প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮৪
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাবো
আবার কি ফিরে আসবো না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোন এক শীতের রাতে’
গাড়ি পার্ক করে কোনাকোনি দিয়ে আমরা গ্র্যান্ড প্লাজার দিকে যেতে যেতে জীবনানন্দ দাশের এই কবিতা হঠাৎ মনে পড়ে গেল কেন, কি জানি? আমি আসলে হয়তবা কখনো সংসারি নই। সংসারে থেকেও আমার মধ্যে এক ঘোর ‘বাউল কন্যা’ বাস করে। জীবনে কখনো গুছিয়ে সংসার করা যাকে বলে আমি কখনো তা করেছি কি? ছন্নছাড়ার মত শুধু কেবলি ‘হেথা নয়, হোথা’ এই ভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছি। সঞ্চয়ের দিকে, অলংকারের প্রতি কখনো আকর্ষণ অনুভব করিনি। সারা পৃথিবীতে হারিয়ে হারিয়ে খোঁজার মধ্যেই থাকে আমার দিবা রাত্রির স্বপ্ন। এবং কবিতার মধ্যে আমি এক পূর্ণাঙ্গ প্রেম অনুভব করি।
গ্র্যান্ড প্লেস একটা সম্পূর্ন ভাবে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস এর ডাউন টাউন অথবা সেন্টারে (ওরা সেন্টার বলে) অবস্থিত। এটা ফিফটিন সেঞ্চুরীতে নির্মিত। ফিফটিন সেঞ্চুরির প্রথম দিকে। এখানে ৮/৯টা প্রাসাদ আছে। তার মধ্যে বিখ্যাত টাওয়ার হলো ‘দি টাউন হল’। এটা একদম সেন্টারে। এই প্রাসাদটি নির্মিত হয় অনেকবার অনেক সময়। কয়েকবারে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে এটা নির্মান করা হয়। এটা ১৪০১ – ১৪৫৫ সালের মধ্যে নির্মান করা হয়।
গোটা ইউরোপের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট হলো স্বর্ণের আধিক্য। সেটা হয়তোবা অরিজিনাল অথবা প্রলেপও হতে পারে। প্রথম দেখলাম এটা বার্কিং হাম প্যালেসে। এরপর লন্ডনের বেশ কিছু জায়গাতে। তবে বেলজিয়ামে এর আধিক্য অনেক বেশী ছিল। বেলজিয়ামের এই গ্র্যান্ড প্লেস-কে স্থানীয়রা ‘ Grote markt ’ও বলে থাকে।
এখানে অনেকগুলো প্রাসাদ থাকলেও মেইন প্রাসাদ হলো ‘Bargue guild hal’। এটা বলতে গেলে একই সাথে সরকারী ভাবে সংরক্ষিত হলেও এটা সাধারণ অথবা ট্যুরিস্টদের জন্যও খোলা থাকে। যদিও এই গ্র্যান্ড প্লেস এর মেইন প্রাসাদটি মেয়র হল হিসাবেই এখন বেশী পরিচিত। এখানে অনেকগুলো প্রাসাদ। ৮/৯টি হবে। তবে মজার ব্যাপার হলো প্রাসাদগুলো এমনভাবে করেছে যে ঠিক স্কয়ার সেপ এসেছে মাঝখানে। এত সুন্দর পরিকল্পিতভাবে করেছে যে ‘মেয়র প্রাসাদ’ যেটাকে বলা হয়, ওখানে রাষ্ট্রিয় কার্যকলাপ করা হয়। এবং জাতীয় ফ্ল্যাগ সর্বদা পতপত করে উড়ছে। যে জন্য ট্যুরিস্টরা বুঝে ফেলে যে, এটা কোন সরকারী ভবন। এবং খুব আশ্চর্য হলাম যে, সেই সময়কার আর্কিটেক্টরা কতটা ক্যালকুলেটিভ। প্রতিটি প্রাসাদ দূর থেকে একই রকম মনে হলেও কাছে গেলেই বোঝা যাবে একটার সাথে অন্যটার ডিজাইন এবং স্থাপত্যে কোন মিল নাই। প্রাসাদের উপরি ভাগেও সুন্দর কালার কম্বিনেশন করেছে। কোনটার উপরিভাগ এ্যাশ (সুরমা) কালার। অন্যটা স্বর্ণালী বর্ণের। ওগুলো সি সত্যিকারের সোনা? নাকি সোনার রং করা যাকে আমরা বলি গোল্ড প্লেটেড? আমার এ বিষয়েও চিন্তা শুরু হলো। এত বিশালত্ব যে চোখ যেন ধাঁধিয়ে যায়। প্রাসাদগুলো ঠিক কোন মানুষ বাস করে না বসত বাটি হিসাবে। তবে সব থেকে বড় প্রাসাদ যেটাকে গ্র্যান্ড প্লেস বলে সেটা সিটি হল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অন্যটা মেয়রের কার্যালয়। সরকারী কর্মকান্ড সব এখানেই হয়। এছাড়া ট্যুরিস্টদের জন্য বিভিন্ন রকম কার্যক্রম প্রতিদিন একটার পর একটা করে চলছে বিরামহীন। এছাড়া বছরের বিশেষ সময়ের জন্য রয়েছে এদের বিশেষ আয়োজন। যেমন ক্রীসমাসের সময় সব এলাহী আয়োজন। আমি এসেছি ক্রীসমাসে, তাই এখন সব অসাধারণ আয়োজন, ডেকোরেশন, কনসার্ট ইত্যাদি লক্ষ্য করছি। কিন্তু বসন্তে এরা করে একটা বিশেষ আয়োজন। আগেই বলেছি এর আর্কিটেক্টদের বিশেষ ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ যে, তারা সেই ১৫০০ সেঞ্চুরীতে এভাবে হিসাব করে এই প্রাসাদ নির্মান করেছিল। প্রাসাদগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে করেনি। এরা ঠিক হিসাব করে করেছে। মাঝখানে এটা চৌকা জায়গা রেখেছে। এই চৌকা জায়গা সত্যিই অভূতপূর্ব। আর চৌকা জায়গাটির চারপাশ ঘিরে প্রাসাদগুলো অবস্থিত। এই স্কয়ার বা চৌকা জায়গাটি ২২৩ বাই ৩৬১ ফিট। সত্যি আশ্চর্যজনক ব্যাপার। কিভাবে এত বড় বড় প্রাসাদ নির্মান করলো, পর পর মাঝখানে চৌকা জায়গা রেখে। মাঝখানে দাঁড়িয়েই আপনি প্রতিটি প্রাসাদ আলাদা আলাদা ভাবে অবলোকন করতে পারবেন। আমি অবশ্য বেশীর ভাগ সময়টাতে সেটাই করছিলাম। আমার কাছে কেন জানি মনে হয়, প্রতিটি সৌন্দর্য দূর থেকে যতটা সুন্দর বা আপনাকে বিমোহিত করবে, কাছে গেলেই ‘চাঁদ’ এর মত খানা খন্দ বেরিয়ে পড়বে। আমার মনে হয় সব সৌন্দর্যের মধ্যেই একটা কলঙ্ক থাকে। আমি তাই দূর থেকে অবলোকন করছিলাম।
খুব বেশী দিন আগের কথা নয় এই অসাধারণ সৌন্দর্য মন্ডিত জায়গাটিকে স্থানীয়রা একটা মার্কেট এরিয়া হিসাবে ব্যবহার করতো। চারপাশে সপিং সেন্টার। এখানে তখন বিভিন্ন রকম ব্যবসায়ীরা দোকানপাট করতো। এমনকি অবিশ^াস্য হলেও সত্য যে এখানে রোজকার কাঁচাবাজার চলতো। এরপর স্থানীয় জনগণ এবং ব্রাসেলস এর উচ্চ পর্যায়ের মানুষ পর্যবেক্ষণ করলো যে, ট্যুরিস্টরা খুব আগ্রহের সাথে এই প্রাসাদগুলো অবলোকন করছে। এবং প্রাসাদের নির্মান ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তখন-ই তারা একে আবারো, প্রাসাদগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছে। এখন এটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি দর্শনীয় স্থান। আমরা অনেক্ষণ ঘুরাঘুরি করে, একটা বড় কনসার্ট হচ্ছিল, সেটা কিছুক্ষণ শুনলাম। এদিকে হাটতে হাটতে, ঘুরতে ঘুরতে পেটের মধ্যে ক্ষুধার উৎপাত শুরু হলো। বেলজিয়ামের ‘শর্মা’ পৃথিবী বিখ্যাত। সব মরক্কোর সেফ। একটা হালাল রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকলাম। শর্মা’র অর্ডার করলাম। সত্যিই সাধে গন্ধে অপূর্ব। এরপর মিঠু ‘সিটি ট্যুর’ করতে চাচ্ছিল। আমি বললাম, ওটা আগামীকাল Falon এর মিউজিয়ামে যাবার আগে ঘুরবো। তার আগে জলদি করে আমি ‘কেভস অফ হান’ দেখবো। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের পথ এটা। আমরা যখন পৌঁছালাম, কপাল ভাল তখনও টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল, ভেতরে যাতায়তের। এরা ভেতরে এক সাথে সবাইকে ঢুকতে দেয় না। ৫/১০ জনের ছোট ছোট দলে এই সফর উপভোগ করতে দেওয়া হয়। অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকরা আপনার ভূগর্বস্থ অভিযানের পুরো সময়কালে আপনার সাথে থাকবেন। সমগ্র গুহাপথ হাটা রীতিমত চ্যালেঞ্জিং শারীরিকভাবে। আমার তো পায়ের যে অবস্থা! তবু জিদ ধরলাম যাবো।
এই গুহার নাম ফরাসি ভাষায় ‘গ্রত দে হান’ অথবা ইংরেজীতে বলে কেভস অফ হান। আর বাংলায় বলে ‘হান এর গুহা সমূহ’। বেলজিয়াম এর ‘হান-সুর-লেস’ শহরের অনাগত স্থানে এটি অবস্থিত। ইউরোপের অন্যতম সুন্দর অবিকৃত গুহায় গহ্বরের জগত আবিস্কার। এটি ১৯৬৮ সালে আবিস্কৃত হয়েছিল। ক্রিসমাসের পরের দিন। হান-সুর-লেসে গুহা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কয়েক বছর ধরে (শুধু মাত্র নিয়োগের মাধ্যমে) জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, এবং অভিযাত্রী এবং দুঃসাহসীদের জন্য একইভাবে আনন্দের উৎস। এর মধ্যে প্রবেশ করার আগে ট্যুরিস্টদের কিছু আনার প্রয়োজন নেই। কারণ, এর ভেতরে যাত্রা শুরু করার আগে যা কিছু প্রয়োজন সবই এরা দিয়ে থাকে। যেমন হেলমেট, হেডল্যাম্প, সুরক্ষামূলক ওভার স্যুট এবং বুট। তারপর দেখা শেষ হলে সেগুলো আবার ফেরত দিতে হয়। আবার ইচ্ছে করলে আপনি আপনার নিজের বুটও আনতে পারেন।
আমার জীবনের সব থেকে একটি চ্যালেঞ্জিং সফর ছিল এটি। আমার হাসবেন্ড এবং আমার কাজিন মিঠুর পূর্ণ সহায়তা ছাড়া এই প্রচন্ড চ্যালেঞ্জিং সফর সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে বাদুড়ও আছে। তবে সেই জন্য এরা হেডলাইট দিয়ে থাকে। হেডলাইটের আলোতে বাদুড়গুলো ভয় পেয়ে সাময়িকভাবে অপসারিত হয়। এই সফরের গাইড-ও আমাকে প্রচুর হেল্প করেছিল। তবে আমি নিজে হার্টের রোগী অথবা মানসিক ভাবে দূর্বল চিত্তের ট্যুরিস্টদের এটি দেখার জন্য পরামর্শ দিব না। তবে দেখে আসার পর আপনার যে অনুভূতি হবে সেটা অবর্ণনীয়। আমি এদের বলিনি যে আমি হার্টের রোগী। এরা বারবার জিজ্ঞেস করছিল।
তাই ‘হান-সুর-লেস’ শহর দেখে আসার পর আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরদিন আমরা আর সকাল সকাল যাত্রা করতে পারিনি। পরদিন ১২টার পরে বের হয়েছিলাম।
আমার প্রতিটি ট্যুরের আগেই এটা মনে হয় যে, মানুষ তো একবারই মৃত্যুবরণ করবে। অতএব, লেটস গো। যার জন্য আমি মাঝে মধ্যেই এরকম রিস্কী ডিসিশন নিয়ে ফেলি। তবে আমার পাঠকদের আমি অনুরোধ করবো, এরকম না করতে। জানের ক্ষতি হতে পারে। (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।
gulshanararina@gmail.com