কানাডার নাগরিকত্ব পেতে আগ্রহী লাখো মানুষ আবেদন প্রক্রিয়াকরণের আশায় অপেক্ষমান
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ২০২০ সালের মার্চে মীনাক্ষী ভেবেছিলেন, কানাডার নাগরিকত্ব পাবার তার যাত্রার বোধ হয় নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে, কারণ কানাডার অভিবাসন, শরণার্থী ও নাগরিকত্ব বিভাগ (IRCC) তার পরীক্ষা নেবার তারিখ জানিয়েছে।
এরপর নাগরিকত্ব পরীক্ষার ঠিক এক সপ্তাহ আগে ১১ মার্চ তার চোখের সামনে বিশ্বটা পাল্টে যায় যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে মহামারি হিসাবে ঘোষণা করে।
আইআরসিসি তারটাসহ সব পরীক্ষা বাতিল করে। কেবল ‘জরুরী’ বিবেচনায় কিছু পরীক্ষা নেওয়া হয় ভার্চুয়াল মাধ্যমে।
মীনাক্ষী বলেন, ‘আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। আমরা সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি।’
নভেম্বরে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু তার আগে বেশ কয়েক মাস পেরিয়ে যায়।
মহামারির সময় পরীক্ষাজট আরও বেড়ে যায়
সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মীনাক্ষী হলেন অপেক্ষা করে থাকা লাখো মানুষের একজন। প্রতিবেদনটি তৈরী করেন র্যাফি বুজিকানিয়ান।
আইআরসিসির কাছে আসা অগণিত অভ্যন্তরীণ ইমেল-এর প্রেক্ষিতে কর্মচারীরা স্বীকার করেন যে, পারমানেন্ট রেসিডেন্টদের নাগরিকত্ব পাবার এই জটে আটকে থাকাদের সংখ্যা ২০২০-এর মার্চের ৮৭,০০০ থেকে বেড়ে চলতি বছরের শুরুতে এক লাখ দুই হাজারে উঠেছে।
জানা যাচ্ছে, গত জানুয়ারির শেষে নাগরিকত্বের পুরো আবেদনপ্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য অপেক্ষমানদের সংখ্যা ছিলো, ৩১১,২৩৫৯ জন।
এদের মধ্যে ১,০২,৯৮৯ জন অপেক্ষা করছেন ১৩ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত। আর ৮৬৫ জন চার বছরেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষমান রয়েছেন।
নাগরিকত্বের পরীক্ষা সম্পর্কিত একটি অস্থায়ী অ্যাডভোকেসি গ্রুপের প্রধান আহসান ওমর সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘এক শ’ দুই হাজার মানুষ মানে হলো কানাডার একটি মাঝারি আকারের শহরের জনসংখ্যা।’
গ্রুপের পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী অনুরোধ জানানো হলে এসব পরিসংখ্যান এবং সংস্থার অভ্যন্তরীণ ইমেলের সংখ্যা প্রকাশ পায়।
ওমর বলেন, ‘আমরা সবাই যে পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি তার কারণে যৌক্তিক বিলম্বের বিষয়টি আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু, যখন স্বচ্ছতার অভাব ঘটে এবং অযৌক্তিক বিলম্ব হয় তখন এর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে গভীর বেদনা সঞ্চিত হতে থাকে।’
অপেক্ষার মূল্য
১০ বছর আগে কানাডায় আসা এবং অন্টারিওর লন্ডনে বসবাসকারী মীনাক্ষীর জন্য এই অপেক্ষা চাকরিবাকরি পাবার ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করেছে।
তার নামের প্রথম অংশটি ভারতের যেখান থেকে তিনি এসেছেন সেখানে বহুল ব্যবহৃত একটি নাম। তিনি কানাডার রিয়েল এস্টেটে তার ক্যারিয়ার শুরু করতে পারতেন এবং নামের সঙ্গে একটি অতিরিক্ত পদবি যোগ করতে পারতেন। কিন্তু বৈধভাবে সেটি করতে হলে তাকে আগে নাগরিকত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
২০১৮ সাল থেকে শুরু করে তাকে পারমানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ড ও ভারতীয় পাসপোর্ট নবায়ন করতে অন্তত ৬০০ ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। আইআরসিসির নিয়ম অনুযায়ী ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড পরক্ষার জন্য তাকে তিনবার আঙুলের ছাপ স্ক্যান করতে হয়েছে। নাগরিকত্বের আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হলে কিছুদিন পর পর এ কাজগুলো করতেই হয়।
২০১৮ সালে নাগরিকত্বের আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হলেও মীনাক্ষি এখনও নতুন করে পরীক্ষার তারিখ পাবার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বুঝতে পারেন না, নতুন করে স্ক্যান করার জন্য অর্থ পরিশোধের দায় কেন তার ওপর বর্তাবে। তার কারণে তো এই বিলম্ব ঘটেনি।
মীনাক্ষি বলেন, ‘জানেন, প্রত্যেক দিন সকালে নিজের সব কাজ বাদ দিয়ে আমি সবার আগে ফোন চেক করি, প্রত্যেকদিন। পরীক্ষার তারিখ কি এলো? আমাকে কি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে?’
টরন্টোর বাসিন্দা বেন মানসুরা আরেকজন পারমানেন্ট রেসিডেন্ট। তবে তিনি আগামী ডিসেম্বরে অনলাইনে পরীক্ষা দেবার তারিখ পাওয়া প্রথম ৫,০০০ জনের মধ্যে নিজের নামটি রাখতে পেরেছেন।
তবে সিনিয়র আইটি ম্যানেজার মনসুরাকে পাস করার তথ্যটি জানতে হয়েছে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে।
তিনি এখনও অপেক্ষা করছেন, ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড ও ভাষাগত যোগ্যতার পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য। সেটা কখন জানতে পারবেন তার কোনও আভাস নেই।
মানসুরা বলেন, তিনি যখনই সর্বশেষ তথ্য জানার জন্য আইআরসিেিত ফোন করেন তখনই ‘ফোন রিসিভকারী পরিদর্শক যেন একই ভাবভঙ্গি প্রকাশ করেন যে, ‘কেন তুমি আমাদের ফোন করছো?’
২০১৯ সালের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার তার ছিলো না, আর চলতি বছরের শেষদিকে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী নির্বাচনেও দিতে পারবেন কিনা সে নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন, যদি অনির্দিষ্টকাল ধরে বিলম্ব চলতেই থাকে।
২০১২ সালে চেক রিপাবলিক থেকে কানাডায় আসা মানসুরা বলেন, ‘আমি এই দেশের মঙ্গলের কাজে অংশ নিতে চাই। কিন্তু আমি এমন অনুভব করি যেন এদেশ আমাকে স্বাগত জানায় না। আমি অনুভব করি, আমার সঙ্গে এরা সমভাবে আচরণ করছে না।’
‘খুব শিগগিরই’ আরও টেস্ট নেয়া হবে: মন্ত্রী
আহসান ওমরের গ্রুপ ৩৫৩ পৃষ্ঠার যে নথিপত্র পেয়েছে তার মধ্যে আইআরসিসিতে পাঠানো কিছু অভ্যন্তরীণ ইমেল এমনও আছে যেগুলি অনলাইনে টেস্ট শুরু হবারও আগের। কর্মচারীরা এই টেস্ট গ্রহণের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলো যেটি ছিলো একজন কর্মচারীর ভাষায় ‘আগ্রাসী পরিকল্পনা’। এতে ২০২০ সালের মধ্যে ৫,০০০ টেস্ট নেয়ার কথা ছিলো।
অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী মারকো মেন্ডিসিনোকে এই বিষয়ে সাক্ষাৎকারে জন্য পাওয়া যায়নি তবে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এখনও অপেক্ষমানদের প্রতি ‘আস্থা রাখার’ আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘খুব শিগগিরই আরও ডিজিটাল টেস্ট ও নাগরিকত্বের অনুষ্ঠান আসছে।’
সিবিসি নিউজকে দেয়া পরবর্তী এক বিবৃতিতে আইআরসিসি বলেছে, তারা গত এপ্রিলের মধ্যে ৬৫,৮৯৩ টি অনলাইন টেস্টের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে এবং ৪৩,৬৯৭ প্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছে।
ক্যালগেরির একজন অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী রাজ শর্মা বলেন, ‘অভিবাসন কর্মকর্তারা গত বছরও এমনই হুড়োহুড়ি করে কাজ করেছে।’
সিবিসি নিউজের পাওয়া পরিসংখ্যান দেখে তিনি বলেন, মহামারির কারণে এই জট তীব্রতর হতে পারে বলে তিনি ধারণা করেছিলেন।
কিন্তু, এত দীর্ঘ সময় ধরে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে অপেক্ষা করে থাকতে হচ্ছে কেন তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। তিনি বলেন, ‘দৃশ্যত এটা স্পষ্ট যে, কিছু আবেদন নিয়ে বিলম্ব করা হয়েছে মহামারিরও অনেক আগে, মহামারিকে অজুহাত হিসাবে দেখানোরও অনেক আগে।’
এখন অনলাইন টেস্টের প্রক্রিয়া মসৃণভাবে এগুনোর বিষয়টি উল্লেখ করে শর্মা বলেন, ‘মনে হচেছ সামনে বসন্তের কিছু আশাব্যঞ্জক লক্ষণ আছে।’
কিন্তু মীনাক্ষির জন্য এটি তেমন স্বস্তিকর নয়। তিনি বলেন, ‘পরের বছর যদি আমাকে চতুর্থবারের মত আঙুলের ছাপ দিতে বলা হয়, আমি আমার আবেদন প্রত্যাহার করে নেবো।’