বহুসংস্কৃতির দেশ হিসাবে এগিয়ে যেতে কানাডার মূল চাবিকাঠি হলো হাইফেন যুক্ততা বরণ করে নেয়া
মারকাস মেডফোর্ড
বহুসংস্কৃতিবাদ হলো প্রমিতকরণের ন্যায়দণ্ড। এটি প্রাণবন্তু, গতিশীল, বৈচিত্র্যকে উদযাপন করে এবং প্রত্যেকের জন্যই সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। বহুসংস্কৃতিবাদ খুবই ভালো এবং মেপল সিরাপের মতই খাঁটি কানাডীয়।
আর এটি বিকশিত হচ্ছে। গত দুই দশক ধরে অভিবাসনের ধারা ঊর্ধ্বমুখি। স্ট্যাটিস্টার-এর সমন্বিত তথ্যে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কানাডায় অভিবাসনের পরিমাণ বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি।
শুধু এটিই বিস্ময়কর নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কানাডার আবেদন আছে। এটি একটি শান্তিপূর্ণ স্থান যা অনেক অভিবাসীকে উন্নত মানের জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের পরিচালিত সেরা দেশের র্যাংকিংয়ে বিশ্বেজুড়ে লোকেরা উত্তম জীবনমানের জন্য সেরা দেশ হিসাবে উপর্যুপরি পঞ্চম বছরের মত কানাডাকে নির্বাচন করেছে।
এখন সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসে সেটি হলো: একটি প্রজন্মের অভিবাসীরা কীভাবে তথাকথিত ‘কানাডীয় পরিচয়ের’ চেহারা পাল্টে দেবে?
কানাডার পরিচিতি পাল্টাচ্ছে
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, কানাডার বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশেরই জন্ম হয়েছে হয় কানাডার বাইরের কোনও দেশে অথবা তাদের বাবা-মার মধ্যে অন্তত একজন বিদেশে জন্মানো।
আমার দাদা-দাদী ১৯৭০ সালে জ্যামাইকা থেকে কানাডায় এসেছিলেন। আমার মায়ের পরিবার ১৯৭২ সালে ত্রিনিদাদ থেকে কানাডায় আসে। সুতরাং যখন আমি কানাডীয় হিসাবে বেড়ে উঠি তখন আমার পরিচয়ের স্বরূপ নির্ধারণকারী অনেক ঐতিহ্যের আমদানি হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে।
অনেক শিক্ষাবিদ ও তাত্ত্বিক যাকে ‘হাইফেন-যুক্ত কানাডীয়’ বলে অভিহিত করেন, অনেক দিক থেকেই আমি হলাম তারই খাঁটি নমুনা (poster-boy)।
হাইফেনযুক্ত কানাডীয় হলো সেইসব মানুষ যারা বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু কানাডার নাগরিকত্ব আছে। এমনও হতে পারে যে তাদের জাতিগত পটভূমি কানাডীয় নয় কিন্তু তারা কানাডার নাগরিক। অনেকে অবশ্য যে দেশে বসবাস করছেন সেই দেশেরই পরিচয় পুরোপুরি ধারণ করছেন এবং কেবল সেভাবেই নিজের পরিচয় দেন, কিন্তু তা ঠিক নয়।
সুতরাং বড় হয়ে আমি যখন অন্য লোকেদের সঙ্গে পরিচিত হই তখন আমি তাদের বলি যে, আমি অর্ধেক ত্রিনিদাদীয়, অর্ধেক জ্যামাইকান। এটা কোনওভাবেই এমন অর্থ বহন করে না যে, আমি স্বল্প পরিমাণে কানাডীয় বা এদেশে বসবাস করার জন্য আমি অন্য কারও চেয়ে কম গর্বিত। এটি হলো নিছক সেই শৈশবে আমদানি করা ঐতিহ্যের শরিক হওয়া। কানাডায় বসবাস করার বিষয়টি নিঃসন্দেহে আমার অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধের অবয়ব দিয়েছে, কিন্তু সেই সংস্কৃতিও এই কাজটি করেছে যা আমার দাদুরা দ্বীপদেশগুলো থেকে এনেছিলেন।
ইতিহাস কানাডার রক্ষণশীল পরিচিতিকে জিতিয়ে দিয়েছে
কানাডার বর্ণবাদী ইতিহাস প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সব রকম আলোচনার আলোকে এটি মোটেও বিস্ময়ের কিছু নয় যে, হাইফেনযুক্ত কানাডীয় হওয়ার ধারণাটি সবসময়ই এগিয়ে থেকেছে এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই ধারণার কট্টর বিরোধী ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন ডিফেনবেকার (Diefenbaker)।
ভালো বর্ণনার অভাবে ডিফেনবেকার হাইফেনযুক্ত কানাডীয় পরিচয়কে সেতুবন্ধন হিসাবে না দেখে বরং বাধা হিসাবে দেখতেন। তার কাছে হাইফেনযুক্ত করাটা ছিলো এক ধরণের সংস্কারাচ্ছন্নতা। তিনি বলেছিলেন, এই ধারণাটি জাতীয় পর্যায়ে একজন ব্যক্তির অবস্থানের বৈধতা নাকচ করে দেয়ার একটি উপায়। তিনি মনে করতেন যে, একজন ব্যক্তির পরিচিতিতে হাইফেন যুক্ত করার অর্থ এটাই বোঝানো যে, সে পূর্ণ নাগরিকের চেয়ে কিছুটা কম কিছু।
সম্ভবত ওই দৃষ্টিভঙ্গি ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে বৃহত্তর মুদ্রা আটকে দেয়। কিন্তু ঘটনার পরের উপলব্ধি হলো এই তত্ত্বটি কানাডার পরিবর্তনশীল নৃতাত্ত্বিক গঠনের সঙ্গে সেভাবে এগুতে পারেনি।
টরন্টোর উপকণ্ঠে খাবার ও বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত স্কারবরো মহল্লায় বেড়ে ওঠা আমি সব সময়ই স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছি যে, একজন মানুষের বহুস্তরের পরিচিতি থাকে। আমার চেনাজানা প্রায় প্রত্যেকেরই বাবা-মা অথবা দাদা-দাদীর মধ্যে এমন লোকজন আছে যারা ভিন্ন কোথাও জন্মেছিলেন অথবা তারা হলেন একটি মিশ্র জাতির সম্পর্কের ফসল। এর মধ্যে উদ্ভট কিছু নেই।
হাইফেনযুক্ত পরিচিতির ব্যাপারে ডিফেনবেকারের পরিপ্রেক্ষিতটা ছিলো খুব বেশি পরিমাণে ‘ভিন্নতা’র ওপর গুরুত্বারোপিত। তার দৃষ্টিভঙ্গি বলে যে, জাতিগোষ্ঠীর বিষয়টি কানাডীয় জাতীয়তার বাইরের কিছু এবং জাতিগত ঐতিহ্য ও কানাডীয় সংস্কৃতি পরস্পর বিসদৃশ। জাতিগত ঐতিহ্য কেবল যে কানাডীয় জাতীয়তার বাইরে অবস্থান করে এটা কোনও বিষয় নয় বরং সহজ সত্য হলো সেগুলোর উৎপত্তিও অন্য কোথাও। সহজ করে বললে, কারও পরিচিতির মধ্যে হাইফেন যুক্ত করার বিষয়টি তার পরিবারের যাত্রাপথের নির্দেশনা ধারণ করে এবং তাদের জীবনের ওপর সূক্ষ্মভাবে আলোকপাত করে।
জাতিগত ও হাইফেনযুক্ত কানাডীয়দেরকেই ‘শুধু কানাডীয়’ বলে মনে করা হলে এদেশের অভিনব সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়। এতে মুছে ফেলা হয় সেই সংগ্রামশীলতা ও ভীতিকর অতীতকে যা তাদেরকে কানাডায় নিয়ে এসেছে এবং মিথ্যা প্রতিপন্ন করে সেই আপ্তবাণীকে যে, আমাদের সবার সঙ্গে সমভাবে আচরণ করা হচ্ছে। হাইফেনযুক্ত পরিচিতির বিরোধী অবস্থান হলো সাধারণভাবে আত্তীকরণের পক্ষে। এই আত্তীকরণের এক মারাত্মক অতীত আছে এদেশে। এর অর্থ হতে পারে বিভিন্ন সংস্কৃতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া।
হাইফেনের ব্যবহার বিভেদের হাতিয়ার হওয়া উচিৎ নয় বরং এটি হবে জনগণকে পরস্পরের কাছে আনার উপায়। এটি হতে পারে কোনও ব্যক্তির ঐতিহ্য থেকে গর্ব বোধ করার একটি উপায় Ñ এবং এ বিষয়ে আরও বেশি জানার আমন্ত্রণ।
কানাডা হলো পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসীদের সম্মিলনস্থল এবং হাইফেনযুক্ত কানাডীয়দের সমবেতকরণের মাধ্যমে মানুষ তাদের ইতিহাসের সঙ্গে এবং একই ঐতিহ্য ধারণ করেন এমন অন্য লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হতে পারেন। এটি ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখতে এবং অন্যদের এসব ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
কানাডা হলো বিচিত্র টাইলসের সমন্বয়ে গড়া মোজাইক শিল্পকর্ম
ডন কারি হলেন নিউ ক্যানাডিয়ান মিডিয়া কালেকটিভ-এর সদস্য, তিনি প্রায়ই অভিবাসন ও কর্মসংস্থানের মত বিষয়ে লেখালেখি করেন। সম্প্রতি আমি জাতিসত্তা এবং অভিবাসন সম্পর্কিত অবস্থানের পার্থক্য এবং কারও পরিচিতিতে এসবের ভূমিকা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলি। কারি নিজে একজন পঞ্চম প্রজন্মের কানাডীয়। তিনি থাকেন নর্থ বে-তে। তার বিশ্বাস অভিবাসন কানাডার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘কানাডা হলো অভিবাসী জাতি এবং আদিবাসীরা ছাড়া অন্য
প্রত্যেকেই অন্য কোথাও থেকে এদেশে এসেছে। কে কখন এসেছে সেটাই হলো তাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য।’
কানাডার বৈচিত্র হলো এর অভিবাসন নীতির ফল এবং কানাডা যে কারণে এত সুন্দর তারও আংশিক কারণ ওই বৈচিত্র। কারি বলেন, কানাডীয়দের উচিৎ আমাদের পার্থক্যগুলোকে বরণ করে নেওয়া এবং আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধে সাচ্ছন্দ্য বোধ করা।
কারি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘কানাডার সংস্কৃতির সংজ্ঞায়ন কঠিন, এর কারণ প্রধানত এই যে, আমরা হলাম একটি মোজাইক শিল্পকর্ম, যুক্তরাষ্ট্র যেমন নিজেকে গলনশীল পাত্র বলে, কানাডা তেমন নয়।’
কারি যথার্থই চিহ্ণিত করেছেন; আমরা একটি মোজাইক শিল্প যাতে অনেক বিচিত্র টাইলসের সমন্বয় ঘটেছে।
আমার বিবেচনায় কানাডীয় বলতে যা বোঝায় তা নিছক সাদৃশ্য নয়, এটি হলো এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধরণের মানুষের কাছ থেকে শেখা এবং তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করা। আমার শৈশবের কিছু প্রিয় স্মৃতির মধ্যে একটি হলো ইরিত্রিয়া উৎসবে ফুটবল খেলা, রাতে বন্ধুদের বাসায় লঙ্গানিসা খাওয়া এবং নিউফাউন্ডল্যান্ডের অশালীন বুলি (slang) শেখা। আমার কাছে ওটাই আদর্শ কানাডীয় শৈশব আর একে আমি গোটা বিশ্বের বিনিময়েও বিকিয়ে দেবো না।
-সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ
(মারকাস মেডফোর্ড টরন্টোর একজন কবি, সম্পাদক এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি এখন নিউ ক্যানাডিয়ান মিডিয়ায় সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।)