ আমার হয়ে লিখেছে। অলৌকিক কোনো কিছু ভর করেছিল আমার মধ্যে। প্রতিবার আমার এমন হয়। ’আমার মা’ নামে একটা বই আছে আমার। প্রায় দেড়শ পৃষ্ঠার বই। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তারপর আরো অনেক লেখা লিখেছি মাকে নিয়ে। আমার মা ছিল খুব সাধারণ এক নারী। আমি ছিলাম তার সাধারণ সন্তান। কিন্তু আমাদের স্মৃতিগুলো ছিল অসাধারণ। সে সব স্মৃতি নিয়ে হয়ত আরো লিখব। প্রতিবার আমার মধ্যে একটা ঘোর তৈরী হবে, অদ্ভুত এক সুখানুভূতি হবে, প্রতিবার ঐশ্বরিক কোনো শক্তি আমার মধ্যে ভর করবে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৪৫১টি হাদিস ইংরেজি অনুবাদ করে স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী ‘দ্য সেইংস অব মুহাম্মদ (সা.)’ নামে একটি সংকলন প্রস্তুত করেন। প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে, লন্ডন থেকে। রুশ সাহিত্যিক ও দার্শনিক লিও তলস্তয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ওভারকোটের পকেটে বইটির একটি কপি পাওয়া গিয়েছিল। বাণীগুলোর নৈতিক মাধুর্য, সৌন্দর্য, সাধারণ জ্ঞান, প্রায়োগিক দিক ও চিন্তাশীলতা বিভিন্নভাবে মনকে আলোড়িত করে। বইটিতে একটি হাদিসে আছে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।(সূত্রঃ প্রথম আলো)
আজ মা দিবস। পৃথিবীর সব মায়েদের স্যালুট।
টরন্টো ৯ মে ২০২১

পলাতকা রাত্রির পিছনে
মানুষ বেঁচে থাকতে একবারও ভাবে না জীবন কত ক্ষণস্থায়ী। যদি ভাবত যে ভাল কাজগুলিই শুধু থাকবে, ভাল একটা কথা, মিষ্টি একটা হাসি, কারো একটু উপকার করা, বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, দুঃখের দিনে পাশে থাকা, একটু স্নেহের পরশ বুলানো, মাথায় একটু ভরসার হাত রাখা, ভালবাসা দেওয়া এসবের মূল্য অসীম। এসবই স্মৃতিতে জাগরুক থাকবে। মৃত্যুর পর বলবে মানুষটা বড় ভাল ছিল। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। ভাল শাসকদের কথা মানুষ শত শত বছর মনে রাখে। আর খারাপ বা অত্যাচারি শাসকদের চিরদিন ঘৃণার সাথে স্মরণ করে। আমি দারুণ স্নেহ ভালবাসার কাঙাল। বিড়ালের মতো গদ গদ হয়ে যাই কেউ একটু মিষ্টি কথা বললে, ভালবাসার কথা বললে। কেউ ভালবাসার অভিনয় করলেও আমি বিগলিত হয়ে পড়ি। সত্যি মনে হয়। ঠকেও জিতে যাই। পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই ভাল। বেশিরভাগ মানুষই ভালবাসতে জানে। আমার মতোই।
আমি কারো কাছে কোনোদিন কোনো অনুগ্রহ চাইনি, হাত পাতিনি, মাথাও নত করিনি। আমি শুধু চেয়েছি কেউ যেনো আমাকে অবহেলার চোখে না দেখে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করে, আমার সাথে ছল চাতুরি না করে। আমি এসব একদম নিতে পারি না। কিন্তু তা সত্বেও আমি জীবনে অনেকই অবহেলার শিকার হয়েছি। আমার প্রাপ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। এইসব কষ্ট কখনো ভোলা যায় না। আমাকে ঠকিয়েছে অনেকেই। অনেককে বিশ্বাস করেও ঠকেছি। কিন্তু তারপরও মানুষের প্রতি আমার ভালবাসার বা বিশ্বাসের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ওসব থেকে আমি শিখেছি বটে কিন্তু আমি নিজেকে বদলাইনি। এর কারণ হচ্ছে আমি মানুষের কাছ থেকে যতনা অবহেলা আর তাচ্ছিল্য পেয়েছি ভালবাসা পেয়েছি তারচেয়ে বহুগুন।
জীবনে চলার পথে অনেকের সাথেই আমাদের সখ্যতা হয়, ঘনিষ্ঠতা হয়, ভালবাসা হয়, প্রেম হয়। আবার একদিন সেসব হারিয়েও যায়। সে এক রহস্য বটে। জীবন খুবই রহসম্যয়। মানুষ একসাথে অনেক কিছু ধারন করতে পারে না সম্ভবত। আমার শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যের অনেক বন্ধুকে, অনেক চেনা মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি আমি, অনেক আত্মীয়দের সাথে দুরত্ব তৈরী হয়েছে। অনেকে আমাকে যেমন খারিজ করে দিয়েছে তেমনি আমিও অনেক সম্পর্ককে ধরে রাখতে পারিনি। আমার অনেক ব্যর্থতা। জীবন সংগ্রামে এতোটাই বিভোর ছিলাম যে অনেক সম্পর্ক স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। আসলে কি সব হারিয়ে যায় জীবন থেকে! যায় না।
সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে পুরনো অনেকের সাথে আবার যোগাযোগ ঘটে যায়। পুরনো বন্ধুরা স্মৃতি হাতরিয়ে অনেক মুক্তো মানিক তুলে আনে। পুরনো অনেক কিছু ভুলে গেছি দেখে নিজেই লজ্জিত হই। নিজেকে বলি ছিঃ আমি এমন! কেমন করে এসব ভুলে থাকলাম! যাদের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলাম এক সময় তাদের সাথেও দূরত্ব তৈরী হয়েছে। ভালবাসা করেছিলাম যাদের সাথে তাদের সাথেও বিচ্ছিন্নতা এসেছে। এসব ভাবলে আজকাল খুব কষ্ট লাগে। আর হয়ত সেসব সম্পর্ক জোড়া লাগবে না। আবার আগের জায়গায় ফিরবে না কিছুই। এই অপূর্ণতা নিয়েই একদিন বিদায় হব। জীবন কত ক্ষনস্থয়ী তা কোভিডকালে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কত আপনজন হারিয়েছি আমরা। কারো জন্য শোক প্রকাশের সময়ও পাই না। নিরিবিলি দুফোটা চোখের জল ফেলার ফুরসত পাওয়া যায় না।
প্রকৃতির এই বিপর্যয় থেকে আমরা শিখি না। এখনও পৃথিবীতে কত অনিয়ম, অবিচার, নিষ্ঠুরতা, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, ঈর্ষা, ঘৃণার বিষবাষ্প ছাড়ানো। একে অন্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা। মনে হয় পৃথিবী থেকে এসবের মুক্তি নাই। অনেক ক্ষুদ্র সব ব্যাপারে আমরা নিচুতার পরিচয় দেই। ঈর্ষাকাতর হই। অনেক সময় অবচেতন মনেও হই। আচ্ছা ঈর্ষা জিনিষটা কে আবিষ্কার করেছে! কোথায় থাকে! জেলাসি ইজ অল বলস। আমার নিজের মধ্যেও জেলাসি আছে। অবচেতনেই জেলাসি কাজ করে।
সে এক রহস্য বটে। এখানেই মানুষের সীমাবদ্ধতা, ক্ষুদ্রতা। এসবের উর্ধ্বে একদম উঠতে পারি না আমরা। ফেসবুকের কথাই ধরা যাক। অনেক হাই প্রোফাইল বন্ধু আছে আমার যাদের সব কিছুতে আমি প্রতিক্রিয়া দেখাই, অনেক তুচ্ছ জিনিস, পাতে নেওয়ার মতো না তাতেও লাইক দেই কিন্তু তারা অনেকেই আমার ব্যাপারে নির্বিকার থাকে। এটাই মনে হয় মানুষের জীবনের ধর্ম। এতে বিষ্মিত হওয়ার কিছু নাই।
কিন্তু আমি আমার সব বন্ধুর প্রতি সমান প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করি। বিশেষ কারো প্রতি পক্ষপাত দেখাই না কারণ আমার কোনো গ্রুপ নাই, বিশেষ কারো নজরে আসার সবিশেষ আগ্রহ নাই। কারো কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নাই। মিলিওনিয়ার বন্ধু যেমন আছে আমার তেমনি দোকানদার বন্ধুও আছে। লেখক বন্ধু যেমন আছে, উকিলও আছে। পুলিশের বড় কর্তা যেমন আছে সিকিউরিটি গার্ড আছে, ডেলিভারি ম্যান আছে, ট্যাক্সি চালকও আছে। এমপি, মন্ত্রী যেমন আছে মেম্বার সাবও আছে। কে নাই! সব টাইপই আছে। রুপবতী যেমন আছে তেমনি কুৎসিত দেখতেও আছে, তরুণ যেমন আছে বৃদ্ধও আছে। দশ বিশ হাজার লাইক আর লক্ষ ফলোয়ারের অধিকারী বন্ধু যেমন আছে, দশ বিশটা লাইক কমেন্টস পাওয়া বন্ধুও কাছে। অল আর সেম।
জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়..
“অনন্ত অঙ্গার দিয়া
হৃদয়ের পান্ডুলিপি গড়ি,
উষার বাতাস ভুলি,- পলাতকা রাত্রির পিছনে
যুগ যুগ ছুটিতেছ কার অন্বেষনে!”
টরন্টো ১১ মে ২০২১

ফেলে আসা বাড়ি এবং একটি সুন্দর সকালের স্বপ্ন
বরিশাল শহরে আমাদের চেয়ে বড় বাড়ি আর কারো নাই। শহরের যে কেউ মল্লিক বাড়ি বললেই চিনে। এক সময় আমি পত্রমিতালী করতাম। পত্রিকায় চিঠিপত্র লিখতাম। আমার নামে প্রচুর চিঠি আসত। জসিম মল্লিক, মল্লিক বাড়ি, বরিশাল এই ঠিকানায় চিঠি চলে আসত। এমন হয়েছে শুধু আমার নাম আর বরিশাল হলেও চিঠি চলে আসত। ’মল্লিক বাড়ির পুল’ ছিল খুব বিখ্যাত। রিকশাওয়ালারা এক টানে নিয়ে আসত যে কোনো জায়গা থেকে। এই পুলের উপর দিয়ে আমরা কত ঝাপাঝাপি করেছি পানিতে। পুলের গোড়ায় ছাপড়া দেওয়া ছোট্ট টং হোটেল ছিল একটা। সকালের পরোটা আর ভাজির ঘ্রাণ এখনও নাকে লেগে আছে। দুপুরের দিকে গুলগুল্লা খেতাম, তারপর ঝাপ দিতাম পানিতে। তখন খাল ছিল ভর ভরন্ত। জোয়ারের সময় ঘোলা জল আসত। বড় বড় মাল বোঝাই নৌকা আসত। কীর্তনখোলার সাথে ডাইরেক্ট সংযোগ ছিল। এখনও আছে সেই খাল কিন্তু সেই যৌবন আর নেই। সরু একটা পানির স্রোত বয়ে যায় শুধু। আমি যেখানে আমার লাইব্রেরি করব সেটা এই খালের পাশেই পড়েছে। আমার মায়ের সেই জলপাই তলায় লাইব্রেরি হবে। সমস্যা একটাই আমি চাই নির্জনতা কিন্তু খালের পার দিয়েই যে রাস্তাটি গেছে সেটা খুবই ব্যস্ত এখন। কোলাহল আমার পছন্দ না।
আমাদের পুরো বাড়িটা আজও নির্জনতায় ভরা। প্রচুর গাছগাছালি, ঘন জঙ্গল, পাখির কলকাকলি, নির্জন ভাতঘুম দুপুরে ঘুঘুর ডাক, রাতে জোনাকির মিটিমিটি আলো, এমনকি দুর্লভ বাদুরেরাও ঝুলে থাকে গাছের ডালে। আমাদের মল্লিক ফ্যামিলিতে অনেক শরিক বলে চারটা ভাগে ভাগ হয়েছে বাড়ি। এখনতো আমি বাড়ি গেলে নতুন জেনারেশন যারা তাদের চিনতেই পারি না। আমার সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে, আমি চিনি না। আমাকেও চেনে না। অথচ একসময় আমরা পুরো তল্লাটের ছেলে মেয়েদের নিয়ে নানা কর্মকান্ড করতাম। আমাদের একটা লাইব্রেরি ছিল পাকিস্তান আমল থেকেই। রেজিষ্টার্ড লাইব্রেরি। নাম ছিল ইকবাল পাঠাগার এন্ড ক্লাব। সেই পাঠাগারে বই ছিল, খেলাধুলার সরঞ্জাম ছিল। এই ক্লাবের উদ্যেগে বার্ষিক ফুটবল প্রতিযোগিতা, হাডুডু, নাটক, ঘোড়ার দৌড়, নৌকা বাইচ, সাঁতার এবং ছোটদের নিয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। আমাদের বাড়ির হান্নান, নিজাম, মিজানুর, হাসিব, ইউনুস, মনু এদের সবাইকে নিয়ে এই আয়োজন করতাম। আমি আর হান্নান এর নেতৃত্বে ছিলাম। বাড়ির মেয়েরাও আমাদের পাশে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আশির দশকে আমি ঢাকা চলে আসার পর সব শেষ হয়ে গেছে। সেই খেলাধুলাও নেই, ক্লাবেরও অস্তিত্ব নেই। শুধু খেলার মাঠ পরিত্যাক্ত পড়ে আছে। খেলার মাঠগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি।
আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো পুকুর ছিল। সেই সব পুকুরে মাছ ছিল, গভীরতা ছিল। আমরা সাঁতার প্রতিযোগিতা করতাম, মাছ ধরতাম। জাল ফেলা হতো। সেই জাল ভরে উঠত শোল, গজার, শিং, বাইলা, মেনি পুঠি মাছ। বরশি ফেলতাম। পুঠি, টেংরা, মেনি মাছ উঠত। স্কুল থেকে এসেই পানিতে ঝাঁপ দিতাম। চোখ লাল না হলে উঠতাম না। মাঝে মাঝে মা এসে পানি থেকে টেন তুলত। সাবান দিতাম না বলে গায়ের চামরা সাদা হয়ে থাকত। কাদায় মাখামাখি থাকতাম। কাপড় ধোয়া ৫৭০ সাবান পেলেই মহাখুশী। পেষ্ট, ব্রাশ ছিল না বলে দাঁত ব্রাশ করতে ভুলে যেতাম। ময়লা, নোংরা একদল রাস্তার ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম। ঘুড়ি উড়াতাম, মার্বেল খেলতাম, চারা খেলতাম, সাইকেল দাবরিয়ে বেড়াতাম। আবার বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনেও পড়তাম। আমার দুরন্তপনার জন্য অনেকে আমাকে দেখতে পারত না। আমাকে বাতিলের খাতায় রেখেছিল। বলাবলি করত, ছ্যামরা উচ্ছন্নে গ্যাছে!
ফল ফলাদির জন্য আমাদের বাড়ি বিখ্যাত ছিল। আম, জাম, লিচু, গাব, কাঠাল, আনারস, তাল, বেল, আমলকি, ডউয়া, জলপাই, চালতা, তেতুল, কাউ, পায়লা, জাম্বুরা, পেয়েরা, বড়ই, আতাফল, জামরুল ছিল। কি ছিল না! সবই ছিল। অনেকগুলো বিশালাকৃতির জাম গাছ ছিল। সেই গাছে রসালো জাম ধরত। দুই চারটা খেলেই পেট ভরে যেতো। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম গাছের নিচে জাম পড়ে আছে। মাটি দেখা যায় না, শুধু জাম। আর এতো সুস্বাদু ছিল। এতো জাম খাওয়ার মানুষ ছিল না। শহরের মানুষরা এসে জাম পেড়ে নিয়ে যেতো ব্যাগ ভর্তি করে।
আমাদের কিছু দিয়ে যেতো। আমরা সেসব লবন, তেল, শুকনো মরিচ দিয়ে মেখে ঝাঁকিয়ে খেতাম। এখন সেই গাছও নেই, ফলও নেই। কেমন করে সব নিধন হয়ে গেলো। আর সেসব দিন ফিরবে না কখনও। লোভ আর নগরায়নের নামে সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
নিজের লেখা একটি কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করছি…
ভালবাসি কোনো নদী বা সমুদ্রের কাছে পৌঁছে যেতে,
যেখানে অনেক গাছপালা আছে,
পাখি ডাকে,
মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়,
বুনো ফুল ফোটে।
মেকানিক্যাল প্রেমহীন শহরে কে থাকতে চায়!
সুন্দর একটি সকাল হবে,
পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়বে, ঘুরবে, ডাকবে,
খুব পরিষ্কার বাতাস বইবে,
কুয়াশায় ভিজে থাকবে চারদিক,
আধফোটা কুঁড়ি পাপড়ি ছড়াতে থাকবে সে রকম কোথাও…।

টরন্টো ১৮ মে ২০২১