এক অন্ধ মায়ের আত্মকথা

শূন্য থেকে শুরু মায়ের জীবনি শূন্যতেই হলো শেষ

রাশিদা আউয়াল

(শেষ পর্ব)মায়েদের দু:খ কষ্ট দেশে কি বিদেশে একই কষ্ট একই জ্বালাতন পোহাতে হয়। গল্প বোঝার জন্য শুরুটা একটু পেছন থেকে শুরু করতে হচ্ছে।

বড় ছেলে থেকেই শুরু হলো বাবার বিষয় সম্পদ বিক্রির পালা। ঢাকার বুকে সাত আটটা বাড়ি থেকে বড় ভাই প্রথমেই দু’টো বাড়ি আর ঢাকার বাইরের ব্যবসা গুছিয়ে সব বিক্রি করে দিলেন।

মা ও ছোট ভাই বোনরা সবাই সরল বিশ্বাসে বড় ভাইকে সাপোর্ট দিয়ে নিজেদের অংশও ছেড়ে দিলেন, বিশেষ করে ভাইদের নিজেদের নামের বাড়ি পর্যন্ত লিখে দিলেন। ভেবেছিলেন,বড় ভাই বাবার মত হয়ত আবার সব সম্পদ ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু নাহ! তা আর হলো না। সহায় সম্পদ একবার হাত থেকে গেলে ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন।

আমি এখানে অনেক কিছু একটু খুলে বর্ণনা করেছি এই ভেবে যে,এমন ভুল বা বিশ্বাস যেন,আর কোনো পরিবার তাদের আপন ভাই বোনদের না করেন বা ঠকতে না পারেন সচেতন থাকেন। সংসারের বড় ছেলে সবার ‘পাওয়ার অফ এর্টনির’ বলে সে ঐ সংসারের সব ধ্বংস ও বাবার নাম নি:চিহ্ন করেছেন। অবশ্য এর শাস্তি তিনি দুনিয়ায় পেয়েছেন। আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করুন।

মা তার বড় ছেলেকে বিয়ে দিলেন নাতি নাতনি হলো। বড় ভাই বাকি ভাইদের ঠকিয়ে ভাগাভাগি করে মায়ের সাথে ভাগ হতে লাগলেন, আর সম্পদ বিক্রি করতে লাগলেন ।

বেশ কিছু দিন পর বড় ছেলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বিদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস ও নিজের সম্পদ বাড়ানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। উনি ভুলেই গিয়েছিলেন যে,একদিন মা ভাই বোনদের নামের সম্পদ বিক্রি করে উনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আজ যা কিছু করেছেন সব মা ভাই বোনদের অবদান। মায়ের দুর্ভাগ্য কান্না তখন থেকে শুরু।

তখনও মায়ের নিজের নামের সম্পদ গুলো অক্ষত সু-রক্ষিত ছিল।

তারপর দ্বিতীয় ছেলেও ক্যাডেট কলেজ থেকে পড়া শেষ না করে বিদেশ পারি জমালেন কিন্তু সেখানে গিয়ে সেও কিছু করতে পারছিলেন না, তাই দেশে এসে ঐ ছেলে বিয়ে করে মায়ের নামের জমি গুলো নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে চলে গেলেন।

মা তখনও ওনার ঢাকার বাড়ির ভাড়া ও কর্মচারির মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে মাসে দুই/তিন লক্ষ টাকার বেশি হাতে পেতেন। মা তখন ছোট দুই সন্তান নিয়ে বেশ ভাল ই কাঁটাচ্ছিলেন। তখনও দু’হাতে খরচ করতেন,আত্মীয় স্বজন ও গরীব দু:খি, মসজিদ মাদ্রাসায় দান করতেন। মা বলতেন ‘দান কখনো বিফলে যায় না’। আমার চোখে দেখা উনি যে, মানসিক ও আর্থিক কষ্ট করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তা কল্পনা করলেও চোখে পানি আসে।

বাবা কখনো মাকে খরচের জন্য কিছু বলতেন না তাই মা ও কখনো হিসাব বা বুঝ করে চলা বা হিসাব বুঝতেন না।

মা কিন্তু ওনার সব ছেলে মেয়েদের বিয়ের খরচ গহনা সব মায়ের নিজের থেকে করেছেন। মায়ের তিন মেয়েই মোটা মোটি সুখ শান্তিতে ছিলেন। যদিও মেয়েদের ঢাকার বুকে ভাড়া থাকা ও ওনাদের সন্তানদের লেখা পড়া করানো একটু কষ্ট সাধ্য ছিল।

মাকে যারা কষ্ট দেন তাদের কি কোনো শাস্তি হবে না? তাদের কি কোনো রকম ভোগান্তি হবে না? ছবি: আমাজননিউজ.কম

তারপর তৃতীয় জন পড়া শেষ করে ব্যবসা না ধরে নেশার জগতে পদচারনা শুরু করলেন। টাকা সম্পদ শেষ হতে আর কি লাগে?

মায়ের তৃতীয় ছেলেকে নেশা থেকে সরানোর জন্য বহু কষ্টে তাকে বিভিন্ন দেশে পাঠালেন কিন্তু উনি কোথাও গিয়ে থাকেন নি। মা এই ছেলের নেশা ও সুস্থ করতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। ছেলেকে বিয়ে দিলেন কিন্তু কোনো কাজ হলো না। এই ছেলেই মায়ের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন এবং মাকে পথে বসিয়েছেন।

মাথার উপর মুরুব্বী ছিল না বলে,ঐ বাড়ির ছোট ছেলেটাও লেখা পড়া ছেড়ে অসৎ পথে ব্যবসা শুরু করলেন ও বিপথে চলে গেলেন।

সব চেয়ে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিলেন কিছুদিন পরই স্বামীকে ছেড়ে মায়ের কাছে এসে আরাম আয়েস ও ব্যবসা করে মায়ের জমানো টাকা অবশিষ্ট সোনা গহনা সব আত্মসাৎ করতে লাগলেন।

এদিকে হঠাৎ করে বড় ছেলেটা হার্ট এটাক করে মারা গেলেন।

আর সেই সুযোগে বড় বউ গোপনে স্বামীর পাওয়ার অফ এর্টনির বলে, সব ভাই বোনদের সম্পদের ভাগ সহ কাউকে না জানিয়ে, সব চেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি মস্তানদের কাছে গোপনে বিক্রি করে পজিশন দিয়ে দিলেন।

মায়ের তখন প্রায় সত্তুর বছর বয়স হবে, মা অসুস্থ হতে লাগলেন, চোখের সমস্যা দেখা দিয়েছে, তিনি আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন।

লক্ষ টাকা ভাড়া বাড়ি,গাড়ি, কাজের লোক ড্রাইভার তখনও সবই ছিল। ছিলনা শুধু আপন জন! যেখানে নিজের পেটের সন্তান-ই পর সেখানে আর অন্যদের কথা না ই বা বল্লাম। সবাই শুধু ওনাকে ঠকানোর ধান্দা করতেন।

এমনি ভাবে সামর্থ ও সচ্ছলতা থাকা সত্বেও বিনা চিকিৎসায় উনি অন্ধ হয়ে গেলেন।

ওনার ছেলেরা সবাই বিদেশে স্থায়ি বাসিন্দা হয়ে গেলেন। কেউ মায়ের জন্য কোনো টাকা পয়সা বা খরচ পাঠাতেন না। শুধু প্রয়োজন হলেই দেশে গিয়ে মাকে সই করিয়ে, প্রয়োজন অনুযায়ি বিক্রি করে টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যেতেন। মা ও চোখ বন্ধ করে সই করতেন।

হঠাৎ একদিন মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ছেলে মেয়ে দেশে থাকা সত্বেও ওনাকে হাসপাতাল নেয়ার মত কেউ ছিল না।

অথচ ওনার তিন তিনটা গাড়ি ছেলেরা বিক্রি করেছেন আর মাকে আশ্বাস দিয়ে গেছেন, আবার কিনে দিবেন বলে, যা মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর ভাগ্যে নিজের গাড়িতেই উঠা হয়নি।

অবশেষে ওনাকে এক প্রতিবেশির গাড়িতে করে হাসপাতাল নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সাথে কেউ না থাকায় ওনাকে ফ্রি বেডে ফেলে রেখে চলে গেলেন সাথে শুধু বুয়া ছিলেন।

পরবর্তীতে হাসপাতালে ‘খিদের জ্বালায় কান্না করছিলেন’ না পেরে পাশের বেডের রোগীর খাবার খেতে হয়েছিল’।

কয়েক দিন পর ঐ হাসপাতালের ফ্রি বেডেই স্ট্রোক করে কোমাতে চলে গেলেন। ঐ সময় মা মারা গিয়েছেন ভেবে কেউ আসেনি।

তখনও মায়ের সম্পত্তি থেকে ছেলে মেয়েরা ভাগে ২/৩ কোটি টাকা করে পাবে। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। কি দুর্ভাগ্যজনক, মাত্র ২০/২৫ হাজার টাকা হাসপাতালের বিলের জন্য মাকে মৃত ভেবে ফেলে চলে গিয়েছিলেন।

বিদেশে ছেলেদের খবর দেয়া হয়েছিল, মা মারা গিয়েছেন বলে, কিন্তু তারা দেশে আসলেন না, আসলেন সম্পদের ভাগ নিতে।

তারপর ওনার এক দূরের আত্মীয় গিয়ে তার নিজের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কোমা থেকে ফেরত আনলেন সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুল্লেন।

ঐ সময় ওনার বড় ও ছোট মেয়ে একদিনের জন্যও হাসপাতালে ওনার সাথে ছিলেন না। ওনারা শুধু ভিজিটর সময় আসতেন আর একটু দেখা করে চলে যেতেন। একটা ফলও কোনো দিন হাতে উঠেনি।

মা বেঁচে থাকতে নিরাপত্তার জন্য বড় মেয়ের কাছে ওনার সব সোনা হিরা, মুক্তা জহরত জমা রেখেছিলেন। উনি হাসপাতালের বিল দিতে পারছিলেন না বলে, বড় মেয়ের কাছে অনেক আকুতি মিনতি করেছিলেন, প্রান ভিক্ষা চেয়েছিলেন, কিন্তু বড় মেয়ে ভেবেছিলেন উনি মারা যাবেন। তাই নিষ্ঠুর লোভি মেয়ে বিল বা গহনা কিছুই ফেরত দেয়নি। কি নিষ্ঠুর পৃথিবী কি নিষ্ঠুর মানুষ!!

মায়ের মুখে শোনা- এই মেয়ের ঘরের নাতিন ও জামাইকে বিয়েতে মা পাঁচ সাত ভরির সোনার গহনার সেট উপহার দিয়েছিলেন।

অথচ সেই কোটিপতি নাতিনের হাতে এক টুকরো আপেলও কোনো দিন উঠেনি।

আর মায়ের সেই ভাই? যাকে পালক নিয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যার আপন ভাই ছিলেন এক অফিসের পিয়ন।

‘শুনেছিলাম বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সেই ভাই নাকি বাবার দাফন ও কবরে শরিক হননি’।

মায়ের অসুস্থতার সময়ও হাসপাতালে কখনো কোনো খোঁজ খবর পর্যন্ত রাখেন নি।

ওনার এক আত্মীয় তার চিকিৎসার ব্যয় ভার বহন করে সম্পূর্ন সুস্থ করে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে ওনার পরবর্তী ছয় মাসের খরচ, বুয়া ও সব রকম ব্যবস্থা করে দিয়ে আসছিলেন।

তারপরও আমাদের অন্ধ মা অসুস্থ শয্যাশায়ি হয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। অবহেলিত অসন্মানে লাঞ্চনা গঞ্জনা সহ্য করে দিনের পর দিন বিছানায় ধুকে ধুকে ক্ষুদা পিঁপাসায় কাতর, প্রস্রাব পায়খানায় পরে থেকে জীবনের শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। মারা যাওয়ার সময় আমি ছিলাম, দেখেছি বাস্তব কতটা নির্মম কঠিন। মানুষ কতটা বিশ্বাস ঘাতক লোভী হতে পারে। তা নাহলে উনি মারা যাওয়ার পরও যে সন্তানরা তিন কোটি টাকা করে জনপ্রতি ভাগে পেয়েছেন, সেখানে দাফন কাফন নিয়ে এতো হিসাব?

আমার একটা প্রশ্ন ? এদের কি কোনো শাস্তি হবে না? এদের কি কোনো রকম ভোগান্তি হবে না? এ আল্লাহর কেমন বিচার?

যে মহিলা স্বামীর ভালবাসায় রাজত্ব করে,পরবর্তীতে বিধবা হয়ে তিরিশ বছর পার করে,অন্ধত্বের জীবন যাপন করে নিজের অট্টালিকতে বিদ্যুৎ বিহীন (বিল না দেয়ায়) রাজ প্রাসাদে তিলে তিলে মায়ার

পৃথিবী থেকে চির বিদায়…….।

কবে হবে এর প্রতিকার ? আমাদের দেশেও কানাডার মত আইন হওয়া উচিত। যেন,এমন সন্তান থাকলে বাবা মা মারা গেলে সরকার সব সম্পদ নিয়ে নেয়।

পৃথীবির সকল মায়েদের প্রতি আমার আকুল আবেদন, তোমরা এতোটা আত্মভোলা হয়োনা। ভালবাসার মহা মায়ায় বিবেকহীন,আলোর পৃথীবিতে থেকেও অন্ধত্বের জীবন বরণ করো না।

আর সন্তানেরা মনে রেখো তোমরাও ‘মা’ ও ‘বাবা’। তোমরা যেমন সন্তানের জুতার ফিতা বাঁধা থেকে শুরু করে স্কুল থেকে বেড় হলে,তার বইয়ের ব্যাগটা ভারি বলে, নিজের কাঁধে নিয়ে নাও ঠিক এমনি ভাবেই তোমাদের বাবা-মাও তোমাদের দু:খ কষ্ট বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন।

মায়ের অভিশাপ মুক্ত থাকলেও এ নির্দয় নিষ্ঠুর পৃথিবী তোমাদের ছাড়বে না। জেনে রেখো এপার ওপার কোথাও ক্ষমা পাবে না।

জবাব দিহি তোমাদের করতেই হবে, হয় এই পৃথীবির কাছে নয়তো পরকালে সৃষ্টিকর্তার কাছে।

সেদিনের জন্য প্রস্তুত থেকো।

রাশিদা আউয়াল

ব্র্যাম্পটন