এবার ডান্ডাজের মাথায় ডান্ডার বাড়ি
খুরশিদ আলম
এবার ডান্ডা মারা হলো ডান্ডাসের মাথায় যিনি এককালে দাসদের স্বাধীনতা প্রদানের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। অবশ্য ডান্ডাটি সরাসরি তাঁর মাথায় পড়েনি। কারণ তাঁর কোন ভাস্কর্য নেই টরন্টোতে। তবে টরন্টোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক রয়েছে তাঁর নামে যেটি আমরা সবাই ‘ডান্ডাস স্ট্রিট’ হিসাবে চিনি। এছাড়াও আরো কয়েকটি স্থাপনার নাম রয়েছে তাঁর নামে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডান্ডাস স্কয়ার এবং ডান্ডাস ও ডান্ডাস ওয়েস্ট নামের দুটি সাবওয়ে স্টেশন। তাঁর সম্মানে এগুলোর নামকরণ করা হয় বহুবছর আগে।
দাসদের স্বাধীনতা প্রদানের বিরুদ্ধে তিনি কাজ করায় এখন এই ডান্ডাস স্ট্রিট-সহ অন্যান্য স্থাপনার নামগুলো বদলে ফেলা হবে। এমনটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে গত ১৪ জুলাই টরন্টোর সিটি কাউন্সিলের এক সভায়। ঐ সভায় দীর্ঘ বিতর্কের পর ১৭ জন কাউন্সিলর নাম পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেন। বিপক্ষে রায় দেন ৭ জন কাউন্সিলর। খবর সিবিসি নিউজের।
ডান্ডাজের মাথায় ডান্ডার বাড়ি এভাবেই পড়েছে। সিবিসি নিউজের খবরে আরো বলা হয়, এর আগে জনদাবীর মুখে টরন্টোর মেয়র জন টরি-ও বিশেষ আগ্রহ দেখান ডান্ডাস স্ট্রিটের নাম বদল করার বিষয়ে। গত ৬ জুলাই সিটি অফ টরন্টো’র এক্সিকিউটিভ কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে মেয়র জন টরি ও সিটি স্টাফদের একটি রিপোর্টের পক্ষে রায় দেন যেটাতে ডান্ডাস স্ট্রিটের নাম বদল করার প্রস্তাব ছিল। একই সাথে ডান্ডাসের নামে সিটিতে অন্য যে সব স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর নামও বদল করার প্রস্তাব ছিল।
নাম বদলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে টরন্টোর মেয়র জন টরি ইতিপূর্বে বলেন, ‘আমরা আমাদের বর্তমান নিজ আদর্শ নিয়ে বাস করবো, আমাদের বর্তমান নিজ মূল্যবোধ নিয়ে বাস করবো। কানাডার কালিমাময় অতীত ইতিহাসকে অস্বীকার না করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।’
উল্লেখ্য যে, গত জুন মাসে রায়ারসন বিশ^বিদ্যালয়ের চত্বরে স্থাপিত এগারটন রায়ারসনের একটি ভাস্কর্যের মাথা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মুগুরের বাড়িতে। তার আগে ভাস্কর্যটির গলায় দড়ি বেধে টেনে হিচরে মাটিতে নামিয়ে আনা হয়েছিল। কারণ তিনি ছিলেন আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার রূপকারদের অন্যতম একজন যেখানে শিশুদের উপর চালানো হয়েছিল নির্মম নির্যাতন। তারা পর্যাপ্ত খাবার পেতো না,্ ক্ষুধার্ত থাকতো। অপুষ্টির শিকার ছিল তারা। অনেক শিশু যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়েছে। এ সব অত্যাচারের কারণে চার হাজারেরও বেশী শিশুর মৃত্যু ঘটেছিল আবাসিক স্কুলগুলোতে।
![](https://probashikantho.com/wp-content/uploads/2021/07/dun.jpg)
ডান্ডাস এর পুরো নাম হ্যানরি ডান্ডাস। তিনি ছিলেন একজন বৃটিশ রাজনীতিবিদ। ডান্ডাস একসময় বৃটেনের ‘হোম সেক্রেটারী’ ছিলেন। ‘সেক্রেটারী অব ওয়ার’ এর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় তিনি দাসদের এর স্বাধীনতা প্রদানের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তার এই ভূমিকার কারণে বৃটেনে দাস ব্যবসা বন্ধ হতে অতিরিক্ত আরো ১৫ বছর সময় লাগে। তিনি সে সময় দাসদের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছিলেন মহা অত্যাচারী এক ব্যক্তি।
এরকম একজন নির্দয়, নিষ্ঠুর মহা অত্যাচারী এক ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয় টরন্টো ও তার নিকটবর্তী শহর হ্যামিলটনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, স্থাপনা, লাইব্রেরী এমনকি এলাকার নামও! অথচ এই বিষয়গুলো নিয়ে এতদিন কেউ কোন প্রতিবাদ করেননি। অন্টারিও’র বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ সরকার বা আগের লিবারেল সরকারও বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। এড়িয়ে গেছে স্থানীয় মিউনিসিপাল সরকারগুলোও। এর একটা কারণ হতে পারে -ডান্ডাস ছিলেন কানাডার ক্ষমতাসীন শে^তাঙ্গদের পূর্বপুরুষ। তাঁর অবমাননা হয় এমন কাজ উত্তরসূরী শে^তাঙ্গরা করবেন এমনটা আশা করা যায় না। অন্য কারণটি হতে পারে ভোটের রাজনীতি। রক্ষণশীল বা শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ^াসী শে^তাঙ্গদের ভোট হারাতে চান না বলেই হয়তো কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আগে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কিংবা এমনও হতে পারে যে, বিষয়টির কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেননি অতীত বা বর্তমানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ফলে ডান্ডাস নামের চরম বর্ণবাদী ও অত্যাচারী এই ব্যক্তিটি এতদিন আমাদের সকলের কাছে একজন মহান ব্যক্তি হিসাবেই গণ্য হয়ে আসছিলেন। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাঁরা ডান্ডাসের অতীত কুকর্মের কথা জানতেই পারিনি। এমনকি জানতেন না অধিকাংশ রাজনীতিবিদও। কারণ শুরু থেকেই ডান্ডাসকে একজন কৃতি পুরুষ, মহান ব্যক্তি, সফল রাজনীতিক হিসাবেই ইতিহাসে উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে ডান্ডাসের আসল রূপটি সিংহভাগ মানুষের কাছে ঢাকা পড়ে ছিল এতদিন।
কিন্তু যাঁরা ডান্ডাসের নামে কানাডায় সড়কসহ অন্যান্য স্থাপনার নাম রাখলেন তাঁরা কি জানতেন না তাঁর অতীত কুকর্মের কথা? তাছাড়া কানাডায় ডান্ডাসের কি এমন অবদানটা ছিল যে তাঁর নামে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করতে হবে? তিনি তো কানাডায় কোনদিন বেড়াতেও আসেননি। আর যাঁরা এই কাজটি করেছিলনে, তাঁদের উদ্দেশ্য কি ছিল?
উদ্দেশ্য স্পষ্টতই ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিস্তারের অশুভ প্রক্রিয়া। বৃটেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের ক্ষমতাসীনরা তাঁদের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষন বিস্তারের লক্ষ্যে অতীতে হেন অপকর্ম নেই যা তাঁরা করেননি। পৃথিবীর অনেক দেশে নির্মম ও বর্বরোচিত গণহত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছেন তাঁরা। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ভারত উপমহাদেশে এই কুকর্ম করেছেন তাঁরা। এমনকি এই কানাডায়ও! নৃশংস গণহত্যার ঘটনা তাঁরা এখানেও ঘটিয়েছেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে যে, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। একটা সময়ে এসে পাপের শাস্তি পেতেই হয়। অতি সম্প্রতি রায়ারসন এর বেলায় আমরা তা দেখেছি। টরন্টোর রায়ারসন বিশ^বিদ্যালয়ের চত্বরে তাঁর ভাস্কর্যের গায়ে কালিমা লেপন করা হয়েছে, গলায় দড়ি বেধে টেনে মাটিতে নামানো হয়েছে, মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে, পদাঘাত করা হয়েছে।
এবার শুরু হয়েছে ডান্ডাসের পালা। গত বছর ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন শুরু হবার পর টরন্টো নিবাসী আর্টিস্ট ও এ্যাক্টিভিস্ট অ্যান্ড্রু লোচহেড অনলাইনে একটি আবেদন (পিটিশন) পেশ করেন ডান্ডাস স্ট্রিটের নাম বদল করার জন্য। ২০২০ সালের জুন মাসে পেশ করা ঐ আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৫ হাজারেরও বেশী লোক স্বাক্ষর প্রদান করেন। তখন থেকেই ডান্ডাসের কুকর্মের কথা মিডিয়াতে আসতে থাকে যা এতদিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল উপনিবেশবাদীদের ‘ভাবমূর্তি’ পরিচ্ছন্ন রাখার স্বার্থে। ঐ সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠির পক্ষ থেকেও ডান্ডাসের নাম বাদ দেয়ার জোরালো দাবী উঠে। আর তখন টরন্টো সিটি কর্তৃপক্ষও নড়ে চড়ে বসে ডান্ডাসের বিষয়ে।
‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে গত বছর ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য মিনেসোটায় শে^তাঙ্গ এক পুলিশ সদস্য কতৃক জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর। হত্যাকান্ডের বিষয়টি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে ছড়িয়ে দেন প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা। এর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। প্রথম দিকে প্রতিবাদের ভাষা ছিল রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল ও স্লোগান দেওয়ার মধ্যে। তবে করোনার এই মহামারী কালেও যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে এই আন্দোলনের বাতাস যখন কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোতে লাগে তখন এটি আরও বেগবান হয়। এখন এই আন্দোলন শুধু ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ‘আই কান্ট ব্রিদ’ লেখা প্ল্যাকার্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলন রূপ নিয়েছে বর্ণবাদবিরোধী কঠিন আন্দোলনে। বিভিন্ন শহরে বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত মানুষের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সড়কের নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে।
নাম বদলের এই অন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কানাডার সাবেক গভর্নর জেনারেল অ্যাড্রিয়েন ক্লার্কসন বলেন, ‘কানাডায় ডান্ডাস কোন প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি নয়। টরন্টোর সঙ্গেও তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বাধা না দিলে সেদিন দাস হিসাবে যাদেরকে আফ্রিকা থেকে জোর করে ধরে আনা হয়েছিল তাঁরা স্বাধীন ভাবে নিজ নিজ দেশে বসবাস করতে পারতেন।’
ডান্ডাস অবশ্য সরাসরি দাস প্রথা বিলুপ্তিতে বাধা দেননি। তবে কৌশলে এই প্রথা বজায় রাখার জন্য তিনি যে কাজটি করেছিলেন তা হলো, দাস প্রথা বিলুপ্তির আইনে একটি শব্দ জুড়ে দেয়া। সেই শব্দটি ছিল ‘ক্রমান্বয়ে’। অর্থাৎ হঠাৎ এই প্রথা বাতিল না করে ক্রমান্বয়ে তা বাতিল করা হবে। আর এই একটি শব্দেই ১৫ বছর পার হয়ে যায় দাস প্রথা বা দাস বাণিজ্য বন্ধ হতে। আর এই ১৫ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ আফ্রিকানকে ধরে এনে দাস বানানোর প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। পাশাপাশি যারা আগে থেকেই দাসের জীবন অতিবাহিত করছিলেন তাঁদেরকেও পরবর্তী আরো ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল স্বাধীনতা পেতে। এই দাসদের উপর যে কি ভয়াবহ রকমের অত্যাচার চালানো হয়েছিল ছিল তা কল্পনা করলেও গা শিউরে উঠে।
দাস প্রথা বহুকাল আগেও ছিল। তবে ঔপনিবেশিক যুগে পর্তুগিজ জলদস্যুদের মাধ্যমে এই প্রথা ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। তখন পর্তুগিজ জলদস্যুরা আফ্রিকা থেকে নারী-পুরুষদের জোর করে ধরে এনে ইউরোপে বিক্রি করে দিতেন। পরে ইংরেজ ও ফরাসিরাও এই জঘন্য ব্যবসায় যুক্ত হন।
কিন্তু কে এই ডান্ডাস, কি তাঁর পরিচয়, কি কারণে তিনি বিখ্যাত বা কুখ্যাত সেই সম্পর্কে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন শুরু হবার আগ পর্যন্ত প্রায় কারোরই কোন আগ্রহ ছিল না। অথবা বলা চলে, কেউ এই নাম নিয়ে মাথা ঘামাননি। কানাডায় বহু সড়ক ও স্থাপনার নাম আছে বিভিন্ন জনের নামে। দুই চারজন অতি বিখ্যাত ব্যক্তি ছাড়া আর কারো নামের ব্যাপারে সাধারণত আমাদের সিংহভাগ লোকের কোন আগ্রহ নেই। যেমনটি ছিল না ডান্ডাসের ব্যাপারেও।
ডান্ডস নামের এই ব্যক্তিটি তাঁর সময়কালে বৃটেনে যথেষ্ট প্রভাবশালী একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন বৃটেনের স্কটল্যান্ডের মুকুটহীন রাজা। এই একটি মাত্র বাক্য থেকেই অনুমান করা যায় তিনি কতটা প্রভাবশালী ছিলেন। আর সেই প্রভাব খাটিয়েই তিনি ‘ক্রমান্বয়ে’ শব্দটি জুড়ে দিয়েছিলেন দাস ব্যবসা বন্ধের প্রস্তাবিত আইনে। কারণ তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল এই দাস ব্যবসাকে দীর্ঘায়িত করা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুগ যুগ ধরে প্রায় দেবত্বের আসনে বসিয়ে এই বর্ণবাদী, দাস ব্যবসায়ী আর গণহত্যা পরিচালনাকারীদের জন্মদিন- মৃত্যুদিন পালন করা হয়ে আসছে। এদেরকে ‘জাতীয় বীর’ বা ‘মহানায়ক’ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেয়া হয়েছে, এদের ‘অবদান’-কে মূর্ত্যমান করার জন্য মূর্তি বা ভাষ্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।
তথাকথিত এই মহামানবেরা মানুষের পায়ে বেড়ি পরিয়েছিলেন, মানুষকে পণ্য বানিয়েছিলেন, দাস বানিয়ে বিক্রি করেছিলেন, মহিলা দাসদের ধর্ষণ করেছিলেন, মানুষের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি এমন কি দেশ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিলেন, দখলের জন্য প্রয়োজনে গণহত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। অথচ কি আশ্চর্যের বিষয়, যুগ যুগ ধরে এই মানুষগুলোই ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ বা ‘পূজনীয়’ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নিয়েছেন। ডান্ডাসও ছিলেন এমনই একজন ব্যক্তি।
যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ নিউজ এর সূত্র থেকে জানা যায়, ডান্ডাস ‘সেক্রেটারী অফ স্টেট ফর ওয়ার’ পদে নিয়োগ পান ১৭৯৪ সালে। তার আগে ১৭৭৪ সালে তিনি ছিলেন পার্লামেন্টের সদস্য। তিনি বাধা না দিলে বৃটেনে দাস ব্যবসা ১৮০৭ সালের বদলে ১৭৯২ সালেই বন্ধ হয়ে যেত।
১৮০৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাস কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও দাস ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হতে সময় নেয় আরো প্রায় আড়াই দশক। অন্যদিকে এই দাস প্রথাকে বাতিল করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধে কয়েক লক্ষ সৈন্যের মৃত্যুও হয়। উইকিপিডিয়ার সূত্রে জানা যায়, চার বছরব্যাপী ঐ যুদ্ধে ৬ লাখেরও বেশী আমেরিকান সৈন্য মৃত্যুবরণ করেন।
এডিনবার্গ নিউজ এর সূত্র থেকে আরো জানা যায়, জনগণের অর্থ অপব্যবহারের দায়ে তাঁকে একবার অভিয্ক্তু করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তাঁকে সেই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তিনি আর সরকারী কাজে ফিরে আসেননি।
ডান্ডাস তাঁর সময়কালে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন একজন মহা অত্যাচারী শাসক হিসাবে। কিন্তু একই সাথে ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন রাজনীতিবিদ। আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি স্কটল্যান্ডের মুকুটবিহীন রাজা হিসাবে বিবেচিত হতেন। তাঁর সম্মানে এডিনবার্গে একটি সুউচ্চ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয় ১৮২৮ সালে। ১৫০ ফুট উচ্চ ঐ স্মৃতিস্তম্ভের উপর বসানো হয় তাঁর একটি পূর্ণ আকৃতির ভাস্কর্য। সেই থেকে বৃটেনের লোকজন এই ভাস্কর্যকে সম্মান জানিয়ে আসছিলেন। একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছিল এলাকাটি।
কিন্তু দিন পাল্টেছে। যদিও তা বহুযুগ পরে। লোকজন এখন অনুধাবন করতে পারছেন, এতদিন ধরে তাঁরা যাঁকে অতিমাত্রায় সম্মানের আসনে বসিয়ে রেখেছিলেন তিনি আসলে তার যোগ্য নন। এমনকি ডান্ডাস পরিবারের বংশধররাও তাঁকে সেই সম্মানের আসন থেকে নামিয়ে আনার পক্ষে। এডিনবার্গ নিউজ জানায়, তাঁর সরাসরি বংশধরদের একজন বেঞ্জামিন কেরী দাবী করেছেন এডিনবার্গের যে স্মৃতিস্তম্ভে ডান্ডাসের ভাস্কর্য বসানো আছে সেখানে একটি ফলক বসানো উচিৎ যার মধ্যে তাঁর অতীত অপকর্মের তথ্য সংযুক্ত থাকবে। বেঞ্জামিন আরো বলেন, ‘ডান্ডাস ছিলেন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি যিনি দাস ব্যবসাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য তাঁর প্রভাবকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছিলেন। এবং আমার বিশ্বাস আমার কোন জ্ঞাতিভাই বা বোন এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন না।’
সিটি অফ এডিনবার্গের কাউন্সিল লিডার এ্যাডাম ম্যাকভি বলেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আমাদের শহরের অগ্রগতি ও সাফল্যের জন্য যে অবদান রেখেছেন এবং এখনো রাখছেন সে সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু উদযাপন করার আছে। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের স্কটিশ ইতিহাসের সেই মুহুর্তগুলোর বিষয়েও খোলামেলাভাবে কথা বলা দরকার যখন কেবল মানুষের বর্ণের কারণে তাঁদের হত্যা করা হতো, দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা হতো এবং বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো।’
ডান্ডাসের সম্মানে এডিনবার্গে যে সুউচ্চ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মান করা হয়েছিল ১৮২৮ সালে, গত বছর ১১ জুন তার পাদদেশে একটি নতুন ফলক স্থাপন করা হয় যেখানে তাঁর অতীত অপকর্মের কিছু তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।
এই তথ্যগুলোর মধ্যে আছে –
‘ডান্ডাস ছিলেন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তিনি যে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন, তা আজ অবধি ঘটছে।’
‘তিনি যখন ১৭৯২ সালে হোম সেক্রেটারী এবং ১৭৯৬ সালে সেক্রেটারী অব স্টেট ফর ওয়ার পদে নিয়োজিত ছিলেন তখন দাস প্রথা বিলুপ্তির প্রক্রিয়টি যাতে বিলম্বিত হয় তার জন্য কাজ করেছেন।’
‘ডান্ডাসের কারণে দাস ব্যবসা বন্ধ হয়নি ১৮০৭ সাল পর্যন্ত। আর এই বিলম্বের কারণে ৬ লাখেরও বেশী আফ্রিকান মানুষকে দাস ব্যবসায়ীরা জোর করে ধরে এনেছিল বিক্রি করার জন্য।’
‘ডান্ডাস স্কটল্যান্ডে গণতান্ত্রিক উপায়ে মতবিরোধের প্রক্রিয়াকে দমিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যকে প্রতিপালন ও বিস্তার করার পক্ষে কাজ করেছেন এবং আদিবাসীদের উপর ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘তিনি সরকারী তহবিলের অপব্যবহার করেছিলেন যার জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। পরে তাঁকে সেই অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হলেও তিনি আর সরকারী কোন পদে অধিষ্ঠিত হননি।’
‘২০২০ সালে এই ফলকটি ৬ লাখেরও বেশী আফ্রিকান লোকদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হলো যাদেরকে দাসত্বের জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। আর এর জন্য দায়ী ডান্ডাস’
অতীতে কানাডায় ব্রিটিশ ও ফরাসীরা তাঁদের উপনিবেশ বিস্তারের পাশাপাশি নিজেদের তথাকথিত ‘বীরত্বগাথা’, ‘কীর্তি’, ‘অবদান’ ইত্যাদিকে মহিমান্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সড়ক, ভবন, স্কুল ও পার্কের নামকরণ করেছিলেন এমন কিছু ব্যক্তির নামে যারা বস্তুতপক্ষে মানবতার বিপক্ষে কাজ করেছেন। ডান্ডাস, রায়ারসন এমনসব ব্যক্তিদেরই প্রতিনিধি। এরকম ব্যক্তি কানাডায় আরো আছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড, বৃটেনের এককালের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিল, ক্যাপ্টেন জর্জ ভেঙ্গুভার, স্যামুয়েল ডি চ্যাপলেনইন, জেমস ম্যাকগিল ও কুইন ইসাবেলা।
তাঁরা জোর করে মানুষকে দাস বানিয়েছেন, ধর্মান্তরিত করেছেন, তাদের সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছেন। কৃষ্ণবর্ণের মানুষদেরকে ঘৃণা করার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন। তাঁদেরকে শোষণ করেছেন, বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন। দখলদারিত্বের জন্য গণহত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। কিন্তু তারপরও সেই অত্যাচারী, ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী, নারী লোভী, বর্ণবাদী মানুষগুলোর ভাস্কর্য কি ভাবে এতকাল ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কানাডাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে? এবং কি উদ্দেশ্য নিয়ে?
ম্যাকগিল ইউসিভার্সিটির আর্ট ইতিহাসের অধ্যাপক চার্মাইন নেলশন বলেন, এইসব ভাস্কর্য বা স্মৃতিস্তম্ভ¢গুলো অর্থহীন, তুচ্ছ জড় পদার্থ নয়। বরং এই ভাস্কর্যগুলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা কৌশলগতভাবে বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য একটি তাবিজ হিসাবে ব্যবহার করছেন।
আজ সময় এসেছে ঐ সব ‘প্রাতস্মরণীয়’ পাষন্ড ব্যক্তিদের আসল চেহারা জনগণের সামনে তুলে ধরার। তাঁদের ভাস্কর্য সরাবার। তাঁদের স্মরণে যে সকল স্থাপনা, স্কুল ও সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সেগুলোর নাম বদলাবার। আর এর জন্য গড়ে তুলতে হবে জোর আন্দোলন।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ