মহামারি মোকাবিলার বা লং-টার্ম কেয়ার হোমে রোগীদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না অন্টারিওর
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : মহামারির মোকাবিলায় অন্টারিওর কোনও প্রস্তুতি ছিল না এবং লং-টার্ম কেয়ার হোমের রোগীদের সুরক্ষা দেওয়ারও কোনও পরিকল্পনাও ছিল না। এক বছর ধরে চলে আসছে এই অবহেলার ধারাবাহিকতা। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি স্বাধীন কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে। খবর দি কানাডিয়ান প্রেস এর। রিপোর্ট করেছেন শন জেফোর্ডস।
প্রাদেশিক সরকারের লং-টার্ম কেয়ার কোভিড-১৯ কমিশন তার ৩২২ পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রাদেশিক সরকারের কাছে পেশ করে। এতে সেইসব পদক্ষেপ এবং নিষ্ক্রিয়তার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে যেগুলি কোভিড-১৯ মহামারিকালে লং-টার্ম কেয়ার কর্মসূচিকে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
কমিশনার তার রিপোর্টে লিখেছেন, “লং-টার্ম কেয়ার সেক্টরকে পঁচিয়ে দিয়েছে এমন অনেক চ্যালেঞ্জ ছিলো কয়েক দশক ধরেই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে তহবিলের স্বল্পতা, কর্মচারীর অভাব, পুরনো অবকাঠামো এবং দুর্বল নজরদারি ইত্যাদি যা মহামারিকালে অন্টারিওর ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের জন্য প্রাণঘাতী পরিণতি বয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখে।”
রিপোর্টে দেখা যায়, এই প্রদেশ ২০০৩ সালের সার্স মহামারি থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে বলা হয়, ভবিষ্যতে অন্টারিওর ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে সুদূরপ্রসারি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
কমিশন বলেছে, চিকিৎসাসেবার দুর্বল সুবিধাদি এবং নার্সিং হোমগুলোতে বাসিন্দাদের অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। গত এপ্রিলের শেষ নাগাদ নার্সিং হোমগুলোতে প্রায় চার হাজার বাসিন্দা ও ১১ জন স্টাফ কোভিড-১৯-এ মারা যায়।
এছাড়া, কর্মচারীর স্বল্পতা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বল্প প্রশিক্ষিত জনবলের কারণেও পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছে।
“এটি স্পষ্ট ও অত্যাবশ্যক যে, অন্টারিওকে বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের কল্যাণে এবং ভবিষ্যতের যে কোনও মহামারির জন্য প্রস্তুতি নিতে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করতে ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।”
সাড়াদান ছিলো খুব ধীর
কমিশনার বলেন, প্রদেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের জন্য নতুন সুবিধাদি গড়ে তুলতে হবে। সরকারের বিবেচনা করে দেখা দরকার, ওইসব নার্সিং হোমের ব্যবস্থাপনা কেমন। সেগুলোতে
মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করার কথাও ভাবতে হবে।
রিপোর্টে কমিশন ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী কেয়ার হোম গড়ে তোলার একটি নতুন মডেলেরও সুপারিশ করে। এই মডেল হবে বেসরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হাসপাতাল, আদালত ভবন ও হালকা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালনার অনুরূপ।
রিপোর্টে অভিমত দেয়া হয় যে, কোভিড-১৯ সম্পর্কে যখন তথ্য ছড়িয়ে পড়ছিলো সে সময় এর প্রতি প্রাদেশিক সরকার এবং নির্দিষ্ট করে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ডেভিড উইলিয়ামসের সাড়া ছিল অতিশয় ধীর।
মহামারি সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এটা স্বীকার করতে প্রাদেশিক সরকার দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি এমন কারও মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এর প্রতিরোধে মাস্ক পরা খুবই কার্যকর এসব বিষয় মেনে নিতেও সরকারের মধ্যে দ্বিধা ছিল।
কমিশনার লিখেছেন, “বিলম্ব করাটা ছিলো প্রাণঘাতী।”
অন্টারিও ২০২০ সালের ১৯ মে এই কমিশন নিয়োগ করে। মহামারির প্রথম অভিঘাতে দীর্ঘমেয়াদি কেয়ার হোমগুলোতে কী ব্যত্যয় ঘটেছে তা নিরূপনের লক্ষে এই কমিশন গঠন করা হয়।
সে সময় প্রদেশে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১,৯০৪ জন আর লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে রোগী ভর্তি ছিল ১,৪০০ জন। ওই সময় পর্যন্ত পাঁচজন স্টাফও মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু এমনকি কমিশন কাজ শুরু করার এবং দুই পর্বে অন্তর্বর্তী সুপারিশ পেশ করার পরও এই ভাইরাস কেয়ার হোমগুলোতে মৃত্যুর তাণ্ডব চালিয়েই যাচ্ছিল।
সুপিরিয়র কোর্টের অ্যাসোসিয়েট চিফ জাস্টিস ফ্রাঙ্ক ম্যারোক্কোর নেতৃত্বে গঠিত কমিশন কেয়ার হোমের রোগী, স্টাফ ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে।
কমিশন ডা. উইরিয়ামস থেকে শুরু করে কেয়ার হোম বিষয়ক মন্ত্রী মেরিলি ফুলারটন এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্রিস্টেইন ইলিয়টসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
লং-টার্ম কেয়ার হোমে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দায়িত্ব পালনকারী সেনা কর্মকর্তারাও কমিশনে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যে তারা তাদের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন যার ফলে ওইসব হোমের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সম্পর্কে মারাত্মক এই রিপোর্ট বেরিয়ে আসে।
কমিশন জানায়, তারা সব মিলিয়ে সাত শতাধিক মানুষের বক্তব্য নিয়েছে।
‘কাজে ঝাপিয়ে পড়ার আহবান এবং ভীতিকর দুটোই’
বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে কর্মরত গ্রুপ ক্যানএজ কমিশনের উদঘাটিত তথ্যগুলোকে একই সঙ্গে “কাজে ঝাপিয়ে পড়ার আহবান এবং ভীতিকর” বলে অভিহিত করেছে।
এক বিবৃতিতে ক্যানএজ-এর সিইও লরা টাম্বলিন ওয়াটস বলেন, “এই রিপোর্ট মর্মঘাতী। এতে সরকার এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কর্তৃক জনগণকে পরিত্যাগের, হাজার হাজার বাসিন্দার অকারণ মৃত্যুর এবং স্টাফদেরকে মৌলিক প্রয়োজন পিপিইর সুরক্ষা না দেওয়ার বেদনাদায়ক চিত্র বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে।”
গ্রুপটি বলেছে, কমিশনের উদঘাটিত সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যের মধ্যে রয়েছে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে সমন্বয়ের মারাত্মক অভাব, জনগণকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করার নীতি এবং দর্শনার্থীদের ওপর বিধিনিষেধের অপর্যাপ্ততার ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া।
অন্টারিওর সম্মুখ সারির স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্যের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়নের প্রধান বলেন, “এখন এই অবহেলার অবশ্যই অবসান হতে হবে।”
এসইআইইউ হেল্থকেয়ারের প্রেসিডেন্ট শার্লিন স্টুয়ার্ট বলেন, “কমিশনের রিপোর্ট সেটিই নিশ্চিত করেছে যা আমরা খুব ভালো করেই জানতাম। আমরা জানতাম যে, জনস্বাস্থ্যের এই মহাসঙ্কটকালে নিষ্ক্রিয়তা আড়াল করার জন্য প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডের লৌহ-অঙ্গুরীয় (রৎড়হ-ৎরহম ংষড়মধহ) সদৃশ স্লোগানের পুরোটাই ছিলো চরম মিথ্যা।”