কানাডায় শ্বেত সন্ত্রাসীদের হত্যাযজ্ঞ : কুইবেকের পর লন্ডন, এরপর কোথায়?
খুরশিদ আলম : কানাডায় মুসলমানদের উপর আবারো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলো। এবারের হামলায় প্রাণ হারালেন একই পরিবারের তিন প্রজন্মের চার সদস্য। আর অল্পের জন্য বেঁচে যায় ৯ বছরের এক শিশু। তবে আহত হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
নিহতদের মধ্যে আছেন তালাত আফজাল (৭৪), তাঁর ছেলে সালমান আফজাল (৪৬), পুত্রবধু মাদিহা সালমান (৪৪) এবং নাতনী ইউমনা আফজাল (১৫)। আহত শিশুটির নাম ফয়েজ আফজাল। রাস্তা পারাপারের সময় অতর্কিতে তাঁদের উপর একটি পিকআপ ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই হামলা ঘটনো হয়।
অন্টারিও প্রভিন্সের লন্ডন শহরে সন্ত্রাসী এই হামলার ঘটনা ঘটে গত ৬ জুন রবিবার সন্ধ্যায়। হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যান নামের ২০ বছর বয়সী এক শে^তাঙ্গ যুবককে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ৪ জনকে হত্যা ও আরেকজনে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ঘটনার দিন রাত পৌনে নয়টার দিকে পরিবারটি প্রতিদিনকার মত হাটতে রেরিয়েছিলেন। স্থানীয় হাইড পার্ক রাস্তা ধরে হাটার এক পর্যায়ে তাঁরা যখন রাস্তা পারাপারের জন্য গ্রীন লাইটের অপেক্ষা করছিলেন তখনই ঘটে হামলার ঘটনাটি। পুলিশ জানায় ইসলামবিদ্বেষ থেকেই পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়।
হামলার দুদিন পর কানাডার পার্লামেন্টে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, এটি সন্ত্রাসী হামলা। কোন সড়ক দুর্ঘটনা নয়। ইসলামবিদ্বেষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। কানাডার শে^তাঙ্গ বর্ণবাদী গোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
লন্ডনের মেয়র এড হোল্ডার নিহতদের পরিবার ও নগরীর মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, এটি একটি গণহত্যার কাজ যা ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং লন্ডনবাসীর বিরুদ্ধে। অবর্ণনীয় বিদ্বেষ এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে আমাদেরকে অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে মমত্ববোধ, সহানুভূতি, ন্যায়বিচার এবং সর্বোপরি ভালবাসা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
ঘটনার পর লন্ডন পুলিশ প্রধান স্টিভ উইলিয়াম ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমাদের কমিউনিটির এই চার সদস্যকে হারানো একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা।
নিরাপরাধ ও নিরীহ মুসলিম পরিবারটিকে নির্মম ভাবে হত্যা করার খবর মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে লন্ডনসহ গোটা কানাডায় এক শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়। নিহতদের স্মরণে লন্ডনে তিন দিন পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। দূরদুরান্ত থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে এসে নিহতদের প্রতি সম্মান জানান অনেকেই পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। নিন্দা জানান নির্মম এই হত্যাকান্ডের।
উল্লেখ্য যে, হামলাকারী ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যানের বিরুদ্ধে আগের কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। আর সে কোন বিদ্বেষী গ্রুপ বা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত এমন তথ্যও তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ খুঁজে পায়নি। এ কথা জানান লন্ডন পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর পল ওয়েট।
তবে কানাডার জননিরাপত্তা মন্ত্রী বিল ব্লেয়ার নিশ্চিত করেছেন যে লন্ডনের ঘটনাটি পুলিশ তদন্ত করছে সন্ত্রাসবাদের একটি কাজ হিসাবে। তিনি বলেন, লন্ডনের ঘটনাটি পরিস্কারভাবেই বিদ্বেষপ্রসূত। এটি স্পষ্টতই বর্ণবাদী ও সন্ত্রাসী কর্ম। সিবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
উল্লেখ্য যে কানাডায় মুসলিমদের উপর ভয়াবহ হামলার এটি তৃতীয় ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী। ঐ দিন ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিবের নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন।
মসজিদে মাগরিব নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের উপর হামলা চালানোর পর গাড়িতে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন আলেকজান্ডার। ঘটনাস্থল থেকে কিছু দূর গিয়ে ২৭ বছর বয়সী ঐ যুবক নিজেই ৯১১ এ কল করে পুলিশ ডাকেন এবং গুলিবর্ষণের ব্যাপারে পুলিশকে সহযোগিতার কথা বলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁর গাড়িতে তল্লাসী চালিয়ে দুটি রাইফেল এবং একটি একে-৪৭ রাইফেল উদ্বার করেন।
সেদিন প্রধানমন্ত্রী কানাডিয়ানদেরকে ভীত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশ্য আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা, তাঁরা চায় অনৈক্য সৃষ্টি করতে এবং বিদ্বেষের বীজ রোপন করতে। আমরা তা হতে দিব না। তিনি কানাডায় বসবাসরত ১০ লাখ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কানাডার ৩৬ মিলিয়ন হৃদয় আপনাদের সঙ্গে সহমর্মী। আপনারা জেনে রাখুন আমরা আপনাদেরকে মূল্যায়ন করি। আপনারা কানাডার সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন অপরিমেয় ভাবে। আপনরা এ দেশেরই অংশ।
মুসলিম হত্যার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ইটোবিকোক এর ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম অর্গানাইজেশন অব টরন্টো’র মসজিদের সামনে। গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর ঘটে এই নৃশংস হত্যার ঘটনা। ঐ মসজিদের স্বেচ্ছাসেবক এক মুসল্লিকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সমর্থক Guilherme ‘William’ Von Neutegem নামের এক যুবক। নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আসলিম জাফিস। ৫৮ বছর বয়স্ক আসলিম জাফিস ঐ দিন সন্ধ্যায় রেক্সডেল এবং কিপলিং এ্যাভিনিউর (৬৫ রেক্সডেল) নিকটবর্তী ঐ মসজিদের সামনে একটি চেয়ারে বসেছিলেন। ভিডিওতে দেখা গেছে খুনী Von Neutegem চেয়ারে বসে থাকা আসলিম জাফিস এর পিছন দিক থেকে এসে সহসা আক্রমণ করেন। আসলিম জাফিস আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেই অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যু হয়। Von Neutegem-কে পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার এর অভিযোগ আনা হয়। কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, Von Neutegem ব্রিটেনের একটি বিদ্বেষী গ্রুপের অনুসারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একটি শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদী গ্রুপেরও অনুসারী সে।
কুইবেক সিটি এবং ইটবিকোকের নৃশংস দুই হত্যাকান্ডের ভীতিকর স্মৃতি কানাডিয়ান মুসলিমদের মনে এখনো জীবন্ত হয়ে আছে। এবার তার সঙ্গে যোগ হলো হৃদয়বিদারক আরেক ভয়ঙ্কর স্মৃতি।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, কুইবেকের ঘটনার পর কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সে সময় হ্যালিফেক্স সেন্টার ফর ইসলামিক ডেভলাপমেন্ট এর ইমাম জিয়া খান বলেছিলেন, ‘কমিউনিটির অনেকেই মনে করছেন কুইবেকের হত্যাযজ্ঞ বর্ধিত সহিংসতার শুরু মাত্র।’
জিয়া খান বলেছিলেন, ‘কুইবেকের ঘটনা এমন নয় যে তা শুধু মাত্র আমাদেরকে বিচলিত করছে, এটি এমন একটি ঘটনা যা রীতিমত আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাঁরা এখন ভাবছেন এর পরের টার্গেট কোন মসজিদ? তিনি বলেছিলেন এ ধরণের ভাবনা বা অনুভূতির মধ্যে থেকে কেউ স্বস্তি অনুভব করতে পারেন না। কমিউনিটির কেউ কেউ ভীত হয়ে আছেন ভবিষ্যতে আরো আক্রমণ ঘটতে পারে এই আশংকায়।’
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, কুইবেকের মসজিদে হামলার পর মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আবারো হামলা হতে পারে বলে যে আশংকা দেখা দিয়েছিল তা একেবারেই অমূলক ছিল না। গত ৬ জুন লন্ডনের ঘটনায় এবং তারো আগে ইটবিকোক এর মসজিদের সামনের ঘটনায় তা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়ে গেল।
এবং এবার আবারো সেই আশংকা! লন্ডনের ঘটনার পর এর পরের টার্গেট তাহলে কে বা কারা অথবা কোন মসজিদ?
উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের উপর ছোটখাট বিদ্বেষী হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে কানাডায়। মসজিদে হামলা, হিজাব পরিহিতা মহিলাদের উপর হামলা ঘটেই চলেছে এবং দিনে দিনে এর মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এগুলো ঘটাচ্ছে কানাডার উগ্র শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা। অনলাইনেও এই উগ্রবাদীরা বেশ সক্রিয়। সিটিভি নিউজে প্রকাশিত নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে রক্ষণশীল কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়লগ (ISD)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ও গত বছর ১২ জুন প্রকাশিত গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আয়রন মার্চ, ফেসিস্ট ফোর্জ, ফোরচ্যান ও গ্যাব (4chan and Gab) এর মত বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে কানাডার বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গবাদী উগ্র সম্প্রদায় সক্রিয়।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গবেষকরা দেখেছেন, প্রান্তিক সাইট ফোরচ্যান-এর ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ নামের একটি বিশেষ মেসেজ বোর্ডে রক্ষণশীল কানাডীয়রা ১৬ লাখেরও বেশি পোস্ট দিয়েছেন।
আইএসডির সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টের অন্যতম লেখক জ্যাকব ডাভে সিটিভি নিউজ -কে বলেন ‘এর ফলে মনে হচ্ছে এটি সত্যিই এমন একটি বিষয় যেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে ব্যবহারকারীদের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে লক্ষ্য করে চরম নোংরা কায়দায় ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে।’
উল্লেখ্য যে, অন্টারিও’র লন্ডন শহরে গত কয়েক বছর ধরেই ঘৃণা বা বিদ্বেষী হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার তথ্য থেকে জানা যায়। এই সংস্থাটির হিসাবে দেখা যায় গত ২০১৫ সালে লন্ডনে ২০টি বিদ্বেষী ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন ঘটনা এগুলো। পরের বছর এর মাত্রা সামান্য কমে ১৭টিতে দাঁড়ায়। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে তা আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঐ সালে ঘৃণাজনিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ২৬টি, ২০১৮ সালে ৩৪টি এবং ২০১৯ সালেও ৩৪টি। তবে ঐ সময়ের মধ্যে বিদ্বেষের কারণে হত্যাকান্ডের কোন ঘটনা ঘটেনি লন্ডনে। কিন্তু ২০২১ সালে এসে ঘটলো মর্মান্তিক এক হত্যাকান্ডের ঘটনা।
হত্যাকান্ডের শিকার পরিবারটি সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা জানা গেছে
সিবিসি নিউজের সূত্রে জানা যায়, সালমান আফজাল এবং মাদিহা সালমান পাকিস্তান থেকে কানাডায় এসেছিলেন ২০০৭ সালে। নতুন জীবনের সন্ধানে এবং শিশু কন্যা ইউমনা আফজালের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁদের কানাডায় আসা। ছেলে ফয়েজ আফজালের জন্ম হয়নি তখনো। তাঁদের কোন ঘনিষ্ট আত্মীয়ও ছিল না তখন এখানে।
মাদিহা সালমান : মাদিহা সালমান পাকিস্তান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি নেন। ক্লাশে ১৭৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনিই একমাত্র মহিলা ছিলেন। কানাডায় আসার পর লন্ডনের ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টর্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পিএইচডি করার জন্য পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
মাদিহা ছিলেন একজ উদ্যমী, দীপ্তিমান, উদার এবং স্নেহময়ী নারী। তিনি এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ কাজ করেছেন। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন একটি সুন্দর পরিবার এবং জোরালের অবদান রেখেছেন নিজ পেশা ও কমিউনিটি নেটওয়ার্কে।
ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র মোয়াজ শেখ বলেন, ‘মাদিহা সবসময় আমাদের যে কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। ইউনিভার্সিটিতে তিনি ছিলেন আমাদের ইনস্ট্রাকটর। ক্লাশের পরও আমরা তাকে পেতাম সাহায্যের জন্য। তিনি ছিলেন খুবই সহায়ক একজন শিক্ষক।’
মাদিহা একজন লেখকও ছিলেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তিনি কলাম বা প্রবন্ধ লিখতেন। তিনি তার লেখনী ব্যবহার করতেন ভালবাসা ও শান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এ কথা জানান তার পারিবারিক বন্ধু হালিমা খান।
সালমান আফজাল : মাদিহার স্বামী সালমান আফজাল ছিলেন একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। পাকিস্তানের করাচী ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করেন ১৯৯৭ সালে। লন্ডনের স্থানীয় বিভিন্ন কেয়ার হোমে বসবাসরত বয়স্ক ব্যক্তিদের তিনি সেবা দিতেন অত্যন্ত আন্তরিকতা ও ভালবাসা দিয়ে। স্থানীয় Ritz Lutheran Villa নামের কেয়ার হোমের প্রধান নির্বাহী জেফ রেনেউদ সিবিসি নিউজকে বলেন, সালমান আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিতেন আমাদের মা-বাবা, আমাদের দাদা-দাদী ও নানা-নানীদের। তিনি বয়স্কদের সঙ্গে কাজ করতেন অত্যন্ত সহৃদয়তা ও যত্ন সহকারে। তাঁদের প্রতি সালমানের ছিল গভীর ভালবাসা। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন একজন মহান ব্যক্তি। সদাহাস্যময়ী সালমান ছিলেন পজিটিভ মাউন্ডের এবং সাহায্যের জন্য সদাপ্রস্তুত থাকতেন। দারুন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসাবে তার সুনাম ছিল।
স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটিতেও সালমান ছিলেন সুপরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন একজন ব্যক্তি।
ইউমনা আফজাল : ইউমনা আফজাল লন্ডনের স্থানীয় অকরিজ সেকেন্ডারী স্কুলে গ্রেড ৯ এর ছাত্রী ছিল। তার আগে সে লন্ডন ইসলামিক স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। সেখানকার প্রিন্সিপাল আসাদ চৌধুরী বলেন, ‘ইউমনা ছিল একজন দারুন মেয়ে এবং রোল মডেল স্টুডেন্ট।’
অকরিজ স্কুলের প্রিন্সিপাল মাইক ফিলিপস বলেন, ‘ইউমনা গত সেপ্টেম্বরে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। মাহমারীর কারণে পরবর্তী সময়ে ক্লাশগুলো মূলত অনলাইনেই চলছিল। তবে এর মধ্যেও ইউমনা তার শিক্ষকদের মাঝে একটি ইমপ্রেশন তৈরী করতে পেরেছিল। যে কজন শিক্ষকের ক্লাশে সে যোগ দিয়েছে তাঁরা বলেন, ইউমনা ছিল নিবেদিত প্রাণ একজন আদর্শ শিক্ষার্থী। শিক্ষা গ্রহণে সে খুব উৎসাহী ছিল এবং সহ-শিক্ষার্থী ও স্কুল উপভোগ করতো। তার স্বপ্ন ছিল কর্মজীবনে সে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে এবং তার মধ্য দিয়ে সে সকলের সেবা করে যাবে।’
ইউমনা’র দাদী নিহত তালাত আফজাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তিনি পাকিস্তান থেকে এসে আফজাল- মাদিহা পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন।
এদের সবারই একটি করে সুন্দর স্বপ্ন ছিল। ছিল একের প্রতি অন্যের ভালবাসা। সমাজের প্রতিও ছিল তাঁদের ভালবাসা ও কর্তব্য নিষ্ঠা। ছিল অবদানও। কিন্তু সবকিছু মূহুর্তেই গুড়িয়ে দিলেন বর্ণবাদী ও শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী এক সন্ত্রাসী যুবক। সালমান পরিবারের চারজনকে খুন করার পরও তার মধ্যে কোন অনুশোচনা ছিল না। পুলিশ যখন তাকে নিকটস্থ এক পার্কিং লট থেকে গ্রেফতার করে তখনও নাকি তার মুখে ছিল হাসি। অর্থাৎ সে যা করেছে তার জন্য সে তৃপ্ত। যেমনটা লক্ষ্য করা যায় মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের চোখে-মুখেও। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সন্ত্রাসীরই একই চরিত্র।
ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যানের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে আদালতে। লন্ডন পুলিশের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে এই হামলা ছিল পরিকল্পিত এবং মুসলিম বিদ্বেষপ্রসুত।
কে এই ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যান
২০ বছর বয়সী ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যান সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। একটি এ্যগ প্যাকেজিং ফ্যাক্টরীতে পার্ট-টাইম কাজ করে আসছিলেন তিনি। কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন কোন প্রমাণ পুলিশ এখন পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। এ তথ্য জানায় সিটিভি নিউজ। লন্ডন ডাউনটাউনে অবস্থিত একটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ তিনি বাস করতেন।
ন্যাথানিয়েল এর বাবা-মা’র ডিভোর্স হয়ে যায় ইতিপূর্বে। তাঁরা ৬ ভাই-বোন। ন্যাথানিয়েল এর একটি যমজ বোন রয়েছে। এই যমজ ভাই-বোন সবার বড়। বাবা-মা’র ডিভোর্সের পর ন্যাথানিয়েল মায়ে সঙ্গে থাকতেন। তবে ডিভোর্সের জন্য সে তার মাকেই দোষারোপ করেন। পরে সে তাঁর এক মেয়ে বন্ধুর বাসায় থাকা শুরু করেন। এর কিছুদিন পর তিনি নিজে একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া করে সেখানে চলে যান।
ন্যাথানিয়েল এর বাবা মার্ক ভেল্টম্যান গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘হত্যাকান্ডের খবরটি আমার কাছে ছিল প্রচন্ডভাবে একটি অভিঘাতের ও আতঙ্ককের। যারা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানানোর কোন উপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই।’
মাহামারীর মাধ্যেও মানুষের ঢল নেমেছিল শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো-ও
গত ১২ জুন শনিবার লন্ডনের ইসলামিক সেন্টার অফ সাউথওয়েস্ট অন্টারিও’র পার্কিং লটে অনুষ্ঠিত হয় নিহতদের জানাযা। এ সময় নিহতদের প্রতি সম্মান জানাতে পাশর্^বর্তী ফুটবল মাঠে জড় হয়েছিলেন অন্যান্য কমিউনিটির বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ।
শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কানাডার ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল রাজনীতিবিদদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন লিবারেল পার্টি প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা এরিন ও’টুল, অপর বিরোধী দল এনডিপি’র নেতা জাগমিত সিং, অন্টারিও’র প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি প্রধান ও প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড এবং অন্টারিও’র প্রধান বিরোধী দল এনডিপি নেতা এন্ড্রিয়া হরওয়থ। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ শোকার্ত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, ‘কানাডায় ইসলামোফোবিয়া বিদ্যমান, বর্ণবাদ বিদ্যমান। কিন্তু এগুলোর শিকার হওয়া উচিত নয় করো। আমাদের সবাইকে একত্র হয়ে দাঁড়াতে হবে। ইসলামোফোবিয়া, বিদ্বেষ, সন্ত্রাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে বলতে হবে না না।’ খবর সিটিভি নিউজের।
একই অনুষ্ঠানে কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান এরিন ও’টুল বলেন, ‘কানাডায় ইসলামোফোবিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য দলীয় নেতাদেরকে রাজনীতি একপাশে রেখে এগুতে হবে। বিভিন্ন প্রভিন্সের প্রিমিয়ার, সিটির মেয়র, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে সহিংসতা ও বিদ্বেষকে মোকাবেলা করার জন্য।’
এনডিপি নেতা জাগমিত সিং বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসবাদকে জয়ী হতে দিব না। আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না। লন্ডনের এই হত্যাকান্ডের পর আমাদেরকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিনি প্রশ্ন রাখে বলেন, ‘আর কত লাশ পড়লে আমরা বাস্তব পদক্ষেপ নিব? প্রকৃত পরিবর্তন আনার জন্য আর কতজন মুসলিম ভাই ও বোনকে প্রাণ দিতে হবে? আমাদেরকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড এই হত্যাকান্ডকে সন্ত্রাসবাদ এবং ঘৃণাজনিত অপরাধ হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এই ভয়াবহ অপরাধ নিখুঁতভাবে ঘৃণা ও বর্ণবাদ দ্বারা প্ররোচিত হয়েছে। এটি একটি অপরাধ। একটি পরিবারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কর্ম এটি।’
অন্টারিও এনডিপি নেতা এন্ড্রিয়া হরওয়থ বলেন, ‘এই ধরণের বিদ্বেষপ্রসুত সন্ত্রাসী কার্যক্রম অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অন্টারিও’র অধিবাসীদেরকে এই সত্যতা স্বীকার করতে হবে যে এখানে বিদ্বেষ বিদ্যমান এবং মুসলিম সম্প্রদায় কানাডায় বিদ্বেষের ভয় মোকাবেলা করে আসছে। আমাদেরকে অবশ্যই এটি স্বীকার করতে হবে এবং এটি হলো প্রথম পদক্ষেপ। ইসলামোফোবিয়া, শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সহিংসতা এবং তাঁদের ঘৃণাজনিত অপরাধ এখানে খুবই বাস্তব, খুবই পরিচিত যা মুসলিম সম্প্রদায় মোকাবিলা করে আসছে।’
এদিকে হত্যাকান্ডের পর গত ১৫ জুন অন্টারিও’র লন্ডন সিটি কাউন্সিল সর্বসন্মতিক্রমে এক প্রস্তাব পাশ করে ইসলামোফোবিয়াকে নিন্দা জানানোর জন্য। তার কদিন আগে ১১ জুন লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ধর্মে বিশ^াসী লোকদের সম্মিলিত পদযাত্রা। কয়েক হাজার লন্ডনবাসী এই পদযাত্রায় যোগ দেন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানাতে। একই ধরণের পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় টরন্টো, কিচেনার, ওয়াটারলু, থান্ডার বে, অটোয়া-সহ আরো কয়েকটি শহরে।
নিহত আফজাল-মাদিহা পরিবারের বন্ধু ইয়াসমীন খান বলেন, ‘বিভিন্ন ধর্মে বিশ^াসী লোকদের এই সম্মিলিত পদযাত্রা মুসলিম কমিউনিটির প্রতি সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সমর্থনের অর্থ হলো আমরা পরিবর্তনের এক ধাপ কাছাকাছি পৌঁছেছি।
মুসলিম বিদ্বেষ অনেকদিন ধরেই ‘স্বাভাবিক’ পর্যায়ে
সিবিসি নিউজ জানায়, লন্ডনের এই হত্যাকান্ডের পর মুসলিম কমিউনিটিতে একদিকে যখন শোকের গভীর ছায়া নেমে এসেছে তখন এর পাশাপাশি জোরালো দাবী উঠেছে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে আরো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য।
মার্কহামে অবস্থিত মানবতা বিষয়ক এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ফাইরাজ আজিজ বলেন, ‘এখন সময় এসেছে কিভাবে আমরা এই বাধা অতিক্রম করবো সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার। শুধু ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে নয়, বিদ্বেষ, বর্ণবাদ, ইহুদী বিদ্বেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধেও।’
অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রধান কমিশনার এনা চাধা বলেন, ‘এ জাতীয় ঘটনাগুলো দুঃখজনক ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যে অন্টারিওতে ইসলামোফোবিয়া আর জেনোফোবিয়া (ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে অহেতুক ভয়) বাস্তব এবং চলমান।
লন্ডনের এই হত্যাকান্ডের আগে গত চার বছরে কানাডায় আরো দুটি বর্বরোচিত হত্যাকান্ড ঘটেছে যার টার্গেট ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। প্রথমটি ঘটে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে কুইবেক সিটিতে এবং দ্বিতীয়টি ঘটে ইটবিকোকে গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর। এ কথা বলেন ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস’ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা ফারুক। তিনি বলেন, ‘নৃশংস এই তৃতীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা কানাডার মুসলিমদের মধ্যে ভয়, ক্রোধ, হতাশা এবং ক্লান্তির নতুন অনুভূতি তৈরী করেছে। কানাডার মাটিতে এটি একটি সন্ত্রাসী হামলা। ইসলামোফোবিয়া কানাডায় এখনো বড় ধরণের সমস্যা।’
উল্লেখ্য যে, কানাডায় সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম বিরোধী তৎপরতা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিপূর্বে হাফিংটন পোস্টে (অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায় টরন্টো নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত দুটি মসজিদে গত বছর তিন মাসের ব্যবধানে মোট ৬ বার হামলা হয়েছে। এসব হামলার মধ্যে আছে মসজিদের ভেতরে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা, জানালা ভেঙ্গে ফেলা এবং জানালা ও দেয়ালে বর্ণবাদী চিত্র এঁকে রাখা। মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা (এমএসি) তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এসব তথ্য উল্লেখ করেছে।
সংগঠনটি বলেছে, ‘এখন এসব ঘটনা ঘটছে ভীতিকর হারে। আমরা পুলিশি তৎপরতার জন্য অপেক্ষার বিষয়টি আর মেনে নিতে পারি না।’
এএমসি মুসলিমদেরকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে কর্তৃপক্ষকে এখনই ‘পদক্ষেপ নেওয়ার” আহবান জানিয়ে বলেছে, টরন্টোর সবচেয়ে বেশি মানুষ আসা এই মসজিদে মুসলমানদের ভীতি প্রদর্শনের জন্যই এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে মনে হয়।
কানাডার মুসলমানদের জাতীয় পরিষদের সিইও মোস্তফা ফারুক হাফিংটন পোস্ট কানাডাকে বলেন, ‘হামলার ঘটনাগুলোর তদন্তে পুলিশ যে প্রক্রিয়ায় তদন্ত করে তা ‘পুরোপুরি অর্থবহ নয়।’
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে যেমনটা বোঝা যাচ্ছে সেটি হলো, প্রথম সন্দেহভাজন চিহ্নিত হবার কয়েক দিন পরই পুলিশ ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ নাকচ করে দেয়। এটাই ‘সমস্যা।’
এদিকে গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত এক বিশেষ জরিপে দেখা গেছে, কানাডায় বর্ণবাদ বা জাতিবিদ্বেষকে এখন তেমন একটা বড়ো সমস্যা হিসাবে দেখা হচ্ছে না যদিও কানাডায় ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ বা হেট ক্রাইম বেড়েই চলেছে। গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত ইপসস-এর বিশেষ ঐ জরিপে এই বলা হয়, এক-চতুর্থাংশেরও বেশি কানাডীয় মনে করেন, গত পাঁচ বছরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার বিষয়টি ‘অধিকতর গ্রহণযোগ্য’ হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ২০১৭ সালে কানাডায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইমের সংখ্যা ১৫১ শতাংশ বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি হেট ক্রাইম ঘটেছিলো অন্টারিও ও কুইবেকে। অন্টারিওতে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন হেট ক্রাইমের সংখ্যা বাড়ে ২০৭ শতাংশ আর কুইবেকে ১৮৫ শতাংশ। মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্যের এই বিস্ফোরণের কারণ কী?
অন্টারিও ইউনিভার্সিটির টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের হেট ক্রাইম বিশেষজ্ঞ বারবারা পেরি বলেন, কানাডায় ইসলামভীতি সব সময়ই ছিলো কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, এর পেছনে অনেক উপাদান সক্রিয় তবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ট্রাম্পের প্রভাব।’
বারবারা পেরি বলেন, কানাডায় যদিও মুসলিমবিরোধী বক্তৃতাবাজী সব সময়ই ছিলো কিন্তু ২০১৭ সালে সেটা হেট ক্রাইমের আকারে বেড়ে গেছে এবং দেশজুড়ে কিছু সংগঠিত শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী গ্রুপ সেটা লুফে নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কানাডায়ও হিংসাশ্রয়ী গ্রুপের ক্রমবিকাশ নিয়ে সেদেশবাসীর সচেতন হওয়া দরকার। বারবারা পেরির বক্তব্য অনুযায়ী, সারা কানাডায় কমপক্ষে ১৩০টি চরম ডানপন্থী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তিনি বলেন, এই সংখ্যাটি ২০১৫ সালের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
উল্লেখ্য যে, টরন্টোর নিকটবর্তী ইটবিকোকের একটি মসজিদে গত ১২ সেপ্টেম্বর জাসিফ নামের এক মুসল্লিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনার পর কানাডায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলো ভেঙ্গে দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলো। কানাডিয়ান প্রেস এর সূত্রে এ কথা জানা যায়। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একটি জোট প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দেশের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলোকে ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানিয়েছিল তখন। মসজিদের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ আসলিম জাসিফের মৃত্যুর ঘটনাটি বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ (হেট ক্রাইম) হিসাবে তদন্ত করার জন্য পুলিশের প্রতি দাবি জানানো হয়েছিল।
যে সংগঠনগুলো ট্রুডো সরকারের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিল তারা তখন বলেছিল, ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা রোধে সরকারের সক্রিয় হওয়ার দরকার আছে।
তারা আরো লিখেছিল, ‘আমরা কানাডীয়রা, সে আদিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম, ইহুদি, শিখ, খ্রিস্টান বা অন্য কোন ধর্মের এবং অশ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের যা-ই হই না কেন, আমরা আক্রান্ত হচ্ছি, আমাদের ঘরে, আমাদের উপাসনালয়ে এবং আমাদের সমাবেশে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠনের হাতে আমরা হামলার শিকার হচ্ছি।’
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস, ওয়ার্ল্ড শিখ অরগানাইজেশন, দ্য সেন্টার ফর ইসরায়েল অ্যান্ড জুইশ অ্যাফেয়ার্স, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং দ্য কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্ক।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর খোলা চিঠি সরকার কতটা গুরুত্ব দিয়েছে বা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানা যায়নি। তবে পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, কানাডায় মুসলিম বিদ্বেষ বা ঘৃণা পরিস্থিতির যে উন্নতি ঘটেনি তা নিশ্চিত করে বলা যায় লন্ডনের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর।
কানাডার মুসলিম সম্প্রদায় এদেশের অংশ হয়েও তাঁরা অধিক হারে ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এবং আগের তুলনায় বেশী মাত্রায় হচ্ছেন। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার তথ্য এটি। কখনো কখনো তা নৃশংসতার চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে। লন্ডনের ঘটনা তারই প্রমাণ।
কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের জোর দাবী, এ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে অবিলম্বে। এখন আর কথায় বা প্রতিশ্রুতিতে কাজ হবে না। নিতে হবে বাস্তব পদক্ষেপ, যেমনটা বলেছেন এনডিপি নেতা জাগমিত সিং। তিনি বলেছেন, ‘ লন্ডনের এই হত্যাকান্ডের পর আমাদেরকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।’
মসুলিম সম্প্রদায়ের আশংকা, নয়তো আবারো যে কোন মূহুর্তে ঘটতে পারে আরেক ট্র্যাজেডি।